সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

সামাজিক অপরাধ ও মূল্যবোধ

তপন কুমার ঘোষ

সামাজিক অপরাধ ও মূল্যবোধ

খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে বড়ই উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা। তুচ্ছ কারণে একজন আরেকজনকে হত্যা করছে। বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হচ্ছে। মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি দিয়ে নিরপরাধ মানুষ মারা হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু থেকে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা। শিক্ষকের হাতে ধর্ষিত হচ্ছে শিক্ষার্থী। এসব খবর লজ্জায় নুইয়ে দেয় মাথা। সামাজিক অপরাধের মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, হতাশা, মাদকের প্রভাব, সম্পদের লোভ, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, সুস্থ বিনোদনের অভাব, আয় বৈষম্য ও সমাজের নানা অসংগতিকে এসব সামাজিক অপরাধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মূল্যবোধের অবক্ষয়কে বিশেষভাবে দায়ী করা হচ্ছে। বাংলাদেশের দৃশ্যমান অনেক উন্নতি হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার আট শতাংশের ঊর্ধ্বে। বাজেটের আকার ফিবছর বাড়ছে। মাথাপিছু আয় ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে ১ হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার। অবকাঠামোগত অনেক উন্নতি আছে। বিদ্যুৎ খাতে অর্জন প্রশংসনীয়। বেড়েছে গড় আয়ু ও শিক্ষার হার। কিন্তু এই উন্নয়নের পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে আমাদের মূল্যবোধ। হারিয়ে যাচ্ছে মানবিকতা।

মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যবোধ। মূল্যবোধ পরিবর্তনশীল। দেশ-কাল-পাত্রভেদে মূল্যবোধ ভিন্ন হতে পারে। সমাজের বিবর্তন হয়। এটা কালেরই নিয়ম। এই পরিবর্তন ভালো না মন্দ তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। বিবর্তন সব সময় আগের চেয়ে ভালো কিছু নিয়ে আসে তা কিন্তু নয়। মূল্যবোধ রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়। শিশু প্রথম মূল্যবোধের শিক্ষা পায় পরিবার থেকে। শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বাবা-মা। বাবা-মায়ের কাছ থেকেই শিশুরা প্রথম ভালো-মন্দের পার্থক্য শেখে। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা চারপাশে যা দেখে, তা থেকেই শেখে। পরিবারের সদস্য, গৃহশিক্ষক, পাড়াপড়শি, স্কুলশিক্ষক-  সবার কাছ থেকেই শিশু জীবনের শিক্ষা পায়। সার্টিফিকেটনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় ভালো করছে কি না, সেটাই এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ হচ্ছে কি না, তা এখন গৌণ। মূল্যবোধের শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।

সীতানাথ বসাক প্রণীত ‘আদর্শলিপি ও সরল বর্ণপরিচয়’ বইটির সঙ্গে পরিচয় নেই এমন মানুষ সম্ভবত কমই আছেন। বিশেষ করে যাদের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। বর্ণ দিয়ে বাক্য গঠন পদ্ধতি শেখানোর পাশাপাশি অনেক নীতিকথা শেখানো হয়েছে ওই বইয়ে। ছোটকালে পড়া সেই নীতিকথাগুলো আজও মনে গেঁথে আছে। সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যাবাদীকে কেহ বিশ্বাস করে না, বিদ্যা পরম ধন, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর, গুরুজনের অবাধ্য হইও না, গর্ব করা ভালো নয়, অহংকারই পতনের মূল, পরোপকার মহাব্রত, অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করা অনুচিত, যত্ন করিলে রত্ন মিলে- এমনি আরও অনেক নীতিকথা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণপরিচয় বইটি একসময় গ্রামগঞ্জের মুদি দোকানেও পাওয়া যেত। না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে, চোর বলিয়া তাহাকে সবাই ঘৃণা করে। নৈতিক শিক্ষার প্রথম পাঠ বিদ্যাসাগরের ওই চটি বই পড়ে। আগামীর শিশুদের সুশিক্ষা দিতে এসব বিষয় পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি ভাবতে হবে।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ছোটগল্প ‘ডাকহরকরা’র কাহিনি মনে পড়ে কি? গল্পটা অনেক আগে পড়া। একটু এদিক-ওদিক হয়ে যেতে পারে। গল্পের মূল চরিত্র দিনু ডোম। দিনু ডাকহরকরা। পোস্ট অফিসের ডাকব্যাগ পিঠে নিয়ে সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া তার কাজ। একদিন রাতের অন্ধকারে ডাকব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে আক্রমণ করে এক দুষ্কৃতকারী। ডাকব্যাগের মধ্যে মানি অর্ডারের টাকার থলি। দিনু প্রাণপণে ডাকব্যাগ বুকে আঁকড়ে রাখে। ব্যাগ নিয়ে টানাহেঁচড়ার এক পর্যায়ে ছিনতাইকারীকে চিনতে পারে দিনু। এ যে তারই পুত্র নিতাই! এ নিয়ে আদালতে মামলা হয়। মামলার সাক্ষী দিনু। দিনু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। একদিকে সত্য, অপরদিকে পুত্র। অবশেষে সত্যেরই জয় হয়। দিনু আদালতে অকপটে স্বীকার করে, রাতের আঁধারে ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তারই পুত্র নিতাই। নিতাইকে চিনে ফেলায় সে তার মাথায় আঘাত করে পালিয়ে যায়। এই গল্পের মাধ্যমে সত্যের জয়গান গাওয়া হয়েছে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত কবিতা ‘রানার’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অনবদ্য হয়ে উঠেছে কবিতাটি। রানার গ্রামের ডাকহরকরা। ভোর হওয়ার আগেই ডাক শহরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ নিয়েছে সে। ঘরে অর্থের অভাব। পিঠে টাকার বোঝা। তবুও এ টাকাকে যাবে না ছোঁয়া! পোস্ট অফিসের একজন অতি সাধারণ কর্মচারী আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে যায়? দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম দস্যু নিজামের গল্প। নিজাম ডাকাতের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এই পাপ কাজে কেন সে লিপ্ত? নিজামের জবাব, পরিবার পরিজনদের ভরণপোষণের জন্য সে এই পথ বেছে নিয়েছে। তাকে প্রশ্ন করা হয়, তুমি যাদের জন্য এই পাপ করছ, তারা কি তোমার পাপের ভাগিদার হবে? বাড়ি ফিরে গিয়ে তুমি তাদের কাছে জানতে চাও। নিজাম ডাকাতের পাপের ভাগিদার হতে পরিবারের কেউই রাজি হয় না। অবশেষে নিজাম ডাকাতের বোধোদয় হয় এবং টাকাপয়সা লুণ্ঠন ছেড়ে দিয়ে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। এ কাহিনি থেকে আমরা কী বার্তা পাই?

সন্তানদের লেখাপড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহিত করার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। অধুনা মনীষীদের নানা উক্তি, যা প্রধানত উপদেশমূলক, ঘুরপাক খায় ফেসবুকে। অনেকেই লাইক করেন বা শেয়ার করেন। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনাচরণে আমরা এসব পরিপালন বা চর্চা করছি কি না, সেটাই মুখ্য বিষয়। কথায় বলে না, আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও।

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর