সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিদেশ কেন যাই

শিমুল মাহমুদ

বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন। তাদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্রতম অংশ গর্ব করার মতো সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছেন। বাকিদের প্রায় সবাই অমানবিক শ্রম দিয়ে নিজের পরমায়ু ক্ষয় করছেন। মাত্র কটি ডলার, পাউন্ড, ইউরো, রিঙ্গিত, রিয়াল, দিনার বা লিরার জন্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোকিত সময়কে বন্ধক রাখছেন অন্ধকারের কাছে।

পাশের বাড়ির কাছের ছেলেটি বিদেশ গিয়ে নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেছে। বাড়িতে নতুন ঘর তুলেছে। পরিবারে বাড়তি রোশনাই এসেছে। তাই অন্যদেরও যেতে হবে বিদেশ। কত টাকা খরচ করে কত টাকা বেতনের চাকরিতে বিদেশ যাচ্ছেন তার কোনো হিসাব নেই। কোনো দালালের খপ্পরে পড়ে ধারকর্জ জমি বিক্রির টাকায় কী দুর্ভোগ কিনতে যাচ্ছেন তার কোনো হিসাব নেই।

রুটির বদলে বার্গার খেতে বিদেশ যাচ্ছেন। লুঙ্গি-গেঞ্জির বদলে প্যান্ট-শার্ট পরতে বিদেশ যাচ্ছেন। এখন নিজের গ্রামের মানুষের জমিতে, মাঠে কাজ করছেন। বিদেশ যাচ্ছেন ভিনদেশি মালিকের ফ্যাক্টরিতে, খামারে কাজ করতে। ভাষা জানেন না। কাজ বোঝেন না। যে পথ দিয়ে হাঁটছেন সে পথ, সে মাটি আপনার না। নিজের দেশের যে পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ গেছেন, যেটি আপনার জাতিসত্তার পরিচয় সেটি আটকে রাখছে মালিক। বেতন আটকে রাখছে। আপনার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আটকে রাখছে। আপনার চলার, বলার স্বাধীনতা নেই। ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা নেই। বাড়ি ফেরার স্বাধীনতা নেই। আপনি একালের আধুনিক ক্রীতদাস। পিঠে চাবুক হয়তো পড়ে না। অনেকের আবার তারচেয়েও বেশি কষ্ট ও গ্লানির জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। এ জন্যই কি আমরা বিদেশ যাই? এই লাল সবুজ মানচিত্রের বাইরে আর কোথায় এমন সুখ?   

সাইপ্রাস থেকে ফোন করে মুকুল জানিয়েছেন, সেখানকার দালালচক্র আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই দালালদের কারণে সাইপ্রাসের শ্রমবাজার নষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানালেন, বিশ্বের ৩৮টি দেশের বিভিন্ন কারাগারে ৯ হাজার ৬৪০ জন বাংলাদেশি বন্দী রয়েছেন। বিদেশ বিভূঁইয়ে টাকা রোজগার করতে গিয়ে অবৈধ হয়ে বা অপরাধ করে কারাগারে আটকে থাকছেন। দেখার কেউ নেই। কোর্টে পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। কবে মুক্তি মিলবে, আদৌ দেশে ফেরা হবে কিনা কেউ জানে না। গত ১০ বছরে ২৫ হাজার বাংলাদেশি বিদেশে মারা গেছেন। বিদেশে কেউ অমরত্ব নিয়ে যায় না। যে যেখানেই থাকুক সময় হলে মৃত্যু তাকে আলিঙ্গন করবেই। কিন্তু পরিবার পরিজন ছাড়া নিঃসঙ্গ নিভৃত মৃত্যু কারও কাম্য নয়। কুয়েত থেকে ২০১৬ সালে লাশ হয়ে ফিরেছে প্রায় ২০০ বাংলাদেশি। দূতাবাসের কর্মকর্তারা বললেন, এসব মৃত্যুর একটি বড় কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। সেখানে ৪০ শতাংশ নারী গাড়ি চালান। হাতে স্টিয়ারিং কানে মোবাইল। এক হাতে স্টিয়ারিং অন্যহাতে মোবাইলে গেমের বাটন। ডানে বামে সামনে পেছনে কিছুই দেখেন না। ফলে দুর্ঘটনা। বিদেশে লাশ হয়ে গেলে দুর্গতির শেষ থাকে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মরদেহ দেশে আনা অনেক ঝামেলা ঝক্কির। কোনো এয়ারলাইন্স ডেডবডি বহন করতে চায় না। সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি ঝামেলা মিটিয়ে লাশ দেশে পাঠানোও অনেক কষ্টকর। লেবাননের শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের সংখ্যা সর্বাধিক। সেখান থেকেও দেশে লাশ পাঠানো অনেক কঠিন, জানালেন সে দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত। দুবাই এয়ারপোর্টে ২৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে দেখা গাজীপুরের ইমাম হোসেনের সঙ্গে (৩৮)। পৌনে চার লাখ টাকা খরচ করে লেবানন গেলেন। স্কুলের দফতরির চাকরি। বেতন ২৭ হাজার টাকা, যদি সত্যি হয়। সেখানে তাকে ৯-১০ ডলারে এক কেজি করলা কিনে খেতে হবে। পুঁইশাক, ডাঁটা, মিষ্টিকুমড়াও কিনতে হবে এমন দামে। বাংলাদেশি টাকায় ৭-৮শ’ টাকা কেজি। যেটা ঢাকায় ৩০-৪০ টাকায় পাওয়া যায়। খেয়ে পরে কত টাকা দেশে পাঠাতে পারবেন তিনি? কত বছরে পৌনে চার লাখ টাকা উঠে আসবে সে হিসাব নেই। 

ঢাকা শহরে একজন রিকশাচালকের আয় মাসে অন্তত ১৫ হাজার টাকা। ফুটপাথে যে পান সিগারেট বিক্রি করে তারও ১৫-২০ হাজার টাকা আয়। সদ্য বিদায়ী শীতে অলিতে গলিতে রাস্তার মোড়ে যে ছিন্নমূল নারীরা পিঠা বিক্রি করেছে তাদেরও প্রত্যেকের আয় দিনে পাঁচশ টাকার কম নয়। মাসে অন্তত ১৫ হাজার টাকা। তাহলে ধারকর্জ করে, ভিটেমাটি বিক্রি করে কেন বিদেশ যাচ্ছেন? মা বাবা স্ত্রী সন্তান প্রিয়জনের সান্নিধ্য ছেড়ে কেন যাবজ্জীবন কারাবাসে যেতে হবে। যদি বছর বছর ফিরতে না পারেন, যদি বিমান ভাড়ার টাকা জোগাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় তাহলে সেই বিদেশ যাত্রার কী প্রয়োজন? বিদেশ গিয়ে অচেনা অজানা মানুষের আবর্জনা, মলমূত্র পরিষ্কার করার চেয়ে নিজের দেশের জন্য কত কিছু করা যায়। দালালের হাতে পাসপোর্টের নামে নিজের জীবন তুলে দেওয়ার আগে একবার ভাবুন। প্রতিটি মানুষের টাকা প্রয়োজন। কিন্তু টাকার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করার কোনো মানে হয় না। দালালদের পাতা ফাঁদে পা দেওয়ার আগে নিজের বিচার-বুদ্ধি খাটান। কক্সবাজার টেকনাফে প্রতারকদের ট্রলার আসে। অল্প টাকায় মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে শত শত যুবককে নিয়ে যাওয়া হয়। লোভে পড়ে পরিবারের সদস্যরাই ট্রলারে তুলে দিয়ে আসে স্বজনদের। সেসব যুবকের আর মালয়েশিয়া যাওয়া হয় না। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আটকে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয় পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে। অনেককে মেরে ফেলে দেওয়া হয় সাগরে কিংবা জঙ্গলে। তারপরও আদায় করা হয় মুক্তিপণ। দীর্ঘদিন ধরে এমন প্রতারণা চলে আসছে। তবুও নির্বোধদের হুঁশ হয় না।       

সরকারেরও টাকা দরকার। বৈদেশিক মুদ্রার জন্য সরকার বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানিতে উদগ্রীব। বস্ত্র বালিকাদের ঘাম ঝরানো শ্রম আর প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টের টাকায় গড়ে উঠেছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। প্রায় এক কোটি মানুষ যে পরিমাণ টাকা দেশে আনছে ১০ লাখ প্রবাসী যদি সে পরিমাণ টাকা আনতে পারত তাহলে কতই না ভালো হতো। একজন অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন একজন দক্ষ পেশাজীবী নিঃসন্দেহে অনেকগুণ বেশি উপার্জন করবেন। তিনি দেশে থাকলে যেমন দেশ উপকৃত হবে তেমনি বিদেশেও সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। আমরা চাই সেই পেশাজীবী যারা প্রবাসী হলেও দেশের পতাকার মর্যাদা উন্নীত করবেন। যাদের সামর্থ্য নিয়ে গর্ব করবে দেশ।  বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণ বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন। এই মেধাবী তরুণরা পড়া শেষে নিজেদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে বিভিন্ন দেশে গুরুত্বপূর্ণ খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ দেশে ফিরে আসছেন। অনেকেই বিশ্ববাসীর সেবায় নিয়োজিত থাকছেন। সেটা দেশের জন্য গর্ব ও গৌরবের। তাদের একজন যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবেন, দেশে পাঠাবেন সেখানে অদক্ষ অশিক্ষিত একজন শ্রমিক বিদেশ গিয়ে তার এক-দশমাংশও আয় করতে পারবেন না। নিজের যাওয়ার খরচও উঠাতে পারবেন না। উপরন্তু বেশি টাকা কামাতে গিয়ে অবৈধ হয়ে পড়বেন। টাকা আয়ের ধান্ধায় অনেক অপকর্মে জড়িয়ে পড়বেন। দেশের বদনাম করবেন। কুয়েতের শ্রমবাজারটা আমাদের শ্রমিকদের অপকর্মের কারণেই বন্ধ হয়ে গেল।

বাংলাদেশের লাখো তরুণ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে বসেই বিদেশের কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন। এটি একটি স্বাধীন মর্যাদার পেশা। তারুণ্য আজ কত কিছু করে উপার্জন করছে। নিজেরা একটু উদ্যোগী, উদ্যমী হলে বিদেশ গিয়ে জীবন তুচ্ছ করে ক্রীতদাসের ভূমিকায় নামতে হয় না। সম্প্রতি লেবানন, কুয়েত গিয়ে আমাদের শ্রমিকদের এমন কষ্টের দিনলিপি দেখে এসেছি। প্রবাসীদের মধ্যে একটা ছোট অংশ আছে কাজের বাইরেও নানারকম ধান্ধায় জড়িয়ে পড়েছে। তারা ভিসার দালালি করে। রাজনীতির নামে দলাদলি করে কমিউনিটিতে অপকর্ম করে। তাদের বিরুদ্ধে প্রবাসীদের অনেক অভিযোগ। আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশের প্রায় ১ কোটি লোক বিদেশে কাজ করে। এরমধ্যে ৮৪ লাখ বৈধ, ১৬ লাখ অবৈধভাবে। প্রতি ১৬ জনে একজন বিদেশে আছে। মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী বাদ দিলে প্রতি আটজনে একজন বিদেশে আছে। শিশু ও বয়স্ক অর্ধেক বাদ দিলে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন বিদেশে। এরচেয়ে বেশি শ্রমিক আমরা কখনোই পাঠাতে পারব না। তাই যাদের পাঠাচ্ছি দক্ষ শ্রমিক হিসেবে পাঠাতে হবে।

হেলাফেলা অনেক হয়েছে। এবার অদক্ষ, অশিক্ষিত শ্রমিক বিদেশে পাঠানো বন্ধ করতে হবে। কাজের দক্ষতা ছাড়া কোনো লোককে বিদেশ পাঠানো যাবে না। অকাজের লোকদের বিদেশ পাঠিয়ে বেশিদূর এগোতে পারবে না দেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে মধ্যপ্রাচ্যসহ সাত দেশ থেকেই রেমিট্যান্স কমেছে ৭১ কোটি ডলার বা ৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। সুতরাং, বিদেশে কারা যাচ্ছেন, কত বেতনে কী কাজে যাচ্ছেন সবকিছু নতুন করে মনিটর করতে হবে। শুধু সংখ্যা বাড়িয়ে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বদলে দিতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। বিদেশে আমরা বেড়াতে যাব। ঘুরতে যাব। মুটে-মজুরের কাজ করার জন্য এখন আর বিদেশ যাওয়ার কোনো দরকার নেই। বাংলাদেশেও এখন প্রায় দুই লাখ বিদেশি কাজ করছে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে সরকারকে। রাজধানীর গৃহবধূরা এখন গৃহকর্মী পাচ্ছেন না। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ফিলিপাইন কিংবা অন্য কোনো দেশ থেকে গৃহকর্মী আনতে হবে আমাদের। বরেণ্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্প্রতি তার একটি নতুন বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ বিদেশ চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ যাচ্ছেন চিরদিনের জন্য। কোনো মানুষের মধ্যে যদি আলো থাকে তাহলে তিনি দেশ ত্যাগ করতে পারেন না। প্রতিটি মানুষের আত্মার আনন্দ হচ্ছে তার মাতৃভূমি।’ এই প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে কেন বিদেশ যাবেন? আপনারা বিদেশ গিয়ে অন্যের জঞ্জাল সাফ করলে আমাদের বাংলাদেশের জঞ্জাল সরাবে কে? কাদের নিয়ে আমরা গড়ব মধ্যম আয়ের স্বনির্ভর বাংলাদেশ?

     লেখক : সাংবাদিক

ই-মেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর