সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
মতামত

বই এবং নতুন প্রজন্ম

আফতাব চৌধুরী

বই এবং নতুন প্রজন্ম

বার্নার্ড লেভিন বলেছিলেন, মানুষের উচ্চারিত মহত্তম শব্দটি হচ্ছে বই। মানুষ সভ্যতামুখী হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন চিন্তা, নতুন জ্ঞানে পুষ্ট হয়ে ওঠে, আর তাদের সে জ্ঞান-চিন্তাগুলোকে প্রকাশ করার জন্য তারা একটি মাধ্যম খুঁজে বেড়ায়। বোধহয় এটার তাগিদেই একদিন সৃষ্টি হয়েছিল লিপি আর লিখনসামগ্রীর। সেকালে মানুষ গাছের পাতা, ছাল ইত্যাদিতে ব্যাপক কষ্ট করে তৈরি করা কালি দিয়ে লেখালেখি শুরু করে। জন গুটেনবার্গের ছাপাযন্ত্র আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব সভ্যতায় এক নতুন যুগের সূচনা হলো। সেই সঙ্গে ছাপা বই সবার কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠল। যখন ছাপা প্রযুক্তি নতুন নতুন মাত্রা লাভ করতে শুরু করল ঠিক সেই সময়ই বিশ্বে বইয়ের সংখ্যাও বাড়তে শুরু করল।

বই হচ্ছে মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ অবদান। বইয়ের সঙ্গেই মানুষ তার চিন্তা, বুদ্ধি, যুক্তি ও অভিজ্ঞতাকে প্রসারিত করে। বই হচ্ছে মহান জ্ঞানের ভাণ্ডার। বিশ্বের মহৎ লেখকরাও তাদের অর্জিত জ্ঞান, জীবনের অভিজ্ঞতা, সামাজিক জীবনের ঐতিহাসিক-ভৌগোলিকসহ বিভিন্ন তথ্য, ঘটনার চাক্ষুষ বিবরণ, বিশ্বের মহান ব্যক্তিদের মহান জীবনগাথা ইত্যাদি বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন। সে বইগুলো পড়েই আমরা আমাদের জীবন আদর্শ করে গড়ে তুলতে পারি। বই পড়লেই জানা যায় না-দেখা জিনিসের দেখার মজা, কাছে না পাওয়া ব্যক্তির সান্নিধ্য, না জানা কথা জানার সৌভাগ্য। আর বই পড়ার অভ্যাস থাকা লোকদের নৈতিক স্খলন, উচ্ছৃঙ্খলতা ইত্যাদি কোনোকালেই স্পর্শ করতে পারে না। বই-ই হচ্ছে জীবনের পথপ্রদর্শক। জীবনে যতই দুঃখ, হতাশা, বিশৃঙ্খলতা এসে পড়ুক না কেন, বই পড়ার অভ্যাস থাকা একজন ব্যক্তি বই থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপদেশের মাধ্যমে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে, জীবনকে সার্থকভাবে গড়ে তুলতে পারে। বেন জনসন বলেছিলেন, বইয়ের সঙ্গে প্রথম বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলবেন, তার পরে জ্ঞানান্বেষণের জন্য মনকে অনুপ্রাণিত, সুসমৃদ্ধ, সুসংহত করে গড়ে তোলার উদ্দেশে অধ্যয়ন করা উচিত। মোদ্দা কথা, ভালো কথা বলার জন্য, আলোচনা করার জন্য, সুস্থ চিন্তাচর্চা করার জন্যই আমাদের প্রত্যেকের গভীর অধ্যয়নের প্রয়োজন রয়েছে। অবশ্য অনেকেই শ্রেণিকক্ষের বইয়ের মধ্যেই নিজেদের অধ্যয়নকে সীমাবদ্ধ রাখতে চান। কিন্তু বইয়ের বিশাল জগতের মধ্যে এই সাময়িক অধ্যয়ন নিচের সারিতেই রয়েছে। বইয়ের প্রকৃত রসাস্বাদন করতে হলে জীবনী, উপন্যাস, তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ, কবিতার ভালো বই পড়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার নেশা দ্রুতগতিতে হ্রাস পাচ্ছে। যার ফলে এ প্রজন্মের অধিকাংশই আজ জীবনটাকে প্রকৃতভাবে অনুধাবন করতে, জীবনকে সার্বিকভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং এর ফলে তারা দুঃখ, হতাশা ও মানসিক অশান্তির শিকার হচ্ছে, যার ফলে আমাদের সমাজে দিন দিন যুব উচ্ছৃঙ্খলতা বেড়েই চলেছে। ভোগবাদী মানসিকতার শিকার আজকের নতুন প্রজন্ম বইয়ের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে না। জীবনকে শুধু ব্যক্তিসুখ ও উপভোগের বস্তু বলে ভেবে নিয়ে অসংখ্য যুবক-যুবতী তাদের সময় নষ্ট করছে দূরদর্শনের বিভিন্ন বাণিজ্যিক চ্যানেলের সস্তা ধারাবাহিক ও মনোরঞ্জনমূলক ছবি দেখে, পার্ক ইত্যাদিতে সস্তা আলোচনায় ভরা আড্ডায় মোবাইল ফোন, যৌনতাসর্বস্ব প্রেম, বাইক ইত্যাদির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে। বই পড়ার কথা বললে তাদের থেকে একটাই উত্তর পাওয়া যায়— সময় নেই। বই কেনার জন্যও তাদের কাছে টাকার অভাব থাকে। বছরে একটা বই কেনার প্রয়োজন অনুভব করে না আজকের যুবক-যুবতীরা। কিন্তু সস্তা মনোরঞ্জনের নামে টাকা খরচ করতে একবারও কুণ্ঠাবোধ করে না তারা। নতুন প্রজন্মের মধ্যে কিছুসংখ্যক গভীর অধ্যয়নশীল যুবক-যুবতী যে একেবারেই নেই এ কথাও বলা যাবে না। কিন্তু তাদের সংখ্যা একেবারেই সামান্য। পরিবর্তিত সমাজে অধ্যয়নবিমুখ বা পাঠ্যক্রমের বই পড়ে (অনেক ক্ষেত্রে নোটবই) যন্ত্রমানবে পরিণত যুবক-যুবতীদের সংখ্যা যে আজ বাড়তির দিকে, সে কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু অধ্যয়নবিমুখ এই নতুন প্রজন্ম কেমন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে, তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। তাই নতুন প্রজন্মের যুবক-যুবতীদের নিজের সুস্থ জীবন গড়ে তুলতে এবং একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে গেলে বই পড়ার ক্ষেত্রে বিপ্লব গড়ে তুলতে হবে।

নতুবা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। আর এ পরিস্থিতিতে আজ যেসব যুবক-যুবতী অধ্যয়নশীল মানসিকতা বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদের এ বই পড়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে দেশের কোনায় কোনায় বইমেলা, গ্রন্থাগার, বই পড়ার ক্লাব, সাহিত্যানুষ্ঠান, বই পড়ার উপকারিতার বিষয় বিভিন্ন কর্মশালা, বই পড়ার বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে বই পড়ার ক্ষেত্রে একটি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।  এ ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন সংস্থা সংগঠনের নতুন প্রজন্মকে অধ্যয়নমুখী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তৎপরতা গ্রহণ আবশ্যক।

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর