শনিবার, ২৯ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাজেটের লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জ

হাসানুল হক ইনু

বাজেটের লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জ

এবারের ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের শেষ অর্থবছর ২০০৬-০৭-এ বাজেট দিয়েছিল ৬৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার। শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে শুরু করেছিল। ১০ বছরের মাথায় গত অর্থবছর ২০১৮-১৯-এ ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকায় বাজেটের আকার উন্নীত করেছিল। ১০ বছরে শেখ হাসিনার সরকারের বাজেট শুধু আকারেই বড়ই হয়নি, বাস্তবায়নের সক্ষমতার হারও অনেক বেড়েছে। ১০ বছরে বাজেট বাস্তবায়নের হিসাব করলে শেখ হাসিনা সরকারকে GPA-5, GOLDEN GPA-5  দিতে হয়। জাতীয় অর্থনীতির সক্ষমতা বেড়েছে বলেই বাজেটের আকারও বেড়েছে, বাস্তবায়নের হারও বেড়েছে। সুতরাং ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবকে উচ্চাভিলাষী, আকাশচুম্বী, বাস্তবায়নযোগ্য নয়, গণবিরোধী, বড়লোকের বাজেট এসব গতানুগতিক সমালোচনা এখন আর চলে না। জঙ্গিবাদের ধ্বংসস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট। এ বাজেটের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শর্ত ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য আছে। আমাদের জাতীয় লক্ষ্য ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, ২০৩০ সালে SDG   বাস্তবায়ন, ২০৪১ সালে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনের সূত্রপাত ও সুনির্দিষ্ট পথচলা এবারের বাজেট বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই শুরু করতে হবে। তাই এবারের কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনা করা উচিত। তা হলো : জঙ্গি-সন্ত্রাসের পুনরুত্থানের সব ফাঁকফোকর বন্ধ করে রাজনৈতিক শান্তির ধারাকে টেকসই এবং রাজনীতি ও অর্থনীতিকে সুশাসনের পথে সুনির্দিষ্ট যাত্রা করা। অর্থনীতি ও সমাজকে বৈষম্যমুক্ত করতে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্রের পথে চলা শুরু করা। ঋণখেলাপি ও লুটেরাদের কবল থেকে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতকে মুক্ত করা। দুর্নীতি-লুটপাট-অপচয়-লোকসানের দুষ্টচক্র থেকে রাষ্ট্রীয় খাতকে মুক্ত করা। কর ও রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ করে কর-জিডিপির অনুপাত ১০% থেকে ২০%-তে উন্নীত করা। শিক্ষার মান উন্নয়নে সমগ্র শিক্ষা খাত এবং সব নাগরিকের সুস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পুরো স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ইতিবাচক দিক রয়েছে, তা হলো : প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ৮.২% নির্ধারণ করা, মোটরসাইকেলসহ দেশীয় উৎপাদিত পণ্য ও দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা প্রদান করা, কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি করমুক্ত করা, ক্যান্সারে ওষুধের কাঁচামালের দাম কমানো, ইউনিভার্সাল পেনশন চালুর প্রস্তাব, শস্যবীমা চালুর প্রস্তাব, তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিল তৈরি, সুস্পষ্ট না হলেও কয়েক স্তরবিশিষ্ট নতুন মূসক আইন, সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতা ও আকার বৃদ্ধি, গ্রাম থেকে রাজস্ব আহরণ করে রাজস্ব বৃদ্ধির প্রস্তাব, প্রবাসীদের আয় পাঠাতে ২% প্রণোদনা, পোশাকশিল্পসহ রপ্তানি পণ্যে ভর্তুকি ও প্রণোদনা প্রদান, বড় প্রকল্পে ১০ হাজার কোটি বরাদ্দ, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ও বরাদ্দ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক জোন সক্রিয় করা। তবে বাজেট প্রস্তাবে বেশকিছু দুর্বলতা ও নেতিবাচক দিক আছে। সিম কার্ডের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি, টক টাইমের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ, স্মার্টফোনের ওপর অতি উচ্চ কর আরোপ, সঞ্চয়পত্রের আয়ের ওপর উৎসে কর ৫% থেকে ১০%-তে বৃদ্ধি, অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার প্রস্তাব, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কম হওয়া, একদিকে ব্যক্তির আয়কর মুক্ত সীমা ২.৫ লাখ টাকা বহাল রাখা অন্যদিকে সম্পদের ওপর সারচার্জের নিম্নসীমা ২.২৫ কোটি থেকে ৩ কোটি টাকায় উন্নীত করা বৈষম্যমূলক প্রস্তাব, করপোরেট ট্যাক্স অপরিবর্তিত রাখা, অনলাইন কেনাকাটা ও ই-বাণিজ্যের ওপর বাড়তি কর আরোপ ইত্যাদি। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে নগদ লভ্যাংশ দিতে বলা হয়েছে। এ প্রস্তাবটি বিনিয়োগবিরোধী। এতে কোম্পানিগুলোর তারল্য সংকট দেখা দেবে। রিটেইল্ড আর্নিংয়ের ওপর যে কর প্রস্তাব করা হয়েছে তাও একটি ভুল প্রস্তাব। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু পরিবর্তন ও সংশোধন আনার বিষয় বিবেচনা করা দরকার। তা হলো : ব্যক্তি আয়ের কর মুক্ত সর্বনি¤œ সীমা ২.৫ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা করা। সম্পদের ওপর সারচার্জ ৩ কোটি টাকায় বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাহার করে আগের ২.২৫ কোটি বহাল রাখা। সঞ্চয়পত্রের আয়ের ওপর উৎসে কর ১০%-এ বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাহার করে ৫%-এ বহাল রাখা। কালো টাকা/অপ্রদর্শিত টাকা বিনিয়োগের নামে বৈধ করার সুযোগ দিয়ে গত ১০ বছরে কোনো সুফল আসেনি। অর্থনীতিতে কোনো প্রভাবও পড়েনি। ড. কামাল ও বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া এ সুযোগ আর কেউ নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই! অর্থমন্ত্রীর কাছে এ তালিকাটিও প্রকাশ করার আহ্বান করছি। যত যুক্তি-সাফাই দেওয়া হোক না কেন এ প্রস্তাব অনৈতিক ও সংবিধানের চেতনাবিরোধী। যেখানে কালো টাকার কোনো ভূমিকা ছাড়াই ৮%-এর ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, সেখানে কালো টাকা থেকে সাদা হওয়া অল্প কিছু টাকার জন্য এত বড় সাদা অর্থনীতির গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগানো ঠিক নয়। সুতরাং এ প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে হবে। করপোরেট ট্যাক্স অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে কমাতে হবে। এতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। আয়কর অধ্যাদেশের ৫২ (ক) ধারা সংশোধন করে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ফি ৫০০% বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাহার করা। অনলাইন কেনাকাটা ও রাইড শেয়ারিংয়ের ওপর বাড়তি কর প্রত্যাহার করে নতুন শিল্প খাত ও উদ্যোক্তা খাত হিসেবে এ খাতে কর রেহাই করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে মোবাইল খাত। এ খাতে সিম কার্ড, টক টাইম ও স্মার্টফোনের ওপর অধিক কর/শুল্ক আরোপ করা বাঞ্ছনীয় নয়। স্মার্টফোন আসলে একটি মিনি কম্পিউটার। দেশীয় কারখানায় উৎপাদিত স্মার্টফোন বাজারের চাহিদার ৫% পূরণ করতে পারে। বাকিটা আমদানি করতে হয়। উচ্চ শুল্ক থাকায় বৈধ আমদানির পরিমাণ খুবই কম। যেমন বলা যায়, আইফোন বৈধ পথে মাত্র ৩৫ হাজার দেশে এসেছে। কিন্তু ৩০ লাখ আইফোন মানুষের হাতে হাতে। অন্য স্মার্টফোনেরও একই অবস্থা। আরেকটি সমস্যা হলো, এ অবৈধ আমদানিতে নকল স্মার্টফোন বাজার ছেয়ে গেছে। জনগণ ঠকছে। সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। তাই বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহার করা দরকার। দুই বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যেই দেশে উৎপাদিত স্মার্টফোন দিয়ে চাহিদা পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে। তার পরই কেবল স্মার্টফোনের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর আয়ের ওপর দ্বৈতকর/দ্বিগুণ কর আরোপ সমগ্র খাতে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করবে। সুতরাং দ্বৈতকর/দ্বিগুণ কর আরোপের প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করা দরকার। প্রস্তাবিত বাজেটের সূত্র ধরেই বাজেট ও অর্থনীতির কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। আমাদের মনোযোগ দিতে হবে : কৃষি অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি, কর ফাঁকি/রাজস্ব ফাঁকির সংস্কৃতি, সরকারি ব্যয়ের মান রক্ষার, বৈষম্য-দুর্নীতির অবসান, রাজনীতি-অর্থনীতিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও শক্তিশালী করা, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমান্তরালভাবে সংস্কৃতির প্রবৃদ্ধি অর্জন করা ইত্যাদি।

রাজস্ব বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। দেশে মাত্র ২০ লাখ লোকের টিআইএন আছে। কর দেওয়ার যোগ্যতাসম্পন্নদের মধ্যে খুবই স্বল্পসংখ্যক কর দেন। ১ কোটি টাকা কর দিতে সক্ষম এমন ১ লাখ নতুন করদাতা চিহ্নিত করা সম্ভব। জিডিপি-কর অনুপাত ১৫% থেকে ২০%-এ উন্নীত করতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তি হচ্ছে গেম চেঞ্জার। তাই ভ্যাট ও কর আদায়ে ডিজিটাল যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানো দরকার। Electonic Fiscal Device-EFD, Electrnic Cash Register-ECR, Sales Data Controller-SDC  ইত্যাদির যন্ত্রের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। উপজেলায় রাজস্ব অফিস খোলার প্রস্তাব এ বছরই কার্যকর করতে হবে। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে ১০ হাজার কর্মী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগদান করতে হবে। উপজেলা সদরের বাইরেও দেশের গ্রামীণ এলাকায় ৯ লাখ হাটবাজারে অসংখ্য স্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা ব্যবসায় ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যারা কর প্রদানের সামর্থ্য রাখে তাদের করের আওতায় আনতে হবে। বড় কোম্পানিগুলো মামলা করে ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ভ্যাট/ট্যাক্স আটকে রেখেছে। জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে এ টাকা আদায় করা দরকার। রাজস্ব খাত গতিশীল করতে প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন দরকার। রাজস্ব ব্যয়ের খাতও পর্যলোচনা করা দরকার। গত বছর ৩৭ মন্ত্রণালয়/বিভাগের ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে। এ ব্যয় কমানোর জন্য পদক্ষেপ বাঞ্ছনীয়। নতুন ভ্যাট আইনকে স্বাগত জানাই। কিন্তু নানা স্তর ও হারের নতুন ভ্যাট আইন স্পষ্ট নয়। কর রেয়াত শর্তও অযৌক্তিক, এতে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হন। এ পদ্ধতি সহজ করা দরকার। পণ্য উৎপাদনে কাঁচামাল কেনার ক্ষেত্রে ভ্যাট প্রমাণপত্র সঠিক থাকলেই কর রেয়াত পাওয়া উচিত। ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ না করায় কর রেয়াত না দেওয়ার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই নতুন ভ্যাট আইনে ভোক্তাদের ওপর কী প্রভাব পড়বে তা পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তুতি রাখতে হবে।

ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও সুশাসন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, ব্যাংকের সংখ্যা কমাতে ব্যাংক একীভূতকরণে উদ্যোগ নেওয়া, দেউলিয়া আইন ও ইনসলভেনসি আইন সুনির্দিষ্টভাবে প্রণয়ন, বড় বড় ঋণখেলাপি যাতে ঋণ আদায় স্থগিত করতে আইনের ফাঁকফোকরে কোনো সুযোগ না পায় তার ব্যবস্থা করা, ঋণখেলাপিদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা না দেওয়ার প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জাতীয় দিবসে বঙ্গভবন/গণভবনে যেন ঋণখেলাপিরা আমন্ত্রণ না পায় এবং বিদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ না পায়।

বাংলাদেশ ব্যাংককে কর্ম সম্পাদনে স্বাধীনতা প্রদান করা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ভরসা রাখতে হবে। ব্যাংকিং খাতের বিষফোঁড়া সার্জারি করার সক্ষমতা আইনত বাংলাদেশ ব্যাংকের আছে, অর্থ মন্ত্রণালয় যেন এখানে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধা না দেয়। ব্যাংকিং কমিশনের প্রস্তাব বাজেটে করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা থাকলে যে কাজ ব্যাংক কমিশনের করার কথা তার সবই বাংলাদেশ ব্যাংক করার সক্ষমতা রাখে। তাই ব্যাংকিং কমিশন করার আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে আইন অনুযায়ী কাজ করার সুযোগদানের বিষয়টি পর্যলোচনা করার অনুরোধ করছি। ব্যাংক সুদের হার বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। জোর করে সুদহার নির্ধারণ বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে, বিদ্যমান তারল্য সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। উৎপাদনশীল খাতের জন্য ব্যাংক রেট কমানো, রিফাইন্যানসিং কর্মসূচি চালু, কম সুদে ঋণ বিতরণ করতে হবে। অতীতে মসলা চাষ, গবাদিপশু, খামার, বর্গা চাষসহ অন্য কৃষকদের জন্য কৃষিঋণ, এসএমই ঋণ, সবুজ ঋণ, রপ্তানি খাতের জন্য ইডিএফসহ নানা সহায়ক ঋণ চালু করা হয়। ফলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সুদহার একক জিজিটে নেমে আসে, উৎপাদনশীল উদ্যোগগুলোয় সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। আর্থিক খাতে সংকট কাটানোর জন্য মুদ্রানীতির মাধ্যমে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক ফল লাভ করা যায়। সেজন্য ভ্রান্তি অহংকার ত্যাগ করা। মুদ্রা অবমূল্যায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত করা যায়। চলমান সামষ্টিক অর্থনীতি ভালো। মূল্যস্ফীতি ৬%-এর নিচে। প্রবৃদ্ধি ৮%-এর ওপর। এ অবস্থায় ধীরে ধীরে কয়েক ধাপে মুদ্রা অবমূল্যয়ন করলে বাজারে তত চাপ পড়বে না এবং তা ভোক্তাদের জন্য সহনশীলই থাকবে। মুদ্রা অবমূল্যয়ন করলে যে উপকার হবে তা হলো : রপ্তানি আয় বাড়বে, রেমিট্যান্স বাড়বে, চলতি লেনদেনের ঘাটতি কমবে, ব্যাংকের তারল্য বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে, দেশীয় শিল্প বাড়তি নিরাপত্তা পাবে, এজেন্ট ব্যাংকিং করলে বাড়তি টাকা পাওয়া যাবে, পোশাকশিল্পসহ রপ্তানি খাতে প্রণোদনা দেওয়া লাগবে না, প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর ওপর ২% প্রণোদনাও দেওয়া লাগবে না। এতে অনেক টাকা বাঁচবে। তাই এখনই সময় মুদ্রার মান অবমূল্যয়ন করার। শেয়ারবাজার নিয়ে আর কেলেঙ্কারি নয়। বিনিয়োগের স্থায়ী ও নিরাপদ ক্ষেত্র হিসেবে শেয়ারবাজারকে গড়ে তুলতে হবে। শেয়ারবাজারে বার বার ধাক্কা সামলাতে MARKET STABILIZATION FUND MVb Kiv| INVESTMENT CORPORATION OF BANGLADESH- ICB - ওঈই মার্কেট মেকার হিসেবে কাজ করতে পারে। শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্যাংকনির্ভরশীলতা কমানোর জন্য সমান্তরাল নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এর জন্য সহজ শর্তে বিভিন্ন বন্ড বাজারে ছাড়া যেমন : গ্রিন বন্ড, সিটি করপোরেশন বন্ড ইত্যাদি।

কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে অনিয়মতা দূর করতেই হবে। এ বিষয়ে কিছু প্রস্তাব : সব দেশে সব সময়ই কৃষি ঝুঁকিপূর্ণ। আকস্মিক বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাজার মূল্যের ওঠানামার কারণে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই কৃষিব্যবস্থাকে গতিশীল রাখতে বহুমাত্রিক ব্যবস্থাপনা দরকার। আমার প্রস্তাব কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন গঠন, সরকারি গুদামের সংরক্ষণ ব্যবস্থা ২২ লাখ টনে উন্নীত করা। প্রতি গ্রামে শস্য গোলা নির্মাণে কম সুদে শস্য গোলা ঋণ চালু। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে, সীমিত পরিমাণ চাল রপ্তানি করা, চাল আমদানির শুল্কহার নির্ধারণে দেশীয় উৎপাদনের দিকে নজর রাখা, কৃষিঋণ ফেরতদানের সময় বাড়ানো, হারভেস্টিং যন্ত্রপাতিসহ কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর ভর্তুকি প্রদান, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গবেষণায় বাড়তি বরাদ্দ, কৃষি উপকরণে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা এবং এবার বাজেটে চাষিদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য ১.৮২ কোটি কার্ড ধারণকারী চাষির প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা প্রদান করা। এতে মাত্র ৯ হাজার কোটি টাকা লাগবে। গত কয়েকটি অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকি ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ৩.৫ হজার কোটি টাকা খরচ হয়নি। এ টাকা দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত ধান চাষিদের ৫ হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব। এটা সাধ্যের ভিতরেই আছে। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১৪% বরাদ্দ ইতিবাচক। এ খাতে বরাদ্দ ও আওতা বেড়েছে। কিন্তু পরিমাণ কমেছে। National Social Security Plan -এ যে বরাদ্দের কথা ছিল তা দেওয়া হয়নি। এতে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দুটোই কমানোর গতি কমবে। তাই আরও বরাদ্দ দরকার। নগর দারিদ্র্য কমাতে বিশেষ বরাদ্দ দরকার। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা খুব ভালো। কার্যকর করতে আইন লাগবে। শুরুটা পোশাক ও চামড়া শিল্প কর্মচারীদের দিয়ে করা যায়। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১৫.২%। এটা সর্বোচ্চ হলেও যথেষ্ট ও গ্রহণযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক বিচারে বরাদ্দ হওয়া উচিত জিডিপির ৪%। সেখানে বরাদ্দ আছে ৩%-এর কাছাকাছি। বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১%। জনগণের রোজগার থেকে অনেক টাকা চলে যায় চিকিৎসার জন্য। বরাদ্দ দ্বিগুণ করুন। শিল্পাঞ্চলে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতাল করুন। আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যবস্থপানাও জরুরি। তাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক শান্তি দরকার। শেখ হাসিনা সরকারকে অনেক মূল্য দিয়ে এই শান্তি অর্জন করতে হয়েছে। তাই শান্তির শত্রু ও অশান্তির হোতাদের কোনো ছাড় নেই। দমন ওদের করতেই হবে। আগুনসন্ত্রাস দমন মানে প্রতিহিংসা নয়, জঙ্গি দমন মানে প্রতিহিংসা নয়, অন্তর্ঘাত দমন মানে প্রতিহিংসা নয়, খুনিদের বিচার মানে প্রতিহিংসা নয়, দুর্নীতির বিচার মানে প্রতিহিংসা নয়, এসব ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। রাজনৈতিক স্পেস নেই। এ কথা বলাটা আজ ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, শান্তির শত্রুদের জন্য কোনো রাজনৈতিক স্পেস নেই, গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে যারা গণতন্ত্রের পিঠে ছোবল মারে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য মায়াকান্না গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে। দেশে এখনো এমন রাজনৈতিক শক্তি আছে, যারা সামরিক শাসকের বপিত বিষবৃক্ষ। বিএনপির দিকে তাকালেই আমরা তা দেখি। বিএনপি সব খুনি, জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক চক্র মহলের রাজনৈতিক ছাতা। একটি সাম্প্রদায়িক দল। সংসদের ভিতরে বাইরে যেখানেই থাকুক সংবিধানের চার মূলনীতি মানে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার ঘোষণা মানে না। পাক হানাদার বাহিনীর জঘন্য গণহত্যা মানে না। বিএনপি যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করেনি, বিএনপি মিথ্যা তত্ত্বের প্রচারক; ১৫ আগস্ট বেগম জিয়ার জন্মদিন তত্ত্ব, জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক তত্ত্ব। এ ধরনের রাজনৈতিক শক্তিকে ছাড় দেওয়া বা জামাই আদরে রাখা বা ক্রেন দিয়ে টেনে তুলে বিরোধী দল বানানোর রাজনীতি দেশের জন্য ভালো ফল দেবে না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে দেশ-গণতন্ত্র-সংবিধানবিরোধী বিএনপিকে রাজনীতির ময়দান থেকে মাইনাস করতে হবে। যারা খালেদা ও তারেকের জন্য ওকালতি করছেন তারা গণতন্ত্রের রাস্তায় কাঁটা বিছাচ্ছেন।

বাজেট ও অর্থনৈতিক নীতি-কৌশল সমৃদ্ধির বাংলাদেশ উপহার দেবে, তার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হলে বৈষম্যের অবসান ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। তাই আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ : জঙ্গিবাদের ধ্বংসস্তূপের ওপর বৈষম্যমুক্ত সুশাসনের দেশ গড়া। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে শাসনদ- আছে, তা মুখ না দেখে, দল না দেখে, কঠোর প্রয়োগ দরকার। এ প্রসঙ্গে সম্রাট বাবরের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে আমার বক্তব্য শেষ করব। বাবর বলেছেন, ‘সম্রাটের পুত্র থাকে না, ভাই থাকে না। তারা সব সময় একা। সম্রাটের বন্ধু তার সুতীক্ষè তরবারি, তার ছুটন্ত ঘোড়া আর তার বলিষ্ঠ দুই বাহু, তার বন্ধু নিজের বিচার এবং পাঁজরের অস্থির নিচের কম্পমান হৃদয়।’

লেখক : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি। সংসদ সদস্য এবং তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি।

সর্বশেষ খবর