আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে 'সময় এখন নারীর' শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় মেতে উঠেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সফল নারীরা। ছিলেন শিক্ষক থেকে শুরু করে আলোকচিত্রী, গণমাধ্যমকর্মী, ডাক্তার, ফুটবলার, ক্রিকেটার, ছিলেন নারী রাজনীতিবিদও। 'সময়টা এখন নারীর না নারীর নয়' বিষয়টি নিয়ে নিজস্ব প্রেক্ষাপট থেকে তারা বক্তব্য দিয়েছেন। বুধবার সকালে ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কনফারেন্স কক্ষে ওই বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এতে সঞ্চালনা করেন লেখক ও সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী। ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নিউজ টোয়েন্টিফোর ওই বৈঠকের আয়োজন করে।
এতে কবি শামীম আজাদ বলেন, সময় সব সময় নারীর ছিল, এখনো অাছে। নারীর সাধ্য আছে, মায়ের সাধ্য আছে। প্রবাদ আছে, 'তোর বাপের সাধ্য নাই'। বাপের সাধ্য না থাকলেও মায়ের সাধ্য ঠিকই আছে। শিশু জন্মের পরেই তার মাকে দেখে। ৬৬ বছরের জীবনে কোনও শূন্যস্থান রাখিনি। সবকিছু ন্যায়ের ভিত্তিতে করেছি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রহিমা আক্তার লাকি বলেন, সময় শুরু হয়ে গেছে, নারীর লড়াই শুরু হয়ে গেছে। নারীকে এখনও প্রমাণ দিয়ে কাজ করতে হয়। কারণ ছেলেদের ক্ষেত্রে আগেই ভাবা হয়, সে ছেলে সে পারবে। মেয়েদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক রূপা চক্রবর্তী বলেন, নারী ভুলে গেছে যে সে মানুষ। পৃথিবীর সমস্ত শক্তির আধার নারী। কিন্তু আমাদের নারীরা নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আর এজন্যই বলছি সময় এখন নারীর নয়। তার স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হচ্ছে পরিবারের চাপেই। পেশাগত ক্ষেত্রে নারীর বিচরণ আগে সংক্ষিপ্ত ছিল। আগে তারা হয় ডাক্তার নয়, শিক্ষক হতো। এখন সবক্ষেত্রে নারীর বিচরণ। কিন্তু পুরুষের সমান নয়।
জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক সহ-অধিনায়ক জেসি বলেন, আমার বাবা-মা যদি সমর্থন না দিতো তাহলে আমি কখনো এত দূর আসতে পারতাম না। আমার এই উঠে আসার পেছনে আমার বাবা-মায়ের অনেক ভূমিকা রয়েছে। আমি আমার সন্তানকে মেয়ে নয়, মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। খেলাধূলা শুরুর পর আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। তবে যখন দেশ-বিদেশ অনেক সম্মান পাচ্ছিলাম তখন তারাই বাহ্ববা দিয়েছে। আমি মনে করি আমরাও একদিন ছেলেদের সব অর্জনকে ছুঁয়ে ফেলতে পারব।
ইউনাইটেড হাসপাতালের ডিরেক্টর ও চিফ অব কমিউনিকেশন অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ডা. সাগুফা আনোয়ার আরও বলেন, নারী স্বাস্থ্য সচেতন নয়, নিজের ব্যাপারে স্বাস্থ্য সচেতন নয়, কিন্তু স্বামী- সন্তান ও পরিবারের অন্য সবার ব্যপারে স্বাস্থ্য সচেতন। আসলে সে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন হওয়ার সময়ই খোঁজে পায় না।এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের তালিকায় সবার নিচে স্থান হয় নারীর। তাই পরিবারের সহযোগিতা দরকার। নারী প্রতি বৈষম্য, ব্যক্তির বৈষম্য। মা-বাবার নয়, পরিবারের নয়। এটা ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন রকম হয়।
ফুটবলার পিংকী সানোয়ার বলেন, আমি যে প্রেরণা পেয়েছি তার পেছনে ছিলেন বাবা। বাবাই আমাকে জোর করে ফুটবল মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় হলো সেই খেলাটা আমাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। যার পেছনে মূল কারণ ফুটবল কর্তৃপক্ষের অবহেলা। ২০১০ সালে ফুটবল ছেড়ে দিয়েছি। নারীদের ক্রিকেটা এগিয়েছে সেভাবে ফুটবলটা এগিয়ে যায়নি। খেলোয়াড়দের কাছে কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু নারী ফুটবলারদের তারা ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দেয় না। যা হয় লোকদেখানো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জিনাত হুদা বলেন, যে নারীকে আপনি সফল বলছেন তার সাফল্যের পিছনেই অনেক কাঁটা-নুড়ি বিছানো। এর মধ্য দিয়েই নারী এগিয়েছে। সমাজে যেসব নারী এগিয়ে গিয়েছেন তাদের লক্ষ্য করে পুরুষরা অনেক বক্র কথা বলে। আমি নারী-পুরুষের বিভাজনে বিশ্বাসী নই। আমার মতো অনেকেই আছেন। কিন্তু এটাই বাস্তব চিত্র নয়। একটি কন্যা শিশুর মা হয়ে আমি গর্বিত। কিন্তু অনেক জায়গাতেই আছে যে ভ্রুনটা নারীর হলে তাকে জন্মই দেয়া হচ্ছে না।
সংসদ ভবনের জনসংযোগ কর্মকর্তা লাবণ্য আহমেদ বলেন, প্রতিবন্ধকতা থাকে। সমাজে এগিয়ে যেতে হলে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে হবে। তাহলে সাফল্য এসে ধরা দেবে। তবেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখছি সেটি বাস্তব হয়ে ধরা দেবে।
আলোকচিত্রী কাকলী প্রধান বলেন, একদিন হয়তো মানুষ দিবস হবে। পুরুষ দিবস হবে। সময়টা এখনো নারীর নয়। তাহলে এত নির্যাতিতা নারীর ছবি তুলতে আমাদের বার্ন ইউনিটে দৌড়াতে হতো না।
সংসদ সদস্য নূরজাহান বেগম মুক্তা বলেন, গ্রামে প্রবাদ আছে, 'ভাগ্যবানের বউ মরে অভাগার মরে গরু'। উপমহাদেশে এটিই ছিল নারীদের অবস্থা। যে জায়গায় পরিবর্তন এসেছে। 'সময় এখন নারীর' এটা জোরগলায় বলতে চাই। সময় আগেও নারীর ছিল কিন্তু সেই সময়ের স্রোতে নারীরা ভাসতে পারেনি। কিন্তু তাতে এখন পরিবর্তন এসেছে। নারীর ক্ষমতায়নকে মানুষ ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে। তবে গণমাধ্যম কতটা নারীবান্ধব সেটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। রাজনীতিবিদ হিসেবে মিছিল-মিটিং করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। সেটি গণমাধ্যমে আসে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নিউজ টোয়েন্টিফোরের হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সামিয়া রহমান বলেন, আমি নারীবাদ-পুরুষবাদে বিশ্বাসী নয়। মানুষের অধিকারে বিশ্বাসী। এগিয়ে থাকা গোষ্ঠীই কেবল বলতে পারে সময়টা এখন নারীর। কিন্তু বাকিরা এখনো পিছিয়ে। অনেকেই বিশ্বাস করেন নারী পুরুষের গুণাবলী আলাদা। নারী গর্ভধারণ করতে পারে। আর নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা কেবল পুরুষের। কিন্তু বাস্তবতা হল নারী ছাড়া যেমন পুরুষ চলতে পারে না তেমনি পুরুষ ছাড়াও নারী চলতে পারে না। নারী-পুরুষ সমানতালে এগিয়ে গেলেই এ সমাজ এগিয়ে যাবে।
সাবেক ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন কামরুন নাহার ডানা বলেন, প্রথমেই পরিবার থেকে আসতে হবে। ছেলে -মেয়ে উভয়কেই মানুষ হিসেবে বড় করতে হবে। তাদের শেখাতে হবে ছেলে-মেয়ে এক। সম্পত্তির বণ্টনটাও যেন সমান হয়। এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
সাবেক এমপি নিলুফার চৌধুরী মণি বলেন, বাবার অনুপ্রেরণা না থাকলে আপনাদের সামনে আসতে পারতাম না। একজন নারী হওয়ার জন্যই অনেক সময় প্রতিযোতিতায় নামতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছি। দলের মধ্যে ধাক্কা খেয়েছি। স্থানীয় সরকার প্রশাসনে নারীরা এখনো পিছিয়ে। যারা নির্বাচিত হয়ে প্রশাসনে যোগ দেন তাদের ক্ষমতা থাকে না। পরবর্তীতে নির্বাচনে দাঁড়াতে তারা উৎসাহ পান না। ক্ষমতার অভাবে জনগণের জন্য কিছু করতে পারেন না বলে ভোটাররাও তাদের চায় না।
রাজনৈতিক জীবনের নানা চড়াই উতরাইয়ের উদাহরণ তুলে ধরে বিএনপির সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, শিক্ষা জীবনের রাজনীতিতে আমার এমনও মনে হয়েছে, যদি আমি সংগঠনের কোনো পদের জন্য নির্বাচন করি, তাহলে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুও আমাকে ভোট দেবে না। আর তার কারণ আমি একজন নারী।
প্রখ্যাত লেখক ও কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, 'সময় এখন নারীর'- এ কথার সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত নই। বিশ্বজুড়ে নারীর প্রতি মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। মানুষের সভ্যতা সাইকেলের মতো। এই সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে নারী-পুরুষ উভয়কেই দরকার। প্রত্যন্ত গ্রাম ও নিম্নবর্গের নারীদের অবস্থা শোচনীয়। নারী ও শিশুরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের কাছেই নিরাপদ নয়। সমাজকে বদল করতে হবে। এ বদলের দায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষক-রাজনীতিবিদসহ সবাইকে। তৃণমূল থেকেই পরিবর্তনের শুরুটা করতে হবে। এজন্য আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। তবে পুরুষের সমান জায়গায় নারীকে আসতে আরও কতটা সময় পাড়ি দিতে হবে সেটিই এখন ভাববার বিষয়। তবে আশার দিক হচ্ছে অনেক মা আছে যারা সন্তানের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। একজন মা তার একার চেষ্টাতেই অনেক কিছু করছেন। আমরা আসলে অন্ধকার জগতে বাস করছি। নারী এ-ই করতে পারবে, পুরুষ তা করতে পারবে। এই অসম চিন্তা দূর করতে হবে। অন্ধকারে কিছু আলো আছে সেটি আরও বাড়বে। তবেই নারী পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবে।
বিডি প্রতিদিন/৮ মার্চ, ২০১৮/ফারজানা