পুরান ঢাকার দেবীদাস ঘাট লেন। শত শত কারখানায় কোথাও প্লাস্টিক পণ্য রিসাইকেল করে তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক দানা, কোথাও পলিথিনের রোল, কোথাও পলিথিনের শপিং ব্যাগ। আবার একই কারখানার ভিতরে এক পাশে হচ্ছে প্লাস্টিক দানা, অপর পাশে পলিথিন ব্যাগ। পুরো এলাকা যেন পলিথিনের খনি। শুধু এই এলাকাই নয়, গত দুই দিনে সরেজমিন পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ, ইসলামবাগ, কামালবাগ, চানখাঁরপুল, সোয়ারীঘাট এলাকা ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেছে। এখান থেকে তৈরি হওয়া নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যাগ কয়েক হাত ঘুরে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি পলিথিন ব্যাগ বন্ধে আগামী ১ নভেম্বর থেকে বাজার ও কারখানাগুলোতে অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। বাকি আছে ১৪ দিন। তবে এখন পর্যন্ত কারখানাগুলোতে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন বন্ধের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সরানো হয়নি মেশিনারিজ। পলিথিন ব্যাগ বিক্রির পাইকারি ও খুচরা দোকানগুলোও চলতে দেখা গেছে আগের মতোই। গতকাল চকবাজার ও আশপাশের এলাকার দোকান-শপিং মল বন্ধ থাকলেও পলিথিন কারখানাগুলো ঠিকই চালু ছিল। চকবাজার টাওয়ারের পেছনে পলিথিন বিক্রির কয়েকটি পাইকারি দোকানও খোলা দেখা যায়। একই স্থানে পলিথিন ব্যাগ বিক্রির কয়েক শ দোকান গড়ে ওঠায় লোকমুখে জায়গাটির নাম হয়ে গেছে ‘পলিথিন পট্টি’। ঢোকার মুখেই একটি দোকানে ক্রেতা সেজে দরদাম শেষে দোকানদারের কাছে জানতে চাওয়া হয়- আগামী মাসে পলিথিন ব্যাগ বন্ধ হলে কি ব্যবসা করবেন? জবাবে তিনি বলেন, এ দেশে পলিথিন কখনো বন্ধ হবে না। বন্ধই যদি হতো, এই মার্কেটের কয়েক শ দোকানদার এত দিনে নতুন ব্যবসা শুরু করত। কোনো কারখানায় উৎপাদন থামেনি। তার সঙ্গে কথা বলার পর নিকট দূরত্বে দেবীদাস ঘাট লেনে গিয়ে দেখা যায় মূল সড়ক, শাখা সড়ক, অলিগলিতে, বাড়ির ছাদে ছাপড়া তুলে, ফ্ল্যাটবাসায় মেশিন বসিয়ে তৈরি হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। প্লাস্টিক দানা তৈরির কারখানাগুলোর দরজা খোলা থাকলেও অনেক কারখানার দরজা ছিল বন্ধ। সাংবাদিক পরিচয়ে কয়েকটি কারখানার দরজা ঠেলে ঢুকতে গেলে বাধার মুখে পড়তে হয়। পরবর্তীতে গ্রামে কারখানা দেওয়ার জন্য পলিথিন তৈরির পুরনো মেশিনের ক্রেতা সেজে ঢোকার সুযোগ হয় কয়েকটি কারখানায়। দরজা বন্ধ করে ভিতরে তৈরি হচ্ছিল পলিথিনের ব্যাগ। কেউ পুরনো মেশিন বিক্রি করবেন কি না এমন প্রশ্নে অধিকাংশই জানান, এখন পর্যন্ত কোনো মালিক মেশিন বিক্রির সিদ্ধান্ত নেননি। প্রতিদিনই কয়েক হাজার পাউন্ড করে পলিথিন ব্যাগের অর্ডার আসছে। কামালবাগে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। সেখানকার এক কারখানার কর্মচারী তিন ধরনের পলিথিন ব্যাগের জন্য পুরনো দেশি মেশিন ১৫ লাখ টাকায় ও চায়না মেশিন ৩০ লাখ টাকায় জোগাড় করে দিতে পারবেন বলে জানান। সারা দেশে এমন পলিথিন কারখানা কতগুলো আছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কোথাও মেলেনি। তবে ঢাকা মহানগরী প্লাস্টিক কারখানা কর্মচারী ও শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হাজী মো. জাকির হোসেন মৃধা জানান, শুধু ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ৩ হাজারের বেশি কারখানা আছে। তবে এর মধ্যে অনেকগুলো আবার শুধু প্লাস্টিক দানা তৈরি করে। ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন কারখানার বিরুদ্ধে অভিযানের ঘোষণার পরও উৎপাদন বন্ধ না প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২২ বছর আগে আইন করে এগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এত বছরে কেউ বন্ধ করতে পারেনি, দেড়-দুই বছরে এই সরকার কীভাবে করবে? তিনি বলেন, নিষিদ্ধ করায় কয়েকটা শ্রেণির লাভ হয়। আগে শুধু শ্রমিক বেতন আর বিদ্যুৎ বিল দিলে কারখানা চালানো যেত। নিষিদ্ধের পর বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত টাকা দিতে হয়েছে, রাজনৈতিক নেতাদের দিতে হয়েছে, বিভিন্ন এনজিওকে দিতে হয়েছে। এতে খরচ বাড়ায় ডাস্টবিন থেকে মল-মূত্রযুক্ত প্লাস্টিক তুলে এনেও পলিথিন ব্যাগ বানাতে হচ্ছে। পলিথিন বন্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, এটা হলে আমরাও সরকারের পাশে আছি। কিন্তু সরকার গেজেট করে সব ধরনের প্লাস্টিক বন্ধের জন্য তালিকা করেছে। এটা সম্ভব নয়। এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩০-৪০ লাখের বেশি মানুষের রিজিক জড়িত।
তবে সব ধরনের প্লাস্টিক বন্ধ নিয়ে সৃষ্টি হওয়া বিভ্রান্তি দূর করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুরুতেই আমরা সব ধরনের প্লাস্টিক বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলছি না। এত বড় ইন্ডাস্ট্রি একবারে তো বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধ করতে চাচ্ছি। এটার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। প্লাস্টিকের ব্যাগের বদলে আমরা পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে চাচ্ছি। এটা নিয়ে শপিং ব্যাগ উৎপাদনকারীদের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। তারা এক মাস সময় চেয়েছিল, সেটা তাদের দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্লাস্টিক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি। গর্ভবতী মায়ের দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিলছে। মাটি, পানি, সার্বিকভাবে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া সামনে তো প্লাস্টিক দিয়ে প্যাকেজিং করে পণ্য রপ্তানিও করা যাবে না। তাই আগে থেকেই আমাদের বিকল্পের দিকে যেতে হবে। প্লাস্টিকের মোড়কে চিপস, বিস্কুটসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, কসমেটিক্স বিক্রি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোকে প্যাকেজিংয়ের ডিজাইন বদলাতে হবে। প্যাকেটে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে রিসাইকেলে গুরুত্ব দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে আমরা সেদিকে যাব। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর ভিত্তিতে ২০০২ সালে পলিথিনের তৈরি ব্যাগের ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন ও পরিবহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দন্ডও হতে পারে। পলিথিন বাজারজাত করা হলে ছয় মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা। কিন্তু বাস্তবে আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহারের নজির এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। উল্টো বেড়েছে আইন নিষিদ্ধ এ পলিথিন ব্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহার।