শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে

মাকিদ হায়দার

কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে

হিজ মাস্টার্স ভয়েস রেকর্ড কোম্পানির সেই প্রভুভক্ত কুকুরটাকে প্রথম দেখি পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি। আমাদের নিরিবিলি শহরের রূপকথা সিনেমা হলের মালিক মোকারম হোসেনের বাড়িতে। বাড়িটির নাম ছিল চন্দ্রিমা কুঠির। তখনকার দিনে সুজানগর, কাশিনাথপুর যেতে একমাত্র হেরিং বোনের ইট সুরকির রাস্তা ছাড়া পিচঢালা বা কংক্রিটের কোনো রাস্তা ছিল না। শহরের পোস্ট অফিস থেকে সুজানগর যেতে হতো ইট বিছানো ওই হেরিং বোনের রাস্তা দিয়ে। যদি সুজানগর থেকে কেউ আসতেন, সেই যাত্রীর হাতের ডান পাশে পড়ত চন্দ্রিমা কুঠির। আজিম চৌধুরীদের বিশাল পুকুর, পুকুরসংলগ্ন মসজিদটির যার বয়স আনুমানিক দুইশ-আড়াইশ বছর। সেই মসজিদের ঘাটটির পূর্বে-পশ্চিমে দুটি মাঝারি সাইজের কামান বসিয়েছিলেন স্বয়ং আজিম চৌধুরী। আমরা কয়েক বন্ধু প্রায়শই যেতাম কামান দুটির শরীর নেড়েচেড়ে দেখতে। তখনো পাবনা-ঢাকা রোড হয়নি। চৌধুরীদের সেই পুকুর থেকে একটু পশ্চিম দিকে এগোলেই শহরের ফায়ার ব্রিগেড অফিস ও থাকার জায়গা অগ্নিনির্বাপকদের। দেশ ভাগের আগে ওই ভবনটির মূল মালিক ছিলেন চাটমোহরের বিখ্যাত জমিদার পরিবার। ওই পরিবারেই ছেলে প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রীর গৃহকর্তা, প্রমথ চৌধুরী, আরেক ভাই আশুতোষ চৌধুরী। সম্ভবত তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। অথবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। শীতকালে ওই ফায়ার ব্রিগেডের ছোট পরিসরের মাঠটিতে হরেকরকমের গোলাপ আমরা দেখতে পেয়েছি আমাদের শৈশব কৈশোরে, আর ওই ভবনটির উত্তরদিকেই ছিল আমাদের ‘হায়দার’ পরিবারের বড় জামাই মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন মণ্ডলের নারিকেল, পেয়ারা, আমগাছওয়ালা, করগেটেড টিনের একটি বাড়ি, আমাদের ভগ্নিপতি ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, সেই সুবাদে পাড়ার হিন্দু মুসলমান সবার সঙ্গেই ছিল কমবেশি পরিচয়। ভগ্নিপতির বাড়ির পশ্চিমে ‘সিদ্ধার্থ লজ’ নামের একটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি ছিল। ওই লজেরই এক ছেলে সিদ্ধার্থ [১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানের বোমায় ওই বাড়িটি এবং আরেকটি হলুদ দোতলা বাড়ি বিশাল পুকুর হয়ে গিয়েছিল] মহল্লার নাম দিলালপুর, আর ফায়ার ব্রিগেডের পেছনের মহল্লাটির নাম ঘোষপাড়া। ঘোষপাড়ার উত্তরে ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য গির্জা, সেটিও ছিল দৃষ্টিনন্দন। ঘোষপাড়া, দিলালপুর এই দুই মহল্লায় হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সবাই ছিলেন নিকটজনের মতো। বিশেষত বিভিন্ন পালা পার্বণে। সবাই আমন্ত্রিত হতেন সেসব আনন্দ উৎসবে। মুসলমান সম্প্রদায়ের রোজার ঈদে আমরা ভাই বোনেরা আমাদের বড় আপার দিলালপুরের বাড়িতে যেতাম, ভগ্নিপতি নিজেই নিয়ে যেতেন গোস্ত পোলাও খাওয়ানোর জন্য এবং পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলে এক আনা, দু’আনা চার’আনা দিতেন ঈদী হিসেবে, সে, যে, কি— আনন্দের কথা লিখে বোঝানো অসম্ভব।

একদিন বড় আপা রিজিয়া খাতুন সন্ধ্যার কিছু পরে আমাকে বললেন, চল যাই বেড়িয়ে আসি, মহিতোনের বাড়ি থেকে, আমরা দুই ভাইবোন মাত্র দুই/তিন মিনিট পথ হেঁটে যে বাড়িটিতে এলাম সেই বাড়ির নামই চন্দ্রিমা কুঠির। এই দোতলা ভবনের ঠিক দক্ষিণের লাল একতলা বাড়ির এক ছেলে যিনি অকৃতদার এবং তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পাবনার আঞ্চলিক নেতা ছিলেন এবং তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষে ফিরে এসে বোধ হয় কিছুদিন অধ্যাপনা করেছিলেন এডওয়ার্ড কলেজে। নাম প্রভাস লাহিড়ী। প্রভাস লাহিড়ীর বাড়ির উত্তর দিকেই হলো চন্দ্রিমা কুঠির। সেই কুঠিরের এক ছেলে শ্রী মধু মজুমদার, তিনি লেখাপড়া শেষে ব্রিটিশ ভারতে আইসিএস হয়ে বিলেতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি বলে শোনা গিয়েছিল। ইতিমধ্যে ৪৬-এর দাঙ্গা হিন্দু মুসলমানদের ভিতরে বিভেদ, যার ফলশ্রুতিতে খুবই কম মূল্যে ওই চন্দ্রিমা কুঠির বিক্রি করে দিয়ে মজুমদার পরিবার পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ওই বাড়িটির ক্রেতা ছিলেন মোকারম হোসেন। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী।

 

 

রিজিয়া এবং মহিতোন বেগম উভয়েই ছিলেন পূর্ব পরিচিত, কারণ মহিতোন বেগমদের বাড়ি ছিল আরিফপুরে। আমার পিতার বানানো আরিফপুর প্রাইমারি স্কুলে একই সঙ্গে দুজন পড়তেন, বড় আপা এবং তার বান্ধবী মহিতোন। আমাদের পিতা ছিলেন ব্যবসায়ী এবং ৩০ দশকে ছিলেন দোগাছি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং মুসলিম লীগের নেতা। সে কালের রীতি অনুসারে আমাদের বড় আপার বিয়ে হয়েছিল ১৪-১৫ বছর বয়সে এবং তার বান্ধবী রূপসী হওয়ার সুবাদে তারও বিয়ে হয়েছিল ১৩-১৪ বছর বয়সেই। শহরের মহিষের বাথান সংলগ্ন শয়তান পাড়ার তরুণ ব্যবসায়ী মোকারম হোসেনের সঙ্গে, দেশ ভাগের অনেক আগে তবে সৌভাগ্যের বিষয় সেই বান্ধবীর দুটি বাড়ির দূরত্ব ছিল হাঁটা পথে দুই থেকে তিন মিনিটের পথ। সেই সুবাদে বড় আপার সঙ্গে একদিন গিয়েছিলাম তার বান্ধবীর চন্দ্রিমা কুঠিরের দোতলায়। গিয়ে দেখি একটি কলের গান, গ্রামোফোন। অপরটি রেডিও, সেই আমার জীবনে প্রথম গ্রামোফোন এবং রেডিও দেখা এবং একই সঙ্গে দেখতে পেলাম অনেকগুলো গানের রেকর্ড। সেই রেকর্ডের ঠিক মাঝখানে দেখি বসে আছে প্রভুভক্ত কুকুর। রেডিওটির ডানদিকে দেখলাম এক সিংহের মনোগ্রাম। রেডিওটির নাম সম্ভবত ছিল ফিলিপস্, সাইজ মোটামুটি একটি বড় বালিশের মতোই, রেডিও তার আগে দেখিনি, যেমন দেখিনি গ্রামোফোন বা কলের গান। সেদিন আমার মনে হয়েছিল রেকর্ডের উপরে বসে থাকা প্রভুভক্ত কুকুরটি বোধ করি তার প্রভুর গান শোনার জন্যই সারাদিন সারারাত বসে থাকে কখন প্রভু গান গাইবে। আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল বড় আপার বান্ধবীকে জিজ্ঞাসা করতে কুকুর কি নিজে গান গায়? নাকি গান শোনে। পাছে আপার বান্ধবী, তিনি আমাকে ছাগল ভাবেন তাই সে কথা জিজ্ঞাসা করেনি। এত কাছে থেকে রেডিও, কলের গান দেখিনি বলেই ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু সেই ইচ্ছেটুকু এগোতে দিলাম না, কেননা বান্ধবী জেনে নিলেন, আমার নাম, কোন ক্লাসে পড়ি, কোন স্কুলে। এক সময় দুই বান্ধবী যখন তাদের পুরনো দিনের স্কুলের স্মৃতির ভিতরে ফিরে গেলেন তখন আমার ভালো লাগছিল না। শুধু বার দুয়েক ইচ্ছা হয়েছিল গান শুনতে। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ডের প্রভুভক্ত কুকুরের প্রভুর কণ্ঠে। আবার রেডিওর ভিতরে যারা কথা বলেন, সেটিও ছিল আমার ইচ্ছার ভিতরে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি বাড়ির কাজের মেয়েটি একটি ট্রে-তে অনেকগুলো রসগোল্লা, রাজভোগ এবং পানি নিয়ে এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। মিষ্টি দেখেই মনে হলো সবগুলো যদি খেতে পারতাম! মিষ্টিগুলো আমাকেই দিয়েছিলেন মোকারম হোসেনের স্ত্রী। তখন আমি পাবনা জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র সেই ১৯৫৬ সালে।

এমন সময় মিসেস মোকারমের বড় মেয়ে মনোয়ারা বেগম নীলা, নিচতলার পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে উপরে এসে বড় আপাকে বললেন, খালাম্মা কেমন আছেন, শিউলিকে সঙ্গে নিয়ে এলে আমরা দুই বন্ধু গল্প করতে পারতাম আপনাদেরই মতো। আমাকে দেখিয়ে সেই নীলা, আপার কাছ থেকে জানতে চাইলেন ছেলেটি কে, বড় আপা জানালেন আমার ছোট ভাই নাম রোকন, জিলা স্কুলে পড়ে। নীলা বললেন, আমি শুধু দুলাল মামাকেই চিনি [দুলাল রশীদ হায়দার] শিউলিই একদিন আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আপনাদের বাড়িতে।

আনোয়ারা বেগম শিউলি, তার বান্ধবী মনোয়ারা নীলা দুজনই পাবনা গার্লস হাইস্কুলে সপ্তম অথবা অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। ওই চন্দ্রিমা কুঠিরের বেশ কিছু উত্তরে একজন রুটি বিস্কুট কোম্পানির মালিক কফিল উদ্দিন আহমদের বাড়িতে ছিল বেশ কয়েকটি মায়াবী চোখের হরিণ। আমার সহপাঠী ভবানী সাহার চারতলার বাসিন্দা শেখ আবদুল হাদিও আমাকে একদিন নিয়ে গিয়েছিল সেই মায়াবী হরিণগুলোকে দেখাতে। হরিণের চোখ যে এত মায়াবী হয় আমি জানতাম না, চোখগুলো ভেজা ভেজা যেন এইমাত্র ঘুম থেকে ওঠে এলো। হাদি আর আমি দুজনই দুটি হরিণকে বেশ কয়েকটি লাড়ুয়া বিস্কুট বা খাস্তা বিস্কুট খেতে দিয়েছিলাম। হাদির বাবার ছিল আজাদ বেকারি, শহরের হামিদ রোডে। হাদি একদিন তার ইজের প্যান্টের (ইজের প্যান্ট ফিতাওয়ালা প্যান্ট) দুই পকেটে অনেকগুলো বিস্কুট লুকিয়ে এনে আমাকে কিছু দিয়ে সে কিছু খেয়ে, বলল, চল কফিলউদ্দিনের বাড়ির চোখ ভেজা হরিণকে বিস্কুট খাইয়ে আসি, বিস্কুট খেতে দিয়ে মায়াবী চোখের হরিণ দুটোকে কাছে ডাকতেই এগিয়ে এলো, তখনি খুব ভালো করে লক্ষ করলাম, হরিণ দুটো যেন একটু আগেই কেঁদেছে, তাদের মায়াবী চোখের দুই কোণায় বোধ হলো জল লেগে আছে। আর তখনি শুনতে পেলাম কফিল উদ্দিনের বাড়ির ভিতর থেকে বিশাল ভলিউমে বাজছে একটি গান। গানের প্রথম লাইন ছিল ‘মা আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল’ আমার সেই দিন আশা পুরে ছিল, হরিণ দুটির মায়াবী চোখ দেখে, স্কুলেই শুনেছিলাম মায়াবী হরিণের নাম। মায়া হরিণ, ওই মায়া হরিণের চোখের মতোই ছিল মোকারম হোসেনের বড় মেয়ে মনোয়ারা বেগম নীলার দুটি ভেজা ভেজা মায়াবী চোখ; আমার বড় আপার সঙ্গে নীলাদের বাড়িতে যেদিন গিয়েছি সেদিনই খেয়েছি লক্ষ্মী ঘোষের আমার প্রিয় মিষ্টি রাঘবসই এবং রসভর্তি পানতোয়া, রাঘবসই মিষ্টি ছিল শুকনো, তবে খাঁটি দুধের হওয়ার সুবাদে চাহিদা নাকি শহরবাসীর কাছে বেশি ছিল। রসগোল্লা, চমচম, পেরা, রসকদম প্রতি এককেজির দাম ছিল ২/- টাকা শুধু জিলাপির দাম ছিল ১.২৫/- টাকা। বড় আপা বাদে আমার বড় ভাগনি শিউলির সঙ্গে তার বান্ধবী নীলাদের বাড়িতে সেই ১৯৫৬ থেকে যাতায়াতের সুবিধার্থে বাড়ির কর্তা কোনোদিনই কিছু বলেননি, সেই কালে ওই মোকারম হোসেনের চন্দ্রিমা কুঠিরে গ্রামোফোন বা কলের গান বাদেও ছিল রেডিও এবং একটি হুডবিহীন কালো রঙের মোটর গাড়ি। যে গাড়িতে চড়ে নীলা স্কুলে যেত। এ ছাড়া আরও একটি গাড়িকে দেখতাম স্পোকওয়ালা। সেই স্পোকওয়ালা গাড়িটি খুব ব্যবহৃত না হলেও ওই হুডবিহীন গাড়িটিকে সচরাচর শহরের লোকজন দেখতে পেতেন। নীলার পিতা, নীলাকে গাড়ি এবং বন্দুক চালনা দুটোই শিখিয়েছিলেন। বিপদে আপদে পড়লে মেয়ে যেন বন্দুকের সদ্ব্যবহার করতে পারেন। শিখিয়েছিলেন মোটর গাড়ি চালনা। সেই সুখী পরিবারে হঠাৎ করেই দুর্যোগ নেমে এলো ১৯৬১ সালের মে মাসের ৪ তারিখে। মেয়ে এবং মা খুন হলেন ঘাতকের হাতে। জনাব মোকারম তিনি ব্যবসা উপলক্ষে সেই রাতে ঢাকায় ছিলেন, ঘাতকেরা সেটা জানতেন, নীলার বিছানার পাশেই ছিল গুলি ভরা বন্দুক, সেটি তিনি ব্যবহার করতে পারেননি। ৫ মে সকাল বেলা খবরটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার লোক সেই চন্দ্রিমা কুঠিরে ভিড় জমালেও পুলিশ, মা এবং মেয়ের লাশের কাছে যেতে দেননি, আমরা স্কুল থেকে দল বেঁধে যখন সেই বাড়িটির কাছাকাছি পৌঁছেছিলাম তখনই জানতে পারলাম বাড়ির মালিক, রূপকথা সিনেমা হলের মালিক, চাঁপা মসজিদের কাছে আইস ফ্যাক্টরির মালিক এবং লাহিড়ী মোহনপুরের মিল্ক ভিটার কোম্পানির অংশীদার মোকারম হোসেন ঢাকায়। তবে তিনি ওই দিনই পিআইএর ফ্লাইটে ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী আসেন। পাবনা এসে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন এবং আরও পরে সেই হিজ মাস্টার্স ভয়েজ কোম্পানি রেকর্ড, প্রভুভক্ত কুকুর এবং সিংহ মার্কা রেডিও বাড়ির টেলিফোন সবই লুটপাট হয়ে গিয়েছিল। তবে আমার এখনো মনে পড়ে, এমনকি দেশ, বিদেশের অজস্র মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কখনোই দেখিনি, সেই মনোয়ারা বা নীলার চোখের মতো ভেজা ভেজা চোখ দুটি, নীলাকে আমরা মনো খালা ডাকতাম, যেহেতু শিউলিকেও খালা বলতাম। শহরের উত্তর দিকে হেদায়েতের দোকানে এবং বাণী সিনেমা হলের পূর্ব দিকের কাচারিপাড়ার সুখেন ঘোষের ছিল কলের গানের ব্যবসা, ইন্ডিয়া থেকে ৩ টাকা ৪ টাকায় দুর্গাপূজার সময় আসত ওই প্রভুভক্ত কুকুরের রেকর্ডগুলো, যে রেকর্ডে থাকত হেমন্ত, শ্যামল, কিশোর, সন্ধ্যার, মান্নার, আরতির, আল্পনা এবং পান্নালাল ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত গান ‘আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল’।

সেই প্রভুভক্ত চতুষ্পদ কুকুরের হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ড কারও সংগ্রহে কলের গানসহ ৫-১০টি রেকর্ডও আছে হয়তোবা দুই-একজনের ড্রয়িং রুমে। কিছুদিন আগে সাবেক সচিব মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের (সিএসপি) ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখতে পেলাম প্রভুভক্ত কুকুরসহ কলের গান, তবে আজকাল সচিব মহোদয়ের বনানীর বাড়িতে গেলে, খুব শুনতে ইচ্ছে করে ‘আমার সাধ না মিটিল’, তবে কলের গান রেকর্ড সবই ‘এনটিক্স’ হিসেবেই আছে, যন্ত্রটি অচল। শুধু সচল চতুষ্পদ কুকুরের চেয়ে দ্বিপদ সুবিধাবাদী ভক্ত একদল কুকুর। সুবিধা পেলেই পার্টি বা দল বদল করতে একটুও দ্বিধা করেন না, না করলে নাকি জেল জুলুমের ভয়, সেই ভয়েই স্বেচ্ছায় প্রভুভক্ত হয়ে যান রাতারাতি, যেটি একটি মাত্র দ্বিপদের পক্ষেই সম্ভব। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের সেই কালো রেকর্ডের বুকজুড়ে থাকা প্রভুভক্ত কুকুরেরা তোমরা দীর্ঘজীবী হও, অন্তত আমরা যারা শৈশবে, কৈশোরে তোমাকে দেখেছি এবং জেনেছি কুকুরই একমাত্র প্রভুভক্ত প্রাণী। মানুষ হলে কি দেশে কোনোদিন ৭৫ এর ১৫ আগস্ট আসত অথবা ২১ আগস্ট ২০০৪, আসত না। দেশ ভাগের অনেক আগে, আমাদের শহরে দুটি সিনেমা হল ছিল, এমনকি মালিক ছিলেন মোটর গাড়ির ব্যবসায়ী হিমাংশু বিশ্বাসেরা, হিমাংসু বিশ্বাস পরবর্তীকালে বোম্বের ‘বম্বে টকিজের’ মালিক হয়েছিলেন দেশ ভাগের অনেক আগেই। বিশ্বাসদের সিনেমা হলটির নাম ছিল ‘রূপকথা’ আর অপরটির নাম ছিল ‘অরোরা’, উভয় মালিকই অর্থের বিনিময়ে সিনেমা হল দুটি বিক্রি করে পাড়ি জমিয়েছিলেন ভারতে। ৪৭-এ অরোরার নাম বদলে রাখা হয়েছে বাণী সিনেমা হল, যার মালিক ছিলেন উর্দুভাষী জনৈক ইউনুস। আর রূপকথা সিনেমা হলের মালিক হয়েছিলেন মোকারম হোসেন। তবে তিনি সিনেমা হলটির নাম পরিবর্তন না করে পূর্বের মালিকের দেওয়া নামটি বহাল রেখেছেন। ব্রিটিশ ভারতে মোকারম হোসেনের বড় ভাই মোকলেসুর রহমান তিনি কলকাতার পার্ক সার্কাসে বাড়িঘর করে স্থায়ী হতে চেয়েছিলেন। তার ছোট দুই ভাই মোকারম হোসেন ও মোশারফ হোসেনসহ মোকলেছুর রহমান ব্যবসায়ী হওয়ার সুবাদে ছোট ভাইদের জন্য পাবনা শহরে একটি সিনেমা হল, একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরি এবং বৃহত্তর পাবনার লাহিড়ী মোহনপুরের মিল্কভিটা দুধ কোম্পানির অংশীদার হয়েছিলেন। নিজে অকৃতদার হলেও অনুজদের সংসার জীবনের পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি। যতদূর শুনেছি পরে দ্বার গ্রহণ করেছিলেন। অপরদিকে ৬০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে নতুন একটি সিনেমা হল বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন, পাবনার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ট্রপিক্যাল বিল্ডার্সের মালিক আবুল মনছুর। প্রস্তাবিত সিনেমা হলটির নামও রাখা হয়েছিল ‘ইছামতি’। ৬০ দশকের গোড়ার দিকে ঢাকার শ্যামলীতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ডুপ্লেক্স বাড়িটি মনছুর সাহেব বানিয়েছিলেন, নামও দিয়েছিলেন ইছামতি হাউস। তৎকালীন ওই দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি দেখার জন্য অনেক দর্শনার্থী আসতেন, মাঝে মাঝে সিনেমা শুটিং হতো। একদিন আমি সাইকেলে চড়ে ওই ইছামতি হাউসের সামনে দিয়ে যেতে দেখি সিনেমার শুটিং হচ্ছে, সেই প্রথম দেখলাম অভিনেতা সুদর্শন গোলাম মোস্তফাকে। সেই সময় শ্যামলীর উত্তরে খালবিল ছিল, ছিল না তেমন কোনো বাড়িঘর, অর্থাৎ ঢাকা শহর ওই মুহূর্তে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ওইটুকুই ছিল। প্রস্তাবিত ইছামতি সিনেমা হলের পাশের প্লটেই ছিল পাবনা শহরের একটি দৃষ্টিনন্দন হোটেল, যার নাম ছিল ‘তৃপ্তি নিলয়’। তৃপ্তি নিলয়ের মালিক আবু সাঈদ তালুকদার এবং রূপকথা সিনেমা হলের মালিক উভয়েই নিহত হয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়ার অপরাধে পাবনা অপারেশনের প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যে আবু সাঈদ তালুকদার, ডা. দাক্ষী, উকিল আমিন উদ্দিনসহ অনেকেই। তবে তখন মোকারম সাহেব পালিয়ে পাবনা শহরের পূর্ব দিকে রাজাপুর গ্রামে তার এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিলেও ১৯৭১ সালের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিখ্যাত রাজাকার কমান্ডার শহরের শালগাড়িয়ার ঘেটু মিয়ার হাতে নিহত হয়েছিলেন নাটোরে যাওয়ার পথে। নাটোরে সম্ভবত মোকারম হোসেন তার কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার উদ্দেশ্যে নাটোর গিয়ে পৌঁছানোর আগেই ঘেটুকে কে-বা-কারা জানিয়েছিল, মোকারম হোসেন পালিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ সাহায্য দেওয়ার জন্য। দুর্ভাগ্য তাকে নিহত হতে হয়েছিল রাজাকার ঘেটুর রাইফেলের গুলিতে। আমার কলেজজীবন শুরুর ইচ্ছে ছিল পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। কিন্তু দুই অগ্রজ জিয়া ভাই ও রশীদ ভাই তারা চেয়েছিলেন আমি ঢাকার আর্ট কলেজে ভর্তি হই, এডওয়ার্ড কলেজে পড়া আর হলো না। একদিন জিয়া ভাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, আর্ট কলেজে জয়নুল আবেদিন স্যারের কাছে। তিনি তখন রাজি হলেন আমাকে ভর্তি করার জন্য, শুধু আমি রাজি হয়নি, আমি শেষ অবধি ওই (১৯৬৫-৬৭) বছর ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়েই পেয়ে গেলাম অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান, অজিত গুহ, শওকত আলী এবং আকতারুজ্জামান ইলিয়াস, হামিদা রহমান, শামসুজ্জামান খান, রাহাত খানসহ বাংলা অধ্যাপকদের এবং ইংরেজির আবদুল মতিন, নলিনী ভট্টসহ বিশিষ্ট শিক্ষকদের, ‘উনারা কোচিং করাতেন না’। তখনকার ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ তখনো এনএসএফ ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্টের জন্ম হলেও পরিচিতিটা পায়নি, যেমন পেয়েছিল— ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এবং ছাত্রলীগ। সেই ছাত্রলীগের কলেজ শাখার ভিপি ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। কাজী আরেফ আহমেদ, সুধীর হাজরা, বিমান দাশ, লক্ষ্মী বাজারের স্থায়ী নাসির সরদার আর শেলী ভাই। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পরে ১৯৬৬ সালের জুন মাসের ৬ তারিখে জীবনে প্রথম টিয়ার গ্যাস খেয়েছিলাম। আমি আর গাজী আজিজুর রহমান, পাকিস্তানের দয়াবান বাঙালি পুলিশ, আমাদের জীবনের প্রথম টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজ বুঝিয়েছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের দিকে গ্যাস ছুড়ে মারা, দুর্ভাগ্যবশত বাতাস বৈরী হাওয়াতে গ্যাস এসে ঢুকল মুড়ির টিন মার্কা যাত্রীদের দিকে। ওইদিন কলেজে পৌঁছতেই রাজু ভাই সুধীর হাজরা আর ছাত্র ইনিয়নের কলেজ শাখার সভাপতি মতিউর রহমান, কাজী আরেফ আহমেদরা, আমাদের কলেজের সব ছাত্রছাত্রীদের ডেকে জানালেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফার আন্দোলনের প্রাক্কালে জনগণের ওপর টিয়ার গ্যাস ছোড়ার নির্দেশ দিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খাঁন।

জুন ১৯৬৬-এর মাস কয়েক পরেই আমাদের অগ্রজ জিয়া হায়দার পাড়ি দিলেন আমেরিকায় হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলার ওপর তিন বছরের শিক্ষা গ্রহণের জন্য। ফুল ব্রাইড স্কলারশিপের অধীনে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র বাঙালি যিনি নাট্যকলা বিষয়ে শিক্ষা সমাপ্তি শেষে দেশে ফিরলেন ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে। ঢাকায় এসে বানালেন, ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ নামক একটি থিয়েটার প্রতিষ্ঠান এবং তিনি হলেন প্রতিষ্ঠিত সভাপতি। পরের ইতিহাস আরও দীর্ঘ, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়কে নিয়ে যা হায়দার পরিবারের জন্য দুঃখের এবং বেদনাময়। কতিপয় নাট্যকর্মী উড়ে এসে জুড়ে বসে প্রতিষ্ঠিত সভাপতিকে বহিষ্কার করলেন আশির দশকে। তারপর থেকে আমরা হায়দার পরিবারের সদস্যরা একবারের জন্য মনে আনি না সেই অতীত কাল। তবে আমাকে এক অতীত পিছু ডাকে বারবার। পাবনায় গেলেই এডওয়ার্ড কলেজে না গেলে আমার ভালো লাগত না, কেননা তখন ওই কলেজে আমার পছন্দের এক পরী লেখাপড়া করত। সেই বছর শীতের সকালেই ওই কলেজে গিয়ে দেখি কলেজের বিশাল মাঠে ক্রিকেট খেলছে আমার বন্ধু রাঙা। আমাদের সাইদুর রহমান রকু ভাই, নিখিল দা, রাধা নগরের তারা, মাসুদসহ অনেকেই। সেই অনেকের মাঝে দেখি বাবু কাকার ছেলে শামছুল হক। বাণী সিনেমা হলের ম্যানেজার ভানু কাকার ছেলে হারু মোদক, খেলার বিরতিতে শামছুল হক আর হারু একটি সুশ্রী ছেলের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পর্বে জানলাম ছেলেটির নাম স্বপন চৌধুরী, বাড়ি দুলালপুরের আমার বড় ভগ্নিপতির বাড়ির পশ্চিমে। আরও জানলাম, স্বপন চৌধুরীর স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যালস্ লিমিটেডের প্রধান মালিক মি. স্যামসাং চৌধুরীর বড় ছেলে। ওই স্বপন চৌধুরী দিন কয়েক পরে তাদের ভক্সল গাড়িতে করে আমাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখি সেই হিজ মাস্টার্স ভয়েজের প্রভুভক্ত কুকুর নেই। তার পরিবর্তে সেই প্রথম দেখলাম স্যামসাং কাকা সদ্য বিদেশ থেকে কিনে এনেছেন বিশাল একটি ‘গ্রুন্ড্রিগ’ গান শোনার কলের গান। ওই ‘গ্রুন্ড্রিগ’ এ একটি লং প্লে চাপালে একসঙ্গে ১২টি গান শোনা যেত। স্বপন আর আমার কথার মাঝখানে এসেই উপস্থিত হলেন সুদর্শন সুপুরুষ সেই আধুনিক শৌখিন মানুষটি। জনাব স্যামসাং এইচ চৌধুরী একটু পরে এলেন অনিতা মাসিমা সঙ্গে কিছু মিষ্টি নিয়ে। সময়টা ছিল ১৯৬৮-৬৯ সালে অর্থাৎ মফস্বলের অবস্থাপন্নদের গৃহেই ছিল কলের গান। আর হিজ মাস্টার্স ভয়েজের সেই প্রভুভক্ত কুকুর। তবে কলের গানকে চালাতে হতো হ্যান্ডেলের চাবি দিয়ে। বিশাল একটি তামার চোঙার ভিতর থেকে ভেসে আসত আব্বাস উদ্দিনের, হেমন্ত, লতা, সন্ধ্যা, এমনকি কে এ সায়গল আঙ্গুরবালা, কাননবালা, কানা কৃষ্ণদে যিনি ছিলেন গায়ক মান্নাদের আপন কাকা। আরও শোনা যেত পান্না লাল ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত গানটি ‘মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল’।

১৫/২/১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ তার পশ্চিম যাত্রীর ডায়রিতে আমাদের জানিয়েছেন ‘যাকে উদাসীনভাবে দেখি তাকে পুরো দেখি নে, যাকে প্রয়োজনের প্রসঙ্গে দেখি তাকেও না, যাকে দেখার জন্য দেখি তাকেই দেখতে পাই’। আজকাল আমি দেখার জন্য চেষ্টা করি আমার লেখাপড়ার স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সেই সঙ্গে হিজ মাস্টার্স ভয়েসের প্রভুভক্ত কুকুরটিকে। আজকাল প্রভুভক্ত দ্বিপদ কুকুরের অভাব নেই। সেই দ্বিপদরা গুম, খুন করতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। যেমন— ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সেদিন কবি জীবনানন্দের ‘হায় চিল’ কবিতা পাঠ করতে গিয়ে মনে হলো হিজ মাস্টার্স ভয়েজের সেই প্রভুভক্ত কুকুরের কথা। ‘হায় চিল’ বিখ্যাত কবিতাটির সেই চরণ আমাকে এখনো খুব কাঁদায়।

কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।

     লেখক : কবি

সর্বশেষ খবর