বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

হজের বরকত নষ্টকারী কিছু কাজ

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা

হজের বরকত নষ্টকারী কিছু কাজ

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হজ। যা একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য মানুষ পালন করে থাকে। একজন মুমিনের জন্য এটি বিশাল একটা নেয়ামত। কারণ আল্লাহর রহমত ছাড়া এ মহান ইবাদতের সৌভাগ্য সবাই অর্জন করতে পারে না। শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা থাকলেই হজ করা যায় না। তাই যাদের আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দয়া করে এ মহান ইবাদতটির সুযোগ করে দিয়েছেন, তাদের এর যথাযথ মূল্যায়ন করা উচিত। সেখানে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকা যা আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) পছন্দ করেন না। নিম্নে সেরকম কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো, হজ পালনকালে যেগুলো থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

সেলফি নেশা : এটি বর্তমান বিশ্বে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ সবাই এতে লিপ্ত। যার উদ্দেশ্যই থাকে নিজেকে প্রদর্শন করা। যা ইবাদতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। ইবাদতের প্রদর্শনকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘রিয়া’ বলে। যাকে প্রিয় নবী (সা.) গুপ্ত শিরক বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমাদের কাছে রসুলুল্লাহ (সা.) আসলেন, আমরা তখন মসীহ দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি (সা.) বলেন : আমি কি তোমাদের এমন বিষয় অবহিত করব না, যা আমার মতে তোমাদের জন্য মসীহ দাজ্জালের চেয়েও ভয়ঙ্কর? রাবী বলেন, আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি বলেন : গুপ্ত শিরক। মানুষ নামাজ পড়তে দাঁড়ায় এবং লোকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সুন্দরভাবে নামাজ পড়ে।’ (ইবনে মাজাহ : ৪২০৪)।

যেহেতু সেলফি ইত্যাদির উদ্দেশ্য এটিকে ফেসবুক, টুইটার বা ইনিসটাগামে আপলোড করে গ্লোবাল ভিলেজে নিজেকে প্রদর্শন করা, তাই এটিও গুপ্ত শিরকের আওতামুক্ত হবে না। পবিত্র কাবার সামনে দাঁড়িয়ে এ জঘন্য অপরাধ থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত। আল্লাহর প্রেমে পাগল হয়ে হাজার মাইল থেকে ছুটে যাওয়া মুমিনের জন্য এ ধরনের অনর্থক কাজ মোটেও শোভা পায় না। শুধু সেলফি-ই নয়, যে কোনো ধরনের ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি, ফেসবুক, ইউটিউব লাইভ করা থেকে বিরত থাকাও আবশ্যক। কারণ এগুলোর প্রতিটিই আপনার হজকে গুপ্ত শিরিকের আগুনের ঝলসে দিতে পারে। আল্লাহ হেফাজত করুন! তাই প্রতিটি ইবাদতের স্থানকেই এ ধরনের অনর্থক কাজ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফির ব্যাপারে পবিত্র হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছেন যে, কেয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সব থেকে শক্ত শাস্তি হবে তাদের, যারা ছবি তৈরি করে।’ (সহিহ বুখারি ৫৯৫০)।

শরিয়ত কর্তৃক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ছবি তোলার অনুমতি থাকলেও অনর্থক কাজে ব্যবহার করার জন্য ব্যাপক হারে ছবি তোলার অনুমতি ইসলামে নেই।

পর্দার ব্যাপারে উদাসীনতা : পবিত্র হজ যেমন একটি মহান ইবাদত, তেমনি পর্দাও ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাই হজে গমন করে পর্দা ভুলে গেলে চলবে না। বরং সেখানে তো এর প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আল্লাহর ঘরে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নাফরমানি যে কতটা ভয়ঙ্কর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

হজে গমনকারী নারীরা প্রথমত মাহরাম ছাড়া হজে গমন করতে পারবেন না। উচ্চ আওয়াজে তালবিয়া পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাওয়াফের সময় রমল করা যাবে না। সায়ির সময় দৌড়ানো যাবে না।

মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে হবে। কিন্তু যেহেতু ইহরাম অবস্থায় মুখে কোনো কাপড় পেঁচানো যাবে না। তাই কোনো বিশেষ ক্যাপ ব্যবহার করে সামনের দিকে একটি লম্বা কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। অথবা মাথায় শক্ত কোনো পিচ বোর্ড ইত্যাদি বেঁধে তার ওপর থেকে কাপড় ঝোলাতে হবে।

হজে অবস্থানরত মহিলারা হোটেলে নামাজ পড়াই উত্তম কিন্তু কখনো হজের বিধান আদায় করতে গিয়ে বা তাওয়াফের সময় নামাজের সময় হয়ে গেলে সেটা ভিন্ন কথা। এ ছাড়াও তাওয়াফের সময় মহিলারা মাতাফে অবস্থান করার চেয়ে হারাম শরিফের দ্বিতীয়/তৃতীয় তলা ব্যবহার করাই তাদের জন্য উত্তম। এককথায় পর্দার সঙ্গে পুরুষদের ভিড় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে।

হোটেলে অবস্থানকালে টিভি দেখা : তেতো হলেও এ কথাটি সত্য যে, আমাদের অনেকেই হজে থাকাকালীন হোটেলে অবস্থানকালে টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখেন। অহেতুক কাজে সময় নষ্ট করে থাকেন। এটি যে কতটুকু যুক্তিযুক্ত কাজ তা সবার বিবেকের ওপরই ছেড়ে দিলাম।

সংযত না থাকা : পবিত্র হজ পালনের মাধ্যমে একজন বান্দা আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করেন। এ হজের উসিলায়ই আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের সব পাপ মোচন করে তাকে একটি নিষ্পাপ সন্তানের ন্যায় শুদ্ধ করে দেন। তাই ইবলিশ শয়তান সারাক্ষণ হজে আসা হাজীদের বিভিন্নভাবে বিপথগামী করার চেষ্টা করে। কখনো কখনো এর ফলে হাজীদের মধ্যে মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাটির মতো নিষিদ্ধ কাজও করিয়ে ফেলে। যেমনটি শুনেছিলাম আমার একজন কাছের বন্ধুর মুখে। তারা যখন আরাফার ময়দান থেকে ফিরছিলেন, তখন তাদের একটি বাসে তুলে দেওয়া হয়, যেটি মূলত তাদের জন্য ভাড়া করা হয়নি। ফলে সে বাসে থাকা যাত্রীরা তাদের নেমে যেতে বলে, কিন্তু তাদের কিছু সংখ্যক হাজী সাহেব নামতে অস্বীকৃতি জানান। (তাদের ধারণা ছিল এটি তাদের জন্য ভাড়া করা হয়েছে।) এতে করে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা ও একপর্যায়ে কিছু হাজী শয়তানের ধোঁকায় পড়ে মারামারিতে লিপ্ত হয়ে যান। যা সম্পূর্ণ হজের পবিত্রতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া আরাফার ময়দান দোয়া কবুল হওয়ার জায়গা এখানে মজলুমের দোয়া যে কত দ্রুত কবুল হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার প্রভাব হয়তো এ অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ীদের ওপরই বর্তাবে। (আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন!)

পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে। যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের ওপর হজ অবধারিত করে নেয়, সে হজের সময়ে কোনো অশ্লীল কথা বলবে না, কোনো গুনাহ করবে না এবং ঝগড়াও নয়। তোমরা যা কিছু সত্কর্ম করবে আল্লাহ তা জানেন। আর (হজের সফরে) পথ খরচা সঙ্গে নিয়ে নাও। বস্তুত তাকওয়াই উত্কৃষ্ট অবলম্বন। আর হে বুদ্ধিমানেরা! তোমরা আমাকে ভয় করে চল। (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৯৭)।

পবিত্র হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এ ঘরের হজ আদায় করল এবং স্ত্রী সহবাস করল না এবং অন্যায় আচরণ করল না, সে প্রত্যাবর্তন করবে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্য প্রসূত শিশুর মতো হয়ে। (সহিহ বুখারি : ১৮১৯)।

পবিত্র হজ চলাকালীন এমন অনেক সমস্যাই সামনে আসবে কিন্তু এতে উত্তেজিত হওয়া যাবে না।  নিজেকে সংযত করতে হবে। যাতে কোনোভাবেই ইবলিশ শয়তান আমাদের বিপথগামী না করতে পারে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

সর্বশেষ খবর