মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজনীতি বনাম সম্প্রীতি

ব্যারিস্টার আহসান হাবীব ভূঁইয়া

রাজনীতি বনাম সম্প্রীতি

রাজনীতি। রূপক অর্থে রাজার নীতি। আদিমকালে যখন রাজা-বাদশারা প্রজাদের শাসন করতেন তখনকার নিয়মনীতিই ছিল রাজনীতি অর্থাৎ রাজার নীতি। রাজা যা বলতেন তাই আইন, তাই সংবিধান। কালের বিবর্তনে এখন আর রাজাও নেই রাজ্যও নেই, তবে রাজনীতিটা ঠিকই রয়ে গেছে। এবার আসি সম্প্রীতি প্রসঙ্গে। সম্প্রীতির আভিধানিক অর্থ সদ্ভাব, পারস্পরিক মিল। একটা সময়ে এই রাজনীতি ও সম্প্রীতি সমান্তরাল পথে চললেও আজ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। কিন্তু কেন? রাজা-বাদশারা যেমন প্রজাদের শাসনের নামে শোষণ করে রাজ্য হারিয়েছে ঠিক তেমনি আমাদের গুটিকয়েক রাজনীতিবিদ নীতি বিসর্জন দিয়ে পারস্পরিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছেন, এই মহান মানব সেবাকে কলুষিত করেছেন। একটি রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজনীতির অবাধ বিচরণ। অথচ আজ আমাদের কাছে রাজনীতি মানেই খারাপ কিছু, না বুঝে নাক সিটকানো। রাজনীতি শব্দটি যেন খারাপ কোনো কাজের সমার্থক শব্দ। আর রাজনীতিবিদ মানেই যেন খারাপ মানুষ। অনেককেই বলতে শুনি আরে রাজনীতি কি আর ভালো মানুষ করে নাকি। এমনকি এই একই মনোভাব আবার নিজ সহকর্মীকে নিয়েও! এ যেন নিজের গায়ে নিজ হাতে কাদা মাখানোর মতো ব্যাপার। আর এর মূল কারণ হচ্ছে পারস্পরিক সম্প্রীতির অনুপস্থিতি। আপনি যখন আপনার নিজের সহকর্মীকে অসম্মান করবেন, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন তখন অন্যরা কেন আপনাদের সম্মান দেখাবে? রাজনীতিতে মতের অমিল হবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের আদর্শ ভিন্ন, চেতনা বিসদৃশ, চিন্তাধারা ব্যতিক্রম। আর তাই মতপার্থক্য ও নীতির বিভাজন থাকবেই। তবে মনুষ্যত্বের উপাদান বিদ্যমান থাকা বাঞ্ছনীয়। একটি রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠার সুবাদে সময়ের পরিক্রমায় রাজনীতিবিদদের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ অবস্থানের ক্রমাগত ক্ষয় হওয়া দেখেছি। একটা সময় দেখতাম রাজনীতিবিদরা অন্য দলের সহকর্মীদের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগদান করতেন।

রাজনীতিতে একে অপরের বিরোধী হলেও কেউ অসুস্থ হলে দেখতে যেতেন। মারা গেলে জানাজায় শরিক হতেন। এখন সেই দাওয়াত দেওয়া-নেওয়া তো দূরের কথা মানুষ মারা গেলে ফোন করে পর্যন্ত পরিবার পরিজনকে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়াস করেন না। তবে কেন ও কবে থেকে এ বিরূপ মনোভাবের উত্পত্তি? প্রতিটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটপরিবর্তনের পেছনেই একটি প্রেক্ষাপট বিদ্যমান থাকে। এখানেও নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম নয়। স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতার পালাবদলে বারংবার সরকার গঠন করেছে। এই দুই দলের নেতারাই একবার সরকারি দলে তো আবার বিরোধী দলে থেকে রাজনীতি করে এসেছেন। ভাষণে, মিছিলের স্লোগানে একে অপরকে তুলাধোনা করে ছেড়েছেন, সংসদে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন। তবে তার মধ্যেও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের একটা চর্চা ছিল। দেখা হলে কুশল বিনিময় ছিল, ঠাট্টা মশকরা ছিল, ঈদের জামাত একসঙ্গে পড়ার পর কোলাকুলির অভ্যাস ছিল। শুধু একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা এদেশের সব রাজনীতির সংস্কৃতিটাই পাল্টে দিয়েছে। আর তা হলো ২১ আগস্টের বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা। পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন পাকসেনারা আমাদের ৩০ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু স্বাধীন দেশের মাটিতে ১৫ আগস্টের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস বর্বরতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আমাদের দেশেরই কিছু কাপুরুষ। এরপর কয়েক দফা স্বৈরাচারী সরকারের ক্ষমতার জাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালি জাতি একত্রিত হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে জনগণ তাদের ভাগ্য নির্ধারণের গুরুদায়িত্ব সঁপে দেন এদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে। আর এর পর থেকেই দুই দলকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি ক্ষমতায় আনে দেশের জনগণ। কিন্তু একটি পর্যায়ে এসে চিরস্থায়ী ক্ষমতার মোহে ২১ আগস্টের বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা চালানোর মাধ্যমে এদেশ থেকে চিরতরে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নাম-নিশানা মুছে ফেলার ন্যক্কারজনক অপচেষ্টা করা হয়েছিল। কথায় আছে রাখে আল্লাহ মারে কে! বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আগের বিভিন্ন হামলার ন্যায় এ যাত্রায়ও প্রাণে বেঁচে যান তবে প্রাণ দিতে হয় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণীসহ আরও অনেক নিরীহ নিরপরাধ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকে। স্বাধীন বাংলার মাটিতে ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পুনরায় ২১ আগস্টে গ্রেনেড দিয়ে তার শেষ প্রদীপটুকু নিভিয়ে দেওয়ার যেই জঘন্য ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর অপচেষ্টা করা হয়েছিল সেদিন থেকেই আমাদের রাজনীতির সম্প্রীতির কবর হয়ে যায়। এ তো প্রতিপক্ষকে সমালোচনা কিংবা ভোটযুদ্ধে হারানোর কৌশল অবলম্বন নয়, নির্ঘাত জানে মেরে ফেলা! আর এরপর থেকেই সব রাজনীতিবিদের একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, সমীহ রূপান্তরিত হয় অবজ্ঞা, তিরস্কার ও সন্দেহে। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করেন রাজনীতিবিদরা। পর্যায়ক্রমে আজকে তারা দুই মেরুতে অবস্থান করছেন শুধু দলগত আদর্শ কিংবা নীতির প্রশ্নে নয় বরং সামাজিক ও মানসিকভাবেও তারা একে অপরের থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন। এখন ভিন্ন দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে তারা ইতস্তত বোধ করেন, সম্ভব হলে এড়িয়ে যান। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করতে অনেক হিসাব-নিকাশের সম্মুখীন হন। অসুস্থ রোগী ও মৃত সহকর্মীর জানাজায় শরিক হতেও দশবার ভাবতে হয়। গণমাধ্যমের প্রসারের ফলে আজকাল রাজনীতিবিদদের গতিবিধি যেমন সহজলভ্য আবার তাদের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের প্রতিও সাধারণ মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। সবকিছু মিলিয়ে আজকাল রাজনীতিবিদদের বিরোধী দলের কারও সঙ্গে কুশল বিনিময়ও অনেক ঝক্কি ঝামেলার বিষয়। এ চরম সন্দিক্ষণে আশার সঞ্চারণ করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন তিনি বিরোধীদলীয় চেয়ারপারসনের ছেলের মৃত্যুতে একজন প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল উপেক্ষা করে একজন মা হিসেবে আরেকজন সদ্য পুত্রহারা মা-কে সান্ত্বনা দিতে ও সহানুভূতি প্রকাশ করতে সরাসরি তার বাসভবনে চলে যান। কিন্তু বিধিবাম। প্রধান ফটকের বাইরে থেকেই ফিরে যেতে হয় দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। যে আবেগপ্রবণ বাঙালির সব সহানুভূতি ছিল মরহুমের মৃত্যুতে, এ অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহারে ক্ষণিকের মুহূর্তেই তা রূপ নেয় সরব সমালোচনার। আরেকবার অরাজনৈতিক ব্যবহারের কাছে পরাজিত হলো সম্প্রীতি।

অন্যকে অসম্মানিত করে নিজে বড় হওয়ার নজির তাবৎ পৃথিবীতে নেই। বরং সম্মান দিতে জানলে সম্মানের যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভবপর হয়। অসহিষ্ণু এবং অহমিকার রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে আজ রাজনীতির সম্প্রীতি বিপর্যস্ত। আর এই বিদঘুটে অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পন্থা হচ্ছে অহংকার নামক বস্তুটিকে নিজের চরিত্র থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজেকে সজ্জন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, নিজেকে নেতা হতে সাধারণ মানুষের কাতারে নিয়ে আসা।  প্রত্যাশা রইল ভবিষ্যতে ‘সম্প্রীতি বনাম রাজনীতি’ শিরোনামের স্থলে ‘সম্প্রীতি ও রাজনীতি’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ যেন লিখতে পারি।

লেখক : সহ-সম্পাদক কেন্দ্রীয় উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

            ই-মেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর