সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধাঞ্জলি

বেবী আপা : অন্তরে বাহিরে

দুলাল আচার্য

‘মানুষ মরে গেলে তবুও মানব থেকে যায়’— কবি জীবনানন্দ দাশের এই পঙিক্তকে সামনে রেখে বলতে হয় মানুষের মৃত্যু হবে, রয়ে যাবে এই বিশ্বে মানব জাতি। মানুষ হবেন কর্মনিষ্ঠ ও সৃষ্টিশীল। কর্মনিষ্ঠ মানুষের জীবন চলমান। সৃষ্টিশীল কর্ম ও অনুসরণীয় চরিত্র একজন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে অনন্তকাল। আমার দৃষ্টিতে সাংবাদিক বেবী মওদুদ সেই মানুষের শ্রেণিভুক্ত। আমার এ মূল্যায়ন হয়তো সার্বজনীন নাও হতে পারে। আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন স্নেহময়ী জননীর মতো। আমরা তাকে বেবী আপা বলেই ডাকতাম। আজ ২৫ জুলাই তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালের এই দিনে তিনি দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে হার মানেন।

অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বেবী আপা। ক্ষমতার কাছে থেকেও যারা প্রভাব খাটিয়ে অফুরন্ত সম্পদের মালিক না হয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথকে বেছে নেন, নীতির প্রশ্নে থাকেন আপসহীন এবং সাদামাটা জীবনযাপন করে সাধারণ লোকের কাতারে শামিল হন, এমন লোকের সংখ্যা আমাদের সমাজে খুব কম। বেবী আপা ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু ও সজ্জন হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতার মোহ বা আর্থিক অনিয়ম তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। সীমিত আয় দিয়েও যে কীভাবে স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপন করা যায়; এই বিষয়টি আমরা যারা তার কাছে ছিলাম তারা অনেকেই তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম। সাদামাটা জীবন যে কতটা আনন্দের হতে পারে বেবী আপাকে দেখে সেটা উপলব্ধি করা যেত। তিনি বলতেন, জীবনে যত বেশি চাহিদা থাকবে, জীবন তত জটিল হবে। তাই চাহিদাকে কমিয়ে এনে জীবনকে আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলাই মানবজন্মের আসল কাজ।

ছাত্রজীবন থেকেই সব প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতেন। এই ধারাটি ধরে রেখেছিলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী এই লড়াকু নারী নিরন্তর লিখেছেন, গবেষণা করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন, রাজনীতি করেছেন, করেছেন সামাজিক দায়িত্ব পালনও। সেই ছেলেবেলা থেকে কচিকাঁচার মেলায় লেখায় হাতেখড়ি। সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, প্রবন্ধ, ফিচার লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে মনে মনে (ছোটগল্প), নারী ভুবন (কলাম), দুঃখ-কষ্ট-ভালবাসা (উপন্যাস), অন্তরে বাহিরে (কলাম), পাকিস্তানে বাংলাদেশের নারী পাচার, বাংলাদেশের নারী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, নিভৃত যতনে, আমার রোকেয়া, চিরন্তন প্রতিকৃতি রোকেয়া, শেখ মুজিবের ছেলেবেলা, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা, সষি পুষি টুষি (ছড়া), টুনুর হারিয়ে যাওয়া, দীপ্তর জন্য ভালোবাসা, শান্তর আনন্দ, এক যে ছিল অনু, মুক্তিযোদ্ধা মানিকসহ অসংখ্য রচনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির সম্পাদনার ক্ষেত্রে বেবী আপার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বেবী আপার কল্যাণে প্রথম দিকে এই কাজের সঙ্গে আমি যুক্ত হতে পেরেছিলাম। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে শেখ রেহানার সম্পাদনায় নতুনভাবে, নতুন ব্যবস্থাপনায় চলা শুরু হয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার। একই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে বেবী আপার প্রত্যক্ষ নির্দেশে বিচিত্রায় আমারও পথচলা।

বিচিত্রার কাজ করতে গিয়ে বেবী আপার কিছু লেখালেখির কাজ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। তার এই সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত রাখতে পারায় নিজেকে আজও ধন্য মনে করি। শিশুতোষ বই ‘দীপ্তর জন্য ভালোবাসা’ বেবী আপার ছোট ছেলে শফিউল হাসান দীপ্তর (পুটু) জীবনের ছায়া অবলম্বনে। একজন অটিস্টিক শিশুর বেড়ে ওঠার কাহিনী এটি। লেখাটি সম্পাদনা করতে গিয়ে আমি বহুবার কেঁদেছি। এক সময় দেখতাম বেগম রোকেয়ার নিজের লেখা এবং তার সম্পর্কীয় রেফারেন্স অনেক বই বেবী আপা অফিসে পড়ছেন। আর প্রতিদিনই কিছু কিছু পয়েন্ট চম্পকদা-কে কম্পোজ করতে দিতেন। কিছুদিন পর দেখলাম এগুলো সংযুক্ত করে হয়ে গেল ‘পবিত্র রোকেয়া পাঠ।’ বেগম রোকেয়াকে সহজভাবে উপলব্ধি করার একটা অসাধারণ পুস্তিকা। বেবী আপা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর প্রথম দিককার কাজগুলোতে তার শ্রম খুব কাছ থেকে দেখেছি। বিচিত্রার শেষের পাতায় প্রতি সপ্তাহে বেবী আপার একটি নিয়মিত কলাম বের হতো। ‘অন্তরে বাহিরে’ নামে এই লেখাগুলো সংকলিত হয়ে পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। যাতে তার ব্যক্তি জীবনের ছায়া ছিল। এই গ্রন্থটি বেশ প্রশংসিত হয় পাঠক সমাজে।

ছাত্রজীবন থেকেই সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন তিনি। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মহিলা পরিষদে ছিলেন একনিষ্ঠ, সমাজসেবায় অগ্রণী, সাহিত্য সাধনায় সার্বক্ষণিক নিবেদিত থাকা এমনকি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন পেশাদার সাংবাদিক। তিনি সাপ্তাহিক ললনা, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক মুক্তকণ্ঠে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। বিবিসির বাংলা বিভাগের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বাংলা বিভাগ গড়ে তোলায় অনন্য ভূমিকা রাখেন তিনি। নতুন ব্যবস্থাপনা ও সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বিচিত্রা প্রকাশ হলে তিনি এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। তার অধীনে এই ম্যাগাজিনে আমি ১০ বছর সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করি। ম্যাগাজিনটির সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। সর্বশেষ বিডিনিউজের সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক ছিলেন তিনি। সংসদ সদস্য হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বেবী আপা আরও বহুকাল স্ফুরিত হবেন তার কর্মের জন্য, সৃজনের জন্য। বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন তিনি। দেশ, জাতি, সমাজ, সংস্কৃতি ছিল তার ভাবনার বিষয়। সাম্য মৈত্রীর আদর্শ তাকে গণমানুষের পক্ষেই ধাবিত করেছে।

সাপ্তাহিক বিচিত্রা শুধু একটি ম্যাগাজিনই ছিল না। ছিল ছোট একটি পরিবার। আমাদের ১৮ জন ভাইবোনের সংসার। দীর্ঘ ১০ বছরের পথচলায় আমাদের অভিভাবক ছিলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বেবী আপা পরিবারটি পরিচালনা করতেন। ওয়ান-ইলেভেনের কালোথাবা এই পরিবারটি তছনছ করে দেয়। শেখ হাসিনা গ্রেফতারের কিছুদিন পরই আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে বিচিত্রার প্রকাশনা স্থগিত করা হয়। স্রোতের টানের মতো আমরা ছিটকে পড়ি নানা স্থানে। সুদিন ফিরে এলে ১৮ জনের কারও কারও ভাগ্যের দরজা খুলে যায়। কিন্তু আমরা কয়েকজন একেবারে দূরে ছিটকে পড়ি। সেই সাপ্তাহিক বিচিত্রা আর মুক্ত হয়নি। সেই বিচিত্রা আজ নেই, বেবী আপাও নেই। আমরা কয়েকজন স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। আমাদের সামনে এখন বেবী আপার সেই আদর্শিক জীবনপাঠ। যে পাঠ একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও স্নেহময়ী আদর্শ মায়ের উপদেশ। যা চলার পথে উপলব্ধি করছি। মৃত্যু দিবসে বেবী আপার প্রতি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা।

লেখক : সাংবাদিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর