কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থানার সুইটি অভাবের তাড়নায় ঢাকার তানভির-নাহিদ দম্পতির বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজে লাগে। নয় মাস ধরে মেয়েটি কাজ করে। কিন্তু এ সময় প্রায় প্রতিদিনই নানা অজুহাতে এই দম্পতি মেয়েটিকে শারীরিক নির্যাতন করতেন। নির্যাতনে মেয়েটির চোখের নিচে আঘাতের চিহ্ন পড়ে এবং হাতে গুরুতর জখম হয়। এ ছাড়া মেয়েটির শরীরের ইলেকট্রিক ব্যাট দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর মেয়েটির শরীরের নির্যাতনের চিহ্নসহ কিছু ছবি গত ৩ জুলাই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দ্রুত সহযোগিতা চান তানভির-নাহিদ দম্পতির বাসার পাশের এক প্রতিবেশী। বিষয়টি পুলিশের নজরে এলে তানভির-নাহিদকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। এর বাইরে চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে এক চিকিৎসক দম্পতির বাসায় নির্যাতনের শিকার হয় শিশু গৃহকর্মী নিপা। কাজ শুরুর পর বিভিন্ন সময়ে গৃহকর্ত্রী রাখি দাস নানা অজুহাতে শিশুটির ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাতেন। কখনো গরম খুন্তির ছ্যাঁকা, কখনো ছুরির খোঁচা দেওয়া, কখনো দেয়ালে শিশুটির মাথায় ঠোকা হতো। এমনকি শিশুটির গলা চেপে শ্বাসরোধেরও চেষ্টা করা হয়। এই ঘটনায় এই দম্পতিকে আসামি করে মামলা করা হয়।
দেশে বিগত বছরগুলোতে প্রায়ই গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তবে করোনা মহামারীতে নির্যাতনের এই মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। নির্যাতিতদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। এক জরিপে দেখা যায়, গত বছর করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হন শতকরা ৫৫ জন। করোনাকালীন মৃত্যুভয় থাকা সত্ত্বেও গৃহকর্মীদের নির্যাতন তাদের জন্য আরেকটি আতঙ্কের মাত্রা যোগ করে। আবার অনেকেই এ সময় কাজ হারিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েন। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় নিজের সমস্যার কথাও অনেকে কাউকে জানাতে পারেনি। নির্মম নির্যাতনে অনেকেরই মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে করোনায় গৃহকর্মীরা আরও বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
গত এক সপ্তাহে রাজধানীর ভাটারা ও সেগুনবাগিচায় পৃথক দুটি শিশু গৃহকর্মীর নির্যাতনের অমানবিক ঘটনা ঘটে। এ ছাড়াও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত মোট ১৮টি গৃহ শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। আর নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে আটটি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে ছয়জন গৃহশ্রমিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। এ সময় ধর্ষণ করা হয় একজনকে। হত্যা করা হয় ছয়জনকে, আত্মহত্যা করে দুজন এবং শারীরিক নির্যাতনের পর দুজনকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) ‘বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র পরিস্থিতি ও নির্যাতন’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ঢাকাসহ সারা দেশে যারা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে তাদের ৯৫ ভাগের বেশি নারী। আর গৃহকর্মীদের মধ্যে যারা হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৬ থেকে ৩৩ বছরের মধ্যে। তবে নির্যাতনের সব ঘটনা সবসময় সামনে আসে না। কারণ গৃহকর্মী বা তাদের পরিবারের সদস্যরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে মামলা করতে চান না বা সাহস পান না। আবার প্রভাবশালীরা অনেক নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে ফেলেন।
বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, মাথার চুল কেটে দেওয়া, খাবার না দেওয়া, গরম পানি দিয়ে শরীর ঝলসে দেওয়া, ঘরবন্দী করে রাখা, ধর্ষণের মতো নির্যাতনের শিকার হতে হয় গৃহকর্মীদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫ বাস্তবায়ন না হওয়ায় একের পর এক গৃহকর্মীর মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বিচারহীনতার কারণে বারবার গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের সাহস পাচ্ছে। এসব ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে সেই ভয়ে আর কেউ গৃহশ্রমিকদের ওপর নির্যাতন করবে না। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ থাকলেও এর বাস্তবায়ন নেই। গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন বন্ধে নির্যাতনকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে সুবিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি সরকারের কঠোর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।