বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘অবৈধ’ সংসদে ‘বৈধ’ এমপি!

মহিউদ্দিন খান মোহন

‘অবৈধ’ সংসদে ‘বৈধ’ এমপি!

লোকটির পেশা ছিল ছিঁচকে চুরি। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে রাতের অন্ধকারে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, তৈজসপত্র চুরি করত। গ্রামের সবাই জানত বিষয়টি। একদিন সে গেল গ্রামের মসজিদের ইমামকে তার বাড়িতে খাওয়ার দাওয়াত দিতে। ইমাম সাহেব বললেন, ‘দেখো, তুমি তো চুরি করে খাও। তোমার বাড়িতে আমি খেতে পারব না। কারণ তোমার রুজি হালাল নয়।’ লোকটি বলল, ‘হুজুর! আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে চুরি করা কিছু খাওয়াব না। সব হালাল খাওয়াব।’ ইমাম সাহেব দাওয়াত কবুল করলেন। নির্দিষ্ট দিনে তিনি হাজির হলেন চোরের বাড়ি। খেতে বসে দেখলেন পেয়ালায় বড় সাইজের মোরগের রান, যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী মিয়া! সব জিনিস হালাল তো?’ চোর উত্তর দিল, ‘সবই আমার রুজি করা পয়সায় কেনা হুজুর। শুধু মোরগটা পাশের বাড়ি থেকে গত রাতে না বলে এনেছি।’ হুজুর মন খারাপ করে বললেন, ‘তাহলে তো এ গোশত খাওয়া যাবে না। এ তো হারাম।’ চোর বলল, ‘হুজুর! তাহলে তো আপনাকে শুধু করলা ভাজি আর ডাল দিয়ে খেতে হবে।’ তখন হুজুর বললেন, ‘দেখো মোরগটা হারাম। কিন্তু এর শুরুয়া (ঝোল) তো হালাল। কারণ মসলাপাতি তো তোমার হালাল রুজি দিয়ে কিনেছ। দাও, আমার পাতে ঝোল ঢেলে দাও।’ চোর পেয়ালা কাত করে ঝোল ঢালতে গেলে মোরগের রানটি হুজুরের পাতে পড়ে যায়। চোর তো ভয়ে কাঁপতে লাগল। হুজুরের পাতে হারাম জিনিস! সে কম্পিত হাতে সেটা তুলতে গেল। তখন হুজুর বললেন, ‘থামো। জানো না, জো আপসে আয়েগা ও ভি হালাল হ্যায়? যেহেতু শুরুয়ার সঙ্গে ওটা চলে এসেছে তাই ওটা এখন আর হারাম নেই।’ গল্পটি এখানেই শেষ। এ গল্পটি যারা জানেন, গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে বিএনপির সংরক্ষিত আসনের এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার বক্তৃতা শোনার পর তাদের নিশ্চয়ই তা মনে পড়েছে। রুমিন ফারহানা যখন তেজোদীপ্ত গলায় বলছিলেন, ‘আমি এমন এক সংসদে কথা বলছি যেটা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নয়, অবৈধ’- তখন সচেতন ব্যক্তিরা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছেন। যে সংসদের সংরক্ষিত আসনে তিনি সাংবিধানিক আইন ও নির্বাচনী সব বিধিবিধান মেনে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই সংসদকেই বলছেন অনির্বাচিত!, অবৈধ!! এ তো এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের পরপরই বিএনপি ঘোষণা করেছিল তারা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করছে এবং তাদের দল ও জোটের যে কজনকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে তারা শপথ নেবেন না। বিএনপির নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। কেননা, তা একটি রাজনৈতিক দলের স্ট্র্যাটেজি ও সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে, কথা উঠেছে তখনই, যখন দেখা গেল নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে আবার সেই প্রত্যাখ্যাত নির্বাচনে বিজয়ীদের এমপি হিসেবে শপথ নিতে ‘অনুমতি’ দিল দলটি। এটাকে অনেকেই স্ববিরোধী ও নৈতিকতার মানদন্ডে অগ্রহণযোগ্য বলেই মনে করছেন। আর তা নিয়ে দেশবাসী কতই না নাটক-প্রহসন দেখল! প্রথমে ঐক্যফ্রন্টের দুজন শপথ নিলেন। তারপর বিএনপির একজন সেদিকেই পা বাড়ালেন। ঠাকুরগাঁও-৩ থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান শপথ নেওয়ার পরই প্রশ্ন উঠল বিএনপির চেইন অব কমান্ড অবশিষ্ট আছে কিনা? কেননা, দলের সিদ্ধান্তকে থোড়াই কেয়ার করে একজন এমপির শপথ নেওয়া ও সংসদে যোগ দেওয়া সংশ্লিষ্ট দলের শৃঙ্খলার অভাবেরই জানান দেয়। দল কিন্তু আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকল। দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গের অপরাধে জাহিদুর রহমানকে করা হলো বহিষ্কার। কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টে গেল কয়েকদিন পরই। দেশের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সময়ের সবচেয়ে হাস্যরসাত্মক প্রহসনটি মঞ্চস্থ হতে দেখল দেশবাসী। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নির্বাচিতদের শপথ নেওয়ার সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার একদিন আগে অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল বিএনপির চারজন নেতা এমপি হিসেবে শপথ নিয়ে ফেললেন। ঘটনার পরপরই মহাসচিব গণমাধ্যমকে জানালেন, লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ীই তারা শপথ নিয়েছেন। বিষয়টি আরও রহস্যজনক হয়ে রইল নির্বাচিত হয়েও মহাসচিবের শপথ না নেওয়ার মধ্যে। এ বিষয়ে তিনি বললেন, এটাও নাকি তাদের একটি কৌশল। তা হতেই পারে। রাজনীতির মাঠে খেলতে গিয়ে একেক দল একক সময় ভিন্ন ভিন্ন কৌশল আবলম্বন করতেই পারে। এতে কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। এরপর মহাসচিবের আসনটি শূন্য ঘোষিত হলো। নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পর বিএনপি তাতে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিল। শুধু তাই নয়, সেই নির্বাচনে তারা যে চারজনকে প্রাথমিক মনোনয়ন দিল, তার মধ্যে কারাবন্দী চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নামও থাকল। এসব যে তার পূর্বানুমতি ছাড়াই করা হয়েছে তার প্রমাণ মিলল মনোনয়নপত্র সই করার জন্য তার কাছে পাঠানোর পর। খবর বেরিয়েছে, বেগম জিয়া সেই মনোনয়নপত্র সখেদে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছেন, ‘আমি এ নির্বাচন করব না, যাদের শখ হয়েছে তাদের করতে বল।’ রাজনৈতিক পর্যালোচকরা বলছেন, এ থেকে সত্যের একটি বিড়াল থলে থেকে বেরিয়ে এসেছে। বিএনপিতে এখন অনেক কিছুই ঘটছে, যেগুলো চেয়ারপারসন জানেন না। রাবার স্ট্যাম্পের মতো তার নামটাই শুধু ব্যবহার করা হচ্ছে। বগুড়া উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি আনুপাতিক হারে ভাগে পাওয়া একটি সংরক্ষিত (মহিলা) আসনেও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় । আর তার ফলেই রুমিন ফারহানা জীবনে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদের অধিবেশনকক্ষে প্রবেশের অধিকার লাভ করেছেন।

এটা এখন পরিষ্কার, অবৈধ বলে আখ্যায়িত সংসদকে বিএনপি  স্বেচ্ছায় বৈধতা দিয়েছে। এরপর আর ওই নির্বাচন বা সংসদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো নৈতিক অধিকার দলটির থাকার কথা নয়। যদি তারা তা বলে, তাতে মানুষের কাছে দলটির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই শুধু প্রকাশ পাবে। শুধু তাই নয়, বিএনপির অভ্যন্তরে বর্তমানে নিয়ন্ত্রণহীনতা ও সমন্বয়ের অভাব ভীষণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। শীর্ষ নেতৃত্ব নেতা-কর্মীদের যে মোটেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তা এখন ‘ডিস্টিলড ওয়াটার’-এর মতো পরিষ্কার। এ ক্ষেত্রে তারা যে পুরোপুরি ব্যর্থ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় তা প্রকট হয়ে উঠেছে। দলের চেয়ারপারসনের নিজ জেলা বগুড়ায় কমিটি নিয়ে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেল, তা কি লজ্জাকর নয়? সেখানে মারপিট থেকে শুরু করে দলীয় কার্যালয়ে তালা দেওয়া পর্যন্ত সব অরাজনৈতিক ঘটনাই ঘটেছে। ঠিক একই ঘটনা দেখা গেল দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ১১ জুন। ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন নিয়ে মতবিরোধের জেরে ওইদিন নয়াপল্টনের অফিসেও তালা ঝুলিয়ে দেয় একটি গ্রুপ। ঘটনা ঘটেছে স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার উপস্থিতিতেই। কিন্তু ছাত্রনেতারা তাদের কোনো তোয়াক্কাই করেননি! টিভি পর্দায় তাদের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বলে দিয়েছে কতটা উদ্ধত ছিলেন তারা। প্রশ্ন উঠেছে, একটি রাজনৈতিক দলের জুনিয়র নেতা-কর্মীরা কীভাবে সাহস পান সিনিয়রদের সামনে এমন ঔদ্ধত্য দেখাতে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে যখন কোনো দলের সিনিয়র নেতারা নিজেদের কর্মকান্ডের দ্বারা বিতর্কিত হন, তখনই জুনিয়রদের কাছে তাদের সম্মান কমে যায়। বিভিন্ন সময়ে কমিটি গঠনে যেসব বাণিজ্যের কথা শোনা গেছে, ওইসব কারণেই যে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা সিনিয়রদের আর মানতে চাইছেন না, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

এটা অস্বীকার করা যাবে না, বেগম জিয়ার অনুপস্থিতি বিএনপিকে চরম সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তারেক রহমানও দূরে বসে সঠিকভাবে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারছেন এমনটি মনে হচ্ছে না। যেজন্য গৃহীত সিদ্ধান্ত বদলে যাচ্ছে দ্রুত। এর ফলে দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। চেয়ারপারসন ১৬ মাস কারাগারে আছেন। তার মুক্তির ব্যাপারে দলটি এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যারা শপথ নিয়েছেন তারাও বলেছিলেন সংসদে গিয়ে নেত্রীর মুক্তির দাবিতে ঝড় তুলবেন। কিন্তু এ পর্যন্ত তারা একটু ‘দমকা হাওয়া’ও সৃষ্টি করতে পারেননি। এ কথা এখন অনেকেই বিশ্বাস করেন, তারা শপথ নিয়েছেন কেবলই ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়কে বিবেচনায় রেখে। নেত্রীর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়ার কথা শুধুই বাতাবরণ। ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা একাদশ জাতীয় সংসদকে বৈধ সংসদ বলে মনে করেন না। এ কথা তিনি শুধু সংসদে নয়, টেলিভিশন টক-শোতেও বহুবার বলেছেন। প্রশ্ন হলো, স্ব-আখ্যায়িত ‘অবৈধ সংসদ’-এর সংরক্ষিত আসনের এমপি হিসেবে তিনি কি বৈধ? গোটা সংসদই যদি অবৈধ হয়, সেখানে একা রুমিন বৈধ থাকেন কী করে? নাকি গল্পের ঝোলের সঙ্গে মোরগের রানের মতো তিনি হালালে পরিণত হয়েছেন? জানি, এ বিষয়ে কেউ কেউ রাজনীতিকদের আত্মরক্ষার সেই পুরনো বর্মকেই টনে আনবেন- ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’। ধরে নিলাম শেষ কথা নেই। তাই বলে কি ন্যূনতম নীতিবোধও থাকতে নেই? একমুখে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান, সংসদকে অনির্বাচিত ও অবৈধ বলা; অন্যমুখে সংসদে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি (কারও কারও মতে খোঁড়া যুক্তি) প্রদর্শন কোন ধরনের নৈতিকতা- এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার রাজনীতিতে আগমন অল্প দিনের হলেও তিনি অপরিচিত নন। টিভি টক-শোয় তার সপ্রতিভ উপস্থিতি এবং কথা বলা তাকে পরিচিতি দিয়েছে খারাপ নয়। তার ওপর তিনি বহন করছেন মর্যাদাপূর্ণ রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। তার পিতা এ দেশের একজন স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ ছিলেন। পিতাকে কতটা জেনেছেন রুমিন আমার জানা নেই। তবে তাকে জানতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংকল্প বা সিদ্ধান্তে অটল থাকা, কোনোভাবেই স্ববিরোধী অবস্থানে না যাওয়া একজন রাজনীতিকের ক্যারিয়ার গড়তে যে কতটা জরুরি তা বুঝতে হবে। কারণ কোনো ব্যাপারে স্ববিরোধী অবস্থান একজন রাজনীতিককে শুধু বিতর্কিতই করে না, তার ক্যারিয়ারকেও নিয়ে যেতে পারে খাদের কিনারে। রুমিন ফারহানার পিতা অলি আহাদ (বর্তমানে মরহুম) তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ গ্রন্থে এসব বিষয়ে গভীর আলোচনা করেছেন। পিতার সে বইটি বোধকরি তার আরেকবার পাঠ করা উচিত।             

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর