জাকির হোসেন
তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেন। তাঁর জন্ম ১৮৯৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। সে সময়ের হায়দরাবাদ রাজ্যের এক পশতু পরিবারে তিনি বেড়ে উঠেছেন। তার বাবা ফিদা হোসেন খান ও মা নাজনীন বেগম। জাকির হোসেনের জন্মের পর তার পরিবার হায়দরাবাদ ছেড়ে উত্তর প্রদেশের ফারুখাবাদ জেলার কায়েমগঞ্জ এলাকায় বসবাস শুরু করেন। পারিবারিকভাবে বেশ সুখ্যাতি ছিল। জাকির হোসেনের বড়ভাই ইউসুফ হোসেন ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ। তার নাতি সালমান খুরশিদ একজন প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা। তার ভাইপো আনোয়ার হোসেন পাকিস্তান টেলিভিশনের পরিচালক হয়েছিলেন। ১০ বছর বয়সে বাবা ও ১৪ বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ইতাওয়া ইসলামিয়ায় মওলানা বাশিরউদ্দিনের তত্ত্বাবধানে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে আরবি, ফার্সি, উর্দু, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১৫ বছর বয়সে আলিগড় মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল (এমএকিউ) কলেজে ভর্তি হন। প্রথমে চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পরে ইংরেজি, দর্শন ও অর্থশাস্ত্র বিষয়ে স্নাতক হন। ভালো বৃত্তি নিয়ে আইনশাস্ত্রে এমএ করার সময় আলিগড়ে খন্ডকালীন প্রভাষকের চাকরি পেয়ে যান। ১৯২৬ সালে তিনি জার্মানি যান এবং ইউনিভার্সিটি অব বার্লিন থেকে ইকোনমিক্সে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। জাকির হোসেন মাত্র ২৩ বছর বয়সে কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে ১৯২০ সালের ২৩ অক্টোবর আলিগড়ে ন্যাশনাল মুসলিম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে সেটি জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি জার্মানির ফ্রেডারিক উইলিয়ামস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে থাকেন। সেখান থেকে ইকোনমিক্সে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯২৭ সালে জাকির হোসেন জার্মানি থেকে ভারতে ফিরে আসেন। পরবর্তী ২১ বছর তিনি শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক দুদিক থেকেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেন। এটি ভারতীয় স্বাধীনতা-সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুসলিম অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজই পরে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হলে ওই সালেই তাঁকে ভারতের রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ১৯৫৭ সালে বিহার রাজ্যের রাজ্যপাল নিযুক্ত হলে তাঁর এই পদ খালি হয়। এরপর তিনি বিহার রাজ্যের রাজ্যপাল ছিলেন ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের জন্য। ভারতের দ্বিতীয় উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত হন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল- এই পাঁচ বছরের জন্য। এই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ১৯৬৭ সালের ১৩ মে তিনি ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদও ছিল পাঁচ বছর। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। সে সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন বরাহগিরি ভেঙ্কট গিরি। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, পুরো ভারতবর্ষই তাঁর নিজের দেশ ও প্রতিটি ভারতবাসীই তাঁর পরিবার। ড. জাকির হেসেনের মৃত্যু হয় ১৯৬৯ সালের ৩ মে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি ভারতীয় প্রেসিডেন্ট কর্মরত অবস্থায় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে মারা যান। তাকে এবং আরও কয়েক বছর পরে তাঁর স্ত্রীকে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ক্যাম্পাসে কবর দেওয়া হয়।
তাঁর সম্মানার্থে ১৯৭০ সালে ইলিয়ানগুড়িতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের নামকরণও ড. জাকির হোসেনের নামে হয়। জীবিতকালে ১৯৫৪ সালে জাকির হোসেনকে ভারতের সম্মানজনক উপাধি ‘পদ্মবিভূষণ’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এরপর ১৯৬৩ সালে তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মাননা ‘ভারতরতœ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
বিচারপতি মোহাম্মাদ হিদায়াতুল্লাহ
ভারতের প্রধান বিচারপতি, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন
মোহাম্মাদ হিদায়াতুল্লাহ ছিলেন ভারতের ১১তম প্রধান বিচারপতি। এরপর তিনি দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৩১ আগস্ট ১৯৭৯ থেকে ৩০ আগস্ট ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই থেকে ১৯৬৯ সালের ২৪ আগস্ট ও ৬ অক্টোবর ১৯৮২ থেকে ৩১ অক্টোবর ১৯৮২ পর্যন্ত তিনি ভারতের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একজন খ্যাতনামা ও বিজ্ঞ বিচারক হিসেবে তিনি এই উপমহাদেশে শ্রদ্ধেয়। শিক্ষাবিদ ও লেখক হিসেবেও তিনি সমান খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর জন্ম ১৯০৫ সালে। সম্ভ্রান্ত খান বাহাদুর হাফিজ মোহাম্মদ ইল্লায়াতুল্লাহ পরিবারের সন্তান তিনি। তাঁর দাদা ছিলেন বারানসির বিখ্যাত আইনজীবী মুন্সি কুদরাতুল্লাহ। মোহাম্মাদ হিদায়াতুল্লাহর বাবা বিখ্যাত কবি হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। তিনি উর্দুতে কবিতা লিখে গোটা ভারতবর্ষে খ্যাতি লাভ করেন। বাবার সূত্র ধরেই কবিতা, উর্দু সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে উঠেন মোহাম্মদ হিদায়াতুল্লাহ। তার দাদা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। তার বড় ভাই মোহাম্মদ ইকরামুল্লাহ ও আহমেদুল্লাহ দুজনই ছিলেন মেধাবী শিক্ষাবিদ। ১৯২২ সালে মোহাম্মদ হিদায়াতুল্লাহ রায়পুর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন সম্পন্ন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। সে সময় তিনি মেধাগুণে মালেক গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। ব্রিটিশ আইন নিয়ে পড়াশোনায় তখন দেশের সেরা মেধাবীরা সুযোগ পেতেন। মোহাম্মদ হিদায়াতুল্লাহ সে পথেই হাঁটেন। ট্রিনিটি কলেজ ও ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ থেকে যথাক্রমে বিএ ও এমএ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। উচ্চশিক্ষায় তিনি ছিলেন অনুকরণীয় একজন। মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন তিনি। এই অসামান্য অর্জনে যোগ হয় আরও একটি স্বর্ণ পদক। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তিনি লিংকন্স ইন বারে ডাক পান। এরপর এলএলডি, ডি.লিট ছাড়াও বেশ কয়েকটি সর্বোচ্চ শিক্ষা সম্মাননায় ভূষিত হন। ১৯৩০ সালে তিনি ব্যারিস্টার-ইন-ল সম্পন্ন করেন। গ্রাজুয়েশন শেষ করে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৩০ সালে নাগপুরে কেন্দ্রীয় হাই কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসাবে তার ক্যারিয়ার শুরু হয়। আইন ও ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবেও তিনি খ্যাতি কুড়ান। দুর্দান্ত ও বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি ১৯৪৬ সালে অ্যাডিশনাল জজ হিসেবে হাই কোর্টে নিয়োগ পান। ভারতের মধ্যপ্রদেশের সবচেয়ে তরুণ অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে তিনি সবার নজর কাড়েন। পরবর্তীতে তিনি হাই কোর্টের সবচেয়ে তরুণ প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি মধ্যপ্রদেশ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। দুই বছর পর তিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। প্রায় ১০ বছর নিষ্ঠা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৬৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি ভারতের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম মুসলিম প্রধান বিচারপতি। ১৯৭০ সালে তিনি এ সর্বোচ্চ পদ থেকে অবসরে যান। ভারতের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেইন মৃত্যুবরণ করেন। সে সময় ভারতের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন ভি ভি গিরি। গিরি প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট দুই পদ থেকেই সরে যাওয়ার আবেদন করলে মোহাম্মদ হিদায়াতুল্লাহ ভারতের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরে গেলে ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। মোহাম্মদ হিদায়াতুল্লাহ ১৯৮২ সালের ৬ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর সময়কালেও ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময় দেশটির রাষ্ট্রপতি চিকিৎসার প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রে গেলে মোহাম্মদ হিদায়াতুল্লাহ দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে গুরুভার পালন করেন। ভারতের ইতিহাসে তিনি একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ভারতের প্রধান বিচারপতি, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। মোহাম্মদ হিদায়াতুল্লাহ একাধিক ভাষায় দক্ষ ছিলেন। হিন্দি, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি, বাংলা ও সংস্কৃত সব ভাষাতেই তার গভীর আগ্রহ ও জ্ঞান ছিল। তিনি ভারতের একাধিক সাংবিধানিক শীর্ষপদে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। তার লেখা বহু গ্রন্থ দেশে-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও জ্ঞানভান্ডার বলে স্বীকৃতি লাভ করে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মাননা লাভ করেন তিনি। ১৯৯২ সালে তিনি ভারতের বর্তমান মুম্বাই শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ
ব্রিটিশবিরোধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে গ্রেফতার হন, জেল খাটেন সাড়ে তিন বছর
ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ। তিনি ভারতের পঞ্চম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই সাংবিধানিক পদের গুরুভার পালন করেন। পুরনো দিল্লির কাজী পাড়ায় ১৯০৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবা কর্নেল জালনুর আলি আহমেদ দিল্লিতে বসবাস করলেও তিনি আসাম রাজ্যের লোক ছিলেন। তিনিই প্রথম আসামের অধিবাসী যিনি, সারা উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্য থেকে প্রথম ডাক্তারি ডিগ্রি (এমডি) অর্জন করেছিলেন। ফখরুদ্দিনের মা সাহিবজাদী রুকাইয়া সুলতান লোহারুর নবাবের কন্যা ছিলেন। তার দাদা খলিলুদ্দিন আলি আহমেদ আসামের গোলাঘাট পার্শ্ববর্তী কাছারিঘাটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সদস্য ছিলেন। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলেন তিনি। দিল্লির বোন্দা হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। দিল্লির সরকারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে ও পরে কেমব্রিজের সেন্ট ক্যাথরিন কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর তাকে লন্ডনের ইনার টেম্পল থেকে ‘বার’-এর জন্য ডাকা হয়। তিনি ব্যারিস্টার হন। তার ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯২৮ সালে। দেশে ফিরে তিনি অবিভক্ত ভারতের লাহোর হাই কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। লন্ডনে থাকাকালে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২৫ সালে কংগ্রেসে নেতা জওহরলাল নেহরুর তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও পরে বন্ধুত্ব হয়। নেহরুর চিন্তা-ভাবনায় উৎসাহিত হয়ে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যোগ দেন। এরপর তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশবিরোধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। প্রায় সাড়ে তিন বছরের কারাজীবন কাটে তার। ১৯৩৬ সালে তিনি আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৩৮ সালের গোপীনাথ বড়দলুই মন্ত্রিসভায় তিনি অর্থ, রাজস্ব ও শ্রমমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলের সদস্য ছিলেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫২-৫৩ সালের মধ্যে ফখরুদ্দিন রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তিনি আসাম প্রদেশ সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা পদে নিযুক্ত হন। তিনি কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী এলাকা থেকে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ এবং ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সালে নির্বাচন করে এই দুই মেয়াদে আসামের বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আসামের বারপেতা নির্বাচনী এলাকা থেকে ১৯৬৭ সাল ও ১৯৭২ সাল এই দুবারেই তিনি পার্লামেন্টে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের ২০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত করেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনিই হলেন দ্বিতীয় মুসলমান ব্যক্তি, যিনি পঞ্চম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার ও আলোচনার পর তিনি ভারতবর্ষে জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৫ সালের সেই জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে তিনি সারা দেশে রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নামাজ পড়তে যাওয়ার আয়োজন করার সময় হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। তিনি ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি যিনি তাঁর অফিসের কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মারা যান। ১৯৭৫ সালে যুগোস্লাভিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরকালে তাকে কসোভোর প্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি দেওয়া হয়। আসামের বারপেতা এলাকায় ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ মেডিকেল কলেজ নামে একটি মেডিকেল কলেজের নামকরণ করা হয়েছে।
এ পি জে আবদুল কালাম
ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ চালিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের মিসাইল ম্যান
ভারতের মিসাইল-ম্যান খ্যাত বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম। ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দেশের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীদের একজন বিবেচিত হতেন তিনি। পরমাণু গবেষণায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল। তামিলনাড়–র রামেশ্বরমে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবুল পকির জয়নুল আবদিন আবদুল কালাম। বাবা জয়নুল আবদিন ছিলেন এক সাধারণ মৎস্যজীবী। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই রোজগারের তাগিদে খবরের কাগজ বিক্রি করতে হতো আবদুল কালামকে। স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ার জন্য একটা বৃত্তি পান তিনি। ভর্তি হন তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজে। ১৯৫৪ সালে সেখান থেকেই পদার্থবিদ্যায় স্নাতক করেন। তারপর ফের স্কলারশিপ নিয়ে চেন্নাইয়ে পড়তে শুরু করেন এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং। তাঁর স্বপ্ন ছিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর পাইলট হবেন। তাঁর ক্লাসের প্রথম আটজনকে বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। আবদুল কালাম হয়েছিলেন নবম। তাই তাঁর যুদ্ধবিমানের পাইলট হয়ে ওঠা হয়নি। ১৯৯৮ সালে পোখরান পরমাণু বিস্ফোরণ পরীক্ষার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। পড়াশোনার জন্য একবারই শুধু গিয়েছিলেন বিদেশে, ১৯৬৩-৬৪ সালে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসায়। বঙ্গোপসাগরে দু’দশক ধরে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ পরীক্ষা চালিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের মিসাইল ম্যান। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে ছিলেন ডিআরডিও, ইসরোয়। ২০০২ সালে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি। রাষ্ট্রপতি ভবনে ছিলেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। তাঁর সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা সর্বসাধারণ, বিশেষ করে শিশুদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আবার ফিরে যান পড়াশোনার জগতে।
শিলং, ইন্দোর ও আমদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, তিরুঅনন্তপুরমের ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়াতেন। এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মঞ্চেই বক্তৃতা দিতে দিতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য এ পি জে আবদুল কালামকে ‘মিসাইল ম্যান’ বলে ডাকা হয়। ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণসহ পেয়েছেন অসংখ্য সম্মান। লিখেছেন অসংখ্য বই। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- উইংস অফ ফায়ার, ইগনাইটেড মাইন্ড, টার্নিং পয়েন্ট প্রভৃতি।