বুধবার, ১২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাংলার সম্পদে নির্মিত আরাফাতের খাল

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার

বাংলার সম্পদে নির্মিত আরাফাতের খাল

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার বাংলা এক সমৃদ্ধিশালী ও ঐতিহ্যবাহী জনপদ। যুগ-যুগান্তরে পরাক্রমশালী বৈদেশিক শাসকরা ওই সমৃদ্ধিশালী জনপথের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিল। উদ্দেশ্য ছিল সম্পদশালী বাংলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজকোষ পূর্ণ করা। অন্যভাবে, নিজ দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা। আর্য থেকে হুন, দিল্লির সুলতানি শাসক থেকে মুঘল বাদশাহনামদার, ব্রিটিশ বেনিয়া থেকে নব্য ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি সবাই বাংলা অধিকার করে এ সমৃদ্ধিশালী জনপথের সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়েছে। বাংলার সম্পদে যেমন মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তম পত্নী মমতাজমহলের স্মৃতিতে তাজমহল নির্মাণ করেছেন, তেমনি ইংল্যান্ডের শহরগুলোয় ওই সম্পদেই নিয়নবাতি জ্বলেছে। পাকিস্তানিরাও পিছিয়ে নেই; তারাও এ দেশের সম্পদ ব্যবহার করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে: লাহোর, মুলতান, করাচির রাজপথ ঝকঝকে তকতকে করে সাজাতে।

বাংলা সর্বদাই ওই সাম্রাজ্যবাদীদের পদানত থাকেনি। কখনো-সখনো স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। আবার বাংলাই বিদেশি বেনিয়াদের প্রেরিত সেনাপতি অথবা ওয়ালিকে তাদের প্রভুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে প্রেরণা জুগিয়েছে। বিশ্বাসঘাতকদের প্রভুরা তাই যুগ যুগ ধরে চেষ্টা করেছে আবারও বাংলাকে পদানত করতে। ওই চেষ্টা যত না বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিতে তার চেয়ে বেশি সমৃদ্ধিশালী একটি অঞ্চল হারানোর মনোবেদনা থেকে। বাংলার প্রাদেশিক শাসকরা তাদের প্রভুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও বাংলার মাটি, বাংলার জল; এ দেশের পথ-ঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। সম্পদ অর্জনের যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শাসকরা বাংলা জয় করেছে, তাদের দুই হাত ভরে দিয়েছে; যেন ‘ঈশ্বরের দান’। তবে অত্যাচারী শাসকদের বাংলার জনগণ ও তাদের ঈশ্বর কখনো ক্ষমা করেনি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মতো ওই অত্যাচারী শাসকদের ‘ভাতে মেরেছে, পানিতে মেরেছে’। ইবনে বতুতার ‘দোজখ পুর নিয়ামত’ যাকে বলে আর কি!

প্রাচীনকাল থেকে বাংলা সমৃদ্ধিশালী জনপদ ছিল। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার যুগে বাংলা যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে টেক্কা দিয়েছে। এমনকি বাংলার দান-দক্ষিণায় দূর দেশের জনগণ দুই বেলা দুই মুঠো খেয়ে জীবন ধারণ করেছে, তাদের পূর্জা-অর্চনা সেরেছে। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে যা প্রায় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। আজ হয়তো বিশ্বাস না-ও হতে পারে, কিন্তু এ কথা সত্য, বাংলার সুলতানের প্রেরিত অর্থে মুসলিমদের পুণ্যভূমি আরবের দরিদ্র মানুষেরা জীবন নির্বাহ করত। বাংলার অর্থেই সেখানে নির্মিত হয়েছে মাদ্রাসা, সরাইখানা। খনন করা হয়েছে আরাফাতের খাল। যাদের এ কথা বিশ্বাস হবে না তারা যদি একটু ইতিহাসের পাতা ওল্টান পেয়ে যাবেন বাংলার ওইসব গৌরবময় ইতিহাসের গল্পমালা। বেশিদিন আগে নয়, ওইসব ঘটেছিল সুলতান গিয়াস-উদ-দীন আজম শাহের শাসনামলে (১৩৯০-১৪১১)। তিনিই ছিলেন সেই মহতী শাসক যিনি বাংলা থেকে অর্থ প্রেরণ করেছিলেন প্রিয় নবী (সা.)-এর স্বদেশবাসীর জন্য। বাংলার ইতিহাসের পরতে পরতে এমন সমৃদ্ধির কথা লেখা আছে। সমুদ্রের অতলে অভিযান চালিয়ে দক্ষ অভিযাত্রীরাও মণিমুক্তা পাওয়া যাবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারে না। কিন্তু বাংলার ইতিহাস নিয়ে একটু ঘাঁটলে যে কারোর কাছেই উদ্ভাসিত হবে এক ‘সমৃদ্ধিশালী ও সম্ভাবনাময় জনপথের ইতিকথা’, সে কথা নিশ্চিত করে বলাই যাবে।

ডিজিটাল প্রজন্ম শুনে আরও অবাক হবে যে, এ দেশের মাটি ছিল সোনার চেয়ে খাঁটি। তাই একসময় টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত এ দেশের বাজারে। বেশিদিন আগের কথা নয়, মুঘল বাংলায় সুবেদার শায়েস্তা খানের জমানায় (১৬৬৪-১৬৮৮); যার স্মৃতি বহন করে জীর্ণশীর্ণ মলিন দেহে পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গার কোলঘেঁষে আজও দাঁড়িয়ে আছে মুঘলদের নির্মাণ কৌশলের অপূর্ব নিদর্শন লালবাগ কেল্লা। ওই লালবাগ কেল্লাকে কেন্দ্র করে একটি প্রচলিত ঐতিহাসিক গল্প আজ বেশ মনে পড়ছে। ওই কথামালায়ও বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বাক্ষরের চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। জানা যায়, সুবেদার শায়েস্তা খান লালবাগ কেল্লার পশ্চিম দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, চালের দাম আমার সময়ের মতো যার সময়ে এক টাকায় আট মণ পাওয়া যাবে তার জন্যই রইল ওই দরজা পুনরায় খোলার অনুমতি। শায়েস্তা খানের ওই বন্ধ দরজা বেশিদিন বন্ধ থাকেনি। বাংলার নবাবি শাসনের পুরোধা মুর্শিদ কুলি খাঁর জামাতা সুজা-উদ-দীন (১৭২৭-৩৯) ওই দরজা খোলার যোগ্যতা অর্জন করেন। অর্থাৎ তার সময়েও এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত।

হেরোডোটাসের নীল নদের দান যেমন মিসরকে প্লাবিত করে সমৃদ্ধিশালী জনপদে পরিণত করেছে। তেমনি এ দেশের নদ-নদী, খাল-বিল এ দেশের মাটিকে উর্বর করে চাষাবাদের উর্বর ভূমিতে পরিণত করেছে। তবে ওই নদ-নদীই আবার প্রবল ভাঙনে অথবা বন্যায় এ দেশের মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে। পথে বসিয়েছে। সকালে রাজা বিকালে ফকির হয়েছে। তবে এ দেশের হৃদয়শালী সম্পদহীন মানুষ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সর্বস্বান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। টাঙ্গাইল অঞ্চলের এ প্রবাদে সেই চিত্রই ধরা পড়েছে:  ‘বাড়ী দিমু বসিতে/জমিন দিমু আমি চাষিতে/ইছামতী নদী দিমু বাইছালি খেলিতে, ও তুমি কাইন্দোনা।’

তবে বাংলা যে কালেই যত সমৃদ্ধ হোক না কেন সাধারণ মানুষের ভাগ্যের আজও খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। সেই চর্যাপদের যুগ থেকেই বাংলার মানুষকে তাই মাছে-ভাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। আবার কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ উপন্যাসের নায়কের গ্রামবাসীর মতো শাসক কর্তৃক অত্যাচারিত হতে হয়েছে কারণে অকারণে। ওই কারণেই বাংলার মানুষ কখনো শাসক পরিবর্তন নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তাই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ বনাম নবাব বাহিনীর যুদ্ধে তারা নির্লিপ্ত থেকেছে। রবার্ট ক্লাইভ লিখেছেন- ‘২৯ জুন, তিনি ২০০ ইউরোপীয় ও ৫০০ দেশীয় সৈন্য নিয়ে বিজয়গর্বে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেন। এ উপলক্ষে লাখ লাখ দর্শক উপস্থিত হয়। তারা ইচ্ছা করলে শুধু লাঠি ও ঢিলা দিয়েই ইউরোপীয় সৈন্যদের মেরে ফেলতে পারত। কিন্তু বাঙালিরা তা করেনি। কারণ তারা এই মাত্র জেনেই নিশ্চিত ছিল যে, “এক রাজা যাবে পুনঃ অন্য রাজা হবে/বাংলার সিংহাসন শূন্য নাহি রবে”।’ আজও বাংলার মানুষের এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের সে কথাই বলছে।

 

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

সর্বশেষ খবর