বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনার টিকা বানাল যত কোম্পানি

সাইফ ইমন

করোনার টিকা বানাল যত কোম্পানি

গামালেই ইনস্টিটিউটের তৈরি ভ্যাকসিনই বিশ্বের প্রথম

ভ্যাকসিনের প্রতীক্ষায় তখন গোটা বিশ্ব; গবেষণা চলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এ সময় প্রথম সুখবর দিয়েছিল রাশিয়া। সবার আগে মানব শরীরে করোনা ভ্যাকসিনের সফল প্রয়োগে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল রুশ বিজ্ঞানীরা। সেই সাফল্যের পথ ধরে সব পরিকল্পনামাফিক রেজিস্টার হয় বিশ্বের প্রথম করোনা ভ্যাকসিন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট খোদ ভøাদিমির পুতিন ঘোষণা করেন বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, বিশ্বে প্রথমবার কোনো করোনা ভ্যাকসিন রেজিস্টার হলো। আমি জানি, এতে ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি হবে। আর রাশিয়ার তৈরি করোনা ভ্যাকসিনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্পুটনিক-৫’। রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আগেই জানিয়েছিল, এই ভ্যাকসিনটি গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলবে। উপকার হবে সাধারণ মানুষের। কিন্তু কীভাবে কাজ করে এই ভ্যাকসিন? এ বিষয়ে গামালেই রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অ্যালেক্সান্ডার গিন্টসবার্গ বলেন, ‘এটি মানব শরীরে কোনো ক্ষতি করবে না।’ এই ভ্যাকসিন মানব শরীরে কিছু জড় বা নিষ্প্রাণ পার্টিকলস তৈরি করবে। শরীরের অ্যাডিনো ভাইরাসের উপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এগুলো তৈরি হবে। সেখান থেকেই তৈরি হবে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করার মতো অ্যান্টিবডি। এখন পর্যন্ত এই ভ্যাকসিনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে অ্যালেক্সান্ডার গিন্টসবার্গের বক্তব্য অনুযায়ী, ভ্যাকসিন দেওয়ার পর অনেকের জ্বর আসতে পারে। কারণ শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভ্যাকসিন দেওয়ার পর এটি একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। যদিও প্যারাসিটামল খেয়ে খুব সহজেই তা থেকে মুক্তি মিলবে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, গামালেই ইনস্টিটিউট অব এপিডেমোলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজির উদ্ভাবিত এই ভ্যাকসিনই আর সবার আগে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সফলভাবে শেষ করে। অক্টোবর মাস থেকেই জনগণকে করোনাভাইরাসের এই ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে রাশিয়াকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে আন্তর্জাতিক নির্দেশনা অনুসরণ করার আহ্বান জানানো হয়।

 

মডার্নার ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু

ফাইজারের ভ্যাকসিনের পর করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ভ্যাকসিন হিসেবে ফার্মা জায়ান্ট মডার্নার তৈরি ভ্যাকসিনের ইতিমধ্যেই অনুমোদন দিয়েছে আমেরিকা। এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ খুব শিগগিরই শুরু করা হবে বলে জানা গেছে। দেশজুড়ে মডার্না ভ্যাকসিনের কয়েক মিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করা হবে। এই ভ্যাকসিন নেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দেশনা পালনের আহ্বান জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ভ্যাকসিনবিষয়ক অপারেশন ওয়ার্প স্পিড প্রজেক্টের প্রধান গুস্তাভে পেরনা জানান, মডার্না তার উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সরবরাহস্থলে ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, মডার্নার এই ভ্যাকসিন বিতরণে আমেরিকা সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। মডার্নার তৈরি কভিড ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয় আমেরিকা।

ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন অনুমোদনের এক সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ভ্যাকসিন হিসেবে এটি অনুমোদন পায়। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্যরা ২০-০ ভোটে মডার্নার ভ্যাকসিনকে অনুমোদনের সুপারিশ করেন। তাঁদের মতে, ১৮ ও এর চেয়ে বেশি বয়সীদের জন্য ভ্যাকসিনটি নিরাপদ। এর আগে ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিনকে জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদনের পর এখন তার প্রয়োগ চলছে সবখানেই। এর আগে জানানো হয়, মডার্নার ভ্যাকসিন ৯৪ শতাংশ নিরাপদ ও কার্যকর।। আমেরিকা তাই এই কোম্পানির সঙ্গে ২০০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করে। এরপর এফডিএর অনুমোদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৬০ লাখ ডোজ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মডার্নার টিকার বিষয়ে এফডিএ ৫৪ পৃষ্ঠার একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, টিকাটিতে বিশেষ কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। মারাত্মক ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। এফডিএ বলছে, ৩০ হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষায় মডার্নার টিকা ৯৪.১ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

 

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথভাবে তৈরি ভ্যাকসিন

আগেই আশার আলো জাগিয়েছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করে সফল বলে ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগে তারা মানুষের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন। ১ হাজার ৭৭ জনের শরীরে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার পর দেখা গেছে, তাদের শরীরে কভিড-১৯ প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া উৎপন্ন হয়েছে শ্বেত রক্তকণিকা, যা করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে। এই ভ্যাকসিন প্রাথমিকভাবে সফল বলছে ল্যানসেট। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রিটিশ-সুইডিশ ওষুধ প্রস্তুতকারক জায়ান্ট কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা যৌথভাবে এই ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। ভ্যাকসিনটির নাম ChAdOx1 nCoV-19। প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ভ্যাকসিনটি গত এপ্রিলে ১ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর প্রয়োগ শুরু করে তার ফলাফল প্রকাশ করে তারা। যারা এই ভ্যাকসিনটির দুটি ডোজ গ্রহণ করেছিলেন তাদের শরীরে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ভ্যাকসিনটি নিরাপদ তবে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। যদিও সেগুলো খুব বিপজ্জনক কিছু নয়।

সিএনএনের তথ্য অনুযায়ী, মডার্না ও ফাইজারের ভ্যাকসিনের তুলনায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি সংরক্ষণ ও পরিবহন সহজ। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি কমপক্ষে ছয় মাসের জন্য দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা যাবে। অন্যদিকে মডার্নার ভ্যাকসিন মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৩০ দিনের জন্য সংরক্ষণ করা যাবে। ফাইজারের ভ্যাকসিনটি মাইনাস ৭৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে এবং একবার উচ্চ তাপমাত্রায় আনা হলে পাঁচ দিনের মধ্যে তা ব্যবহার করতে হবে। গত বছরের জানুয়ারিতে প্রথম অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি ডিজাইন করে। এপ্রিলে এটি একজন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর প্রয়োগ করা হয়। পরে বৃহৎ আকারে হাজারো  স্বেচ্ছাসেবীর ওপর ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল চালানো হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করেছে। অনেক দেশ চুক্তি করছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে দ্রুত ভ্যাকসিন পাওয়ার আশায়। এই ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অন্যগুলোর তুলনায় কম বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

 

ফাইজার-বায়োএনটেকের অনুমোদন দেশে দেশে 

দেশে দেশে অনুমোদন পাচ্ছে ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন। যুক্তরাজ্যের পর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করছে কানাডা। ইতিমধ্যেই কানাডার স্বাস্থ্য বিভাগ কানাডায় ফাইজারের ভ্যাকসিন প্রয়োগ এবং বিতরণের অনুমতি দিয়েছে। ফাইজার- বায়োএনটেকের ভ্যাকসিনকে অনুমতি দিয়েছে সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় দেশ হিসেবে এই অনুমতি দিল তারা। ফাইজারের ভ্যাকসিন জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রেও। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) অনুমোদনের জন্য এর পক্ষে বেশি ভোট পড়েছে। ফলে শিগগিরই দেওয়া হতে পারে অনুমোদন। এফডিএর অনুমোদন পেলে বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অনেক দেশই সে ভ্যাকসিন বা ওষুধকে প্রয়োগের অনুমোদন দিয়ে থাকে।

জানা যায়, কানাডার স্বাস্থ্য বিভাগ কানাডায় ফাইজারের ভ্যাকসিন প্রয়োগ এবং বিতরণের অনুমতি দেয়। টরেন্টোয় ইউনিভার্সিটি হেলথ নেটওয়ার্ক এবং অন্টারিওর অটোয়ার হাসপাতাল প্রথম ভ্যাকসিন পেয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের পর অন্টারিও হচ্ছে প্রথম প্রদেশ, যারা এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের নির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা করে। কানাডার অন্টারিওতে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। অন্টারিওর প্রিমিয়ার ড্রাগ ফোর্ড জানিয়েছে, লং টার্ম কেয়ার বা হোম এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রথমে ভ্যাকসিন পাচ্ছেন।  ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশটিতে জাতীয়ভাবে ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ৭১ বছরের নেতানিয়াহু ও তার স্বাস্থ্যমন্ত্রী তেল আবিবের একটি হাসপাতালে টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচারের মাধ্যমে ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন। ২২ ডিসেম্বর ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন পৌঁছার পর বিনামূল্যে টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু করেছে কাতার। দেশটির প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে তিন সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি করে ডোজ প্রদান করা হবে। মডার্না ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য চুক্তি করে রেখেছে উপসাগরীয় দেশটি।

২৪ ডিসেম্বর গণভ্যাকসিন কর্মসূচি শুরু করেছে মেক্সিকো। দেশটিতে প্রথম ভ্যাকসিন নিয়েছেন একজন নার্স। বেলজিয়াম থেকে বিমানে আসা ৩ হাজার ডোজ ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিনের প্রথম চালান দেশে আসার এক দিনের মাথায় এই টিকা প্রদান শুরু হয়। ভ্যাকসিন প্রদানের উদ্বোধন টিভিতে প্রচার করা হয়।

সার্বিয়ায় ২৪ ডিসেম্বর ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ফাইজারের ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনা ব্রনাবিক। ২৪ ডিসেম্বর আরব দেশ কুয়েতেও ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হয়। ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনা ভ্যাকসিনের দেড় লাখ ডোজ পেয়েছে কুয়েত।

 

গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্স

বঙ্গভ্যাক্স নামে কভিডের টিকা তৈরি করছে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান।  বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেক তাদের উৎপাদিত করোনাভাইরাস টিকা মানবদেহে পরীক্ষা চালানোর অনুমতির জন্য আবেদন করেছে। বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের কাছে এই আবেদন করা হয়। বলা হচ্ছে, অনুমোদন পাওয়ার পরের সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঢাকার কোনো একটি বেসরকারি হাসপাতালে শ খানেক স্বেচ্ছাসেবকের ওপর টিকাটি প্রয়োগ করা হবে ট্রায়ালের জন্য। গ্লোব বায়োটেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাকন নাগ বার্তা সংস্থা বিবিসিকে বলেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর আবেদনটি তাদের পক্ষ থেকে করেছে ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদিত একটি প্রতিষ্ঠান। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। যার স্পন্সর করছে গ্লোব বায়োটেক। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে হলে সাধারণত তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে করতে হয়, সেই তৃতীয় পক্ষ হিসেবেই এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে, বলেন মি. নাগ। পুরো ট্রায়ালটি পরিচালনা করবে একটি গবেষক দল। মানবদেহে গ্লোব বায়োটেকের টিকার ট্রায়ালটি কীভাবে করা হবে সেটি আবেদনপত্রে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অনুমোদনের আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না বলে জানান মি. নাগ।

 

চীনের সেনাবাহিনীতে প্রয়োগে সফল ক্যানসিনো বায়োলজিকস

ভ্যাকসিনের দৌড়ে এগিয়ে থাকা ১০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিই চীনের। চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকসের একটি ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা চলছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণ হওয়ায় চীনের তৈরি করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ২৫ জুন এই ভ্যাকসিন সেনাদের দেহে প্রয়োগের অনুমতি দেয় চীন। দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাঝে এক বছরের জন্য এটি প্রয়োগ করা হবে। চীনের সেনাবাহিনীর গবেষণা ইউনিট ও ক্যানসিনো বায়োলজিকস যৌথভাবে ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছে। ভ্যাকসিনটি উহান শহরে প্রথম পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। ক্যানসিনো বায়োলজিকস এক বিবৃতিতে জানায়, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাজনিত রোগপ্রতিরোধের জন্য চীনের তৈরি আটটি ভ্যাকসিন দেশে এবং বিদেশে মানবদেহে পরীক্ষার অনুমোদন পায়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন নিজেদের দেশে ও বাইরে ওই ভ্যাকসিনগুলোর পরীক্ষা চালায়। এদের মধ্যে অ্যাড৫-এনকোভ নামের ভ্যাকসিন নিরাপদ প্রমাণিত হয়। এই একই ভ্যাকসিন এরই মধ্যে কানাডাতেও মানবদেহে পরীক্ষার জন্য অনুমতি পেয়েছিল। এখন ভ্যাকসিনটি ব্যবহারের করছে চীনের সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর মধ্যে এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক, নাকি ঐচ্ছিক রাখা হচ্ছে সে সম্পর্কে এখনো কিছু জানানো হয়নি। তবে অ্যাড৫-এনকোভ ভ্যাকসিনটি বিস্তৃত পরিসরে ব্যবহারের আগে আরও কিছু অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। ভ্যাকসিনটি প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রোগীদের মধ্যে উচ্চমাত্রার প্রতিরোধের ক্ষমতা দেখা যায়। 

 

 

সিনোভ্যাক বায়োটেক

 

করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতে অন্যতম সফল মানা হচ্ছে চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেককে। সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেড দাবি করেছে, তাদের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন নিরাপদ এবং পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। সিনোভ্যাক দাবি করেছে, ভ্যাকসিনটি করোনাভাইরাসকে রুখে দিতে সক্ষম। এ ছাড়া মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দ্রুত বাড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখবে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এটি দুই সপ্তাহের মধ্যে শরীরে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে। ট্রায়ালে ৯০ ভাগ মানুষের শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। করোনা মোকাবিলায় বছরে ১০ কোটি ডোজ করোনাভ্যাক উৎপাদনের জন্য তাদের প্রস্তুতি রয়েছে।

 

আইসিএমআরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারত বায়োটেক

নতুন বছরের শুরুতেই ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অধীন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বিতীয় একটি করোনা ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে বলে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে। কোভ্যাকসিন নামের এই ভ্যাকসিনটি ভারতেই আবিষ্কৃত হয়েছে। দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা আইসিএমআরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারত বায়োটেক এই ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছে। এ নিয়ে ভারতে দুটি করোনা ভ্যাকসিন জরুরিভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হলো। সম্প্রতি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকাকে অনুমোদনের জন্য ছাড়পত্র দিয়েছে ওই বিশেষজ্ঞ কমিটি। বিশেষজ্ঞ কমিটির ছাড়পত্রের পরে দুটি ভ্যাকসিন-সংক্রান্ত নথিই এখন ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রকের দফতরে রয়েছে চূড়ান্ত স্বাক্ষরের জন্য। ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক একটি সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্র দেওয়ার কথা ঘোষণা করতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। অক্সফোর্ডের টিকাটি ভারতে তৈরি করছে সিরাম ইনস্টিটিউট। এটি ছাড়াও ভারতের নিজস্ব টিকা কোভ্যাক্সিন এবং ফাইজারের টিকাও জরুরি ভিত্তিতে অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছিল।

এদিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে টিকাটি ভারতে সিরাম ইনস্টিটিউট তৈরি করছে, তার অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। এটি নিরাপদ কি না তার পরীক্ষা ভারতে ১ হাজার ৬০০ মানুষের মধ্যে চালানোর কথা ছিল। কিন্তু ঠিক কতজনের ওপরে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং কী তথ্য তা থেকে বেরিয়ে এসেছে, সেই গোপন তথ্য শুধু বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছেই জমা দিয়েছে সিরাম ইনস্টিটিউট। এত কম স্বেচ্ছাসেবকের ওপরে পরীক্ষা চালানোর পরেও তারা যে ছাড়পত্র পাওয়ার আবেদন করতে পেরেছে, তার কারণ যুক্তরাজ্যে ইতিমধ্যেই এটি ছাড়পত্র পেয়েছে এবং সেখানে তারা টিকাটির কার্যকারিতা নিয়ে যে তথ্য যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রকের কাছে জমা দিয়েছে, সেই একই তথ্য তারা প্রমাণস্বরূপ ভারতেও জমা দিয়েছে। মোট ২৬ হাজার টিকা পরিবহন থেকে শুরু করে রেফ্রিজারেশনে রাখা, কতজনকে একেক দিনে টিকা দেওয়া হবে- এমন প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের মহড়া দেওয়া হয়েছে।

 

জনসন অ্যান্ড জনসন

জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা নিরাপদ ও কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে উৎপাদন হচ্ছে ধীরগতিতে। জনসন অ্যান্ড জনসনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. পল স্টফেলস গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করবে জনসন অ্যান্ড জনসন কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের করোনা থেকে রক্ষা করতে এটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা পোষণ করছেন তারা। তবে বসন্তের আগে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা, সে পরিমাণ টিকা হয়তো উৎপাদন জটিলতার কারণে সরবরাহ করতে পারবে না। কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত অন্যান্য ভ্যাকসিনের চেয়ে এই ভ্যাকসিন দুই দিক থেকে বেশি সুবিধাজনক। অন্যান্য ভ্যাকসিন দুই ডোজ করে দেওয়া হচ্ছে করোনা মোকাবিলায়, অন্যদিকে জনসন অ্যন্ড জনসনের এই ভ্যাকসিন এক ডোজ দিলেই যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে সক্ষম। এ ছাড়াও ফ্রিজে এক মাস পর্যন্ত এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা যাবে, অন্যান্য ভ্যাকসিনের মতো হিমায়িত না করলেও চলবে। সরকারের সঙ্গে ভ্যাকসিন কর্তৃপক্ষ আগামী আগস্ট মাসের মধ্যে ১ বিলিয়ন ডোজ টিকা সরবরাহের চুক্তি করেছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ তারা ১২ মিলিয়ন ডোজ উৎপাদন করতে পারবে বলে ধারণা করছে।

 

কিউরভ্যাক

জার্মান বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি কিউরভ্যাক করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে তাদের এমআরএনএভিত্তিক প্ল্যাটফরমের কাজকে গতিশীল করার ঘোষণা দেয়। এ ক্ষেত্রে ৮০ মিলিয়ন ইউরোর আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয় ইউরোপীয় কমিশন। আগামী জুনেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের তৈরি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর বিষয়ে আশাবাদী। এই পরীক্ষা সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব উৎপাদনব্যবস্থা কাজে লাগিয়েই অল্প খরচে লাখো ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হবে বলে তারা জানিয়েছে।

কিউরভ্যাকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে।

কিউরভ্যাকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই টিকা বাজারে আনার আশা করছে। তবে দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গেলে এর আগেই কিউরভ্যাকের টিকা বাজারে চলে আসতে পারে। তবে দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলেননি ফ্রাঞ্জ। কিউরভ্যাকের সিইও বলেন, ‘দ্রুত টিকা অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছি না। তবে এটা কেবল কর্তৃপক্ষের একান্ত সহযোগিতার মাধ্যমে অর্জন করা যাবে।’ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, কিউরভ্যাকের টিকা তৈরির পেছনে রয়েছেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। কিউরভ্যাকের দ্রুত টিকা আনার ঘোষণা দেওয়ার পর তাদের শেয়ারের দাম বেড়ে গেছে।

সর্বশেষ খবর