বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বিএমডিএ

রশীদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

রাজশাহীতে ‘বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’র (বিএমডিএ) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েও যোগদান করতে পারছেন না সরকারি কর্মকর্তা। ১৬ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের পরিচালক (স্থানীয় সরকার) শ্যাম কিশোর রায়কে পদায়ন করা হলেও গতকাল পর্যন্ত তাকে যোগদান করতে দেওয়া হয়নি।

অথচ পাঁচ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে এ পদে থেকে পুরো বিএমডিএ এখন লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন আবদুর রশীদ। তার প্রভাবের কারণেই সরকারি আদেশের পরও যোগদান করতে পারছেন না প্রায় দেড় মাস আগে নিয়োগ পাওয়া শ্যাম কিশোর রায়। শ্যাম কিশোর রায় বলেন, তিনি যোগদান করলে সম্ভাবনাময় বিএমডিএর দুর্নীতি ও লুটপাটের চিত্র বের হয়ে আসতে পারে এ কারণে হয়তো তাকে যোগদানে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এখনো তিনি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যোগদানের অপেক্ষায় রাজশাহীতে অবস্থান করছেন। এদিকে বিএমডিএর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী (ইডি) আবদুর রশীদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি বিএমডিএ ভবনে অভিযানের পর এবার অভিযোগ তদন্তে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদের গড়ে তোলা সম্পদের অনুসন্ধান চালানোর পাশাপাশি যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সেই অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র এরই মধ্যে জব্দ করা হয়েছে।

 খাল খনন, কর্মচারীদের লাঞ্ছিত করার ঘটনায় গৃহীত পদক্ষেপ, অতিরিক্ত বেতন উত্তোলন, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের ফটোকপিসহ দুই কর্মচারীর সার্ভিস বইয়ের ফটোকপি সংগ্রহ করেছে দুদক। পাশাপাশি খাল খননের অনিয়মের তদন্তের খোঁজ নিতে এরই মধ্যে নওগাঁয় সরেজমিন তদন্ত করেছে দুদকের একটি দল। তবে এসব অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে সর্বশেষ সোমবার বরেন্দ্র ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে বক্তব্য খন্ডানোর চেষ্টা করেছেন ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদ। এ সম্মেলনে বিএমডিএর চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। তারা দাবি করেন, বিএমডিএর দুর্নীতি-সংক্রান্ত খবর ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও বিএমডিএ আগেই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। পাশাপাশি উন্নয়নের নামে সরকারি অর্থ লোপাট, ৭৩ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেতনের অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনসহ নানা অভিযোগ করা হয়। এ নিয়ে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ভবনে অভিযান চালায় দুদক। ওই দিন জব্দ করা হয় বেশ কিছু নথিপত্র। সেই সঙ্গে আরও কিছু নথিপত্র চেয়ে পাঠানো হয়। নথিপত্রগুলো হাতে পাওয়ার পর এরই মধ্যে সেগুলো নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

দুদক রাজশাহী কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালকসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনিয়ম-দুর্নীতি ও সরকারি অর্থ লোপাটের অভিযোগের অনুসন্ধানে আমরা কাজ শুরু করেছি। অনুসন্ধান শেষে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’

বিএমডিএর একাধিক সূত্র জানায়, বিএমডিএর বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম তদন্তে সর্বশেষ গত বুধবার দুদকের একটি দল নওগাঁয় অনুসন্ধান চালায়। এ সময় খাল খননের নামে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা সেটি সরেজমিন অনুসন্ধান করে দুদক। এর বাইরে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালকের অবৈধ সম্পদ, গোদাগাড়ী জোন অফিসে কী কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা, ৭৩ কর্মকর্তার অতিরিক্ত বেতন উত্তোলন, রাস্তা পাকাকরণের নামে অর্থ তছরুপসহ সহকারী কোষাধ্যক্ষ রাকিব হোসেন ও খাবিরুদ্দিনের নিয়োগে অনিয়ম তদন্তেও অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।

জানা গেছে, চলতি বছর নওগাঁয় বিলমনসুর, চকপাকুড়িয়া ও পলাশবাড়ী খাল খনন করা হয়। এর মধ্যে বিলমনসুর খালটির আয়তন প্রায় ৯০০ বিঘা। এ খালটি খননের ফলে এলাকার কৃষকদের অনেকটা উপকার হলেও খননকাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এই তিনটি খালের বিপরীতে ছয়টি গ্রুপে প্রায় ৯ কোটি টাকা খরচ করা হয়। এটি করতে গিয়ে ছয়টি গ্রুপের কাজ পাওয়া ঠিকাদারদেরই পরবর্তী সময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে নতুন করে ৭ থেকে ১৬ লাখ টাকা করে অতিরিক্ত হারে অর্থ প্রদান করা হয়। বর্ধিত কাজ দেখিয়ে এই টাকা নয়ছয় করা হয়। এভাবে আরও প্রায় ১ কোটি টাকা তছরুপ করা হয়।

বিএমডিএ সূত্র জানায়, নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদ প্রায় পাঁচ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। এর মধ্যে আছে রাজশাহী নগরীর উপশহরের এক নম্বর সেক্টরে একটি বাড়ি, তেরোখাদিয়া এলাকায় একটি বাড়ি ও নগরীর নাহার স্কুল এলাকায় ১০ কাঠার একটি প্লট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অডিট আপত্তি, কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি প্রকৌশলী ভবন নির্মাণ করেও সেখানে প্রকৌশলী না থাকা, পিপিআর অমান্য করে খ- খ- আকারে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ক্রয়ের মাধ্যমে সরকারি অর্থের ক্ষতিসাধন, গোদাগাড়ীতে প্রায় ৫০ লাখ টাকার হিসাব জালিয়াতি, চলমান প্রকল্পে অনিয়ম, সরকারি পরিপত্র অমান্য করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেতন স্কেল প্রদান ও পল্লী বিদ্যুতের অবৈধ ব্যবহার এমন সাতটি সুনির্দিষ্ট অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়।

এদিকে বিএমডিএর একটি সূত্র জানায়, ভারপ্রাপ্ত আবদুর রশীদকে সরিয়ে তার স্থলে ১৬ অক্টোবর বিএমডিএ নির্বাহী পরিচালক হিসেবে শ্যাম কিশোর রায়কে পদায়ন করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে তাকে পদায়ন করা হলেও রহস্যজনক কারণে মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। ফলে মন্ত্রণালয়ে যোগদান করলেও তিনি বিএমডিএর কোনো দায়িত্ব বুঝে পাননি।

তবে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদ বলেন, এটি মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। আর দুদকের চলা চলমান অনুসন্ধান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটা অফিশিয়াল। দুদক যেসব তথ্য চেয়েছে সেসব দেওয়া হয়েছে। এখন নতুন করে তারা অনুসন্ধান করছে বলে শুনেছি। তারা তাদের কাজ করছে। এখানে আমাদের কিছু বলার নেই।’ তবে তিনি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন, তার কোনো অবৈধ সম্পদও নেই বলে দাবি করেন আবদুর রশীদ।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর