আর্থিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে জীবনবীমা একটি অপরিহার্য বিষয়। তবে সব বীমা সমান নয়। এর মধ্যে টার্ম প্ল্যান সবচেয়ে সরল ও কার্যকর একটি বিকল্প। এটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কভারেজ প্রদান করে, যেখানে প্রিমিয়াম তুলনামূলকভাবে কম হলেও কাভারেজ অনেক বেশি পাওয়া যায়।
জীবনে অনিশ্চয়তা সবসময় থাকে, আর এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা বা মৃত্যু ঘটলে পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাই এই ব্লগে আমরা সহজভাবে টার্ম প্ল্যান কী, এর বৈশিষ্ট্য এবং কেন এটি আজকের দিনে সবার জন্য জরুরি-তা আলোচনা করবো।
টার্ম প্ল্যান কী?
সহজ কথায়, term plan হলো একটি জীবনবীমা, যেখানে নির্দিষ্ট সময় বা মেয়াদের জন্য কভারেজ দেওয়া হয়। যদি ওই সময়ের মধ্যে বীমাকৃত ব্যক্তি মারা যান, তবে তার পরিবার নির্দিষ্ট অর্থ পেয়ে থাকে। কিন্তু যদি ওই মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং ব্যক্তি জীবিত থাকেন, তাহলে কোনো অর্থ ফেরত পাওয়া যায় না।
ধরুন, আপনি ৩০ বছরের জন্য একটি টার্ম প্ল্যান নিলেন এবং বছরে নির্দিষ্ট প্রিমিয়াম দিতে থাকলেন। এই সময়ে যদি আপনার কিছু হয়ে যায়, তবে আপনার পরিবার বিশাল অঙ্কের আর্থিক সহায়তা পাবে। অর্থাৎ স্বল্প খরচে বড় ধরনের সুরক্ষা। এটাই এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য।
টার্ম প্ল্যানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য
টার্ম প্ল্যান একটি সহজ এবং কার্যকর জীবনবীমার ধরণ, যা স্বল্প খরচে উচ্চ সুরক্ষা প্রদান করে। এর কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য নিচে দেওয়া হলো:
● নির্দিষ্ট সময়সীমা
টার্ম প্ল্যান সাধারণত ১০ বছর, ২০ বছর, ৩০ বছর কিংবা আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য নেওয়া যায়। আপনি নিজের প্রয়োজন ও আর্থিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে সময়সীমা বেছে নিতে পারেন।
● কম খরচে বেশি কভারেজ
টার্ম প্ল্যানের বড় সুবিধা হলো, অন্যান্য জীবনবীমার তুলনায় এর প্রিমিয়াম অনেক কম। অর্থাৎ, অল্প খরচে পরিবারকে উচ্চমাত্রার কভারেজ দেওয়া যায়। এটি বিশেষভাবে উপযুক্ত তরুণ ও কর্মজীবী মানুষের জন্য, যারা সীমিত আয়ের মধ্যেও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা চান।
● মেয়াদ নির্ধারণ
টার্ম প্ল্যান সাধারণত অবসরের বয়স পর্যন্ত নেওয়া সবচেয়ে ভালো। যদি বর্তমানে আপনার বয়স ৩০ হয়, তাহলে অন্তত ৬০ বা ৭০ বছর পর্যন্ত কভার নেওয়া উচিত। এতে কাজের বয়সে হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হলে পরিবার আর্থিক সুরক্ষা পাবে। খুব ছোট মেয়াদের প্ল্যান নিলে কার্যকারিতা কমে যায়।
● রিটার্ন অফ প্রিমিয়াম (TROP)
সাধারণ টার্ম প্ল্যানে মেয়াদ শেষ হলে কোনো প্রিমিয়াম ফেরত পাওয়া যায় না, কারণ এটি কেবল মৃত্যুকালীন সুরক্ষা দেয়। তবে চাইলে টার্ম রিটার্ন অফ প্রিমিয়াম (TROP) অপশন নেওয়া যায়। এতে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম দিতে হয়, কিন্তু আপনি যদি পুরো মেয়াদ সুস্থভাবে কাটান, তাহলে মেয়াদ শেষে আপনার দেওয়া সমস্ত প্রিমিয়াম ফেরত পাওয়া যায়।
● নমনীয় কাভার অ্যামাউন্ট
টার্ম প্ল্যান নেওয়ার সময় আপনি কত টাকার বীমা কভার চাইবেন, সেটি নিজেই ঠিক করতে পারেন। আপনার মাসিক আয়, পরিবারের খরচ, কোনো ঋণ বা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা যেমন সন্তানের পড়াশোনা, সব মিলিয়ে কভার অ্যামাউন্ট বেছে নিতে পারবেন। এতে পরিবার প্রয়োজন মতো সুরক্ষা পায়।
● অতিরিক্ত সুবিধা (রাইডার)
টার্ম প্ল্যানে চাইলে বাড়তি কভার যুক্ত করা যায়। যেমন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু, গুরুতর অসুখ বা স্থায়ী অক্ষমতার জন্য আলাদা সুরক্ষা। এগুলো থাকলে শুধু মৃত্যুই নয়, অসুস্থতা বা দুর্ঘটনার মতো পরিস্থিতিতেও পরিবার আর্থিক সাহায্য পাবে।
কেন টার্ম প্ল্যান দরকার?
টার্ম প্ল্যানকে অনেক সময় জীবনের ‘সেফটি নেট’ বলা হয়। এটি শুধু একটি বীমা নয়, বরং পরিবারকে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত রাখার সহজতম উপায়। কেন এটি প্রয়োজন, তা দেখে নেওয়া যাক :
● পরিবারের নিরাপত্তা
জীবন অনিশ্চিত, যে কোনো সময় দুর্ঘটনা বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে। আপনি যদি এক মাত্র উপার্জনকারী হন তাহলে আপনার অনুপস্থিতিতে পরিবারে বড় আর্থিক চাপে পড়ে যাবে। তাই টার্ম প্ল্যান এইরম পরিস্থিতিতে পরিবারের জন্য একটি ভরসার কাজ করে। বীমার অর্থ তাদের দৈনন্দিন খরচ, চিকিৎসা বা অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
● ঋণ পরিশোধ
অনেকেরই হাউস লোন, গাড়ি লোন বা অন্যান্য দায় থাকে। প্রধান উপার্জনকারীর হঠাৎ মৃত্যুর পর পরিবারকে সেই ঋণের বোঝা টানতে হয়। টার্ম প্ল্যান থাকলে বীমার অর্থ দিয়ে সহজে এসব ঋণ পরিশোধ করা যায়। এতে পরিবার আর্থিকভাবে ভেঙে পড়ে না।
● ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা
সময়ের সাথে সাথে জীবনযাত্রার খরচও বাড়ে। টার্ম প্ল্যান বেছে নেওয়ার সময় আপনি উচ্চ কভার অ্যামাউন্ট ঠিক করতে পারেন, যা ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করবে। এতে মূল্যস্ফীতি হলেও পরিবার পর্যাপ্ত অর্থ পায়। এটি দীর্ঘমেয়াদে পরিবারকে আর্থিক নিরাপত্তা দেয়।
● মানসিক শান্তি
টার্ম প্ল্যান কেবল পরিবারকে নয়, আপনাকেও মানসিক প্রশান্তি দেয়। আপনি জানেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রিয়জনদের আর্থিক সুরক্ষা থাকবে। এই নিশ্চয়তা আপনাকে জীবনযাপন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। মানসিক চাপ কমে যায়, কারণ ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা অনেকটাই হালকা হয়।
টার্ম প্ল্যান নেওয়ার সময় কী কী মাথায় রাখা উচিত?
টার্ম প্ল্যান নেওয়া মানেই শুধু একটি পলিসি কেনা নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সিদ্ধান্ত যা আপনার এবং পরিবারের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। প্রথমেই দেখতে হবে প্রিমিয়াম দেওয়ার সামর্থ্য আছে কিনা, কারণ টার্ম প্ল্যান দীর্ঘমেয়াদী দায়িত্ব এবং আয় অনুযায়ী প্রিমিয়াম বেছে নেওয়া উচিত। এরপর পলিসির শর্তাবলী ভালোভাবে পড়া দরকার, যাতে দাবি করার সময় কোনো সমস্যা না হয়।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য সৎভাবে জানানোও গুরুত্বপূর্ণ, যেমন ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস বা পূর্বের কোনো রোগের তথ্য। আজকাল অনলাইন এবং অফলাইনে দুইভাবেই টার্ম প্ল্যান পাওয়া যায়, যেখানে অনলাইনে খরচ কম হলেও অফলাইনে এজেন্ট থেকে পরামর্শ পাওয়া যায়। কোনো কোম্পানির পলিসি নেওয়ার আগে তার সুনাম, গ্রাহক সেবা এবং অনলাইন রিভিউ যাচাই করা দরকার। ক্লেইম সেটেলমেন্ট রেশিওও একটি বড় বিষয়, কারণ উচ্চ রেশিও মানে পরিবার দাবি করার সময় সহজে সুবিধা পাবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয় ও দায়িত্ব বাড়ে, তাই নিয়মিত টার্ম প্ল্যান রিভিউ করা জরুরি, প্রয়োজনে কভার অ্যামাউন্ট বাড়ানো বা নতুন রাইডার যোগ করা যেতে পারে। সবশেষে, পলিসির ডকুমেন্ট ও তথ্য পরিবারকে জানানো উচিত যাতে প্রয়োজনে তারা সহজে দাবি করতে পারে।
উপসংহার
জীবন অনিশ্চিত, তবে পরিকল্পনা করলে সেই অনিশ্চয়তাকে সামলানো যায়। একটি টার্ম প্ল্যান আপনাকে হয়তো সরাসরি কিছু সাহায্য করবে না, কিন্তু আপনার অনুপস্থিতিতে পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখবে। তাই এটি শুধু একটি বীমা নয়, বরং একটি দায়িত্ববোধের প্রতিফলন।
যারা এখনো সিদ্ধান্ত নেননি, তারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ভেবে দেখুন। কারণ পরিবারকে নিরাপত্তা দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আর কিছু নেই।
বিডি প্রতিদিন/এমআই/বিজ্ঞাপনবার্তা