শরীয়তপুরের নড়িয়ার মোক্তারের চর হতে সুরেশ্বর লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার নদীর তীরে দাঁড়ালে যে কারো মন খারাপ হয়ে যেত। পদ্মার ভয়াল গ্রাসে নিঃস্ব মানুষের আতঙ্ক, দীর্ঘশ্বাস আর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যেত অহরহ। সেই আতঙ্কের এলাকাই এখন দৃষ্টিনন্দন। কংক্রিটের তৈরি ব্লকে সাজানো হাঁটার স্থান, তীর ঘেঁষে সড়ক বাতি, নদীর তীরে বসার স্থান আর ঝাউ গাছের ওপর নদীর হাওয়া আছড়ে পড়ায় দৃশ্য যে কোন মানুষের মন ভালো করে দেবে।
এমন সুন্দর পরিবেশে নদীর তীর রক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। দৃষ্টিনন্দন ৮ কিলোমিটার এলাকার তীররক্ষা বাঁধের ‘জয় বাংলা এভিনিউ’ নামকরণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে নড়িয়ার ১ হাজার ১০০ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মান জানাতে এই সিদ্ধান্ত নেয় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।
স্বাধীনতা দিবসে গতকাল শনিবার বিকালে জয় বাংলা এভিনিউ উদ্বোধন করেছেন, পানি সম্পদ উপমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য একে এম এনামুল হক শামীম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশিদ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হেকিম,শরীয়তপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম আহসান হাবীব।
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, ২০১৫ সাল হতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙন ছিল তীব্র। তখন হাট-বাজার, হাসপাতাল, স্কুল, সড়কসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনা বিলীন হয় পদ্মায়। নড়িয়ার মোক্তারের চর হতে সুরেশ্বর পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার ব্যাপী ভাঙনে পদ্মা নদী অন্তত দুই কিলোমিটার ভেতরে (দক্ষিণে) প্রবেশ করেছে। পদ্মার ভাঙনে ২০১৮ সালেই অন্তত সাড়ে ৬ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়।
ওই বছর ১০৯৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নড়িয়া-জাজিরার পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা প্রকল্প নামের প্রকল্পটির ২০১৯ সালে কাজ শুরু করে পাউবো। পরবর্তীতে তীররক্ষা বাঁধের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা।
জাজিরার বিলাশপুর হতে নড়িয়ার সুরেশ্বর পর্যন্ত ১০ দশমিক ২ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষা বাঁধে নির্মানে ব্যয় নির্ধারন করা হয় ৯৩০ কোটি টাকা ও ১১ দশমিক ৮০ কিলোমিটার নদীর চর খননের ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৪৮৭ কোটি টাকা।
নড়িয়ার মোক্তারের চর হতে সুরেশ্বর লঞ্চঘাট পর্যন্ত পাউবো ৮ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করেছে। আর জাজিরার ২ দশমিক ২ কিলোমিটার অংশের কাজ চলমান আছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল হক বলেন, ‘বাপ-দাদার ভিটা নদীতে বিলীন হওয়ায় অনেক কষ্ট পেয়েছি। দুই বছরেরও বেশি সময় মানুষের আশ্রয় ছিলাম। নদীর তীররক্ষা বাঁধ হওয়ায় ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া জায়গায় পুনরায় বসতি গড়েছি। সব হারানোর কষ্ট থাকলেও এখন স্বস্তি পাচ্ছি।’
কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিহির চক্রবর্তী বলেন, ‘২০১৭ ও ২০১৮ সালের ভাঙনে কেদারপুরের অন্তত দেড় হাজার পরিবার গৃহহীন হযেছেন। গৃহহীন হয়ে তারা আশেপাশের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। বাঁধ নির্মাণ করার কারণে তারা অনেকে এখন ফিরে এসে নতুন করে পদ্মা পাড়ে বসতি গড়ছেন। আর বাঁধটি দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় মানুষের কাছে পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।’
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব বলেন, ‘তীররক্ষা বাঁধের কাজটি নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করতে পারব। বাঁধ ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আনন্দ ও স্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। বাঁধের পাশে মানুষ নতুন করে বসতি গড়ছেন এটা দেখে আমরাও আনন্দিত হচ্ছি।’
পানি সম্পদ উপমন্ত্রী ও শরীয়তপুর ২ আসনের সাংসদ একেএম এনামুল হক শামীম বলেন,‘আমি পদ্মার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সন্তান। শিশু বয়স থেকে নদী ভাঙনে নিঃস্ব হওয়ার কষ্ট দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযেগিতায় আমরা নড়িয়া নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছি। যার ফলে এ অঞ্চলের মানুষ সুরক্ষা ও স্বস্তি পাচ্ছে।’
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল