শুক্রবার, ২৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

রূপগঞ্জে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গাজীর মুঠোয় জিম্মি, মুক্তি চান অভিভাবকরা

হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর উপকণ্ঠের জনপদ রূপগঞ্জে চলছে শিক্ষা নিয়ে বেসাতি। মানহীন শিক্ষক নিয়োগ, তহবিল আত্মসাৎ, মানোন্নয়নে মন্থরগতি আর দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের গুরুতর অভিযোগ আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া ২০১৬ সালে হাই কোর্টের দেওয়া রায় অনুসারে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিরা সভাপতি হতে পারবেন না; যা মানা হয়নি রূপগঞ্জের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। এমপি একাধিক পদে থাকার পাশাপাশি পরিবার, আত্মীয়স্বজন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আর অনুসারীদের প্রধান করেছেন তিনি। এতে ভেঙে পড়েছে সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা। তথ্যমতে, ২০০৯ সালে প্রণীত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালার ৫(২) ও ৫০ বিধি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাই কোর্ট; যার ফলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হিসেবে এমপিদের দায়িত্ব পালন এবং গভর্নিং বডির বিশেষ কমিটিতে তারা থাকতে পারবেন না বলে সে রায়ে আদেশ প্রণীত হয়। অথচ সে রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রূপগঞ্জের অর্ধেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের প্রধান হয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী। শুধু তাই নয়, নিয়মবহির্ভূতভাবে যোগ্য পরিচালক বাদ দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের প্রধান করা হয়েছে তাঁর ছেলে গাজী গোলাম মর্তুজা পাপ্পা, গাজী গোলাম আসরিয়া বাপ্পী, স্ত্রী হাসিনা গাজীকে। অবাক করার মতো ব্যাপার, ছেলের শাশুড়িকেও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি করেছেন গোলাম দস্তগীর গাজী। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার ৪০ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২০ মাদরাসা ও ৫ কলেজের মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এবং তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজন ১১টি প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন। এর মধ্যে গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) ব্রাহ্মণখালীর জনতা উচ্চবিদ্যালয়, ত্রিশকাহনীয় এলাকার ছাত্তার জুট মিলস উচ্চবিদ্যালয় ও মর্তুজাবাদ এলাকার মর্তুজাবাদ ফাজিল মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। মন্ত্রীর স্ত্রী তারাবো পৌরসভার মেয়র হাসিনা গাজী রূপসী এলাকার রূপসী নিউ মডেল উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ, বরপার হাজী নুরউদ্দিন আহমেদ উচ্চবিদ্যালয় ও তারাবোর তারাবো পৌর মাধ্যমিক উচ্চবিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। তাঁর বড় ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পা উপজেলার ভুলতা এলাকার ভুলতা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কাঞ্চন এলাকার হাজী রফিজউদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের নবকিশলয় হাইস্কুল অ্যান্ড গার্লস কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। ছোট ছেলে গাজী গোলাম আসরিয়া বাপ্পী খাদুন এলাকার হাজী আয়েত আলী ভূঁইয়া উচ্চবিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। এমনকি বড় ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পার শাশুড়ি খাদিজা মাহতাব রূপসী গন্ধর্বপুরের গন্ধর্বপুর উচ্চবিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে দায়িত্বভার নিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

নীতিমালা অনুসারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য তহবিল সংগ্রহ, শিক্ষক নিয়োগ, বরখাস্ত, বাতিল বা অপসারণ, নৈমিত্তিক ছুটি মঞ্জুর করা ইত্যাদি পরিচালনার কাজ কমিটির হাতে। উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত বাজেটসহ বার্ষিক বাজেট অনুমোদন, সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষিত ও সাধারণ তহবিল, অন্যান্য তহবিল, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বিলে সই করাসহ মোটামুটি বিদ্যালয়ের অধিকাংশ কাজই হয় পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে। অভিযোগ আছে, অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে নিয়োগ, প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ যেসব কাজে আর্থিকভাবে লাভ হওয়ার সুযোগ আছে, সেগুলো নিয়েই বেশি আগ্রহী ছিল গাজী পরিবার। দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘুষ দিয়ে নিয়োগ পেতে হয়। রূপগঞ্জেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকদের সরিয়ে এমপি গাজীর কাছের হিসেবে ক্রীড়া আর সহকারী শিক্ষকদের প্রধান করেছেন তিনি। এর ফলে পাঠদানের চেয়ে দলীয় কর্মসূচিতেই তাদের অংশগ্রহণ অধিক দেখা যায়। সরাসরি সভাপতি না থাকার বিধানের তোয়াক্কা না করে রূপগঞ্জের এমপি নিজে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর আত্মীয়স্বজন, ঘনিষ্ঠজন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও অনুসারীদের রেখেছেন। এ অবস্থায় রূপগঞ্জের শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ ব্যাপারে গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি কল রিসিভ করেননি। মেসেজ পাঠালেও কোনো উত্তর করেননি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, হাই কোর্টের নির্দেশনা অমান্য করার প্রমাণ ও লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া এমপি, মন্ত্রী বা তাদের আত্মীয় ম্যানেজিং কমিটিতে থেকে প্রভাব বিস্তার করলে বা অনিয়মে জড়ানোর প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর