শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

সবুজ শহরের অভিযান

শাইখ সিরাজ

সবুজ শহরের অভিযান

এই সময়ে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বৈশ্বিক বসবাসযোগ্য প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪০টি শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৩৯। আমাদের পরের অবস্থান অর্থাৎ ১৪০-এ আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর সিরিয়া। এই তালিকার মানদ-গুলো কী কী জানি না। তবে আমি এই ঢাকা শহরেই বেড়ে উঠেছি, বড় হয়েছি।  যদিও কাজের প্রয়োজনে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দেশের নানা প্রান্তে ছুটতে হয়, মন-প্রাণ তো রয়ে যায় এ শহরেই। আমার শৈশবে ঢাকা ছিল সবুজ এক শহর। সে সময় আমার বাসার এলাকা খিলগাঁও ছিল মূলত একটা গ্রাম। বিশ্বরোডের ধারে বিশাল অরণ্যশোভিত বনজ, ফলদ নানা গাছগাছালিতে ছাওয়া সবুজ এক বসতি ছিল। গাছপালায় এত ঘন ছিল যে, সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়তেই অন্ধকার নেমে আসত, বিকালেই ডেকে উঠত শিয়াল। কাছেই ছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর। বিমান ল্যান্ডিং বা উড়ে যাওয়ার সময় শব্দ শুনে আকাশের দিকে তাকালে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কখনো কখনো ঢাউস আকারের বিমান চোখে পড়ত ঠিকই, কিন্তু গাছের ডালপালা, পাতার কারণে পূর্ণ বিমান দেখাটা কখনো সম্ভব হতো না। গাছপালায় এতটাই ঘন ছিল প্রকৃতি। মনে আছে রাস্তাঘাটে হাঁটার সময় খুব সাবধানে থাকতাম, এ বুঝি কোনো গাছের ডাল থেকে মৌমাছি তেড়ে আসে। প্রাকৃতিকভাবেই নানা ফুলের গাছগাছালিতে ভরা ছিল এ এলাকা। ফলে মৌমাছি বাসা বাঁধত গাছে গাছে।

মনে পড়ে আমাদের এলাকায় প্রথম সবচেয়ে বড় যে স্থাপনাটির নির্মাণ শুরু তা হলো কমলাপুর রেলস্টেশন। তখন শুনেছি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল স্টেশন হবে কমলাপুর রেলস্টেশন। রেললাইনের পাশাপাশি হবে ১০০ ফুটের বড় রাস্তা। শহর উন্নয়নে সারি সারি গাছ কেটে ফেলা হলো। এরপরও আমাদের একটা চমৎকার শহর ছিল। ছিল অসাধারণ সুন্দর এক ঢাকা। কিন্তু আমরাই ঢাকাকে নষ্ট করে ফেলেছি। ধূসর করে ফেলেছি। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে অবশ্যই ঢাকাকে সবুজ করতে হবে। ঢাকায় যেভাবে বেড়ে উঠছে ইট-কাঠ-পাথরের কানন, সেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে না সবুজ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো অনেক আগে থেকেই সবুজায়নের তাগিদ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন জাপান ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকলের ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাব মোকাবিলার জন্য ভবন নির্মাণের সময় ছাদে ও কার্নিশে বাধ্যতামূলক প্রশস্ত বাগান গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়। তারা ছাদে সবুজের চাষ করাটাকে আইন পাস করে বাধ্যতামূলক করেছে। প্রতিটি বাড়ির ছাদে গাছ লাগানোকে করা হয়েছে অপরিহার্য। কারণ ওই শহরটিকে সুরক্ষিত করতে হবে। গড়তে হবে অক্সিজেনের খামার। মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে সেই পরিবেশটা নেই। আমরা যখন বাড়ি বা অট্টালিকা তৈরি করি, তখন বাড়ির ছাদটা যে সবুজ হওয়া দরকার এ চিন্তাটা আমাদের থাকে না। দুয়েকজন বাড়ি নির্মাণের সময় ছাদকৃষির বিষয়টি মাথায় রাখেন। বহুমুখী চিন্তা থেকেই তিনি বাড়ি নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে ছাদকৃষিতে সাজিয়ে তোলেন। ইতিমধ্যে অনেকে ছাদকৃষির মাধ্যমে সফল হয়েছেন। আমি দেখেছি ছাদে লাউ, ঝিঙে, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজরসহ বিভিন্ন সবজি, আম, পেয়ারা, মাল্টা, আখ, ডালিম, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, জামরুলসহ নানান ফলের চাষ করে পারিবারিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।

চ্যানেল আইয়ে আমি প্রায় ১২৫টির মতো ছাদকৃষি পর্ব প্রচার করেছি। দেখেছি অবসরে চলে যাওয়া সরকারি-অসরকারি চাকরিজীবী, কিংবা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নিজেদের অবসর সময়টাকে ফলপ্রসূ করে তুলছেন ছাদে এক টুকরো ছাদকৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। তারা বলেছেন, ছাদকৃষি দিয়েছে আত্মিক প্রশান্তি। যার নিজস্ব ভবন ও ছাদ রয়েছে তারা নিজেদের ছাদে একস্তর বা দ্বিস্তরবিশিষ্ট ছাদকৃষি গড়ে তুলছেন। আবার যাদের নিজস্ব বাড়ির ছাদ নেই, তারা বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে ছাদের একপাশে বা বারান্দায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ছাদকৃষি। এ ছাদকৃষি দিয়ে তিনি খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন, মিটছে পারিবারিক পুষ্টি, পাচ্ছেন মানসিক প্রশান্তি। পাশাপাশি পালন করছেন একটা জাতীয় দায়িত্ব। শহরকে সবুজায়নে সহায়তা করছেন। নগরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করছেন। তবে বাড়ির আঙ্গিনা বা ছাদে কোন প্রক্রিয়ায় বা কী ধরনের ছাদকৃষি গড়ে তোলা যায় তা এখনো অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। এমন আগ্রহীদের জন্যই ছাদকৃষি ও এর বিজ্ঞানসম্মত দিকগুলো নিয়ে গবেষণায় নেমেছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ। এ বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব ইসলামের নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থী একটি মডেল ছাদকৃষি গড়ে তুলেছেন। গত বছর এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষের ডাক’ অনুষ্ঠানের ছাদকৃষি পর্বে।

ড. মাহবুব বলছিলেন, টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখে নগরবাসী যখন উদ্বুদ্ধ হচ্ছে ছাদকৃষিতে তখন তিনি চিন্তা করলেন এর একটা গবেষণারও প্রয়োজন সৃষ্টি হয়েছে। সেই তাগিদ থেকেই তিনি গড়ে তুলেছেন ছাদকৃষি গবেষণাগারটি। গত বছর তিনি ছাদে টব, কাঠের বাক্স, সিমেন্টের স্ট্রাকচারসহ বিভিন্ন কাঠামোতে ফল-ফসল চাষ করে ফলনের একটা তুলনামূলক চিত্র আমাদের দেখিয়েছিলেন। পাশাপাশি ছাদকৃষিতে সেচের বিষয়টি নিয়ে তিনি ও তার শিক্ষার্থীরা মিলে কাজ করছিলেন। তখন ড. মাহবুব বলেছিলেন, তিনি ছাদকৃষির একটি মডেল তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এবার ঠিক এক বছর পর আবার সেখানে এসেছি মডেল ছাদকৃষিটির গবেষণার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে।

সারা পৃথিবী এখন সোচ্চার ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারের বিষয়ে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর জীব ও প্রাণের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ কারণে কৃষিকেই সবচেয়ে বেশি মুখোমুখি হতে হচ্ছে পরিবর্তিত জলবায়ুর। এ বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে কৃষির সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। মাটি ও পানির সংকটের মধ্যে থেকেই ফলিয়ে নিতে হবে কাক্সিক্ষত ফসল। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পরিবর্তিত জলবায়ু মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়নে কৃষিকে যুক্ত করার এ অ্যাপ্রোচটিকে বলছে ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার। এটি কোনো কৌশল নয়। বলা যায় কৃষিকে টিকিয়ে রাখার সম্মিলিত প্রয়াস। অধ্যাপক মাহবুব ইসলাম বলছিলেন এ মডেল ছাদকৃষিও মূলত ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারের চর্চা।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বেশ জোরেশোরেই চালিয়ে যাচ্ছে ছাদকৃষি নিয়ে তাদের গবেষণা কার্যক্রম। পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শেখ আহমাদ আল নাহিদের কথা। যিনি গবেষণা করছেন অ্যাকুয়াপনিক্স ছাদকৃষি নিয়ে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাদটিকেও বলা যায় এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাগার। অধ্যাপক মাহবুব ইসলাম তার দলবলসহ ছাদকৃষির নানান দিক নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের কাছে আমি সব সময়ই জানতে চাই, ছাদের নিচের ঘরটি শীতল থাকে কিনা। তাদের সবারই উত্তর ছিল, হ্যাঁ। এর সত্যতা মেলে অধ্যাপক মাহবুবের কথায়। তিনি জানালেন, তাদের গবেষণায় দেখেছেন যে ছাদে ছাদকৃষি আছে সে ছাদের ছাদপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৮ ডেগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কম থাকে। ফলে ছাদকৃষি রয়েছে এমন ছাদের নিচের ঘরটিতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কম থাকে। ঘরটি থাকে শীতল। অনেকেই বলেন ছাদকৃষি ছাদের ক্ষতি করে। কিন্তু এ গবেষক বলছেন ভিন্ন কথা। ছাদকৃষি যেমন ছাদের নিচের ঘরটিকে রাখে শীতল, তেমনি ছাদটিকে দেয় সুরক্ষা। তিনি বলেন, ছাদকৃষির ফলে ছাদের স্থায়িত্ব বাড়ে। কারণ ছাদকৃষি না থাকলে ছাদপৃষ্ঠ গ্রীষ্মকালে ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়। ফলে উচ্চতাপ ইট, বালু, পাথর, সুরকির ক্ষতি করে।

কথা হয় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, গবেষণায় পাওয়া বিষয়গুলো কৃষির সঙ্গে জড়িত সবাইকে জানানো জরুরি। এতে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই উপকৃত হবে।

ড. মাহবুব ছাদকৃষি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করেছেন বেশ কয়েকটি সংগঠনকে। সেখানে আয়োজন করা হচ্ছে প্রশিক্ষণের। ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম এ প্রশিক্ষণ তাদের সমৃদ্ধ করছে।

আশার কথা হচ্ছে, এ প্রজন্মের প্রকৌশল বিদ্যার শিক্ষার্থীরাও নগরকৃষির বিষয়টিকে ভাবছে বেশ গুরুত্ব দিয়ে। গত বছর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তমাল অ্যাগ্রোপলিস নামে একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছিল। এ বছরও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশনে উপস্থিত ছিলাম। দেখলাম তারাও স্থাপত্য কলাকৌশলে কৃষিকেও বেশ গুরুত্ব দিয়েই ভাবছে। নিরাপদ খাদ্যের তাগিদেই শুধু নয়, পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ছাদকৃষি তথা নগরকৃষিকেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ছাদকৃষি নিয়ে এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা বেশ আশাজাগানিয়া। গবেষণার মাধ্যমে ছাদকৃষির সহজসাধ্য মডেল তৈরি করা গেলে শহরের প্রতিটি ছাদ ভরে উঠবে সবুজে।  শীতল হবে শহরের প্রকৃতি। বাড়বে অক্সিজেন, হবে বাসযোগ্য একটি শহর। পৃথিবীও হবে নিরাপদ।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর