সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিরোধী নেতাদের অসহায়ত্ব জনগণকে অসহায় করে তুলছে

মইনুল হোসেন

বিরোধী নেতাদের অসহায়ত্ব জনগণকে অসহায় করে তুলছে

সুসংগঠিত সরকার এবং প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থার অভাবে একের পর এক ব্যাপক জীবনহানির হৃদয়বিদারক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। এই তো গেল ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার বনানীর একটি ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মিত ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৬ জন লোক প্রাণ হারালো এবং আরও শতাধিক লোক আহত হয়ে বেঁচে আছে। ভবনটির অনুমোদিত উচ্চতা সম্পর্কে রাজউকের ব্যাখ্যা বিভ্রান্তিকর। জরুরি অগ্নিনির্বাপণের কাজে অংশ নেওয়ার জন্য ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা প্রস্তুত ছিলেন না। দুই দিন যেতে না যেতেই গুলশান ডিসিসি মার্কেটে আগুন লাগল। বহু দোকান ভস্মীভূত হলো। আগুন লাগছে, না লাগাচ্ছে তাও অনুধাবন করা যাচ্ছে না।

ব্যক্তির ইচ্ছায় সরকার চালাতে গিয়ে সরকার ব্যবস্থার হাত-পা কেটে ফেলা হয়েছে। তাই সরকারের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ করছে না। জনগণের ভোটের ওপর সরকারের আস্থা নেই। সে জন্য সরকারকে চলতে হচ্ছে সরকারের সহযোগীদের দুর্নীতি ও মিথ্যার ওপর নির্ভর করে। জনজীবনের যেখানেই সংকট দেখা দিচ্ছে সেখানেই সরকারের প্রস্তুতিহীনতা ধরা পড়ছে। তবে বিরোধী দল না থাকায় পুলিশি শক্তির সমর্থন ক্ষমতাসীনদের জন্য এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করেছে। 

চলাচলের অনুপযোগী হাজার হাজার বাস বেপরোয়াভাবে চালানোর ফলে গত কয়েক মাসে কয়েকশ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কিছু লোককে জীবন হারাতে হচ্ছে। এ ছাড়াও বিভিন্নভাবে অসহায়ত্বের শিকার হচ্ছে জনগণ।

জনগণের এ অসহায়ত্ব বোধগম্য কিন্তু তাই বলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও সেই অসহায়ত্বের অংশীদার হয়ে থাকবে এবং নিজেদের নামসর্বস্ব অস্তিত্বের অনুকূলে অজুহাত দেখাবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। এ রকম শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজমান থাকার কারণেও কিছু নেতার মধ্যে আত্মতুষ্টি থাকতে পারে- যে আর যাই হোক তারা নেতা। তারা যদি নির্বাচনকালীন ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে অপারগ হন তাহলে পরিবর্তন আনার জন্য বিরোধী দলের ভূমিকা থাকার প্রশ্ন ওঠে না। বিরোধী রাজনীতির চরিত্র ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো হতে পারে না। জনগণের অসহায়ত্ব দূরীকরণে তাদের সাহস দেখাতে হবে। বাসায় বসে জেলে যাওয়ার মধ্যে তো কোনো সাহসিকতা নেই। জনগণ জাগবে, পরে নেতারা আসবেনÑ এটা কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নয়। 

রাজনৈতিক দল তো কথা বলার দোকান নয় যে বিধাতার বর পাওয়ার আশায় পথ চলবেন। বিরোধী রাজনীতির শীর্ষ নেতাদের সঠিক নেতৃত্বের অভাবের কারণে তরুণ পার্টি কর্মীরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, জেল-জুলুম সহ্য করছে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ধ্বংস হচ্ছে, যা দেখলে বেদনা অনুভব না করে পারা যায় না। 

অলস রাজনীতি বলে কিছু নেই। অকার্যকর রাজনীতি, রাজনীতি পদবাচ্য নয়। কোন ধরনের রাজনীতিতে কারা কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে সেটা গুরুত্বসহকারে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার।

বিদ্যমান বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাটাই বিরোধী রাজনীতির লক্ষ্য হতে হবে। আর তা যদি অর্জন করা সম্ভব না হয় তাহলে বিরোধী রাজনীতি থাকা অর্থহীন। বিরোধী দল আছে দেখিয়ে সরকার তার সুযোগ নিয়ে থাকে।

সরকারি দলসহ সব দলই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নিয়মে চলছে। নির্বাচন হোক আর না-ই হোক, বিগত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলগুলোতে কয়েকশ কোটি টাকার ব্যবসা তো ঠিকই হয়েছে।

সরকারের জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই জনস্বার্থ সংরক্ষণে নির্লজ্জ অব্যবস্থাপনা চলতে পারছে। মন্ত্রণালয় বিশেষের ব্যর্থতার জন্য কারও মন্ত্রিত্বের চাকরি হারানোর কথা ভাবতে হচ্ছে না। ভোটাধিকারকে অবজ্ঞা করার পর জনস্বার্থ উপেক্ষা করার কাজটি অধিকতর সহজ হয়েছে। সব রকমের অন্যায়-অবিচারের কাছে জনগণ ভীষণ অসহায় অবস্থায় আছে। নিজেদের ভোটের সরকার না হলে যা হয় তাই হচ্ছে।

সরকারের সংগঠিত রূপকে চরম বিশৃঙ্খল করে ফেলা হয়েছে, বেশিরভাগ অদক্ষ এবং অযোগ্য লোককে নিয়ে সরকার গঠন করা হয়েছে। সরকার গঠনে যোগ্যতার বদলে আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

দুর্নীতি এখন অগণতান্ত্রিক রাজনীতির চাবিকাঠি। ভেনিজুয়েলার ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থাকার জন্য সামরিক বাহিনীসহ প্রশাসনের সবাইকে দুর্নীতির মাধ্যমে লাভবান হতে দিয়েছেন। তাই তিনি গণআন্দোলনের মুখে ব্যর্থ সরকার নিয়ে এখনো টিকে থাকার আশা ছাড়ছেন না। জনগণের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সৈন্যও তার দেশে এনেছেন। এরূপ ক্ষমতাপাগলরা দেশকে বিক্রিও করে দিতে পারে।

গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে গত সাধারণ নির্বাচনে যে জঘন্য কাজটি করা হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার নিন্দা এখনো অব্যাহত রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বার বার সতর্ক করে যাচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তারই প্রতিধ্বনি তোলা ছাড়া আর কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। রাতের ভোট ডাকাতি সম্পর্কে তারা অজ্ঞ এবং বোবা রয়েছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধারাও কোনো সাহসী ভূমিকা রাখতে পারেননি। বিরোধী নেতাদের যে রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয় থাকার স্বাধীনতা নেই, এ সম্পর্কে কারও দ্বিমত নেই। তারা কেবল সতর্কতার সঙ্গে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিতে পারছেন। তাই সরকার এখন বিরোধী দলের নেতাদের গুরুত্ব দেওয়ার কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। ইচ্ছামতো তাদের কোণঠাসা করে রাখছে।

আমাদের রাজনীতিতে এখন আর কোনো রাজনৈতিক সংঘাত নেই। আছে কেবল পুলিশি মামলা মোকাবিলা করার সংগ্রাম।

এ প্রসঙ্গে আমি পাকিস্তান আমলের একটি উদাহরণ দেব। তখন আইয়ুব খানের শাসন চলছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং অন্যান্য শীর্ষ বিরোধী নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, রাজনীতির গণতন্ত্রায়ন ছাড়া তারা আর রাজনৈতিক দলের পুনরুজ্জীবন ঘটাবেন না।

আজকের বাংলাদেশে নির্বাচন এখন ডাকাতির পর্যায়ে চলে গেছে। পাকাপোক্তভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য একদলীয় ব্যবস্থা চালু করার উচ্চাভিলাষ মাথায় নিয়ে বাঁধন-কষণ শক্ত করা হচ্ছে। ব্যর্থ সরকারের নেতারাই স্বৈরশাসক হয়।

অথচ মনে রাখা হচ্ছে না যে, বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্রবিরোধী একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতার সংগ্রাম করেনি। যারা গণতন্ত্রকে হত্যা করতে চান তাদের জনগণের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য অনুধাবন করা প্রয়োজন। সরকার যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, তার সঙ্গে জনগণের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মিল পাওয়া যাচ্ছে না।

বিরোধী নেতৃত্বের এবং বিরোধী দলের নমনীয় ভূমিকা বিরোধী রাজনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। বিদেশিরা ভাবছে বাংলাদেশের বিরোধী দল রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজেদের অসহায়ত্ব মেনে নিয়েছে। তাদের ভূমিকা পালনের কিছু নেই।

পাকিস্তান শাসনামল থেকেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দেখেছি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যদি একেবারেই অসম্ভব করা হয় তাহলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলতে অসুবিধা কোথায় যে, এখন গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চা সম্ভব নয় এবং টেলিভিশন শোর রাজনীতি বন্ধ হওয়াই ভালো। গণতন্ত্রের জন্য অন্যান্য দেশে তো আন্দোলন হচ্ছে।

কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ফল অস্তিত্ব জনগণের দুর্দশা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে এবং সরকারকে আরও বেপরোয়া করে তুলছে।

জনজীবনে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কাদের হাতে সেটাই বোঝা দুষ্কর। মনে হচ্ছে যে কেউ অসহায় জনগণের ওপর কর্তৃত্ব খাটাতে পারে। জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতেও যেন কারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

তবে পরিবর্তন আসবেই। জ্ঞান ও বুদ্ধির ভিত্তিতে যাতে সেই পরিবর্তন শান্তিপূর্ণ পথে আসে তার চেষ্টা করাই আমাদের সবার দায়িত্ব হওয়া উচিত।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুবিধাবাদীদের দলীয়করণের রাজনীতি বর্জন করতে হবে। যোগ্য ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বকে অস্বীকার করা অভিজ্ঞ রাজনীতির শিক্ষা নয়। সবাইকে দলীয়করণের চিন্তা-ভাবনার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা আমাদের জানা ছিল না। গণতন্ত্র ধ্বংসের এ রাজনীতি আমদানি করা হয়েছে। সাংবাদিক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে দলীয় নেতাদের রাজনৈতিক কর্মী হবেন তা ছিল কল্পনাতীত। সুশীল সমাজের অস্তিত্ব এভাবে দুর্বল করা হয়েছে।

            লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর