সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

সুখ বিলিয়ে দুঃখ কুড়োনোই মুসলমানের দায়িত্ব

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

সুখ বিলিয়ে দুঃখ কুড়োনোই মুসলমানের দায়িত্ব

‘সবার সুখে হাসব আমি/কাঁদব সবার দুঃখে। নিজের খাবার বিলিয়ে দেব/অনাহারির মুখে। আমার বাড়ির ফুল-বাগিচায়/ফুল সকলের হবে।/আমার ঘরে মাটির প্রদীপ/আলোক দিবে সবে।/আমার বাড়ি বাজবে বাঁশি/সবার বাড়ির সুর/আমার বাড়ি সবার বাড়ি/রইবে না ক দূর।’ (সবার সুখে, জসীমউদ্দীন)।

ইসলাম কাকে বলে বা ইসলামের সংজ্ঞা কী- কেউ যদি আমাকে এ প্রশ্ন করে তবে আমি আকাইদ শাস্ত্রের জটিল জটিল প্রামাণ্য সংজ্ঞা বলব না। বলব না শাব্দিক বিশ্লেষণ কিংবা তুলে ধরব না ইমান ও ইসলাম নিয়ে মতবিরোধের ফিরিস্তি। শুধু পল্লী কবির ‘সবার সুখে’ ছড়াটি শুনিয়ে দেব। যেটি পড়েছিলাম শৈশবে। যা থেকে এখনো মমতাময়ী মায়ের ঘ্রাণ ভেসে আসে। যাতে মিশে আছে বাবার বকুনি। মাস্টার মশাইয়ের শাসন। ছোটবেলায় পড়া এ ছড়াটি এখনো হৃদয়ে দোলা দেয়। আকাইদ ও কালাম শাস্ত্রের সূক্ষ্ম-জটিল আলোচনার পরও যখন আমি বুঝতে পারি না ইসলাম কাকে বলে তখন আমি মনের পাঠশালায় ছোট্ট শিশু হয়ে বসে যাই মায়ের কাছে। মমতাময়ী মাকে কল্পনা করি স্বর্গের কোনো অপ্সরীর সঙ্গে। শুভ্র শাড়ি আর নূরানী চেহারা নিয়ে মা আমার সামনে বসে আছেন। হুরদের চেয়েও লক্ষ্য গুণ সুন্দর চোখ আমার মায়ের। সেই চোখ থেকে মায়া ঠিকরে পড়ছে। চোখের মায়া আমার সমস্ত শরীর ধুয়ে দিচ্ছে। ধুয়ে দিচ্ছে সব দুঃখ-কষ্ট। মায়া মায়া চোখে মা আমার দিকে তাকিয়ে  বলছেন- বাবা সেলিম! কী সমস্যা তোর? মাকে বল।  মা! ইসলাম কাকে বলে? আকাইদের এতো কঠিন কঠিন আলোচনা মাথায় ঢোকে না তোমার খোকার।

বাবা সেলিম! তোকে তো ছোটবেলায়ই ইসলাম শিখিয়েছিলাম। দুনিয়ার রঙে ডুবে তুই হয়তো ভুলে গেছিস। ভুলে যাওয়াতে ভালোই হলো। আমি আবার আমার খোকাকে পেলাম আমার ছাত্র হিসেবে। তাহলে শোন! ইসলাম হলো- ‘সবার সুখে হাসব আমি/কাঁদব সবার দুঃখে।/নিজের খাবার বিলিয়ে দেব/অনাহারির মুখে...।’

হ্যাঁ! মা। তুমি ঠিকই বলেছ। পবিত্র কোরআন এবং রসুল (সা.)-এর জীবনী পর্যালোচনা করে ইসলামকে এমনই মনে হয়েছে। কোরআনের প্রতিটি আয়াত এবং রসুল (সা.)-এর প্রতিটি পদক্ষেপ ‘পরের সুখে হাসা আর তাদের দুঃখের কাঁদার’ কথাই বলেছে। কিন্তু মা! আজকের বিশ্ব মুসলমান তো পরের সুখে হাসছে না। কাঁদছে না অন্যের দুঃখেও।

তোর কথা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তবে হলফ করে বলতে পারি তোদের পৃথিবীতে এখন কোনো মুসলমানই নেই। তুই কি ইকবালের সেই কবিতাটি পড়িসনি... উর্দুটা মনে পড়ছে না। অনুবাদ শোন- ‘খুব তো বলছ, পৃথিবী থেকে মুসলমান বিদায় নিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করি, আসলেই কি কোনো মুসলমান এ পৃথিবীতে বেঁচে আছে? খ্রিস্টানি পোশাক আর হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির ধারক মুসলমান, তোমাকে দেখে ইহুদিরও শরম পায়। মুখ লুকায় লজ্জা ও ঘৃণায়। তুমি সৈয়দ, মির্জা কিংবা পাঠান বলে নিজেকে পরিচয় দাও। কিন্তু পরিচয় কি দিতে পারবে খাঁটি মুসলমান বলে?’ বাবা! তোরা কত পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় দিস। অমুক মাজহাব, তমুক পীর, ওই দল, সেই বংশ কিন্তু কই কখনো তো নিজেকে খাঁটি মুসলমান বলে পরিচয় দিতে পারিস না। অথচ কোরআন বলছে- খোদার কাছে সেই মানুষটিই শ্রেষ্ঠ, যার কথা হবে- ‘ইন্নানি মিনাল মুসলিমিন। আমি তো কথায় ও কাজে সত্যবাদী মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’

মা! সত্যিই আমরা মেকি মুসলমান হয়ে আছি। ইসলামের শিক্ষা যেখানে সবার সুখে সুখী হওয়ার কথা, আমরা সেখানে নিজের সুখে সুখী ভাবছি। নিজের দুঃখকে বড় করে দেখছি। আমাদের মাঝে আজ আমিত্বের ব্যাধি মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে। দুনিয়ার সব মানুষ মরে গেলেও আমাদের কষ্ট হয় না। কিন্তু নিজের কনে আঙ্গুলে সামান্য চোট লাগলে আমরা অস্থির হয়ে পড়ি। এটা কি ইসলামের শিক্ষা মা?

কেন রে সেলিম? তুই কি মুসলিম শরিফের ওই হাদিসটি পড়িসনি? ‘পৃথিবীর সব মুসলমান একটি শরীরের মতো। শরীরের এক অংশের সুখে যেমন পুরো শরীর আনন্দে নেচে ওঠে তেমনি একজন মুসলমানের সুখে বিশ্ব মুসলমান হাসবে। আবার শরীরের কোনো অংশে ব্যথা পেলে যেমন পুরো শরীর-মন ব্যথায় কাতর হয়, তেমনি কোনো মুসলমান দুঃখ পেলে পুরো বিশ্বের মুসলমান কেঁদে ওঠবে। নবীজীর এই কথা যদি তোরা জীবনে ধারণ করতে না পারিস তবে যত বড় পাগড়ি আর মেসওয়াকই তোরা হাতে নিস না কেন, নবীজীর প্রেমিক উম্মত হতে পারবি না। প্রেমিক উম্মত তো তারাই যারা আরেক উম্মতের সুখের জন্য, মুক্তির জন্য কাঁদবে। নিজের সব বিলিয়ে দেবে। এমনকি নিজের জীবন, সন্তান-সন্ততিও বিলিয়ে দেবে। তোরাই তো ওয়াজ করে বলিস, উম্মতে মুহাম্মাদীর মুক্তির জন্য আবু বকর, ওমর ওসমান, আলী-ফাতেমা তাদের জীবনের সব নেকি বিলিয়ে দিয়েছেন। এতেও নাকি নবীর মনে প্রশান্তি আসেনি। তখন মা ফাতেমা হাসান-হোসাইনকে উম্মতের নাজাতের জন্য কোরবানি করার মানত করেন। সে ধারাবাহিকতায়-ই তো ঘটেছে কারবালার অমর ইতিহাস। এটাও তো ইসলাম। এটাই তো পরের সুখে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। তোরা ভুলে গেছিস সেই কারবালার শিক্ষাও। তাই তো তোদের মাঝে এজিদি ক্ষমতালিপ্সা ঝেঁকে বসেছে। তোরা ভুলে গেছিস অন্যের কথা। পরে আছিস নিজেকে নিয়ে। তাই তোদের ধ্বংস ছাড়া আমি আর কিছু দেখছি না। মহান মাবুদ যদি তার প্রতিশ্রুত মাহদিকে পাঠিয়ে তোদের রক্ষা করেন তবেই মুক্তি মিলবে তোদের। নতুবা ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে তোদের টেনে তোলার মতো কোনো সম্ভাবনাই দেখছি না। হে আল্লাহ আমাদের ইমানি শক্তি দান করুন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর