শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
সমরেশ মজুমদার

এদেশে জন্মাইনি তবু আমার বুকের ভিতরে বাংলাদেশ

এদেশে জন্মাইনি তবু আমার বুকের ভিতরে বাংলাদেশ

ছবি : রোহেত রাজীব

বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদার ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয়। লিখেছেন উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিণী, সাতকাহন, মৌষলকালসহ বিখ্যাত সব উপন্যাস। অজস্র গল্পের স্রষ্টা তিনি। গত বছর বাংলাদেশ প্রতিদিন তাঁকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। এ উপলক্ষে টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান যে জলে আগুন জ্বলে-তে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন—সামিয়া রহমান

 

আপনি জানেন কি ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে আপনার অসম্ভব জনপ্রিয়তা; আপনার প্রতি ভালোবাসা মানুষের আকাশছোঁয়া।

উল্টোটাও বোঝায়। ধরুন বাংলাদেশ আমাকে সারা পৃথিবীতে পরিচয় দিয়েছে। আমি পৃথিবীর যেখানে, যে শহরে গিয়েছি সেখানকার যে পাঠক আমার কাছে গিয়েছেন তিনি বাংলাদেশের মানুষ।

 

এটা তো আমাদেরও গর্ব। আমি আসলে লেখক সমরেশ মজুমদার সম্পর্কে জানার আগে ব্যক্তি সমরেশ মজুমদার সম্পর্কেও জানতে চাই। সেই জলপাইগুড়ির কথা, ডুয়ার্সের চা বাগানের কথা। 

যে চা বাগানে আমি জন্মেছিলাম, সেই চা বাগানের বাড়ির পিছে সরু রাস্তা ছিল। তার নাম ছিল আসাম রোড। ওই রাস্তাটা আসামে গিয়েছিল। দুই পাশে জঙ্গল আর বড় বড় ইউক্যালিপটাস গাছ, শাল, সেগুনের গাছ। সারাদিন পাখি ডাকতো। দুই একটা গাড়ি যেত। এইবারে যখন গেলাম মাসখানেক আগে, বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠলো। কোনো গাছ নেই। সব গাছ কেটে বাদ দিয়েছে। ঐ সরু রাস্তা এখন এইট লেনের রাস্তা হয়েছে যেটাকে বলছে এশিয়ান হাইওয়ে। গাছগুলো নেই, পাখিগুলোও নেই। আমিও তো নেই।

 

সেটা তো আপনার এখনকার হতাশা, কষ্টটুকু। সেই সময়ের চিত্রগুলো কত বদলে গেছে। ছোটবেলার কোনো মজার স্মৃতি, কোনো গল্পের কথা শুনতে চাই।

আমরা যখন ছোট, এই যেমন আট বছর দশ বছর বয়স, ফুটবল খেলতাম। ফুটবল অনেকসময় পেতাম না। জাম্বুুরা দিয়ে ফুটবল খেলতাম। চিনেন জাম্বু্বুরা? আমরা বাতাবি লেবু বলতাম। সেই ফুটবল খেলার মাঠে দুই একজন দর্শক থাকতো। তারমধ্যে একটি মেয়ে, মেয়েটির বয়স হয়তো সাত কি ছয়, তার পিঠে তার বাচ্চা ভাই কাপড়ে বাঁধা থাকতো। তার চোখের উপরে আব ছিল। মানে উঁচু একটা মাংসপিণ্ড। সে ছিল মদেসিয়া শ্রেণির শ্রমিকের মেয়ে। তার বাবা চা বাগানে কাজ করতো। আমরা তার সঙ্গে কথা বলতাম না। আমরা তখন ওর চেয়ে অনেক উচ্চ শ্রেণিতে ছিলাম আরকি। শুধু জানতাম ঐ মেয়েটির নাম এতোয়ারি। উত্তরাধিকারেও কিন্তু এতোয়ারির কথা আছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর পার হয়েছে। আমি এতদিন এতোয়ারিকে দেখিনি। এই বছর আমি চা বাগানে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধুরা ছিল, আড্ডা মারছি। আমি এই গল্পটাই বললাম, এতোয়ারির গল্প। সঙ্গে সঙ্গে সেই বাড়ির যে মহিলা তিনি বললেন, আপনি এতোয়ারির সঙ্গে দেখা করবেন? আমি বললাম, সে বেঁচে আছে?

 

কি অদ্ভুত!

অদ্ভুত আরও একটি ব্যাপার ছিল। এতোয়ারিকে আনা হলো। প্রৌঢ়া একজন মহিলা এলেন। দেখলাম তার মাথায় আব নেই। অপারেট করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করছে মহিলা, কেমন আছিস? বললো, ভালো আছি। এই মানুষটাকে চিনতে পারছিস? আমার দিকে তাকালো, তাকিয়ে বললো, ও তো বাবলু। বাবলু আমার ডাক নাম।

 

নাম মনে আছে!

ডাকনাম। পঞ্চাশ বছর পর একজন প্রৌঢ়া আমাকে বলছে আমার নাম বাবলু। আমি একটু মজা করার জন্য বললাম, তোর বাবা হাঁড়িয়া খেতো, মনে আছে? হাঁড়িয়া হচ্ছে দেশি মদ। সে বলে, তুই খাস? আমি বললাম, আমায় খাওয়াবি? আমার দিকে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। বললো, তুই হাঁড়িয়া খাস?  পঞ্চাশ বছর আগে আমরা কোনো কথা বলতাম না। আমি বললাম, ঠিক আছে তোর বাড়িতে চল, আমাকে চা খাওয়াবি। বলে, নাহ। আমি বলি, কেন? বলে, আমার বদনাম হবে। ও চলে গেল। কিন্তু শুনে গেল আমি বিকেল বেলা ফিরে যাব। ফেরার সময় যখন গাড়িতে উঠছি, দেখলাম ও দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা বোতল, বোতলে হাঁড়িয়া। তুই খেতে চেয়েছিলি, নিয়ে যা। আমি ভেবে পাই না যে পঞ্চাশ বছর ধরে একটা সম্পর্ক মনের মধ্যে যদি সে তৈরি করে থাকে, সেটা সে লালন করে গেল কি করে? পঞ্চাশ বছর পরে কোনো মানুষ, যার সঙ্গে কখনো কথা বলিনি তাকে ডাকনামে ডাকা যায়?

 

সে কি জানে যে আপনি সেই বাবলু থেকে এখন এই সমরেশ মজুমদার হয়ে গেছেন?

নাহ। সে কিছুই জানে না। স্মৃতি হাতড়ালে এরকম অনেক গল্প পাওয়া যায়। তখন মনে হয় পৃথিবীতে অনেক কিছুই আমি পেয়েছি।

 

একসময় আপনি অভিনয় করতেন, থিয়েটার করেছিলেন।

অভিনয় করব ভেবেছিলাম। সবার কপালে সবকিছু হয় নাতো।

 

থিয়েটার থেকে সরে আসলেন কেন?

এটা আরেকটা মজার গল্প। আমরা গ্রুপ থিয়েটার তৈরি করেছিলাম কলকাতায়। কিন্তু আমাদের কেউ নাটক দিত না। যত বিখ্যাত নাট্যকার ছিলেন বাদল সরকার, মুনীর চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র এরা আমাদের বলতেন তোমাদেরকে নাটক দিলে তো একটা কি দুটো শো হবে। আর এই বড় বড় গ্রুপ চাইছে ওদেরকেই দিতে পারছি না। আর তোমাদের দিব কেন? আর প্রিন্টেড নাটক মানে ছাপার নাটক করলে পরে বদনাম হয়। নাম হয় না। আমার এক বন্ধু বললো, তুই যখন গল্পের বই পড়িস তুই একটা নাটক লিখে ফেল। আমি নাটক লিখে ফেললাম। পরের দিন নিয়ে গিয়ে শুনালাম তাদের। সবার মুখ গম্ভীর। পড়তে পড়তেই বুঝলাম কিছুই হয়নি। তখন আমার ঐ বন্ধু বললো, তুই আগে এক কাজ কর, গল্পটা আগে লিখে ফেল। তারপর নাট্যরূপ দে। ভাবলাম কথাটা তো ভালোই। সো আই ট্রাইড টু রাইট অ্যা স্টোরি। একটা গল্প লেখার চেষ্টা করলাম। গল্পটা পড়ালাম, সবাই বললো খুব ভালো লাগছে, কিন্তু নাটক হবে না।

 

এটাই কি সেই পনের টাকার গল্প?

হ্যাঁ। সবাই বললো তুই এটা কাগজে পাঠিয়ে দে। দেশ পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। পনের টাকা পেয়েছিলাম সেই গল্পটা লিখে। টাকাটা হাতে পাইনি। টাকার কথা বন্ধুদের বলতেই সঙ্গে সঙ্গে হইহই, কফি হবে। তখন চার আনা করে কফির দাম ছিল। সাতজন কফি খেয়ে ফেললো। খেয়ে বললো আবার লেখ, আবার খাব। এভাবে নাটক থেকে সরে গেলাম গল্পে। তারপর দীর্ঘ দশ বছর আনন্দবাজার, দেশ পত্রিকায় আমি নাটকের রিভিউ করেছি। যেহেতু আমার নাটকের প্রতি একটা টান ছিল। সেটা করতে গিয়ে আমি প্রথম বাংলা সিরিয়ালটা তৈরি করলাম। তার আগে বাংলা টিভি সিরিয়াল ছিল না। সরকারি উদ্যোগে নাটক ছিল টিভিতে। প্রথম টিভি সিরিয়ালের নাম তেরো পার্বণ।

 

অনেকে বলেন যখন উপন্যাস থেকে নাটক হয় বা ফিল্ম হয়, যেমন আপনার প্রচুর উপন্যাস চলচ্চিত্র হয়েছে, নাটক হয়েছে, এতে মূল গল্পের প্রতি অবিচার করা হয়। সেটা কতটা ঠিক?

এটা নিয়ে অনেক তর্ক আছে। যেমন পথের পাঁচালী অলটাইম গ্রেট ফিল্ম। সত্যজিৎ রায়ের এটা একটা অনবদ্য ক্রিয়েশন। কিন্তু কেউ কেউ অখুশি। তার কারণ পথের পাঁচালীতে দুর্গা কখনো ট্রেন দেখেনি। ট্রেন দেখার আর্তি ছিল তার। ভাইকে বলতো, অপু, আমাকে ট্রেন দেখাবি? দেখা হয়নি। একটা অতৃপ্তি নিয়ে সে চলে গেছে। পথের পাঁচালী ছবিতে সত্যজিৎ বাবু কিন্তু ট্রেন দেখালেন। দুই ভাইবোন দৌড়ে দৌড়ে কাশবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, দূরে ট্রেন। যারা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তারা এতে আপত্তি করেছে।  উপন্যাসে যা নেই তা কেন ছবিতে দেখানো হবে? আমি মনে করি দুটি আলাদা মিডিয়া। উপন্যাস আলাদা, ছবিও আলাদা। যেমন মিডিয়া সেভাবে তাকে কথা বলতে দেওয়া উচিত।

 

 

আপনার বিখ্যাত উপন্যাস উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষের কাছে চলে আসি এবং সেখানে অনেকে বলে থাকেন যে আপনার জীবনের অনেক চরিত্রের সঙ্গে এই উপন্যাসগুলোর মিল আছে। মিল আছে কী?

একটাই উপন্যাসের সঙ্গে মিল আছে। সেটা বোধহয় খুব আলোচিত হয় না। এখনো সময় আছে— উপন্যাসের নাম। একজন লেখককে নিয়ে। তার সঙ্গে আমার খুব মিল আছে কারণ আমারই মানসিক কথা ফুটে উঠেছিল সেখানে। ঐ উপন্যাসের মূল চরিত্র শহর থেকে দূরে চলে গিয়েছিল সমুদ্রের ধারে এক বাংলো কিনে। একা থাকতেন। তার কাছে একটি মেয়ে এলো। আশ্রয় মানে একটা রাতের আশ্রয়, পরদিন চলে যাবে। ওখানে কোনো হোটেল নেই। ভদ্রলোক মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার নাম কি। মেয়েটি বলেছিল আমি যে নামই বলবো আপনি সেটাকেই বিশ্বাস করবেন। আপনার না মেনে কোনো উপায় নেই। প্রশ্ন করা হয়েছিল, তোমার ঠিকানা কি? বলেছিল উত্তরে, আমি যা বলবো তাই আপনি বিশ্বাস করবেন। আমাকে জায়গা দিন। আমার অতীতটাকে নিয়ে কেন টানছেন? এছাড়া যারা বলে অনিমেষের সঙ্গে আমার মিল আছে, বলতে পারেন অনিমেষের ভাবনার সঙ্গে আমার মিল আছে। অনিমেষের জীবনযাপনের সঙ্গে কোনো মিল নেই।

 

আপনার জীবন সেইভাবে কোনো উপন্যাসে ছাপ ফেলেনি আপনি বলছেন। ঊনসত্তর, সত্তরের অস্থির রাজনৈতিক সময় আপনি কালবেলা লিখেছিলেন। আপনার রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে এর কোনো মিল ছিল?

দেখুন, সেটা একটা বয়স হয়তো সবারই ওপর দিয়ে গেছে। আমারও ছিল। যারা এস্টাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে, একটা জিহাদ, একটা রাগ প্রকাশ করার প্রবণতা থাকে। আর সেই এস্টাব্লিশমেন্টটা যদি আমাদের ঠিকঠাক সাহায্য না করে রাগটা আরও বেড়ে যায়। এটা বোধ হয় আজকের আঠারো, বাইশ, তেইশ বছরের ছেলেমেয়ের মধ্যেও আছে। আমি কখনো রাস্তায় নেমে উঁচু কণ্ঠে স্লোগান দেইনি। সেটা ছিল ১৯৭৯-৮৪ সময়কাল। তখন বামফ্রন্ট সরকার প্রচুর ক্ষমতাধর। তীব্র মেজরিটিতে তারা আছেন। সেই সময় আমি যখন লিখলাম যে সিপিএম নকশাল আন্দোলনের পেছনে ছুরি মেরেছে। লেখাটা কিন্তু বেরোলো আনন্দবাজারে, দেশ পত্রিকায়। লক্ষ লোক এই পত্রিকা পড়ে। এই লেখাটা লেখার সময় কিন্তু ভয় আসেনি মনের মধ্যে যে এটা লেখার পরের দিন আমাকে কেউ মারতে আসবে বা সরকার আমাকে জেলে পুরবে। একটা ছোট গল্প বলি এ প্রসঙ্গে। উত্তরাধিকার বেরিয়েছে। যেখানে অনিমেষ জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় এসেছে। আন্দোলন দেখছে, আন্দোলনে নামেনি। বইমেলাতে উপ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি সম্পর্কে আমার বন্ধুর ভাই এবং একসময় আমাকে খুব দাদা দাদা বলতো, অনেকদিন সম্পর্ক নেই। দেখামাত্রই সে জড়িয়ে ধরে বললো আপনি উত্তরাধিকার লিখেছেন, এটা কমিউনিস্ট পার্টির দলিল। আপনি আপনার প্রকাশককে বলুন এটার একটা বিজ্ঞাপন দিতে। আমি পঞ্চাশ হাজার কপি সরকারের কাছ থেকে কিনবো। তখন বইটা বিক্রি হয়েছে মাত্র পাঁচশো কপি। আমি নতুন লেখক। পঞ্চাশ হাজার কপি মানে বুঝতে পারছেন কত টাকা পাবো?

 

বিশাল ব্যাপার।

আমি দৌড়ে দৌড়ে প্রকাশকের কাছে গিয়ে বললাম আপনি এটার বিজ্ঞাপন দিন। তখন প্রতি কপি বইয়ের দাম ছিল পঞ্চাশ টাকা বা চল্লিশ টাকা দাম। আমি একটা বই বিক্রি করলে আট টাকা পাই। পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি হলে চার লাখ টাকা পাব, ভাবা যায় না! উনি আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। উনি খুব প্রবীণ লেখকও ছিলেন, গজেন্দ্র কুমার মিত্র। উনি আমাকে বললেন, তুমি কি চাও এই পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি হয়েই বইটা শেষ হয়ে যাক? মানে? যেই আমি বলবো কমিউনিস্ট পার্টির দলিল তাতে যারা কমিউনিস্ট পার্টিকে পছন্দ করে না তারা এই বইটা পড়বে না, যারা সাহিত্য পছন্দ করে তারা ভাববে ম্যানিফেস্টো, পড়বে না। তুমি চাও তাই? মানে, পঞ্চাশ হাজার কপির বেশি আমার বই বিক্রি হবে? আপনি কি বলছেন। তিনি হাসলেন। কি চাও? আমার হঠাৎ মনে হলো এই লোকটা আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আমি বললাম, থাক তাহলে। বিজ্ঞাপনটা আর বের করিনি। আজকে এই বইটার এক লাখের বেশি বিক্রি হয়েছে। গজেন্দ্র কুমার মিত্রের ভবিষ্যত্বাণী সত্যি ছিল। তারপরে বের হলো কালবেলা ।

 

কিন্তু কালবেলা কি কোনো চাপের মুখে লিখেছিলেন?

না, না। যখন উত্তরাধিকার শেষ করলাম আমি আর লিখতে পারছিলাম না। কারণ এতো বড় উপন্যাস লেখার আমার অভ্যাস ছিল না। একটা গল্প বানাবার ক্ষমতা ছিল না। উত্তরাধিকারের শেষে ছিল অনিমেষের পায়ে গুলি লেগেছে। সে মাটিতে পড়ে গেছে। এখানেই শেষ ছিল। পাঠকরা ভাবলেন যেহেতু আনন্দবাজার পত্রিকার কাগজ এবং তারা বুর্জোয়াদের দালাল তারা আমার লেখা বন্ধ করেছে। হাজার হাজার চিঠি আসতে লাগলো, অভিযোগের পর অভিযোগ। সাত দিনের মাথায় সম্পাদক আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন তুমি এটা কি করলে? আমি তোমাকে বলেছি বন্ধ করতে? বন্ধ করলে কেন? তুমি আবার লেখ। ঐ আবার লিখতে বলার কারণে কালবেলা লিখলাম। কালবেলা যখন বেরোল তখন ঐ আবার বুদ্ধদেবের সঙ্গে দেখা বইমেলাতে। বুদ্ধদেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা কি করলেন আপনি? আমি বললাম, কেন? আপনি আমাদের ছুরি মারলেন? কমিউনিস্টদের আপনি ছুরি মারলেন? মনে রেখ ওটা এইট্টি ফোর এবং সেই সময় যদি সিপিএমের বড় নেতা বলেন ছুরি মারলেন, তখন বেঁচে থাকার কোনো অধিকার থাকে না তার। কিন্তু এই ঘটনাগুলো হওয়া সত্ত্বেও আমি আক্রান্ত হইনি। এ থেকে বোঝা যায় রাজনীতির নেতাদের বিরুদ্ধে সত্যি কথা বললে সবসময় বোধ হয় আক্রান্ত হতে হয় না।

 

একটা অভিযোগ আসে যে এখনকার তরুণ সমাজ তারা অনেক বেশি সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর বা আত্মকেন্দ্রিক। এখনকার তরুণ সমাজ কি আসলেই রাজনীতিবিমুখ হয়ে গেছে?

না, না। নকশাল আন্দোলনের সময় বা তার পরবর্তীকালে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল তখন মানুষের সঙ্গে ছিল আদর্শ। এই আদর্শ মানুষকে পাগল করে দিত আবার আদর্শ মানুষকে বসিয়েও দিত। অর্থাৎ কিছু পাওয়ার জন্য নয়, আত্মতৃপ্তির জন্য মানুষ রাজনীতি করতো। কিন্তু এখন মানুষ জানে আমার বড় ভাই বেকার আর আমি ক্লাস সিক্স অব্দি পড়েছি বা আমার বড় ভাই এমএ পাস করেছে, কোনো রকমে একটা স্কুলে মাস্টারি করছে। আর আমি সিক্স অব্দি পড়ছি, কিন্তু আমার পড়তে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু আমি যদি সরকারি রাজনৈতিক দলে ঢুকে যাই তাহলে আমি দশ বছর কেন পাঁচ বছরের মধ্যে দুই তিনটি বাড়ি করে ফেলব, তিনটি মোটরসাইকেল আমার হবে।

 

তাহলে আদর্শগত কোনো বিচ্যুতি ঘটছে?

এখন আদর্শ বলে কোনো শব্দই নেই। এটা হচ্ছে আমি আত্মতুষ্ট হবো। আমি রোজগার করবো।

 

তার মানে এখনকার সমাজ ব্যবস্থা আমাদের অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে।

অনেক বেশি আত্মকেন্দ্র্রিক। এককালে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ছিল। বাবা, মা, কাকা, জেঠা সবাই মিলে আমরা। তারপরে স্থান সংকুলান হলো। বাবা, মা আমাকে আর ভাইকে নিয়ে আলাদা হলেন। তখন কিন্তু আমার কাকা, পিসি এরা নেই। আমি, আমার মা, আমার বাবা, আমার ভাই চারজনে পরিবার। এইবার আমি একটা ভালো চাকরি নিয়ে আমেরিকায় গেলাম, আর ফিরলাম না। আমার ভাই অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেল, আর ফিরলো না। রইলো কে? বাবা আর মা। এবার বাবাও ভাবছেন, মা মারা গেলে উনি কি করবেন? আর মাও ভাবছে বাবা মারা গেলে উনি কি করবেন, কীভাবে একা থাকবেন? তখন মাও নিজের ভাবনাগুলো ভাবতে আরম্ভ করলেন, বাবাও নিজের ভাবনা ভাবতে আরম্ভ করলেন।

 

আমি যদি লেখক সমরেশ মজুমদারের কাছে জানতে চাই যে তার প্রিয় উপন্যাস কোনটি—উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিণী, সাতকাহন না মৌষলকাল?

বলা খুব মুশকিল। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন আমার মা বেশি প্রিয়, আমার স্ত্রী বেশি প্রিয়, আমার বড় পিসিমা যিনি আমাকে মানুষ করেছেন তিনি বেশি প্রিয়? নাকি আমার দুই কন্যা বেশি প্রিয়? আমি কি জবাব দিতে পারব?

 

তাহলে মাধবীলতা বা দীপাবলি এটার মধ্যেও কি ভেদাভেদ করতে পারেন না?

সব একই শেড। মাধবীলতা সকালবেলার চা খায়, বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, দীপাবলি বিকেলে অফিস থেকে ফিরে এসে রান্নাবান্না করে, খাবার দিয়ে বলে খাও, পার্থক্য নেই।

 

একটা মজার কথা আছে আপনাকে নিয়ে। বলা হয় দীপাবলি চরিত্রটা আপনার জীবনের পছন্দের কোনো চরিত্র থেকে এসেছে, যার আপনি প্রেমে পড়েছিলেন।

এই রে! আমি তো ওয়েট করছি এখনো।

 

এখনো প্রেমে পড়ার জন্য?

আমি চাই দীপাবলি বলে কেউ আসুক। কিন্তু আর আসার সময় নেই। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে চলে যাবে।

 

প্রেম নিয়ে যখন কথা শুরুই হলো তাহলে জানতে চাই— সমরেশ মজুমদারের জীবনে কতবার প্রেম এসেছে?

দাঁড়ান, আমি যখন রবীন্দ্রনাথের গান শুনি তখনি প্রেমে পড়ি। বিশ্বাস হয় না? আমি যখন রবীন্দ্রনাথের গান গাই তখন প্রেমে পড়ি। সৈয়দ শামসুল হক আমার খুব প্রিয় লেখক। উনি খুব ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। নামাজ পড়তেন, কোরআন পাঠ করতেন, আল্লাহকে প্রচণ্ড রকমভাবে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। আমি একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, এত সব করার পর আপনি রাতে শুতে যান কখন? বলেছিলেন, এই সাড়ে দশটা-এগারোটার দিকে ঘুমাতে যাই। ঘুমিয়ে পড়েন? নাহ, ঘুম আসে না। কেন, ঘুম আসে না কেন? অস্বস্তি লাগে। তখন কি করেন? ঘুমের ওষুধ খান? বলেছিলেন, না না। তাহলে? তখন রবীন্দ্রনাথের গানের সিডি বাজাই। সিডি চলতে চলতে ঘুম এসে যায়। ঘুমিয়ে পড়ি। আমি তখন বলেছিলাম, সারাদিন এতো সব কাজ করেও আপনার ঘুম আসে না অথচ রবীন্দ্রনাথের গান আপনাকে ঘুম পাড়ায়? কীভাবে ঘুম পাড়ায়? বলেছিলেন যখন শান্তি আসে মনে তখন ঘুমটা আসে। অশান্ত মন কখনো ঘুমাতে পারে না। আর শান্তি তখনি আসে যখন মানুষ প্রেমে পড়ে।

 

রবীন্দ্রনাথের কথা যখন তুললেন তখন আমি একটু জানতে চাই আমাদের সবার জীবনেই রবীন্দ্রনাথের অনেক প্রভাব রয়েছে, আপনার জীবনে তার ছায়া কতখানি?

আমার কোনো ঈশ্বর নেই। আমি জন্মসূত্রে হিন্দু। কিন্তু কেন  হিন্দু আমার বাবা তা ব্যাখ্যা করতে পারেনি, আমার পিতামহ ব্যাখ্যা করেননি। আমি ঘুম থেকে ওঠে ঘুমাতে যাওয়া অব্দি সময়টার মধ্যে কোনো ধর্ম আচরণ করতে দেখিনি বাবাকে। আমি সেই অর্থে একজন খ্রিস্টান, একজন মুসলমান বন্ধুকে অনেক বেশি ঈর্ষা করি। তাদের একটা কোরআন বা বাইবেল আছে, আমার নেই। মানে বাঙালি হিন্দুর কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই। যে ধর্মগ্রন্থগুলোকে বলা হয় সেগুলো বাঙালির নয়। তাহলে কী নিয়ে বাঁচব? এই ভাবতে ভাবতে আমি জানলাম আমার একজন ঈশ্বর আছেন, তার নাম রবীন্দ্রনাথ। তিনি প্রতি মুহূর্তে আমাকে বাঁচার রসদ জোগান। যখনি দুঃখ পাই, আমি গীতবিতান খুলি, যখন সুখ পাই তখনো গীতবিতান খুলি এবং আমি উজ্জীবিত হয়ে উঠি। লহ, লহ, আরও লহ। রবীন্দ্রনাথ সামনে আছেন, আমি নিই। আমি কেন,  অনেকেই নেন।

 

সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে কার লেখা আপনার পছন্দ?

ওপার বাংলার শীর্ষেন্দু মুখার্জির লেখা খুবই ভালো লাগে। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ লেখা, আত্মস্থ লেখা। আর এপার বাংলায় আমার বয়োকনিষ্ঠ কিন্তু আমার অত্যন্ত বন্ধু ছিল হুমায়ূন আহমেদ। যদিও ও খুব মজা করে বলতো, সমরেশদা যারা ষোল বছর বয়সে হুমায়ূন পড়ে না, সে বাঙালি না। আর যে চব্বিশের পর হুমায়ূন পড়ে সে বাঙালি না। খুব মজা করে বলতো, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম না। কেননা ওর অনেক লেখার মধ্যে এতো বেশি  আবেগ থাকতো, আমার খুব ভালো লাগতো। তারপরে মিলনের কিছু লেখা আমার ভীষণ রকম ভালো লাগে, শামসুল হক সাহেবের লেখা ভালো লাগে। কিন্তু কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে জানেন। হুমায়ূন যেভাবে পাঠক পেয়েছিলেন, পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন এবং হুমায়ূন চলে যাওয়ার পরও সেই জনপ্রিয়তা একটুও কমেছে বলে আমার মনে হয় না। সেই জনপ্রিয়তা কিন্তু পরবর্তীকালে বা সমসাময়িক লেখকরা কেন পাচ্ছেন না? এটা তাদেরই বিশ্লেষণ করা উচিত, তাদেরই ভাবা উচিত।    

 

অন্যদের লেখায় সেই আবেগটা নেই?

আমি হুমায়ূনকে একটা কথা বলতাম, দ্যাখো তোমার উপন্যাস পড়ে আমি বুঝতেই পারি না যে নায়ক বা নায়িকা কোন সময়ের। যদি ধরেন তারা এই রাস্তা দিয়ে হাঁটে, ঢাকার রাস্তা দিয়ে সে কোন সময়ে হাঁটছে? এরশাদের আমলে হাঁটছে? জিয়া, বেগম জিয়ার আমলে হাঁটছে, নাকি শেখ হাসিনার আমলে হাঁটছে, বোঝা যাচ্ছে না। কেননা তুমি লেখো না পরিবেশের কথা, সেই সময়ের রাজনীতি, কোন সরকার এলো না গেলো, সেখানে জমির দাম কত, সবজির দাম কত, সেটা তুমি লেখো না। মানুষ একাত্ম হয় শুধু তোমার আবেগের কারণে। কিন্তু মানুষ তো এগুলোও চায়। ও বলতো, লিখলে মার খাব। এটা হতে পারে একেক জায়গায় একেক রকম। কিন্তু আমরা যখন লিখি, তখন আমি অন্তত খোলামেলা লিখি এবং সেটা কিন্তু বাংলাদেশের পুরুষ নারী প্রত্যেকেই পড়েন। এখানে একটা কথা বলা উচিত। হিন্দু অথবা মুসলিম, এ দুটো ধর্মের মানুষদের মধ্যে মুসলমান ধর্মের মানুষরা অনেক বেশি উদার, হিন্দুরা অনেক বেশি মৌলবাদী। এটা আমি কলকাতায়ও বলেছি আপনাদের এইখানেও বলছি। কেন মৌলবাদী তার ব্যাখ্যা দিচ্ছি। আমাদের কোনো লেখায় লক্ষ্মী পুজো, দুর্গা পুজো ইত্যাদি থাকবেই, বাংলাদেশের পাঠক কিন্তু সেটা পড়তে দ্বিধা করে না। কিন্তু আমাদের কোনো লেখায় বা আপনাদের কোনো লেখায় যখন স্বাভাবিকভাবে চাচা বা আপা এই সব শব্দ আসে, নায়ক নামাজ পড়ছে, পশ্চিমবঙ্গের পাঠক তা বন্ধ করে দেবে। তারা আর পড়তে পারে না। তাদের অস্বস্তি হয়। তারা কমিউনিকেট করতে পারে না। আমি বলি এটা মৌলবাদের চূড়ান্ত লক্ষণ। দে ক্যান নট অ্যাকসেপ্ট রিলিজিয়ন, রিলিজিয়নকে অ্যাকসেপ্ট করতে না পারলে সাহিত্যকে ধরতে পারবে না, তুমি সেই সময়ের মানুষকে ধরতে পারবে না, এই সময়ের মানুষকেও পারবে না। এ কারণে আমি বার বার বলি, আমাদের মৌলবাদী পাঠকদের লজ্জিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশের মানুষ পাঠক হিসাবে মৌলবাদী নন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ধর্ম কখনো উগ্র হতে পারে, কিন্তু সে যখন পাঠক হয়, তখন উগ্রতা থাকে না, একেবারেই থাকে না। আমি আপনাকে একটা ঘটনা বলি তাহলে বুঝবেন। আমি আর আমার এক বন্ধু একবার নিউইয়র্কে থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্ব্বরের আগের রাতে এক বাস টার্মিনাল থেকে কুইনসে আসছিলাম। শুনলাম ট্রেন বন্ধ, রিপেয়ার হচ্ছে। এতো ঠাণ্ডার মধ্যে আরও দুটো ব্লক গিয়ে একটা স্টেশনে উঠতে হবে। আমার অতো শীতবস্ত্র ছিল না যে ঠাণ্ডার মধ্যে এত পথ হেঁটে যাব। একটা ট্যাক্সি নিলাম আমরা। ট্যাক্সিকে বললাম কুইনসে যাব। সেই ট্যাক্সিওয়ালা কিছুক্ষণ পরে কুইনস যেদিকে, তার উল্টো দিকে চলে যাচ্ছিল সমুদ্রের ধারে। তখন তাকে বললাম, তুমি কোথায় যাচ্ছো? সে বলল রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম তুমি ট্যাক্সি চালাও না? সে বলে, আমি ক্যাজুয়াল রোডে চালাই না। পুলিশকে ফোন করতে বললাম। বলে পুলিশ জানলে লাইসেন্স ক্যান্সেল করে দেবে। একটা ম্যাপ দিল, রোড ম্যাপ। এই করতে করতে হঠাৎ বলে, স্যার আই এম আউট অব গ্যাস। আর পাঁচ মিনিট চলবে। আপনিই বলেন, রাত একটা দেড়টার সময় যদি থার্টিফার্স্ট রাতে গ্যাস আউট অব কার হয়, তাহলে পরিণতিটা কি হবে? ভোর চারটার মধ্যে আপনি গাড়ির মধ্যে জমে মরে থাকবেন। গরম থাকবে না গাড়ি, একদম ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তখন মাইনাস থার্টি টু অর থার্টি থ্রি। হঠাৎ দেখি দূরে একটা গ্যাস স্টেশনের আলো বিপ বিপ করছে। আমরা ঐখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা বন্ধ হলো, এবং আলোটা নিভে গেল। সেখান থেকে এক ভদ্রলোক আপাদমস্তক মোড়া, মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ, গলায়, হাতে গ্লাভস, চাবিটাবি নিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে। তো আমরা হ্যালো স্যার, হ্যালো স্যার করছি, কেউ শুনে না। তখন খেয়াল হলো আরে গাড়ির কাচ তো উঠানো, শুনতে পাবে কীভাবে! গ্লাসটা নামাতে আমার বন্ধু চিৎকার করলো, আরে ভাই শুনছেন, আরে ভাই শুনছেন। প্রাণের দায়ে তখন সে ভুলে গেছে সে নিউইয়র্কে আছে। লোকটা দাঁড়ালো। এগিয়ে এলো। তখন ড্রাইভার ভিতরের আলোটা জ্বালালো, সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আরে দাদা আপনি কবে এসেছেন? আমি বললাম আপনি আমাকে চেনেন? সে বলে কি কন, আমি একটু আগেই গর্ভধারিণী পড়ছিলাম। নোয়াখালীর একজন লোক, একটা গ্যাস স্টেশনে সারাদিন চাকরি করে, রাত দুইটার সময় বাসায় যায়। সেই লোক আমাদের গাড়িতে উঠালো, ড্রাইভারকে প্রচুর ধমক দিল। নতুন করে গ্যাস ভরে দিল, গ্যাস দোকান খুলে। আমাদের পৌঁছে দিল কুইনসে। বলল, দোয়া করেন দাদা যেন ভালো থাকি, বাচ্চারা ভালো থাকে।

 

এইটাই তো জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, তাই না?

এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে বলুন তো?  সে বলল, আমি কট্টর ধর্মপ্রাণ মানুষ, আল্লাহ ছাড়া কিছুই বুঝি না। আমি বললাম, আপনি আমাকে এতো সাহায্য করলেন? সে বলে আপনি তো আমাকে আনন্দ দেন। এর চেয়ে পাওয়া কি হতে পারে ভাই, আমি জানি না।

 

এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। কমিউনিকেশনের কথা বললেন, আনন্দের কথা বললেন, এবং আপনারা আমাদেরকে আনন্দ দেন, উপন্যাস গল্পের মধ্য দিয়ে। চলচ্চিত্র নাটক উপন্যাস সবই বিনোদন। যেহেতু দাদা আপনি অভিনয় করেছেন, অভিনয়ের ব্যাপারেও নিশ্চয়ই আগ্রহ আছে। একটা অভিযোগ সবসময় আসে যে আপনাদের নাটকগুলো আমরা দেখতে পাই, আমাদের নাটকগুলো আপনারা দেখতে পান না।

এটা অত্যন্ত অন্যায় ব্যাপার, এর মধ্যে একটা চক্র কাজ করছে। এ চক্রটা মূলত পশ্চিমবঙ্গের যারা চ্যানেল ইউনিয়নগুলো চালায় তারাই করছে। তারা প্রচুর পরিমাণে টাকা চায়।

 

যেটা আমাদের পক্ষে আসলে দেওয়া সম্ভব না।

সেটা সম্ভব হচ্ছে না বলে তারা দেখাচ্ছে না। এটা একটা চক্র ছাড়া আর কিছু নয়। আর দ্বিতীয়ত আমি এখানে কলকাতার যে চ্যানেল পাই। যেমন ধরুন—

 

স্টার জলসা, জি বাংলা।

কিন্তু যেটা সবচেয়ে পপুলার নিউজ চ্যানেল এবিবি আনন্দ বা চব্বিশ ঘণ্টা এটা পাই না। এটার জন্য কোনো ভাইসভারসা কারণ আছে কিনা জানি না। কিন্তু এটা বন্ধ করা উচিত, দুই সরকারের উদ্যোগে বন্ধ করা উচিত। একটা কমন প্লাটফর্মে এসে দুই দেশের চ্যানেল দুই দেশের দর্শকদের পৌঁছে দেওয়া উচিত।

 

সংস্কৃতিমন্ত্রী?

হ্যাঁ, তিনি। ওপার বাংলার ছবি এপার বাংলায় দেখানো, এপার বাংলার ছবি ওপার বাংলায় দেখানোর কথা হয়েছে। সম্প্রতি বেলাশেষে বলে একটা ছবি এখানে দেখানো হয়েছে। সেটা একটা হলে রিলিজ হয়েছে। এবং কলকাতায় বাংলাদেশের যে ছবিটা রিলিজ করেছে, সেটি কিন্তু উইথআউট প্রচার রিলিজ হয়। মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা আগ্রহ হয়নি, ছবি দেখতেও কেউ যায়নি। ঠিক এইভাবে চললে কিছু দিনের মধ্যে মানুষ উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। আমরা কলকাতায় ছবি দেখাব, চলবে না। কলকাতার ছবি এখানে এলে চলবে।

 

প্রচারটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

এটা প্ল্যান করে করা উচিত।

 

আপনার কাছে আরও কিছু প্রশ্ন আছে, আপনার জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, অনেক সম্মান পেয়েছেন। আপনি কি মনে করেন আপনি সার্থক?

পুরস্কার পেলে আমার না হাসি পায়। বিশ্বাস করুন, মনে হয় আমার আমি এর যোগ্যই নই, আমাকে বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। আমার বোধ হলো যে আমি কি লিখেছি, যে পুরস্কৃত করা হবে! বরং রফিক আজাদ আমার খুব বন্ধু ছিল, চলে গেছে, ওকে যে পুরস্কৃত করা হয়েছে লাইফ টাইম হিসেবে আমি খুব গর্ব অনুভব করেছি। কারণ রফিক তো আর লিখবে না, লেখার কথাও না। ও যা লিখেছে তার জন্য ওকে সম্মান জানানো উচিত। আমি এমন কিছুই লিখিনি যে পুরস্কৃত হবো, হওয়ার কথা বা উচিত।

 

কিন্তু পাঠক আপনাকে ভীষণ পছন্দ করে—

এর চেয়ে বড় পুরস্কার কি আছে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমি যদি কোনো পাঠককে বলি যে, আমি আপনার বাড়িতে সাত দিন গিয়ে থাকব। থাকতে দেবেন? কেউ কি না করবে? 

 

অবশ্যই দেবে।

এর চেয়ে বড় আর কি আছে। 

 

আপনার জীবনের স্বপ্ন কি সমরেশ মজুমদার? 

আমি যেন মৃত্যুর আগে, আগ মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে পাই। এটাই আমার শেষ আশা, ঐ গান শুনতে শুনতে, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।

 

বাংলাদেশের মানুষের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে?

আপনারা আমাকে দু’হাত ভরিয়ে দিয়েছেন। আমি তার কতটা যোগ্য প্রতিদান দিয়েছি আমি জানি না। আপনাদের ভালোবাসা আমাকে রিদ্ধ করেছে। আমি বাংলাদেশে জন্মাইনি, কিন্তু আমার বুকের ভিতরে বাংলাদেশ। নমস্কার।

 

অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।

সর্বশেষ খবর