বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশ্বসেরা সাকিব

রণক ইকরাম

বিশ্বসেরা সাকিব

মাগুরার সেই ছেলেটি

মাগুরায় তাকে সবাই ফয়সাল নামেই চেনে। পরিবারের মানুষজনের কাছে এখনো তিনি ফয়সালই। অনেকেই জানেন না বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ডাক নাম ফয়সাল। জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৩ মার্চ মাগুরায়। সাকিবের বাবা মাশরুর রেজা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং মাতা শিরিন শারমিন একজন গৃহিণী। পারিবারিক বলয়ের কারণে ছোটবেলা থেকেই খেলাপাগল ছিলেন সাকিব। তবে সেই বলয়ের কারণে সাকিবের হওয়ার কথা ছিল ফুটবলার। সাকিবের বাবা খুলনা বিভাগের হয়ে এবং এক কাজিন বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলতেন। কিন্তু সাকিবের গন্তব্য ছিল ভিন্ন দিকে। একজন ক্রিকেটার সারা বিশ্ব কাঁপানোর যে অদৃষ্টের লিখন ছিল, সাকিব সেদিকেই হাঁটছিলেন। সাকিবের বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে ফুটবলার হোক। একটা সময় সাকিব নিজেও ফুটবলার হতে চাইতেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জয় করে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেলে সারা দেশে শুরু হওয়া ক্রিকেট জ্বরে আক্রান্ত হলেন সাকিবও। তাই শেষ পর্যন্ত সাকিব ক্রিকেটকেই বেছে নিলেন। তার সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

২০০১ সালের দিকে ক্লাস সেভেনে থাকাকালীন আলোকদিয়ার মাঠে সাকিব গিয়েছিলেন ভাড়ায় খেলতে। বিধ্বংসী ব্যাটিং আর পেস বোলিংয়ে নজর কাড়লেন সবার। ভুল পড়ছেন না, ঠিকই পড়ছেন। শুরুর দিকে সাকিব আল হাসান কিন্তু পেসারই ছিলেন। আলোকদিয়ার মাঠের সেই খেলায় আম্পায়ার ছিলেন সাদ্দাম হোসেন গোর্কি। তিনি আবার স্থানীয় পর্যায়ের একজন কোচও। সাকিবের খেলা তাকে দারুণ মুগ্ধ করল। এই মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটাতে সাদ্দাম হোসেন সাকিবের মেধাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। তার পরামর্শে সাকিব মাগুরায় ইসলামপুরপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দেন। এটি মাগুরা লিগের একটি পরিচিত দল। এর আগ পর্যন্ত সাকিবের সব খেলা হয়েছিল টেপড টেনিস বলে। তখনো পর্যন্ত সাকিব আসল ক্রিকেট বলের দেখাই পাননি। সেখানেও নতুন ক্রিকেট বলে প্রথমে পেস বোলিং শুরু করেন সাকিব। জোরে বল করার মধ্যে আলাদা মজা পেতেন সাকিব। কিন্তু তার কোচ সাদ্দাম হোসেন সাকিবকে স্পিন বল শুরু করতে বলেন। সত্যিকার ক্রিকেট বল দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে করা সাকিবের প্রথম বলটি ছিল স্পিন বল। এবং প্রথম বলেই উইকেট পান সাকিব।

 

সাকিব ২০০১ সালে বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রমে মাগুরা জেলা থেকে নড়াইল ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হন। নড়াইল ক্যাম্প থেকে ঢাকার বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য যে ২০ জন সুযোগ পেয়েছিল, সাকিব তাদেরই একজন। তখনই আসলে সাকিবের মূল ক্যারিয়ারের শুরু। বিকেএসপিতে ভর্তির পর বাংলাদেশের হয়ে বয়সভিত্তিক দলগুলোতে [অনূর্ধ-১৫-১৭-১৯] খেলার সুযোগ পান। আর সেখানেই মেধার স্বাক্ষর রাখেন সাকিব। পনেরো বছর বয়সে অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলা সাকিব আসলে তখনই জাতীয় দলে কড়া নাড়ছিলেন।

 

 

 

এক নজরে...

পুরো নাম : সাকিব আল হাসান।

পরিচিত : সাকিবুল হাসান।

জন্ম : ২৪ মার্চ ১৯৮৭ মাগুরা।

বর্তমান বয়স : ৩২ বছর ৩ মাস ৩ দিন।

খেলার ধরন : অলরাউন্ডার।

ব্যাটিং ধরন : বাঁ-হাতি।

বোলিং ধরন : বাঁ- হাতি অর্থোডক্স।

খেলার ক্ষেত্র : বাংলাদেশ, অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার, বাংলাদেশ ‘এ’ দল, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড একাদশ, বার্বাডোস ট্রাইডেন্টস, ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস, ঢাকা আবাহনী, ঢাকা মোহামেডান, লিজেন্ড অব রূপগঞ্জ, জ্যামাইকা তাল্লাওয়াস, করাচি কিংস, খুলনা ডিভিশন, কলকাতা নাইট রাইডার্স, পেসোয়ার জালমি, সানরাইজার্স হাইদ্রাবাদ, ওরচেস্টারশায়ার।

 

অভিষেকের দিন...

৬ আগস্ট ২০০৬, বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ের পঞ্চম ওয়ানডে ম্যাচ। অভিষেক হলো এক তরুণ খেলোয়াড়ের, নাম সাকিব আল হাসান। বল হাতে ১০ ওভারে ৩৯ রানের বিনিময়ে এলটন চিগাম্বুরার উইকেট এবং ব্যাট হাতে ৪৯ বলে অপরাজিত ৩০ রানের একটি ইনিংস। এটি ছিল সিরিজের শেষ ম্যাচ যাতে জিম্বাবুয়ে ৩-২ ব্যবধানে জয়ী হয়। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে সাকিব, ফরহাদ রেজা ও মেহরাব হোসেন জুনিয়র বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আয়োজিত ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন ১৫ জনের বাংলাদেশ স্কোয়াডে  ডাক পান সাকিব। বাংলাদেশ সেবার টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় পর্বে যেতে সক্ষম হয় এবং সপ্তম টিম হিসেবে টুর্নামেন্ট শেষ করে। সেবার শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দেয়। টুর্নামেন্টে ৯ ম্যাচে তিনি ২৮.৮৫ গড়ে ২০২ রান করেন। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করেন মোহাম্মদ আশরাফুল (২১৬)। সাকিব ৪৩.১৪ গড়ে ৭টি উইকেটও নেন। সে বছরই মে মাসে দুই টেস্ট ও তিন ওয়ানডের এক সফরে ভারত বাংলাদেশে আসে। মে মাসের ১৮ তারিখ সাকিবের টেস্ট অভিষেক হয় ভারতের বিপক্ষে। অভিষেকটা খুব একটা ভালো না হলেও ছন্দে ফিরতে সময় নেননি সাকিব। পরের গল্প কেবলই এগিয়ে চলার।

 

বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হয়ে ওঠা...

সাকিবের ক্যারিয়ারটা বেশ অদ্ভুতুড়ে। শুরুর দিকে বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে দলে ঢোকেন সাকিব। এরপর দলে ঢোকার পর হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান। মূলত একজন অলরাউন্ডার হিসেবে পারফর্ম করলেও ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড দলের বাংলাদেশ ট্যুরের আগ পর্যন্ত সাকিবকে বোলার নয়, ব্যাটসম্যান হিসেবেই গণ্য করা হতো। তখন টেস্টে সাত নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামলেও ওয়ানডেতে কিন্তু প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানের মধ্যেই থাকতেন সাকিব। তখনকার কোচ জেমি সিডন্স হুট করে ঘোষণা দেন, সাকিবকে স্পেশালিস্ট বোলার হিসেবেই টেস্ট সিরিজ খেলানো হবে। কোচকে হতাশ করেননি সাকিব। উদ্বোধনী টেস্টের প্রথম ইনিংসেই তিনি ৩৭ রান দিয়ে তুলে নেন সাতটি উইকেট। তখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি বোলারের টেস্টে এটাই ছিল বেস্ট বোলিং ফিগার। বাংলাদেশ সিরিজ হারে ২-০ তে, কিন্তু সাকিব ১৭.৮০ গড়ে ১০টি উইকেট নিয়ে সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন। ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচটিতে বাংলাদেশ জয় পায়। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ানডেতে এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম জয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলাদেশ সিরিজ হারে ২-১ ব্যবধানে। সাকিব ৩ ম্যাচে ৫ উইকেট তুলে নেন।

পরের মাসেই বাংলাদেশ দল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায়। সাকিবের বোলিং পারফরম্যান্স এখানেও অব্যাহত থাকে। প্রথম টেস্টের প্রথম দিন সাকিব উইকেটশূন্য থাকলেও দ্বিতীয় দিনেই পাঁচ উইকেট তুলে নেন। দ্বিতীয় টেস্টে সাকিব আবারও এক ইনিংসে ৫ উইকেট তুলে নেন। সিরিজ শেষে সাকিবের ঝুলিতে জমা হয় ২০.৮১ গড়ে ১১টি উইকেট। ২০০৮ এর ডিসেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশে দুটি টেস্ট ও একটি ত্রিদেশীয় ওয়ানডে টুর্নামেন্ট [অপর দলটি ছিল জিম্বাবুয়ে] খেলতে আসে। দুটো টেস্টই শ্রীলঙ্কা জিতে নেয়। সেই সঙ্গে ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালও। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে সাকিবের করা হার না মানা ৯২ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজের একমাত্র জয়ের স্বাদ এনে দেয়। সাকিব ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন। ২২ জানুয়ারি, ২০০৯ সাকিব আইসিসির ওডিআই অল-রাউন্ডার র‌্যাংকিংয়ে ১ নম্বরে উঠে আসেন। ২০১১ সালে আইপিএলের নিলামে তাকে ৪ লাখ ২৫ হাজার ডলারের বিনিময়ে কলকাতা নাইট রাইডার্স কিনে নেয়। এরপর কেবলই এগিয়ে চলা কলকাতার হয়ে জিতেছেন ট্রফি। বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ মাতিয়েছেন বিশ্বের সেরা সব ক্রিকেটারের সঙ্গে। মোহাম্মদ আশরাফুলের পর মাশরাফিকে যখন অধিনায়ক করা হয়, তখন সাকিবকে ডেপুটি করা হয়। এরপর মাশরাফির ইনজুরিতে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পান সাকিব। সেই সুযোগেই দলকে বিজয় এনে দেন।

এরপর স্থায়ীভাবে দলের দায়িত্ব নেন। আবার সেটি হারিয়েও ফেলেন। শৃঙ্খলাজনিত কারণে ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল। এরপর আবার ফিরেও এলেন। বর্তমানে টেস্ট ও টি-২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাকিব। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে নিজের নামটাকে আস্তে আস্তে জ্বলজ্বলে করে তুলছেন সাকিব আল হাসান।

 

বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন

বিশ্বকাপ শুরুর আগেই দেখা গেল অলরাউন্ডার র‌্যাংকিংয়ে সবার উপরে আরেকবার ওঠে এলেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু এমন শীর্ষে ওঠা সাকিবের জন্য দুধ ভাত হয়ে গিয়েছিল। তাই সাকিবকে তেমন কেউ আলাদা করে গোনায় আনেননি। তবে বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক সাকিবকে চিহ্নিত করেছিলেন  ডেঞ্জারম্যান হিসেবে। পন্টিং তার বক্তব্যের পেছনে যুক্তিও তুলে ধরেছিলেন। বলা বাহুল্য পন্টিংয়ের কথার পুরোটাই পারফরম্যান্স দিয়ে তুলে ধরেছেন সাকিব। নিজের ইচ্ছায় ব্যাটিং অর্ডার পাল্টে তিন নম্বরে নামছেন বেশ কদিন ধরে। বিশ্বকাপেও তিনেই খেলছেন সাকিব। বড় ইনিংস খেলার জন্য সময় পাওয়ার আকাক্সক্ষায় সাকিবের ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন। আসলে সাকিব রানক্ষুধায় ভুগছিলেন। সে কারণেই বুঝি বারবারই ওঠে আসছেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায়। আফগানিস্তান ম্যাচ পর্যন্ত ৬ ম্যাচে ৪৭৬ রান নিয়ে শীর্ষেই ছিলেন সাকিব। অবশ্য মঙ্গলবারই তাকে টপকে গেছেন ডেভিড ওয়ার্নার ও ফিঞ্চ। তবে মজার ব্যাপার হলো অস্ট্রেলিয়ান এ দুই ব্যাটসম্যানই সাকিবের চেয়ে এক ইনিংস বেশি খেলেছেন। আর এর আগেও সাকিব শীর্ষস্থান হারানোর পর পরের ম্যাচেই আবার সেই স্থান পুনরুদ্ধার করেছেন। অন্যদিকে বল হাতে ৬ ম্যাচে নিয়েছেন ১০ উইকেট। সবমিলিয়ে প্রায় মাঝামাঝি পর্যায় পেরিয়ে আসা ২০১৯ বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনে পরিণত হয়েছেন সাকিব আল হাসান। আর না হওয়ারও কোনো কারণ নেই।

বিশ্বকাপের ইতিহাসে এর আগে কেউই এক টুর্নামেন্টে এমন অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সাকিবই প্রথম ক্রিকেটার যিনি, এক টুর্নামেন্টে ন্যূনতম ৪০০ রানের পাশাপাশি ১০ উইকেট নিলেন। এক ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে। এখনো বাকি লিগ পর্যায়ের আরও দুই ম্যাচ। আর এর আগেই সাকিব নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাকিবকে নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে। কেবল বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও কথা উঠছে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারটা নাকি সাকিবকে এখনই দিয়ে দেওয়া উচিত! কিন্তু বিশ্বকাপের ইতিহাস বলছে টুর্নামেন্ট সেরা হওয়ার জন্য কমপক্ষে সেমিফাইনাল খেলতে হয়েছে অন্যদের। সাকিবের বাংলাদেশের সেমিফাইনালের আশা এখনো টিকে আছে। কিন্তু যদি সেমিতে উঠতে না পারে তাহলেও কিন্তু সাকিবের পরিসংখ্যান ঠিকই থেকে যাবে!

এবারের বিশ্বকাপের আগে এত দিন এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সেরা অলরাউন্ডার মানা হতো ল্যান্স ক্লুজনার এবং যুবরাজ সিংকে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ল্যান্স ক্লুজনার ব্যাট হাতে ২৮১ রানের পাশাপাশি বল হাতে ১৭ উইকেট দখল করেন। অন্যদিকে ২০১১ বিশ্বকাপে যুবরাজ সিংয়ের ৩৬২ রানের সঙ্গে ১৫ উইকেট শিকার করেন। রানের দিক থেকে এ দুজনকে এরই মধ্যে টপকে গেছেন সাকিব। উইকেট সংখ্যায় তাদের তুলনায় খানিকটা পিছিয়ে। কিন্তু অলরাউন্ড নৈপুণ্যের মাইলফলক হিসেবে ৪০০ রান ও ন্যূনতম ১০ উইকেট ধরলে সাকিবের ধারে-কাছে আর কেউ নেই। বিশ্বকাপে তো বটেই এমনকি ওয়ানডে ইতিহাসেই নির্দিষ্ট কোনো সিরিজে ন্যূনতম ৪০০ রানের পাশাপাশি ১০ উইকেট নেওয়ার নজির আছে কেবল তিনটি। সেটিও ১৯৮০ সালে বেনসন অ্যান্ড হেজেজ ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপে। ১৯৮০ সালে ১৪ ম্যাচে তা করে দেখিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি গ্রেগ চ্যাপেল। এরপর দুবার একই মাইলফলক ছুঁয়েছেন ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডস; ১৯৮১ ও ১৯৮৫ সালে। যথাক্রমে ১৪ ও ১৩ ম্যাচ খেলে এ রেকর্ড স্পর্শ করেন রিচার্ডস। কিন্তু এমন অভিনব মাইলফলক ছুঁতে সাকিব আল হাসানের লাগল মাত্র ৬ ম্যাচ। গ্রুপ পর্বেই বাংলাদেশের আরও খেলা বাকি দুটি। সাকিবের এই রেকর্ডটা বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ কিন্তু থাকছেই।

সাকিবের দাদা তাকে গল্পের ছলে প্রায়ই বলতেন, ‘তুমি বড় হয়ে বিখ্যাত হবে, পৃথিবীর সবাই তোমাকে চিনবে। যখন তুমি নিজ শহরে আসবে সবাই তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে আর হাততালি দেবে।’ সাকিবের দাদা যখন এমনটা বলেছিলেন, নিশ্চয়ই তিনি তা ঠাট্টা করেই বলেছিলেন। কিন্তু সেই কথাটিকেই আস্তে আস্তে সত্যতায় রূপ দেন সাকিব। সত্যি সাকিবের শহর তো বটেই সারা দেশের মানুষই তার জন্য পাগল। ২০১৯ বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার পর সাকিব নিজেকে পরিণত করেছেন বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনে। সাকিবের এই সাফল্য কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটেরও বড় বিজ্ঞাপন!

 

সাকিবময় বিশ্বকাপ

তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক

৬ ম্যাচে ৪৭৬

আসরের সেরা বোলিং

১০-১-২৯-৫ [আফগানিস্তানের বিপক্ষে]

ব্যাক-টু-ব্যাক সেঞ্চুরি

১২১ (ইংল্যান্ড), ১২৪* (উইন্ডিজ)

বিশ্বকাপে দেশের হয়ে প্রথম হাজারি

২৭ ম্যাচে ১০১৬

বিশ্বকাপে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট

২৭ ম্যাচে ৩৩

বিশ্বকাপে দেশের হয়ে সর্বাধিক ম্যাচসেরা

তিনবার

একমাত্র ডাবল হোল্ডার

১০০০ রান ও ৩০ উইকেট

ম্যাচ ৫০ রান ও ৫ উইকেট নেওয়া দ্বিতীয়

 

►   বিশ্বকাপের এক আসরে ৪০০ রানের সঙ্গে ১০ উইকেট শিকার করা একমাত্র অলরাউন্ডার সাকিব।

বিশ্বকাপ ইতিহাসে একই সঙ্গে এক হাজার রান ও ৩০ উইকেট শিকারের একমাত্র কীর্তির মালিক সাকিব। বিশ্বকাপে ৯০০ রানের সঙ্গে ২৫ উইকেট আছে মাত্র সনাথ জয়সুরিয়া ও স্টিভ ওয়াহর।

বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে বল হাতে পাঁচ উইকেট এবং ব্যাট হাতে ফিফটি করা দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান সাকিব। এর আগে 

২০১১ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১ রানে ৫ উইকেট ও অপরাজিত ৫০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ভারতের যুবরাজ সিং।

  বিশ্বকাপের এক আসরে সেঞ্চুরি আছে, ৫ উইকেটও আছে এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে সাকিব তৃতীয়। আগের দুজন ভারতের কপিল দেব (১৯৮৩) ও যুবরাজ সিং (২০১১)।

প্রথম বাংলাদেশি এবং ১৯তম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে ১০০০ রান করেছেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপে ১০০০ রান করা বাকি ১৮ জনের মধ্যে বর্তমান ক্রিকেটার মাত্র একজন।

 

আলোকিত পরিসংখ্যাণ

 

সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার

এই বিশ্বকাপে সাকিব যেভাবে পারফর্ম করছেন তাতে প্রশ্নটা আবারও উঠতে শুরু করেছে। সাকিবই কি বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে সেরা অলরাউন্ডার? ব্যাটে দুরন্ত পারফরম্যান্স করে আছেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান স্কোরারের দৌড়ে। উইকেটও নিয়েছেন ১০টি। তবে কি হ্যাডলি, বোথাম, কপিল, ইমরান, গ্যারি সোবার্স বা জ্যাক ক্যালিসকে পেছনে ফেলে সেরার সেরা অলরাউন্ডারের তকমা কেড়ে নিচ্ছেন সাকিব?

পিচ যেমনই হোক না কেন, নিউজিল্যান্ডের স্যার রিচার্ড হ্যাডলির ফাস্ট বোলিং খেলা ছিল সত্যিই মুশকিল। বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে খেললেও বল করতেন ডান হাতে। ৮৬টি টেস্টে ৪৩১ উইকেট নিয়েছেন। সঙ্গে যোগ করুন লোয়ার অর্ডারে নেমে ৩১২৪ রান। সেরা স্কোর অপরাজিত ১৫১ রান। ওডিআইতে ১১৫ ম্যাচে রয়েছে ১৭৫১ রান এবং ১৫৮ উইকেট। ১০২ টেস্টে ইংল্যান্ডের স্যার ইয়ান বোথাম করেছেন ৫২০০ রান এবং ৩৮৩ উইকেট। ১১৬টি ওডিআইতে রয়েছে ২১১৩ রানের সঙ্গে ১৪৫ উইকেট। তার ফাস্ট মিডিয়াম বোলিংয়ে ধরাশায়ী হননি এমন ব্যাটসম্যান কমই আছেন।

১৯৮৩-তে ইংল্যান্ডের মাটিতে দেশকে প্রথমবার বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন কপিল দেব। ১৩১ টেস্টে ৫২৪৮ রান সঙ্গে ৪৩৪ উইকেট। ২২৫টি ওডিআইতে ৩৭৮৩ রান ছাড়াও তুলে নিয়েছেন ২৫৩ উইকেট।

ক্যাপ্টেন হিসেবে পাকিস্তান ক্রিকেটকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন ইমরান খান। ১৯৯২-তে তার নেতৃত্বেই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান। ফার্স্ট বোলার ইমরানের রয়েছে ১৮২ ওডিআই উইকেট (১৭৫ ম্যাচে)। ব্যাটে অবদান ৩৭০৯ রান। আর ৮৮ টেস্টে করেছেন ৩৮০৭ রান সঙ্গে ৩৬২ উইকেট।

ব্যাটে-বলে বিধ্বংসী ছিলেন দ. আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস।

১৬৬ টেস্টে ১৩২৮৯ রানের সঙ্গে তার ঝুলিতে ২৯২ উইকেট। ৩২৮ ওডিআই খেলে তুলে নিয়েছেন ২৭৩ উইকেট। সঙ্গে করেছেন ১১৫৭৯ রান।

এরকম আরও ক্রিকেট গ্রেটদের সঙ্গে তুলনা করুন উপরে তুলে ধরা সাকিবের পরিসংখ্যানের উত্তরটা মিলে যাবে। ৫৫ টেস্টে ৩৮০৭ রান, ২০৫ উইকেট; ২০৪ ওয়ানডেতে ৬১৯৩ রানের পাশাপাশি নিয়েছেন ২৫৯ উইকেট। আর সাকিব কিন্তু এখনো খেলছেন!

 

 

►  ক্রিকেট ইতিহাসেই টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি তিন ধরনের ক্রিকেটে একই সময়ে এক নম্বরে থাকা একমাত্র ক্রিকেটার তিনি। ২০১৫ সালে সাকিব এই কৃতিত্ব প্রথম করে দেখান। পরবর্তীতেও সাকিব এই কৃতিত্ব করে দেখিয়েছেন।

 

►  ওয়ানডেতে ৫ হাজার রান ও ২০০ মাইলফলক স্পর্শ করা দ্রুততম ক্রিকেটার সাকিব, মাত্র ১৭৮টি ওয়ানডে লেগেছে তার।

 

►  সাকিব টেস্ট ক্রিকেটে একই ম্যাচে সেঞ্চুরি আর ১০ উইকেট নেন। সাকিবসহ এই রেকর্ড আছে মাত্র চারজন অলরাউন্ডারের, বাকি তিনজন হলেন- ইয়ান বোথাম, ইমরান খান ও অস্ট্রেলিয়ার এ কে ডেভিডসন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর