চট্টগ্রামে প্রতিদিনই মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে জেলা প্রশাসনের ১০-১২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সকাল-বিকাল অভিযান পরিচলনা করছেন। তবুও অনেকের মধ্যে মাস্ক না পরার প্রবণতা লক্ষণীয়। পক্ষান্তরে প্রতিদিনই বাড়ছে টিকা গ্রহণের সংখ্যা। ফলে টিকা দেওয়ার কারণে অনেকের কাছে তৈরি হয়েছে আস্থা ও সাহস, চলাফেরায়ও সহজ মনোভাব। মানছে না স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দুরত্ব। ফলে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। গত রবিবার একদিনেই মারা যান ১১ জন।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, টিকায় আস্থা বৃদ্ধি এবং মাস্ক না পরার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণেই কার্যত করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। অথচ দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার দুই সপ্তাহ পরই মানুষের শরীরে ইম্যুনিটি তৈরি শুরু হয়। গত ৮ এপ্রিল থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় ডোজ দেয়া। এ হিসাবে ২১ এপ্রিলের পর থেকে ইমিউনিটি তৈরি হওয়ার কথা।
কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানা যায়, চলমান কোভিশিল্ড ভ্যাক্সিনের দু’টি ডোজ। প্রথম ডোজ দেওয়ার সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহ পর টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ মানুষের মধ্যে প্রয়োজনীয় এন্টিবডি (ইম্যুনিটি) তৈরি হয়। টিকা নেওয়ার পর প্রথম তিন সপ্তাহে যে কেউ এবং তিন সপ্তাহ পর ২৪ শতাংশ মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হতে পারেন। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার আরও ৪ সপ্তাহ পর সর্বোচ্চ এক বছরের জন্য আরও শক্তিশালী ইম্যুনিটি তৈরি হয় ৮২ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষের মধ্যে। অর্থাৎ দুই ডোজ নেওয়ার পরও ১৮ শতাংশ মানুষ (১০০-৮২=১৮) কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে এই ১৮ শতাংশের কারণে বাকিরা নিরাপদ। কারণ ৮২ শতাংশ মানুষের ইম্যুনিটি তৈরি হলে সেটা হয়ে যাবে হার্ড ইম্যুনিটি, যা করোনা সংক্রমণের চেইন ভেঙে দেবে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. অজয় দেব বলেন, করোনার দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও মাস্ক পরতে হবে। কারণ টিকা দেওয়ার পরও যে ১৮ শতাংশের শরীরে ইম্যুনিটি তৈরি হয়নি, আপনিও তাদের একজন হতে পারেন। তাছাড়া আপনার শরীরে ইম্যুনিটির জন্য করোনা সুবিধা করতে না পেরে কিছুদিন দুর্বল হয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকতে পারে। যে সময়ে ইম্যুনিটিবিহীন কারও শরীরে তা প্রবেশ করতে পারে। তাই আমাদের টিকা ওপর আস্থা রাখতে হবে। সঙ্গে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। পৃথিবী থেকে করোনা পূর্ণাঙ্গরূপে বিদায়ের আগে কিংবা টার্গেট জনগোষ্ঠীর (৮০-৯০ শতাংশ) ইম্যুনিটি অর্জন না করা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, টিকা নিলেও মাস্ক না পরার কোনো সুযোগ নেই। সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্থ্যবিধিও মানতে হবে। অন্যথায় করোনা সংক্রমণ রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. উমর ফারুক বলেন, মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রতিদিনই সকাল-বিকাল ১২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নগরে এলাকাভিত্তিক অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে জরিমানা, মাাস্ক বিতরণ ও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হয়। তবুও অনেকের মাঝে সতর্কতা দেখা যায় না।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত প্রায় একমাস ধরে নগরে সকাল-বিকাল সাড়াঁশি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। সর্বশেষ গত ১৮ এপ্রিল ১০ অভিযানে ২৪ মামলা, ১৯ এপ্রিল ১০ অভিযানে ২৯ মামলা, ২০ এপ্রিল ১১ অভিযানে ৩২ মামলা ২২ এপ্রিল ১১ অভিযানে ৩৩ মামলা, ২৩ এপ্রিল ১২ অভিযানে ৪৫ মামলা ও ২৬ এপ্রিল ১২ অভিযানে ১২ মামলা দায়ের করে জরিমানা আদায় করা হয়। তবুও মাস্কে অনীহা দেখা যায়।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে চট্টগ্রামে টিকার জন্য মোট নিবন্ধন করেন ৫ লাখ ৪১ হাজার ২২ জন। টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণ করেন ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৭৬০ জন, এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯৭ জন ও মহিলা ১ লাখ ৭৮ হাজার ৩৬৩ জন। দ্বিতীয় জোজ গ্রহণ করেন ২ লাখ ৮ হাজার ৯২৪, এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৭৮ জন ও মহিলা ৭৭ হাজার ১৪৮ জন।
সরেজমিন দেখা যায়, নগরের হালিশহর নয়া বাজার উচ্চ সংক্রমণ এলাকায় কিন্তু গত সোমবার সন্ধ্যার পর দেখা যায় ওই এলাকার অসংখ্য মানুষ রাস্তায় দেদারসে যাতায়াত ও গল্পগুজব করছে। এ সময় অধিকাংশের মুখেই ছিল না মাস্ক। তাছাড়া পথে প্রান্তরে, সড়কে চলাফেরা করার সময় অনেকের মুখেই মাস্ক দেখা যায় না। কারো মাস্ক থুথনিতে, কারো মাস্ক হাতে বা কারো মাস্ক পকেটে। মাস্ক পরছেন না অনেক শ্রমজীবী মানুষ। অনেকে আবার মাস্ক না পরতে নানা অজুহাতও খোঁজে। কেউ বলেন, টিকা নিয়েছি তাই মাস্ক পরছি না, কেউ বলে শ্বাস নিতে পারছি না। এভাবে মাস্ক না পরাতে বিপদ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ