সোমবার, ১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
কাঁদো জাতি কাঁদো

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : ষড়যন্ত্রের নানাদিক

প্রফেসর ড. আবু সাইয়িদ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : ষড়যন্ত্রের নানাদিক

বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাঙালি জাতির নয়, বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত, দুঃখী মানুষের কণ্ঠস্বর ও মুক্তির প্রতীক। সে কারণে তার হত্যাকাণ্ডের ক্যানভাস বিশাল ও বিস্তৃত। জাতিক ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। জাতিকভাবে সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকটি বিষয় প্রধান হয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা  যেখানে শোষণ ও সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান হবে না। দুঃখী মানুষের মুক্তি এই লক্ষ্যে তিনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন; ঘুণেধরা প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামো এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, বিচার ও প্রথাসিদ্ধ শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভেঙে জনগণের কল্যাণকর নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনা। তিনি বলতেন, ‘আমার সেনাবাহিনী হবে পিপলস্ আর্মি।’ ১. বিদ্যমান ঘুণেধরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে সরাসরি জনগণের কাছে জবাবদিহি হতে পারে এমন একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা কার্যকর করা। কারণ এই আমলাতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর কথায় ‘ঘুণেধরা, দুর্নীতিপূর্ণ এবং জনগণকে হয়রানি করার জন্য।’ সেজন্য প্রত্যেক স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা দিয়ে আমলাদের তাদের অধীনস্থ করার পদক্ষেপ নেন। জনগণের কাছে প্রশাসনকে জবাবদিহি করা। এর ফলে ব্রিটিশ-পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত আমলাতন্ত্রে বিরাট অভিঘাত তৈরি হয়। ২. তৎকালীন বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীতে পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা-অফিসারদের সংখ্যাই ছিল বেশি। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত অধিকাংশই ছিল পাকিস্তানি মানসিকতায় আচ্ছন্ন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর জৌলস ও কর্তৃত্ব তাদেরকে পুরনো স্বপ্নযুগে বারবার পিছু টেনে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে উজ্জীবিত বা তাড়িত ছিল না। বরং মুক্তিযোদ্ধা সেনা-অফিসারদের বঙ্গবন্ধু পদোন্নতি দেওয়ার ফলে পাকিস্তান  থেকে ফেরত আসা অধিকাংশ সেনা-অফিসার ছিল বিক্ষুব্ধ। বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় তারা এগিয়ে আসেনি, বরং তারা ছিল উল্লসিত এবং তাদের মুখে ছিল পাকিস্তানের স্লোগান ‘জিন্দাবাদ’। ৩. বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সবচেয়ে ক্রিয়াশীল ছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তারা দেশে এবং বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ব্যাপক অপপ্রচার চালায়। মুসলিম বাংলা স্লোগান দিয়ে ওই নামে বেতার স্থাপন করে মিথ্যাচার ও কুৎসা রটায়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে বাংলাদেশবিরোধী প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে অপতত্পরতা চালায়। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার’ নামে অঘোষিত যুদ্ধে নামে। লক্ষ্য স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ যেন অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ৪. মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই মুজিব নগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যাতে অর্জিত না হয় সেই লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা সি আই-এর সঙ্গে গোপন যোগাযোগ স্থাপন করে। হেনরি কিসেঞ্জার লিখিত ‘হোয়াইট হাউস ইয়ার্স’ বইতে দেখা যায় মোশতাক ও তার সহচরবৃন্দ কমপক্ষে ১৩ বার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ নয়, বড়জোর পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কনফেডারেশন গঠন। মোশতাক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই চক্রান্ত সফল হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। গোপনে অস্ত্র, অর্থ এমনকি যুদ্ধের শেষদিকে পারমাণবিক নৌ-যুদ্ধবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবিত করে যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করা যায়। ৫। বঙ্গবন্ধু জমির সিলিং নির্ধারণ ও দেশজ শিল্প স্থাপনে ৩ কোটি টাকার অধিক বিনিয়োগ না করার সীমা বেঁধে দেন। কলকারখানা জাতীয়করণ করেন। ফলে ভূস্বামী, ধনীক ও বণিক শ্রেণি একযোগে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে হাত মেলায়। ৬. বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে  আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রতিবিপ্লবী শক্তির নাশকতামূলক তত্পরতা। চীনপন্থিরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে এবং সারা দেশে খুন, হত্যা, নাশকতা, থানা ও ফাঁড়ি লুট, অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে অরজাকতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস নেয়। অন্যদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা স্লোগানে বললেও তাদের হটকারী কাজের পরিণতি প্রতিবিপ্লবীদের শক্তিশালী করে। মূলত জাসদ গঠিত হয়েছিল মুজিব বাহিনীর চৌকষ, মেধাসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। যেখানে প্রয়োজন ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কাজে অংশগ্রহণ, জাতীয় স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর হাতকে শক্তিশালী করা, সেক্ষেত্রে তারা সশস্ত্রভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। এদের মধ্যে একটি অংশ যেসব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করেছে তা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রণোদনায় উৎসাহিত করেছে। তারা গণবাহিনী সৃষ্টি করেছে। সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহের উসকানি দিয়েছে। ৭. বঙ্গবন্ধু দুর্নীতি উচ্ছেদ, কালোবাজারি, মুনাফাখোর ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এদের শাস্তির  জন্যে তিনি প্রকাশ্যে ‘ফায়ারিং স্কোয়াড’ আইন প্রণয়নের ঘোষণা করেন। ফলে অসৎ আমলা, দেশপ্রেমহীন সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্রাংশ, রাজনীতিবিদ ও  শোষকদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে। তারা মরিয়া হয়ে বঙ্গবন্ধুকে উত্খাতের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দুষ্প্র্রাপ্য করে তোলে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পি.এল-৪৮০ অধীনে জাহাজ বোঝাই যে খাদ্য বাংলাদেশে আসছিল তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্তে অন্যদিকে ঘুরে যায়। দেশে খাদ্যসংকট তৈরি হয়। এই খাদ্য সংকটের পেছনে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাজনীতিবিদ, সচিব পর্যায়ের আমলা,  শিল্পপতি ও ধনিকচক্র। এই অবস্থায় খুনি রশিদ-ফারুক-এর ভিডিও ভাষ্য মতে উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের মদদে এবং খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। হত্যার বিচার হয়েছে, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি। 

লেখক : ৭২ খসড়া সংবিধান প্রণেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী

সর্বশেষ খবর