রবিবার, ৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঈদের খাবার খেতে হবে সতর্কভাবে

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

ঈদের খাবার খেতে হবে সতর্কভাবে

ঈদ সমাগত, এক মাস সিয়াম সাধনার পরে ঈদে চলবে খাওয়া-দাওয়ার ধুম। রোজার শেষে ঈদের দিনটায় একটু বেশি খাওয়া হয়ে যায়। এই দিনে ভোজনের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতিও থাকে। ছোট-বড় সব বয়সের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রকমের খাওয়া-দাওয়াটাই অন্যতম আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান। শুধু নিজ ঘরেই নয়, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানেও চলে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। আবার এসব খাবারের বেশির ভাগই ‘রিচফুড’। আসলে ঈদের আনন্দ সবার জন্যই, কিন্তু ছোটদের সবচেয়ে বেশি। ছোট বলে তারা একটানা রোজা রাখে না, শখ করে দু একটা রাখে।  রোজা শেষে ঈদের দিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে মজার মজার খাবার খেতেই তাদের বেশি পছন্দ। অতিভোজনে যে কারও মতো ছোটদেরও সমস্যা হতে পারে, তবে সাধারণত ওদের সমস্যা কম হয়। কোনো কিছু খেলেই শরীরে সমস্যা হবে এমন কথা নয়। শুধু পরিমাণটা ঠিক রাখলেই হলো। তরুণদের রোজা রাখতে যেমন খুব সমস্যা হয় না, তেমনি রোজার শেষে ঈদের বিভিন্ন রকমের খাওয়া-দাওয়াতেও তাদের অনেকেরই কোনো অসুবিধা হয় না।

আগে থেকেই কোনো শারীরিক সমস্যা না থাকলে হজমে সহায়ক সব ধরনের এনজাইমের সঠিক নিঃসরণ হয়। তাই যে কোনো খাবার বিশেষ করে গুরুপাক খাদ্য সহজে হজম হয়। তবে এক মাস রোজায় দীর্ঘ সময় পানি ও অন্যান্য তরল খাবার কম খাওয়া হয়। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইফতারের পরও অনেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করে না। আবার ইফতার ও সাহরিতে ছোলা, পিয়াজু, অধিক মসলাযুক্ত মাংস ইত্যাদি খেয়ে অভ্যস্ত হওয়ায় শাকসবজি বা আঁশ জাতীয় খাবার কম খাওয়া হয়। ফলে অনেক রোজাদারেরই কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা অনিয়মিত পায়খানা হওয়ার অভ্যাস হয়। তাই মলত্যাগের সময় পায়ুপথে ব্যথা, জ্বালাপোড়া এমনকি রক্তক্ষরণও হতে পারে। ঈদের দিন প্রচুর তৈলাক্ত খাবার, পোলাও, বিরানি, মুরগি, খাসি বা গরুর মাংস, কাবাব, রেজালা ইত্যাদি খাওয়া হয়। এসব খাবার অন্ত্র থেকে অতিরিক্ত পানি শোষণ করে। তাই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা আরও বেড়ে যায়। যাদের আগে থেকেই অ্যানাল ফিসার, ফিস্টুলা বা পাইলসের সমস্যা আছে, তাদের পায়ুপথে জ্বালাপোড়া, ব্যথা বেড়ে যেতে পারে, এমনকি রক্তক্ষরণের মাত্রাটাও বেশি হতে পারে।

মধ্যবয়সী এবং বয়স্কদের খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে যারা উচ্চ রক্তচাপ,  হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, হাইপারকোলেস্টারলেমিয়া, কিডনি বা লিভারের  রোগে ভোগেন, তাদের অবশ্যই ঈদের খাবারের ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকা দরকার। এমনকি বয়স্কদের এসব রোগ না থাকলেও সতর্ক থাকতে হবে।

ঈদের খাবারে যে সমস্যাগুলো দেখা যায়, বিশেষ করে বয়স্কদের, তা হলো— ক. রোজার এক মাসে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন প্রণালিতে যে পরিবর্তন আসে সেটাতেই অনেকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ ঈদের দিনে তৈলাক্ত, চর্বিযুক্ত খাবার অতিরিক্ত খাওয়া হয়। অতিভোজনের ফলে পাকস্থলির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কারণ অধিক চাপে পাকস্থলির এনজাইম ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে পেট ব্যথা, গ্যাস্ট্রাইটিস, ডায়রিয়া, মাথাধরা, বমি, পেটফাঁপা, পেটে অস্বস্তিকর অনুভূতি, ভরা ভরা ভাব, বারবার ঢেঁকুর ওঠা এমনকি বুকে ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে। যাদের পেপটিক আলসার ডিজিজ আছে ঈদের দিন তৈলাক্ত ও ঝাল মসলাযুক্ত খাবার খাওয়ায় পাকস্থলি ও ক্ষুদ্রান্ত্রের ক্ষতে পুনরায় প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং বুক জ্বালা, পেট জ্বালা ইত্যাদি অনেক বেড়ে যায়। 

অনেকেই আই.বি.এস. বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম রোগে ভোগেন। তারা দুগ্ধজাত খাবার যেমন পায়েস, সেমাই, হালুয়া ইত্যাদি খেলে অস্বস্তি, ঘন ঘন মলত্যাগ ও অসম্পূর্ণ মলত্যাগের অনুভূতি হয়।

এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায়— ক. ঈদের দিন সকালে সেমাই বা পায়েস খেতে পারেন। সঙ্গে কিশমিশ, বাদাম, ফলমূলও খাওয়া যায়। খাবার কিছুক্ষণ পর নামাজে যাওয়ার আগে বিশুদ্ধ পানি পান করুন। খ. খাবারের ফাঁকে ফাঁকে পানি পান না করাই ভালো। এতে হজম রসগুলো পাতলা হয়ে যায়, ফলে হজমে অসুবিধা হয়। তাই খাওয়ার অন্তত বেশ কিছুক্ষণ পর পানি পান করুন। গ. একসঙ্গে বেশি খাবার না খেয়ে অল্প অল্প করে খাওয়া ভালো। ঘ. পোলাও বা বিরানির সঙ্গে টমেটো, শসা ইত্যাদির সালাদ এবং খাবারের পর দই খাওয়া ভালো। তবে পোলাও, বিরানি জাতীয় খাবার অতিরিক্ত খাবেন না। ঙ. যারা আগে থেকেই পেটের পীড়া বা পেপটিক আলসার রোগে ভোগেন, তারা সকালে উঠেই ডমপেরিডন, রেনিটিডিন, ওমিপ্রাজল বা প্যান্টোপ্রাজল খেয়ে কিছুক্ষণ পরে খাবার খেতে পারেন। এন্টাসিড জাতীয় ওষুধও খাওয়া যায়। চ. যাদের আইবিএস আছে তারা দুধ, দুগ্ধজাত খাবার, শাক জাতীয় খাবার পরিহার করুন। ছ. রাতে অল্প খাওয়ার চেষ্টা করুন। খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বেন না। খাবারের পর শুয়ে না পড়ে একটু পায়চারি করা ভালো, পরে বিছানায় যাবেন। জ. ঈদের সময় সাধারণত সবাই একত্রে বসে খাওয়া-দাওয়া করেন এবং খাবার সময় গল্পগুজব করার কারণে অতিরিক্ত বাতাস পাকস্থলিতে ঢুকে বার বার ঢেঁকুর তোলার সমস্যা হতে পারে। তাই খাবারের সময় যতটা সম্ভব কম গল্পগুজব করুন ও খাবার ভালো করে চিবিয়ে খান। ঝ. বয়স্কদের ভারী খাবার না খাওয়াই ভালো। যদি একান্তই খেতে হয়, তবে পরিমাণে খুব কম খেতে হবে। যে খাবারে সমস্যা বেশি হয় তা এড়িয়ে চলুন। ঞ. যাদের হার্টের অসুখ বা রক্তে কোলেস্টেরল আছে, তাদের খাবারে চর্বি ও ঘি পরিহার করতে হবে। কিডনির সমস্যা থাকলে অধিক মাছ-মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ট. ঈদের দিনে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, চিড়িয়াখানা, হোটেল রেস্তোরাঁ এমনকি রাস্তায় দিনভর ঘোরাফেরা করেন। মনে রাখতে হবে যেখানে সেখানে পানীয় বা অন্যান্য খাবার দাবারের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ঠ. এ ছাড়াও অনেকেই ঈদের দিনটিতে পরিবারের সঙ্গে কাটানোর জন্য গ্রামের বাড়িতে যান। এ সময় ভ্রমণের কারণে যানজটে এবং অতিরিক্ত গরমে শরীর খারাপ হতে পারে যেমন পানিশূন্যতা, বমিভাব ইত্যাদি। তাই ভ্রমণের আগে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে এবং সঙ্গে পানি রাখতে হবে। রাস্তাঘাটের মুখরোচক কিন্তু ভেজালযুক্ত খাবার-দাবার খেয়ে পেটের পীড়ায় ভোগার চেয়ে তা এড়িয়ে চলাই উত্তম।  প্রয়োজনে বাসা থেকে খাবার তৈরি করে ভ্রমণের সময় সঙ্গে নিয়ে যাবেন।

ঈদের দিনে মাত্রা জ্ঞান রেখে নিজ নিজ স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাবার গ্রহণ করতে হবে। এক মাসের অনভ্যস্ত পাকস্থলি হঠাৎ অধিক খাবারের চাপ সহ্য করতে পারে না বলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তি হতেও দেখা যায়। এ কারণে খাবার যেন হয় পরিমিত এবং সময় জ্ঞান রেখে বিরতি দিয়ে খাওয়া উচিত। সারা দিন এবং যখন তখন খাওয়া নয়। তাহলেই সুস্থ থাকা যাবে। খাবার হবে স্বাস্থ্যসম্মত ও সহজপাচ্য। তবে সমস্যা হলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে খেয়ে নেওয়া উচিত দরকারি কিছু সাধারণ ওষুধ।  তাহলেই সুস্থ থাকা যাবে সব সময়।

লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ ও অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর