রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সব দায়িত্ব কি রাজনীতিকদের?

নঈম নিজাম

সব দায়িত্ব কি রাজনীতিকদের?

সব দায়িত্ব কি রাজনীতিকদের? আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির একটা কথা আছে- ‘আপনার দেশ আপনার জন্য কতটা করতে পারে তা জানতে না চেয়ে বরং নিজেকে প্রশ্ন করুন, দেশের জন্য আপনি কী করতে পারেন?’ কাজ করতে চাইলে অনেক ভাবে করা যায়। না চাইলে শুধু সমালোচনা করেই একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিছু মানুষ আছে একটা জীবন কাটিয়ে দেয় অন্যের সমালোচনা করেই। নিজে কী করল তার খবর নেই। অথচ পাড়াপড়শিকে নিয়ে ঘুম নেই। সামাজিক, নৈতিক দায়িত্ব ও মূল্যবোধ অনেক আগেই ক্ষয়ে গেছে। নাগরিক হিসেবে স্বাভাবিক দায়িত্বটুকু কেউ পালন করতে চায় না এখন। অথচ কথায় কথায় আমরা বিদেশ টেনে আনি। দেশে রাজপথ পার হই মোবাইল ফোন কানে লাগিয়ে কথা বলতে বলতে। ট্রাফিক আইন মানতে চায় না কেউই। পরদেশের পরিচ্ছন্নতার প্রশংসাও সবাই করি। কিন্তু নিজের দেশে ময়লা ফেলি রাজপথে। ঢাকার বাইরের মহাসড়কগুলো দিয়ে এখন আর চলা যায় না। পৌর মেয়ররা ময়লা ফেলেন হাইওয়ের দুই পাশে। যেন হাইওয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে মেয়র সাহেবদের ময়লা ফেলার জন্য। বড় বড় কথা বলে সবাই, দেশের প্রতি দূরে থাক নিজের পরিবারের প্রতিও দায়িত্ব অনেকে পালন করে না। অনেক সন্তান বাবা-মায়ের খোঁজ রাখে না। আবার অনেক বাবা-মা নিজেদের ব্যস্ততার কারণে খোঁজ নেন না সন্তানের।

সেদিন কথা হচ্ছিল একজন মনোচিকিৎসকের সঙ্গে। বললেন, সামাজিক অস্থিরতা ভয়াবহভাবে বিকশিত হচ্ছে। সমাজের উঁচুতলার লোকজন সন্তান, পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো নেই। রোগী দেখে কুলাতে পারছি না। বড় কঠিন এক পরিস্থিতি। এ কথা শুধু মনোবিজ্ঞানীর নয়, বাস্তবতা আরও জটিল। অতি-আধুনিকতার নামে পারিবারিক বন্ধন শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেক সন্তান বাড়ি থেকে বের করে দেয় বৃদ্ধ বাবা-মাকে। আবার কেউ বিদেশিদের মতো বছরে দু-চারবার ফোনে খোঁজ নেয়। সব কিছুতেই কৃত্রিমতা। মনের তাগিদে এখন কেউ কিছু করে না। প্রযুক্তির জোয়ারে মন নামক শব্দটি মরে গেছে। শহর অথবা গ্রাম সবখানেই একই চিত্র। সম্পর্কের স্বাভাবিকতা নেই। সংসার জীবনে বিয়ে আর ডিভোর্স এখন অনেকের কাছে কোনো ঘটনাই নয়। সেদিন এক সরকারি আমলা এক সাংবাদিক বন্ধুকে বললেন, ভালো নেই ভাই। কাজ করি বাড়ি যাই। বউ চলে গেছে পরকীয়া করে আরেকজনের সঙ্গে। বিদেশ গিয়ে সন্তান পরবাসী হয়েছে। বিয়ে করেছে বিদেশিনীকে। একাকিত্বের জীবন। এখন ডিভোর্সকে অনেকে মনে করে অতি-আধুনিকতা। সংসারকে ভাবে অশান্তির অনল। সন্তানকে মনে করে ভেজাল। বড় হয়ে সেই সন্তানই বদলে যায়। চারপাশের সবকিছুই বেখাপ্পা। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম সব শেষ। অতিলোভ সর্বনাশ ডেকে আনছে। মানুষ হারিয়েছে মনুষ্যত্বের বোধটুকু। রাস্তায় মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, বাকি সবাই তামাশা দেখে। ছবি তোলে। সামাজিক গণমাধ্যমে তা আপলোড করে। লাইক দেখে। মনে হয় আনন্দের কোনো কাজ করছে। বিবেকবোধ এখন কারও কাজ করে না। নিরীহ বলে খ্যাত মানুষই হঠাৎ হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো ঘটিয়ে বসে। কেন? কী সমস্যা তাদের? পুরো সমাজটাই একটা রক্তক্ষরণের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত করছি? কারও জবাব নেই কারও কাছে। আকাশ সংস্কৃতি ধ্বংস করছে আমাদের চিরচেনা সংস্কৃতি। ইন্টারনেট আর সামাজিক গণমাধ্যম হরণ করছে ব্যক্তিগত জীবন। অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে শেষ হচ্ছে পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ। আর একবার এ মূল্যবোধ শেষ হয়ে গেলে ফিরে পাওয়া কঠিন।

উন্নত বিশ্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে মানসিক চিকিৎসক ও পরামর্শক রাখা হয়। আমাদেরও সেই সময় এসে গেছে। বাস্তবতা সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। অন্যের প্রতি দোষ চাপিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। বরং প্রশ্ন থেকে যায়, তুমি কী করলে জগৎ ও সংসার নিয়ে? দায়িত্বের জায়গাগুলো ভুলে গেলে চলবে না। মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ায় সবারই কমবেশি কিছু দায়িত্ব থাকে। এ দায়িত্ব সমাজ, দেশ ও পরিবার-পরিজনের প্রতি। আর অন্যের কষ্টে খুশি হওয়ার কিছু নেই। আগামীকাল এ কষ্ট তোমাকেও ভোগ করতে হতে পারে। মানুষ পরিচয়ে বেঁচে থাকলে সঙ্গে মানবতাবোধটুকু থাকতে হবে। মানবতা শেষ হলে আর কিছুই থাকে না। মানুষের পাশে দাঁড়ানো কষ্টকর কিছু নয়। দরকার আন্তরিকতাটুকু। আর্তমানবতার সেবার চেয়ে বড় কিছু নেই। চলার পথে একজন রাজনীতিবিদ কমবেশি কাজ করেন। ভালোমন্দ সবখানেই আছে। আমি সবাইকে এক কাতারে মূল্যায়ন করছি না। ভালো রাজনীতিবিদ অনেক আছেন এখনো। আবার ক্যাসিনো লিডারের সংখ্যাও সারা দেশে কম নয়। রাজনীতিবিদরা দুর্বল হলে সরকার ভালো চলে না। কারণ রাজনীতিবিদদের ব্যর্থ প্রমাণে আমলারা তৈরি থাকেন। আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বলে একটা কথা চালু ছিল ব্রিটিশ শাসনকালে। আমরা সেই বেড়াজাল থেকে বের হতে পারিনি এখনো। সময় বয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধান হয় না। দেশের আমলাতন্ত্রের মানসিকতা বদল করতে হবে। ঔপনিবেশিক আমল এখন আর নেই। বাস্তবতার নিরিখে কাজ করতে হবে সবাইকে। আমলারা অনেক সময় দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। কাজ করলে কমবেশি ভুল হবে। কাজ না করলে কোনো দায়দায়িত্ব নেই। রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের দাবি বেশি। আশাও অনেক। সব কাজ আইনের প্রতি সমান্তরাল রেখে তারা করতে পারেন না। রাষ্ট্র শাসনে সবাই খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর মতো সৎ, ন্যায়পরায়ণ হবেনÑ এমন আশাও করি না। আর হজরত আলী (রা.)-এর মতো শক্তিশালী হবেনÑ তাও মনে করি না। এ যুগে তা সম্ভবও নয়। কিন্তু ন্যূনতম সততাটুকু আশা করতে পারি। একজন জনপ্রতিনিধি মানে মানুষের সম্পদ লুণ্ঠনকারী হতে পারে না। ক্যাসিনো কিংবা মাদক ব্যবসায় জড়াতে পারে না। মাঠ পর্যায়ের নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। উন্নয়নকাজে সমতা রাখতে হবে। পুলিশের নিয়োগে স্বাভাবিকতা কিছুটা ফিরেছে। চাইলেই সম্ভব। এভাবেই যেতে হবে প্রাথমিক শিক্ষক, দফতরি নিয়োগে। এডিবির অর্থের হরিলুট বন্ধ করতে হবে কঠোরভাবে। টেন্ডার বাণিজ্যের কবর তৈরি করতে হবে। খালিদ, জি কে শামীম নতুন করে তৈরির সুযোগ নেই। অর্জিত সাফল্য নস্যাতের চেষ্টা করলেই নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা। দুঃসাহসী কান্ডারির ভূমিকায় অন্যায় ও অসংগতির বিরুদ্ধে লড়ে চলেছেন শেখ হাসিনা। এ লড়াই সফল করতে হবে যে কোনোভাবে।

বুঝতে হবে দেশটা কারও একার নয়। সবাইকে ভাবতে হবে সমান্তরালভাবে। এ শহরে কেউ আইন-কানুনের তোয়াক্কা করেনি। মনে করেছে, সরকারি দলে সাত খুন মাফ। না, কোনো কিছুই মাফ নয়। অভিশাপ নেমে এসেছিল। শাপমোচনের পালা চলছে। এ শাপমোচনই আওয়ামী লীগকে নতুন পথ দেখাবে। আইনের শাসন দরকার। একটা আদর্শিক চিন্তা থেকে আগে সবাই রাজনীতি করত। এখন আর আদর্শের বালাই নেই। সবাই রাজনীতি করতে আসে ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে। ক্যাসিনো শুধু মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় নয়, সব ব্যবসায় অনেকে ক্যাসিনো বানিয়ে বসে আছে। ব্যাংকিং খাত, শেয়ারবাজার, টেন্ডার বাণিজ্য, সরকারি কাজ ও নিয়োগে ফাঁকিও এক ধরনের ক্যাসিনো। আমাদের নীতি-নৈতিকতা শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিষ্ঠুরতার কোনো শেষ নেই। আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতেই দরকার আইনের শাসন। এ নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি ধরে রাখতে হবে। জেগে ওঠা অর্থনীতির গতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। ধর্মের নামে অধর্মচর্চা বন্ধ করতে হবে। কিছু মানুষের কাজই মিথ্যাচার ও গুজব রটানো। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের কোনো রাজনৈতিক দলে দরকার নেই। সন্ত্রাসীরা নিজেদের বাঁচাতে রাজনৈতিক দলে আশ্রয় নেয়। সরকারি দল হলে তো কথাই নেই। ক্ষমতার জায়গাটুকু ওদের বেশি পছন্দ। বিরোধী দলে গেলে সন্ত্রাসীদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। বিএনপি এখন পাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের পর পায়নি। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরও পায়নি। আগামীতে কোনো সমস্যায় পড়লেও পাবে না। ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর! রাজনীতিকরা অতি আবেগে অনেক কিছু বোঝেন না। যখন বোঝেন তখন আর সময় থাকে না। আব্রাহাম লিংকনের একটি কথা আছে- ‘মানুষকে বিশ্বাস করা বিপজ্জনক। আবার না বিশ্বাস করা আরও বেশি বিপজ্জনক।’ এ দুই অবস্থানের হিসাব-নিকাশ ঠিক রেখেই রাজনীতির সুস্থধারা বজায় রাখতে হবে। মানুষকে বাস্তবতায় রাখতে হবে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে খলিফা ওমর (রা.)-এর জীবনে একটি বড় ঘটনা আছে। তাঁর শাসনকালে এক যুদ্ধে পারস্যের নিহাওয়ান্দ প্রদেশের শাসনকর্তা হরমুজান আটক হন। অগণিত মুসলমানকে হত্যার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। আটকের পর তাকে আনা হয় খলিফা ওমর (রা.)-এর সামনে। মুসলমানদের হত্যা করা ছাড়াও বার বার যুদ্ধ লাগানো, শান্তির শর্ত লঙ্ঘনসহ অভিযোগ অনেক। হজরত ওমর (রা.) তাকে প্রশ্ন করলেন, আপনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ কি সত্য? জবাবে হরমুজান বললেন, সত্য।

এবার খলিফা বললেন, আপনার বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানেন?

► জানি হুজুর! মৃত্যুদন্ড। আমি সেই সাজার জন্য প্রস্তুত আছি।

► শেষ মুহূর্তে আপনার কোনো শেষ ইচ্ছা থাকলে বলতে পারেন।

► আপনি মুসলিম জাহানের খলিফা। কঠোরতার পাশাপাশি দয়ালু। মারা যাওয়ার আগে আমি শুধু এক পেয়ালা পানি পান করব।

পানি আনার নির্দেশ দেওয়া হলো। সে পানি দেওয়া হলো হরমুজানকে পান করতে। পানি হাতে নিয়ে হরমুজান বললেন, আমি ভীত আছি এই পানি পান করার আগেই আমার দেহ কেউ তরবারির কোপে আলগা করে ফেলে কিনা। খলিফা বললেন, কথা দিচ্ছি এই পানি পান না করা পর্যন্ত আপনার দেহে কেউ আঘাত করবে না। হরমুজান পানির বাটি ফেলে দিলেন মাটিতে। তারপর খলিফাকে বললেন, এই পানি আমি আর পান করছি না। পড়ে গেছে। আপনি কথা দিয়েছেন এই পানি পান না করা পর্যন্ত কেউ আমাকে হত্যা করবে না। বিস্মিত হলেন খলিফা ওমর (রা.)। তারপর বললেন, আপনি নতুন কৌশল নিয়েছেন। তবে আমি আমার কথা রাখব। আপনাকে কেউই হত্যা করবে না। মুক্তি দিলেন হরমুজানকে। পুরো দরবার বিস্মিত হলো। হরমুজান চলে গেলেন। কিছুদিন পর আবার ফিরে আসেন বিশাল দলবল নিয়ে। দরবারে এসে হরমুজান বললেন, আপনি আমার সহকর্মীদের এবং আমাকে ইসলামের দীক্ষায় দীক্ষিত করুন। আজ থেকে আমরা ইসলামের জন্য লড়ে যাব। স্বামী বিবেকানন্দ নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন মানবতার জন্য। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ তৈরির আহ্বান ছিল তার। জীবন চলার পথে আজ দূরদর্শী মানুষ আর দেখি না। খলিফা ওমর (রা.)-এর সেই জমানা এখন আর নেই। স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বানও কেউ শোনে না। এ সমাজে হৃদয়হীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অসুস্থ, হিংসুটেরা সমাজকে অস্থির করে তুলছে। সামাজিক ন্যায়বিচার বলে কিছু নেই। এ সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। এ পথ থেকে উত্তরণের জায়গাটুকুও ধোঁয়াশা। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধোঁয়াশা অবস্থান কারও জন্যই ভালো নয়। সমাজের স্বাভাবিক অবস্থা ধরে রাখতে হবে। কিন্তু কী করে সম্ভব, জানি না।

                লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর