শিরোনাম
শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিশ্বখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের আত্মহনন কাহিনী

সাইফ ইমন

আসলে ‘প্রাণ’ এক আশ্চর্য সম্পদ, ক্ষয়হীন আশা, মৃত্যুহীন মর্যাদা। আত্মার মৃত্যু নেই; হনন হয় মাত্র। এসব বিজ্ঞানের কথা নয় সাহিত্যের ভাষা। কারণ আত্মা নিয়ে কথা উঠলেই যে দর্শন চলে আসে। উঁকি দেয় পরাবাস্তবতা। লেখকরা তখন খাতা-কলম নিয়ে বসেন। কারও লেখা থেমে যায় কারও লেখা চলতেই থাকে। যাদের লেখা অবিরত চলতেই থাকে তারা এক সময় বিরক্ত হয়ে সব ঝেড়ে ফেলে নতুন একটা শুরু চান পুরনো হালখাতায়। বেছে নেন আত্মহননের পথ। অন্তত আত্মঘাতী লেখকদের সুইসাইড নোট, কবিতা, ব্যক্তিগত ডায়েরি ইত্যাদি পড়লে এমনটাই ধারণা হবে আপনার। মজার বিষয় এটা যে একরকম ‘মানসিক বৈকাল্যতা’ এ কথা প্রায় সব আত্মঘাতী লেখকই স্বীকার করে গেছেন। এই ‘মানসিক বৈকাল্যতা’কে সোজা ভাষায় বলা হয় ‘পাগল’। কারণ মৃত্যু জীব-জগতের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মাঝে মাঝে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম ব্যাঘাত ঘটে। সাহিত্যিকরা প্রায়ই দাবি করেন প্রকৃতি নিয়ম ভাঙা পছন্দ করে না। তারপরও কেউ কেউ আছেন যারা নিয়ম ভাঙেন। তাদের মনে হয় নিয়ম ভাঙাই পছন্দ। প্রাচীন চীনে সিমা সিয়েন নামে এক সাহিত্যিক বলে গেছেন, মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তার তাত্পর্য হবে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী বা বেলে হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন সাহিত্যিকের আত্মহত্যা আর একজন সাধারণ ব্যক্তির আত্মহত্যা কখনই এক নয়। তবে দিন শেষে পরিণতি কিন্তু একই। কারণ আপনি ‘বিষ’ জেনে খেলেও মারা যাবেন আবার ‘বিষ’কে পানি মনে করে খেলেও মারা যাবেন। সাহিত্যিকদের আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন রকম মন্তব্য করেছেন। মনস্তাত্ত্বিকের ব্যাখ্যার সঙ্গে দার্শনিকের ব্যাখ্যার যেমন মিল নেই, আবার প্রবল আধ্যাত্মবাদী বা অদৃষ্টবাদীর ব্যাখ্যার দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা। ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’ কোনো সাহিত্যিক যখন এমন কথা বলছেন তখন কেউ আবার ‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্প লিখছেন। সব থাকার পরও যখন এক ধরনের না-থাকা বিরাজ করে তখনই রাতের আঁধারে একগাছা দড়ি হাতে বের হওয়ার ঘটনা ঘটে। এমনই একজন হলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হার্ট ক্রেন। হুট করে গুডবাই এভরিবডি বলে মেক্সিকান উপসাগরে একটি নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তখন হার্ট ক্রেনের বয়স মাত্র ৩২। আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিক কোয়েসলার আত্মহত্যার আগে লিখেছিলেন দীর্ঘ চিঠি। হার্ট ক্রেন এমনটা করেননি; তার চিরকুটটা ছিল এমন— বন্ধুরা, কাজ তো শেষ তবে আর অপেক্ষা কেন?  ক্রেন এখানে কাজ শেষ বলতে কী কাজের কথা বুঝিয়েছেন! যার পর পৃথিবীতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই করার মতো! সাহিত্যের আরেক দিকপাল পল ক্লি ঝাঁপ দিয়েছিলেন সিন নদীতে ৪৯ বছর বয়সে। কবি গিলিজ ডিলুয়েজকে বাধ্যতামূলক অক্সিজেন মেশিন ব্যবহার করতে হতো। একদিন তিনি মেশিনটি ফেলে দেন জানালার বাইরে। ১৯৮১ সালে ‘এ কনফেডারেসি ডানসেসিন’-এর জন্য লেখক জন কেনেডি টুলকে পুলিত্জার পুরস্কার দেওয়া হয়। এরও এক দশক আগে বিষাক্ত কার্বন-মনো অক্সাইড গ্যাস নিয়ে আত্মহত্যা করেন জন কেনেডি। মৃত্যুর পর তার মা প্রায় ১০ বছর হন্যে হয়ে ঘুরেছেন যেন বইটি প্রকাশ পায়। কী আছে সেই বইয়ে আমি এখনো জানি না; তবে জার্জি কসিনস্কি সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন, আমি এখন ঘুমোতে যাচ্ছি, আমি এখন একটু বেশি সময় ধরেই ঘুমাব। তোমরা এটাকে অনন্তকালের ঘুম বলতে পার। এ ছাড়াও আত্মহত্যা করেন লেখিকা ‘সারাহ কেন’ মাত্র ২৮ বছর বয়সে। লন্ডন কিংস কলেজের হাসপাতালের বাথরুমে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন তনি। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্টারনাল মেডিসিন ফিজিশিয়ান’ অ্যালেক্স লিকারম্যান সম্প্রতি আত্মহত্যার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, আত্মহত্যার সবচেয়ে প্রচলিত কারণ হলো মানসিক চাপ ও বিষাদগ্রস্ততা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় যন্ত্রণার স্থায়ী অনুভূতি এবং আত্মহত্যার মাধ্যমে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার অনড় এক বিশ্বাস। দ্বিতীয়ত, কিছু মানুষ গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই ভিতর থেকে আত্মঘাতীপ্রবণ হয়ে থাকে। এরা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়। নিরাময়যোগ্য হলেও রহস্যজনক এই মানসিক রোগটি সম্পর্কে বিজ্ঞান এখনো ধোঁয়াশাতেই আছে। তৃতীয়ত, আত্মহত্যার বিষয়গুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাদক ও অ্যালকোহলের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিছু কিছু মানুষ ভাবপ্রবণ হয়ে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। চতুর্থত, সাধারণত মেয়েদের ক্ষেত্রে যারা প্রেমঘটিত বা অন্য কোনো সম্পর্কের অবনতির কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাদের মাঝে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। পঞ্চমত, অনেকেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় অনিরাময়যোগ্য রোগে ভোগার জন্য। আজকের রকমারিতে থাকছেন বিশ্বখ্যাত কবি-সাহিত্যিকরা যারা বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ।

 

বাবার পথে হেঁটেছিলেন প্রখ্যাত কবি জন ব্যারিম্যান 

পুলিত্জার জয়ী কবি জন ব্যারিম্যানের বাবার আত্মহত্যার পর মা আবার বিয়ে করেন। বাবার এমন মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। কখনো মেনে নিতে পারেননি বাবার এমন মৃত্যু। তিনি পড়াশোনা করেন কলম্বিয়া কলেজ ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে ১৯৫৫ সালে তিনি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সনেট কাব্য সংকলনের জন্য ১৯৬৪ সালে তিনি পুলিত্জার পুরস্কার পান। ৩৮৫টি কবিতা ছিল বইটিতে। প্রকাশের পর বইটি ওই সময়ের অন্যতম সেরা কাব্যগ্রন্থের স্বীকৃতি পায়। সেই সঙ্গে জন ব্যারিম্যানকে এনে দেয় বিশ্বজোড়া খ্যাতি। এত কিছু পেয়েও কেমন যেন আনমনা থাকতেন জন ব্যারিম্যান। তারপর একদিন বাবার পথেই হাঁটলেন। তিনি ১৯৭২ সালে ওয়াশিংটন এভিনিউ ব্রিজ থেকে প্রায় ৯০ ফুট নিচে মিসিসিপি নদীতে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।

 

রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন প্রেমিক কবি মায়াকোভস্কি

গত শতকের শুরুতে রুশ বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃত মায়াকোভস্কিকে বলা হয় রাশিয়ান কবিতার ‘রেগিং বুল’। পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ, মানুষে মানুষে অসাম্যের কথা বলেছেন এই কিংবদিন্ত কবি তার লেখনীতে। তার কবিতা অনূদিত হয়েছে নানান ভাষায়। সমাদৃত হয়েছে পৃথিবীর নানান দেশে। এই কবির পুরো নাম ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ মায়াকোভস্কি। ঘটনাক্রমে তার সঙ্গে পরিচয় হয় অভিনেত্রী ভেরোনিকা পোলানস্কায়ার। প্রথম দেখাতেই তিনি ভেরোনিকা পোলানস্কায়ার প্রেমে পড়েন। সম্পর্কের টানাপড়েন তাকে ভীষণ রকম বিমর্ষ, অধৈর্য আর বিপর্যস্ত করে তোলে। ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে স্ত্রী ইয়ানশিনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেন মায়কোভস্কি। পোলানস্কায়ারকে বিয়ের করার কথা বলেন মায়াকোভস্কি। কিন্তু তাদের মাঝে সম্পর্কের টানাপড়েন নতুন করে শুরু হয়। এভাবে দিন দিন প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়েন এই কবি। ১৯৩০ সালের ১৪ এপ্রিল মায়াকোভস্কির সঙ্গে পোলানস্কায়ারের দেখা হয়। এরপর সকাল ১০টা ১৭ মিনিটে মায়াকোভস্কি রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন।

 

নিজের মাথায় নিজে গুলি করেন নোবেলজয়ী আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

১৯৬১ সালে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন নোবেলজয়ী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। প্রথমে বেজমেন্টের স্টোর রুমের তালা খোলে সেখান থেকে তার বন্দুক বের করেন। তারপর তার কেচহাম বাড়ির সামনের প্রবেশপথ দিয়ে চলে যান উপরতলায় থব্যারেলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেন নিজের মুখে, তারপর ট্রিগারে চাপ দিয়ে উড়িয়ে দেন নিজের মগজ। এভাবেই শেষ হন কিংবদন্তি লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। অথচ তিনি বলে গেছেন, মানুষ কখনই পরাজয় বরণ করে না, প্রয়োজনে লড়াই করতে করতে ধ্বংস হয়ে যাবে। আধুনিক মার্কিন সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ বলা হয় আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে। তার বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী উপন্যাস দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি গোটাবিশ্বে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখর তাকে স্পর্শ করলেও এই সাহিত্যিকের পুরো জীবন অস্থিরতার মাধ্যমেই অগ্রসর হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন এই সাহিত্যিক।

 

কার্বন মনো-অক্সাইড নিয়ে আত্মহত্যা করেন অ্যানি সেক্সটন

নোবেলজয়ী অ্যানি সেক্সটন আধুনিক ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়ে আছেন। অন্য কবিরা যে বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতেন অ্যানি সেক্সটন সে বিষয়গুলোই তুলে আনতেন কলমে। হস্তমৈথুন, রজঃস্রাব, গর্ভপাত ইত্যাদি বিষয়ও তার লেখায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু পুরো জীবনজুড়েই হতাশাগ্রস্ত ছিলেন এই কবি। মানসিক চাপ কমাতে তিনি মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার কবিতা বিখ্যাত সব পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হয়। তিনি ১৯৬৭ সালে পুলিত্জার পুরস্কার লাভ করেন। অতিরিক্ত মদ্যপান করতেন এই কবি। তবে তা কখনো তার সৃষ্টিশীলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তিনি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবারই বিফল হতে থাকেন। তার সর্বশেষ কবিতার পাণ্ডুলিপি একজন রিপোর্টারকে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটা যেন প্রকাশিত না হয়।’ ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর তিনি গাড়ির মধ্যে কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস ছেড়ে আত্মহত্যা করেন।

 

কবি কারিন বোয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যান না ফেরার দেশে

কারিন বোয়ে বিষণ্ন ও বিয়োগান্ত বিষয়ে কবিতা লিখতেন। তার বেশির ভাগ কবিতা প্রতীকধর্মী। তিনি পড়াশোনা করেন উপশাল ও স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা সংকলন। একটি সাহিত্য পত্রিকাও ছিল তার। কারিন বোয়ে তার কবিতায় পরাবাস্তবতার জগৎ সম্পর্কেও প্রথম আলোকপাত করেন। কবিতাগ্রন্থ প্রকাশ করার পর তা বিখ্যাত হয়ে যায়। এরপর একটি উপন্যাসও লেখেন কারিন বোয়ে। তিনি বিয়ে করেছিলেন, তবে সমকামী ছিলেন। ফলে তার বিয়ে  বেশি দিন টেকেনি। পরবর্তীতে বান্ধবী মারগেট হ্যানেলের সঙ্গে সম্পর্ক হয় তার। জীবনের শেষ ১০ বছর তিনি মারগেট হ্যানেলের সঙ্গেই থাকেন। জানা যায়, মানসিক চাপের কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেন। ১৯৪১ সালের এপ্রিলে একদিন তিনি গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। কিছুদিন পর তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

 

স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে আত্মহত্যা করেন থম্পসন

ঔপন্যাসিক হান্টার এস থম্পসন আমেরিকান বংশোদ্ভূত। সর্বকালের অন্যতম সেরা ঔপন্যাসিক বলা হয় হান্টার এস থম্পসনকে। নিজের শেষ লেখাটির নাম দিয়েছিলেন ফুটবল খেলার মৌসুম শেষ। নোটটি তিনি লিখেছিলেন স্ত্রী অনিতাকে উদ্দেশ্য করে। থম্পসন এতে লিখে যান— ‘আর কোনো খেলা নেই। আর কোনো বোমা নেই। চলতে থাকা নেই। কোনো মজা নেই। সাঁতার কাটা নেই। ৬৭। ৫০ এর পরও ১৭টি বছর। আমার চাওয়ার অথবা দরকারের চেয়েও ১৭টি বাড়তি বছর। বিরক্তিকর। আমি সব সময়েই উদ্দাম। কারও জন্য কোনো আনন্দ নেই। ৬৭। তুমি লোভী হয়ে যাচ্ছো। বুড়োমি দেখাও। শান্ত হও- এটা ব্যথা দেবে না।’ এই লেখার মাত্র চার দিনের মাথায় আত্মহত্যা করেন থম্পসন। নিজেই নিজেকে গুলি করে মেরে ফেলেন তিনি। অনেক দিন ধরে শারীরিক বিকলাঙ্গতায় ভুগছিলেন থম্পসন। মৃত্যুর সময় টেলিফোনে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আত্মহত্যা করেন তিনি।

 

হেঁটে খরস্রোতা পাথুরে নদীতে নেমে আত্মহত্যা করেন কবি ভার্জিনিয়া উলফ

ভার্জিনিয়া উলফ ইংরেজি ভাষার প্রখ্যাত কবি। তার মৃত্যুও কাব্যিকভাবেই ঘটেছে। নিজের ওভারকোটের পকেটে নুড়ি পাথরবোঝাই করে হেঁটে নেমে গিয়েছিলেন খরস্রোতা পাথুরে নদীতে। আর কোনো দিন ফিরে আসেননি। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো— মিসেস ডাল্লাওয়ে (১৯২৫), টু দ্য লাইটহাউস (১৯২৭), ওরলান্ডো (১৯২৮)। ভার্জিনিয়ার বিখ্যাত উক্তি —‘নারী যখন ফিকশন লেখে তখন তার একটি কক্ষ আর কিছু অর্থ খুব প্রয়োজন।’ ৫৯ বছরের জীবনে উলফ বেশ কয়েকবার মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার রোগের নাম ছিল ডিপোলার ডিজঅর্ডার। তিনি ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ আত্মহত্যা করেন। শেষ বিদায়ের আগে প্রিয়তম স্বামীর উদ্দেশ্যে এক চিঠি লিখে যান ভার্জিনিয়া। চিঠিটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পড়া সুইসাইড নোটগুলোর একটি। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ওই চিঠিটি এখনো পড়েন বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীরা, উলফের পাঠকরা। ‘আমি নিশ্চিতভাবে অনুভব করছি যে, আমি আবার পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি অনুভব করছি যে, ওরকম আরেকটি ভয়াবহ সময়ের ভিতর দিয়ে যেতে পারব না আমরা এবং আমি এবার সেরে উঠব না। আমি কণ্ঠ শুনতে আরম্ভ করেছি।’

 

গ্যাসের চুলায় মাথা ঢুকিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেন কবি সিলভিয়া প্লাথ

সিলভিয়া প্লাথ আমেরিকান কবি ও ঔপন্যাসিক। পড়াশোনা করেছেন স্মিথ কলেজ এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরেক কবি টেড হিউজের সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৫৬ সালে। এই কবি দম্পতির দুই সন্তান ফ্রিডা ও নিকোলাস। সিলভিয়া প্লাথের অধিকাংশ কবিতা কনফেশনমূলক হওয়ায় তাকে ‘কনফেশনাল কবি’ বলা হয়। হঠাৎ করেই বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন তিনি। এরই মাঝে তার লেখা ‘ড্যাডি’ কবিতাটি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করে। বলা হয়, এটা তার অন্যতম সেরা কবিতা। উল্লেখ্য, ২০ বছর বয়সে মাত্র কৈশোর পেরোনো সিলভিয়া আত্মহত্যার প্রয়াস চালান। সেবার তিনি ব্যর্থ হন। কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতা ঠিকই রয়ে যায় তার। দ্বিতীয়বার তার উদ্দেশ্য সফল হয়। কবি টেড হিউজের সঙ্গে সম্পর্কছেদ হয়ে যায় তার। এ ঘটনায় প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান সিলভিয়া। একদিন তিনি ধীরে ধীরে মাথা এগিয়ে দেন গ্যাসের চুলার দিকে। গ্যাস প্রবাহের গতি বাড়িয়ে দেন নিজ হাতে। দপ করে আগুন জ্বলে উঠলে মুহূর্তেই সিলভিয়ার মাথায় আগুন ধরে যায়। এভাবেই মারা যান তিনি। সিলভিয়া প্লাথ ১৯৮২ সালে মরণোত্তর পুলিত্জার পুরস্কার পান।

 

গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন কথাসাহিত্যিক ফোস্টার ওয়ালেস

ডেভিড ফোস্টার ওয়ালেস ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক এবং ইংরেজির প্রভাষক। ফিকশন এবং নন-ফিকশন উভয় ধরনের লেখাতেই ফোস্টার ওয়ালেস ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার লেখা ইনফিনিটি জাস্ট বইটি ইংরেজি ভাষার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ বইয়ের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। নব্বই দশকের শুরুতে তিনি মেরি কার নামে এক কবির প্রতি আকৃষ্ট হন। যদিও কবি মেরি কারের কোনোরূপ আগ্রহ ছিল না তার প্রতি। ওয়ালেস কবি মেরির প্রতি এতটাই আসক্ত ছিলেন যে, তিনি নিজের শরীরে ট্যাটু দিয়ে মেরি কারের নামও লিখেছিলেন। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি মদ এবং নেশার দিকে ঝুঁকে পড়েন। হতাশা কাটানোর জন্য এরপর তিনি তার মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটানো শুরু করেন। দীর্ঘদিন হতাশায় থাকার পর ৪৬ বছর বয়সে ২০০৮ সালের ১২ মেপ্টেম্বর ফোস্টার ওয়ালেস তার গাড়ির গ্যারেজে গিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি দুই পাতার একটি নোট লিখে যান।

 

ইউকিও মিশিমা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নিজের পেটে ধারালো অস্ত্র চালিয়ে আত্মহত্যা করেন

জাপানি প্রখ্যাত লেখক ইউকিও মিশিমা। এই লেখকের প্রকৃত নাম কিমিতা হিরাওকা। তিনি একজন অসাধারণ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, মঞ্চাভিনেতা, পরিচালক, চলচ্চিত্র অভিনেতা, অর্কেস্ট্রা পরিচালনাকারী। এক কথায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন ইউকিও মিশিমা। অনেকেই মনে করেন তিনি নোবেল পুরস্কারের যোগ্য দাবিদার ছিলেন। কিন্তু শিল্পসাহিত্যের এসব অঙ্গনের পরিচিতি ছেড়ে তিনি রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে পড়েন। তিনি ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছাত্র হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তখন থেকেই জাপানের বিভিন্ন বিখ্যাত পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন তিনি। লেখা ছাপাও হতো নিয়মিত। তার লেখা সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে তখন থেকেই। এর আগে মাধ্যমিক স্কুলে থাকা অবস্থায়ই ‘বুনগেই বুনকা’ পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন। এত কম বয়সী একজন ছাত্রের লেখা ছাপা নিয়ে সম্পাদনা পর্ষদ বিপাকে পড়লে প্রকৃত নাম ‘কিমিতা হিরাওকা’ বাদ দিয়ে ‘ইউকিও মিশিমা’ ছদ্মনামে লেখা ছাপানো হয়। তারপর ওই ইউকিও মিশিমা নামেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। তবে তার লেখালেখিতে বাধা হয়ে দাঁড়ান তার বাবা। তিনি বদরাগী ছিলেন। ছেলের লেখালেখি একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। এমনকি তার কোনো লেখা পেলেই নষ্ট করে ফেলতেন। যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানের ধ্বংসযজ্ঞতা মিশিমাকে দারুণ নাড়া দেয়। জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধ ও আবহমান ঐতিহ্যের অবক্ষয়-চিত্র তার লেখায় সব সময়ই ওঠে এসেছে। সেই সঙ্গে মিশিমার ক্যারিয়ারে বরাবরই মৃত্যু ভাবনা এসেছে তারই রচিত শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তিনি কখনই হতাশার কাছে পরাজয় স্বীকার করে স্বীয় জীবনকে মাদক কিংবা গ্যাসের চুলায় সমর্পণ করেননি। এসবের পাশাপাশি তিনি একজন দক্ষ সামুরাইও বটে। তাই মিশিমা জাপান সেলফ ডিফেন্স ফোর্স-এ যোগ দেন এবং পরবর্তীকালে শিল্ড সোসাইটি নামে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি গোপনে প্রায় এক মাস প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ নেন এবং ১৯৬৮ সালে একশ লোকের একটি ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন, যারা সম্রাটের প্রতিরোধের শপথ নিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ২৫ নভেম্বর মিশিমা এবং শিল্ড সোসাইটির চারজন সদস্য সেলফ ডিফেন্স ফোর্স-এর টোকিও সদর দফতরে হামলা চালিয়ে তার কমান্ডার জেনারেল মাসউদাকে বেঁধে রেখে হাতে একটি সোর্ড নিয়ে হুমকি দেন জেনারেলের ৮০০ সৈন্যকে মিশিমার ভাষণ শুনতে কোর্টইয়ার্ডে আসার জন্য। সেই ভাষণে তিনি সৈন্যদের যুদ্ধ-পরবর্তী গণতন্ত্র ছেড়ে প্রাচীন জাপানের সামুরাই শাসনে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার কথা বলেন। তার আধা ঘণ্টার ভাষণ সৈন্যদের কাছে ভালো মতো পৌঁছার আগেই সাত মিনিটের মাথায় তারা বিদ্রূপ আর চিৎকার শুরু করেন। যখন তিনি সমবেত সৈন্যদের কাছে তার ভাষণের মূল উদ্দেশ্য পৌঁছাতে পারছিলেন না তখন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ঐতিহ্যবাহী ংবঢ়ঢ়ঁশঁ পদ্ধতিতে নিজের পেট ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে আত্মহত্যা করেন। সামুরাইরা শত্রুর হাতে ধরা পড়ার পর আত্মসমর্পণ না করে এই প্রথায় আত্মহত্যা করেন।

 

মানসিক বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যা করেন এডগার অ্যালান পো

এডগার অ্যালান পো ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক। অ্যালান পো ১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি আমেরিকার বোস্টন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোর থেকেই লেখালেখি শুরু করেন তিনি। অসাধারণ প্রতিভাবান এই লেখকের সারা জীবন কাটে অভাব, অনটন ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। তিনি খামখেয়ালি জীবনযাপন করেছেন। মদ্যপান করতেন প্রচুর। আরও ছিল জুয়া খেলার ভয়ানক নেশা। ১৮৮৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান কাউকে কিছু না বলে। পরবর্তী কয়েক দিন তার কোনো খোঁজ কেউ দিতে পারেননি। ঠিক ছয় দিন পর অক্টোবরের ৩ তারিখ বাল্টিমোরের রাস্তায় নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় অ্যালান পোর। কাছের মানুষজন ্এরপর তাকে বাল্টিমোর হাসপাতালে নিয়ে যান। এর চার দিন পর হাসপাতালে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এই লেখককে। ডেথ সার্টিফিকেটে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে মানসিক বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর