১২ রবিউল আউয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী, শ্রেষ্ঠ মানব মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মদিন। বাবা আবদুল্লাহ আর মা আমিনার ঘর আলো করে তিনি এসেছিলেন এবং একই দিনে এ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। জীবনে কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। কোনো লোভ-লালসা তাঁকে স্পর্শ করেনি। আরবরা যখন তাঁকে দুনিয়ার সমস্ত ঐশ্বর্য দিতে চেয়েছে তখনো তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেই রসুলের উম্মত আল্লাহর বান্দা আমরা আজ কত ভীতু কত নীচু। বুকে সত্য লালনের চেষ্টা করি সত্য, কিন্তু মুখে প্রকাশ করার সাহস রাখি না। আমাদের মেরুদ- কেমন যেন নুইয়ে গেছে। ভয়ভীতির কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু আমরা কেন যেন এমনিই ভীতু হয়ে কুঁকড়ে-মুকড়ে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আল্লাহর বান্দা রসুলের উম্মত আমাদের ভয় কীসের? আমরা মুসলমান। মুসলমান একবার মরে, বার বার মরে না। তবু কেন মরার ভয়? বাঙালির অনেক দুর্বলতা আছে। আবার নেপোলিয়ন ও আলেকজান্ডারের মতো অনেক অসাধ্যসাধনের ক্ষমতাও আছে। আলেকজান্ডার প্রথম যখন রাজ্য জয়ে বেরোতে চেয়েছিলেন তখন তাঁর বাবা বলেছিলেন, ‘রাজ্য জয় পরে হবে। গোশালে আমার প্রিয় ঘোড়া কদিন থেকে কথা শুনছে না। কেমন যেন করছে। আগে তাকে ঠিক করে এসো।’ আলেকজান্ডার গোশালে গিয়ে দেখেন ঘোড়ার মুখ পশ্চিম দিকে, সূর্য পুব দিকে। নিজের ছায়া দেখে সে লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করছে। ব্যাপারটা বুঝে এক ঝটকায় পশ্চিমমুখী ঘোড়াকে পুবমুখী করে দেন। তার লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি শেষ। কয়েক মিনিট পর পিতার কাছে এসে বলেন, ‘আমি ঘোড়া ঠিক করে এসেছি।’ আলেকজান্ডারের বাবা দ্বিতীয় ফিলিপ বেশ কয়েকদিন তাঁর প্রিয় ঘোড়ার অস্বাভাবিক আচরণে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি বীর তা জানি। কিন্তু ক্ষিপ্ত ঘোড়াকে বাগে আনলে কী করে?’ মহাবীর আলেকজান্ডার বললেন, ‘কেন! ব্যাপারটা তো খুবই সোজা। আমি গিয়ে দেখলাম আপনার প্রিয় ঘোড়া নিজের ছায়া দেখে লাফালাফি করছে। তার ছায়া লাফাতে দেখে আরও লাফাচ্ছে। আমি এক ঝটকায় তার পশ্চিমের মুখ পুবে করে দিলাম। ছায়া দেখা বন্ধ। সেও শান্ত হয়ে গেল।’ পিতা বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার বিশ্বজয়ের সময় হয়েছে। তুমি বেরিয়ে পড়।’ মওলানা ভাসানীকে পাই না, বঙ্গবন্ধুর ছায়া দেখি না, তাই কার আশায় থাকব, যে দেশটাকে এক ঝটকায় দুর্নীতি থেকে সুনীতিতে ফিরিয়ে আনবেন, মানুষের মধ্যে প্রচন্ড উদ্দীপনার সৃষ্টি করবেন? মহান ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনে কলম ধরে সেই প্রত্যাশাই করছি- আল্লাহ যেন আমাদের সুশাসনের দিকে অগ্রসর হওয়ার শক্তি দেন।
গত এক-দেড় মাস বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর জন্য খুবই পেরেশান ছিলাম। জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? যতবার কাছে গেছি ততবার শুনেছি- ‘বজ্র, আর ভালো লাগে নারে। এখন মরে যেতে ইচ্ছে করে। মানুষের কোনো কাজেই যদি লাগতে না পারলাম তাহলে নিজের জন্য জীবন বয়ে কী লাভ?’ লতিফ সিদ্দিকী জেল খেটেছেন অনেক। পাকিস্তান আমলে ছয়-সাত বছর, বাংলাদেশ আমলে তার থেকে কম নয়। সে তুলনায় আমরা জেল খাটার বেলায় খুবই অভাবী, দরিদ্র। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলতেও কেমন যেন একটা বাধোবাধো লাগে। সেই লতিফ সিদ্দিকীর জামিনের জন্য অনেকের কাছে ছোটাছুটি করেছি। তাঁরা যে আমাদের কত ভালোবাসেন, সম্মান করেন, গুরুত্ব দেন এটাও প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছি। কিন্তু কেন যেন সবার নেত্রীভীতি! অথচ আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি লতিফ সিদ্দিকীর জামিনে মুক্তির ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেত্রী বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করেননি। করার কথাও নয়। বরং একটি ফালতু মোকদ্দমায় তাঁকে জেলে রাখায় কিছুটা বিরক্ত। তাঁর যখন মন্ত্রিত্ব যায় তখন জামিন পেতে যদি অসুবিধা না হয় এখন এই ফালতু মামলায় জামিনে অসুবিধা কোথায়? দুদক তো নিয়মমত মামলাটি রুজু করতেও পারেনি। আসামি মন্ত্রণালয়ের কেউ নন। ক্রেতা আর মন্ত্রী। কোনো মন্ত্রী কোনো আদেশ ইস্যু করেন না, এখানেও করেননি। তাই চামচিকারা নানাভাবে নানা কিছু করার চেষ্টা করে। তবে সবার সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগেছে। সেদিন বহুদিন পর তাপসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বড় ভাইয়ের ব্যাপারে। পরশকে এত দিন পর চিনব কিনা জানি না। তাপস-পরশ মণি ভাইয়ের দুই ছেলে। মণি ভাই এবং তাঁর স্ত্রী আরজু মণিকে ঘাতকরা ১৫ আগস্ট হত্যা করেছে। মণি ভাই ছিলেন আমাদের পরিবারের ছায়া। স্বাধীনতার পরও মণি ভাইয়ের কাছে আমি কাদের সিদ্দিকী ছিলাম না। ছিলাম লতিফের ছোট ভাই। রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর ছিল দাও-মাছ সম্পর্ক। অনেকেই আমাকে রাজ্জাক ভাইয়ের পক্ষে টানতেন। অথচ আমি কারও পক্ষে ছিলাম না। আমি বঙ্গবন্ধুর পক্ষ ছাড়া অনেক সময় আমার পক্ষেও থাকতাম না। তার পরও রাজনীতিতে সব সময় পক্ষ-বিপক্ষ থাকে। কিন্তু তখন নীতি-নৈতিকতা ছিল। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী নিচের ক্লাসে দুর্বল ছিলেন। যত ওপরে উঠেছেন ততই তাঁর মেধার বিকাশ ঘটেছে। ম্যাট্রিকে সেকেন্ড ডিভিশন, ইন্টারমিডিয়েটে ফার্স্ট ডিভিশন, এরপর অনার্স, এমএ-তে বড় ভালো রেজাল্ট করেছেন। ঢাকা জেলে শেখ ফজলুল হক মণি লতিফ সিদ্দিকীকে এমএ পাস করতে সব রকম সাহায্য করেছেন। বলতে গেলে মূল শিক্ষকই ছিলেন তিনি। দিল্লিতে নেত্রী পরশ-তাপসের জন্য বড় চিন্তিত থাকতেন যতটা থাকতেন জয়-পুতুলের জন্য। তাপসও খুব একটা সাহস পাচ্ছিল না। যাক ওসব কথা। শেষ পর্যন্ত জামিন হয়েছে। আগে জজ কোর্টে জামিন হলে কেউ হাই কোর্টে জামিন বাতিলের কথা চিন্তাও করত না। এখন হাই কোর্টের জামিনে দুদক সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। আমি তো সাদা চোখে দেখি এ আপিল অর্থহীন। দেখা যাক, সামনে কী হয়। আল্লাহ আমাদের কপালে যা রেখেছেন তা আমরা সানন্দে গ্রহণ করব। আল্লাহর দয়ায়ও কারও হাত নেই। ফকির-মিসকিন দশ দুয়ারে যেতে পারে। এক জায়গায় না পেলে অন্য জায়গায় চাইতে পারে। কিন্তু মুসলমানের দরজা একটাÑ আল্লাহ। আল্লাহ ও রসুল (সা.) ছাড়া মুসলমানের আর কোনো জায়গা নেই- এটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেই এত দূর এসেছি। বাকি যেটুকু সময় পাব আল্লাহর ওপর ভরসা করেই যাব।
সেদিন হঠাৎই সৈয়দ আবুল হোসেনের অফিসে গিয়েছিলাম। খুবই ভদ্র, মৃদুভাষ,ী সদাহাস্য একজন সফল মানুষ। এনায়েতপুর তাঁর শ্বশুরবাড়ি। আমি পীর-মুরশিদের লোক নই। তবু অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তেমনি এনায়েতপুরের পীরদের সঙ্গে আমার খুবই ভালো সম্পর্ক। দু-তিন বার সৈয়দ আবুল হোসেনের শ্বশুর সামনে বসে নিজের হাতে খাইয়েছেন। ময়মনসিংহের শভুগঞ্জের পীর রেজাউল করীম শালা না সম্বন্ধি ঠিক জানি না। কিন্তু রেজাউল করীম ভালো জানাশোনা মানুষ। জ্ঞান আছে, মেধা আছে। সেই সৈয়দ আবুল হোসেন কিছুদিন আগে বিদ্যাসাগর পুরস্কার পেয়েছেন। ভারতের চারজন এবং বাংলাদেশের একজন শিক্ষা অনুরাগী হিসেবে তিনি পেয়েছেন। আমার খুবই ভালো লেগেছে। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার আগেই অর্থ চুরির অভিযোগ- এ নিয়ে বেশ কয়েকবার লিখেছি। আবারও লেখার ইচ্ছা আছে। তবে আমরা ছিলাম বঙ্গবন্ধুর পাগল। বঙ্গবন্ধুর ট্যাবলেট খেয়েছিলাম। তাই কোনো দিকে দেখতাম না। সৈয়দ আবুল হোসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পাগল। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কিছুই ভাবেন না। ও রকম আরেকজন বোরহান কবীর। ’৯০-এ দেশে ফিরে নঈম নিজাম, বোরহান কবীর, সাগর আরও কয়েকজন যুব সাংবাদিক পেয়েছিলাম। সেদিন বোরহানের একটা লেখা পড়ে উৎফুল্ল হয়েছিলাম। খুব ভালো লেগেছে ওর কথাবার্তা। প্রধানমন্ত্রীর কেমন কল্যাণ আর নিরাপত্তা চান বলে বোঝানো যাবে না। এমন ভক্ত-অনুরক্ত শুভাকাক্সক্ষী থাকে বলেই আমরা বেঁচে থাকি। কোনো সময় সুযোগ পেলে এদের নিয়ে দুই কথা লিখব। সৈয়দ আবুল হোসেনকে নিয়ে অবশ্য অবশ্যই লিখব। এটা আমার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
গত সপ্তাহে চার জাতীয় নেতা সম্পর্কে লিখেছিলাম, ‘জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা কেন?’ লিখতে গিয়ে একজনের কথাই শেষ করতে পারিনি। এর মধ্যে আবার প্রতিদিনের অফিসে গিয়েছিলাম নঈম নিজামকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। এক দিন পর গিয়ে পাইনি। লন্ডনে চলে গেছেন। ডা. মাহমুদের কথা শুনে পরদিন সকালে জামালপুরের পিটিআই গুরু ট্রেনিং স্কুলে গিয়েছিলাম। তাও প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা লেগেছিল। ময়মনসিংহ থেকে চেচুয়া-মুক্তাগাছা-নরুন্দী হয়ে জামালপুরের রাস্তা ভালো ছিল না। গুরু ট্রেনিং স্কুলে বড় ভাইকে না পেয়ে শেরপুর যাওয়ার জন্য জামালপুর ঘাটে গিয়েছিলাম। ফেরিঘাটের লোকজন বলাবলি করছিল, এক জিপ টাকা নিয়ে লতিফ সিদ্দিকী এবং আরেকজন নিজাম এমপির বাড়িতে উঠেছে। কথাবার্তা শুনে আমার ভালো লাগেনি, এক জিপভর্তি টাকা! তাঁদের কাছে ২০-৫০ হাজার অথবা লাখ টাকা থাকতে পারে তবে তা জিপভর্তি টাকার কোনো ব্যাপার ছিল না, ব্যাগভর্তিও ছিল না। যা হোক, ফুলপুরের তিক্ত অভিজ্ঞতায় জামালপুরে আর বেশি সময় না থেকে চলে এসেছিলাম। আল্লাহর দয়ায় মুক্তিযুদ্ধে একটা জায়গা করে নিয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হলে মারাত্মক ওলটপালট শুরু হয়। ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মুক্ত, ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা মুক্ত। আল্লাহর অশেষ দয়ায় ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনানায়কদের সঙ্গে একমাত্র বাঙালি হিসেবে পাকিস্তানি জল্লাদ হানাদার সেনাপতি নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ করিয়েছিলাম। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। তাঁর সঙ্গে বঙ্গভবনে দেখা। দিদা আকুল হয়ে মাথায়-পিঠে-কাঁধে হাত বোলাচ্ছিলেন। আমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় সেনানায়করা। সেটা ছিল ২৮ ডিসেম্বর। পল্টনে চারজনকে শাস্তি দেওয়ার অভিযোগে কলকাতা থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন। আমি সেই সুভাগা বা দুর্ভাগা বাঙালি, বাংলাদেশের প্রথম গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল বিদেশ থেকে আমার নামে। তাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সে ব্যাপারে ফয়সালা করতে গিয়েছিলাম। ও রকম সময় আমার নামে একটা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে যেমন লাগে তেমনই লেগেছিল।
ভারতীয় জেনারেল সাহেবদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘরে গেলে প্রথম অবস্থায় তিনি খুব একটা ভালো আচরণ করেননি। কিন্তু ভারতীয় জেনারেলদের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে নরম-গরমে অনেক কথা হওয়ার পর তিনি স্বীকার করেন পল্টনে চারজনকে শাস্তি না দিলে ঢাকায় যে অরাজকতার সৃষ্টি হতো সেখানে চারজনের স্থলে ৪ হাজার অথবা ৪০ হাজারকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে সামাল দেওয়া যেত কিনা সন্দেহ। একসময় আমার কথাটিকে গুরুত্ব দেন এবং বলেন, ‘যা হওয়ার হয়েছে, দেশকে সামাল দিতে হবে, বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে হবে।’ নিরহংকার মানুষ ছিলেন তিনি। একটা সময়ের কথা বলি। ’৭২-এর শেষের দিকে রাশিয়া আমাদের ২ লাখ টন খাদ্য বরাদ্দ দিয়েছিল। তাদের অসুবিধার কারণে সময়ের আগেই তা ফেরত চেয়েছিল। আমরা বড় বেশি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু ছোট্ট একটি চিঠি দিয়ে আমাকে মহান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেই ভারত যাওয়ার কাহিনি। তখন বিদেশ সফরে ২০০ ডলার বরাদ্দ ছিল। আমরা ছিলাম তিনজন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাদের জন্য বরাদ্দ তিন দু গুণে ৬০০ ডলার। আমাদের এখানে ১ ডলার সাড়ে ৬ টাকা, ভারতে সাড়ে ৪ টাকা। ওই টাকায় কী হবে? বঙ্গবন্ধুকে বলতেই তিনি প্রতিজনে ২ হাজার ডলার নিতে বলে দিলেন। সে হিসাবে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে দেওয়া হয়। ডলার আনতে গিয়ে দেখা গেল তিনজনের ৬ হাজার নয়, তিনজনের ৬০০ ডলার বরাদ্দ হয়েছে। তখনকার দিনে মোবাইল ছিল না। ল্যান্ডফোনই ভরসা। তাও সব সময় সচল থাকত না। আমার সহকারীর কাজ করতেন শামসুদ্দিন আহমেদ বালু মোক্তার এমপি। তাঁর বাবাও ছিলেন সিঙ্গারডাকের অ্যাডভোকেট জমিরউদ্দিন এমপি। বালু মোক্তার সাহেব ডলার না নিয়ে ফোন করেন। বলেছিলাম চলে আসুন। প্রায় তখনই অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন ভাইয়ের ফোন পাই। হ্যালো বলতেই, ‘ভাই কাদের, মনে হয় রাগ করে আছো। তুমি একটু আসতে পারবে?’ আমাদের পারিবারিক আদব-কায়দায় বড়র সঙ্গে বেআদবির কোনো স্থান নেই। এখন মাঝেমধ্যে মোহাম্মদপুর থেকে সচিবালয় অথবা মতিঝিল যেতে ২ ঘণ্টা লাগে। তখন ১০-১২ মিনিট লাগত। সেদিন হয়তো আরও ২-১ মিনিট কম লেগেছিল। ঘরে ঢুকতেই তাজউদ্দীন ভাই চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এসে হাত ধরে বললেন, ‘জানি, তোমার রাগ হয়েছে। নেতা ৬ হাজার লিখে দিয়েছেন। তা আটকে দিয়ে আমি ৬০০ দিতে বলেছি। এতে তোমার রাগ হওয়ারই কথা। কিন্তু আমি তোমাকে ৬ হাজার দেব না। হাতি তো তার দেহ দেখে না, তুমি তোমাকে জানো না। মুক্তিযুদ্ধে তোমরা কয়েকজনই তো সারা পৃথিবী জয় করেছ। আর তুমি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বঙ্গবন্ধুর চিঠি নিয়ে যাচ্ছ। তাঁর সঙ্গে নেতার কি কথা হবে না? এ আর মল্লিক দিল্লিতে আমাদের হাইকমিশনার। তুমি টাকা দিয়ে কী করবে? সরকারি নীতি প্রত্যেকের জন্য ২০০ ডলার। তোমার নামে ২ হাজার বরাদ্দ হলে একসময় কথা হবে। স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য তোমার বন্ধু বেশুমার, শত্রুও কিন্তু কম নেই। যারা তোমার কাছেপিছে পড়ে গেছে তাদের সামাল দিতে অনেক সময় লাগবে।’ আমি তাঁর কথা সেদিন বুঝিনি। কিন্তু প্রতিজনে ২০০ ডলার করে নিয়েই পরদিন দিল্লি গিয়েছিলাম। পালাম বিমানবন্দরে কাউকে পাইনি। পরে হঠাৎই লতিফ ভাইয়ের বন্ধু এক ফার্স্ট সেক্রেটারি কাকে যেন বিদায় দিতে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ইমিগ্রেশনে দেখা।
-কাদের ভাই আপনি এখানে?
-হ্যাঁ, এলাম।
-আমরা তো জানতাম আপনি কাল আসবেন।
-তা জানি না, আজই এসেছি।
তিনি নিয়ে তুলেছিলেন লোদি হোটেলে। ১২৫ টাকা তিন বেডের রুম। রাত আমাদের ভালোই কেটেছে। পরদিন সকালেই এ আর মল্লিক স্যার এসেছিলেন তাঁর হাইকমিশনের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কথাবার্তার মাঝে ত্রিপুরার মুখ্যসচিব আসেন। তাঁদের স্টেট হাউসে থাকলে তাঁরা খুব খুশি হবেন। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার জনসংখ্যার চেয়ে দ্বিগুণ-তিন গুণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিরালার বাড়ির পাশেই ত্রিপুরার স্টেট হাউস। সেখানে নিয়ে ওঠালেন। ১২টার দিকে আমার ছোটবোন রহিমার স্বামী পাশার এক বন্ধু মোকলেছুর রহমান সাড়ে ৭ হাজার টাকা বালু মোক্তারের হাতে দিয়ে গেলেন। তারপর আরেকজন যেন কে এসে ৫ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন। পরদিন সকালে গেলাম ইন্দিরা গান্ধীর ১ নম্বর সফদর জং রোডের বাড়িতে। সে এক অমর স্মৃতি। ঘরের বারান্দায় গিয়ে দেখি বিশাল ভারতের ছোটমটো প্রতিমার মতো ইন্দিরা গান্ধী দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হলো মা-ই যেন সন্তানের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন। চিঠি দিলাম। একনজর দেখলেন। পিএস আর কে ধাওয়ানকে বললেন, ‘বাঘার জন্য সংসদের ভিআইপি গ্যালারিতে আসন রেখো। ও যাবে।’ অনেক কথা অনেক আলোচনার পর বেরিয়ে এলাম। বিকালে গেলাম মহান ভারতের রাজ্যসভা-লোকসভার যৌথ অধিবেশনে। সেখানে মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লোকসভার সদস্য ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধুর খাদ্য সাহায্য চেয়ে পত্র দেওয়া সম্পর্কে এক হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য দিলেন। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আমরা রক্ত দিয়েছি। মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের মহান নেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন খাদ্য ঘাটতিতে সাহায্য করতে। তাঁরা যদি না খেয়ে থাকে আমরাও না খেয়ে থাকব। এক বেলা খেয়ে হলেও প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের অভুক্ত মানুষের জন্য খাদ্য সাহায্য মঞ্জুর করতে হাউসের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’ সারা হাউস টেবিল চাপড়ে ইন্দিরা গান্ধীকে খাদ্য মঞ্জুরের সমর্থন জানায়। আমার বুকের ভিতর সে যে কেমন তোলপাড় করছিল কাউকে বোঝাতে পারব না। রাতে গিয়েছিলাম আজমির। সেই জীবনে প্রথম আমার আজমির যাওয়া। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার দিকে আহমদাবাদ এক্সপ্রেসে আজমির পৌঁছেছিলাম। অজু-গোসল করে তিনবার মাজার জিয়ারত করে দুপুরের খাবার খেয়ে বেঙ্গল লজের মোয়াল্লিম খাজা নাজিমুদ্দিন চিশতিকে মুঠো করে হাজার পাঁচেক টাকা দিতে যাব, সে সময় দেখি তিনিই বালু মোক্তারের হাতে ৫ হাজার টাকা গুঁজে দিলেন। বললেন, ‘বাংলাদেশে গেলে দরকার পড়লে টাকাটা নেবেন।’ মোয়াল্লিম নাজিমুদ্দিন চিশতি ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী, আবদুল হামিদ চৌধুরী, কায়সার চৌধুরীদের বহুদিনের পুরনো মোয়াল্লিম। আজমির থেকে দিল্লি এলাম। পরদিন ইন্দিরা গান্ধী খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং। তাঁর দাওয়াতে ১৫-২০ জন মন্ত্রীর মধ্যে বোকার মতো বলে বসেছিলাম। কথাটা খেতে বসেছিলাম বলেই হয়তো বলেছিলাম। খাওয়ার সময় মনে হয় ছোট-বড় কোনো পার্থক্য থাকে না। অনেক কথাই সহজে বলা যায়। ইন্দিরাজি অনেকক্ষণ আমাদের সামনে থেকে খাওয়া শুরু করে চলে গেলে শরণ সিংকে বলেছিলাম, ‘আচ্ছা, আপনাদের মন্ত্রিসভায় প্রায় সবাই পুরুষ। নারী হিসেবে ইন্দিরাজি কখনো বিব্রত হন না?’ হাসতে হাসতে পাঞ্জাবি শরণ সিংয়ের পড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। কোনোরকম নিজেকে সামলে বলেছিলেন, ‘আরে টাইগার, ইন্দিরাজির মন্ত্রিসভায় তিনি একাই পুরুষ। আর আমরা তো সব মহিলা!’ পরদিন কলকাতা। সেখানে ছিলাম চার-পাঁচ দিন। উত্তরা স্পিনিং মিলের গিরিধারী লাল মোদির বড় ভাই ওম প্রকাশ মোদি সঞ্জয়ের সঙ্গে মারুতি গাড়ি নির্মাণে অংশীদার হয়েছিল। ওম প্রকাশ সকালে হাজির। ২০ হাজার টাকা বালু মোক্তারের হাতে গুঁজে দিয়ে একটা অ্যাম্বাসেডর গাড়ি রেখে চলে গেলেন। যে কদিন ছিলাম রাত-দিন গাড়িটি পড়েই ছিল। অ্যাম্বাসির লোকজন তো পাছে লেগেই ছিল। আমাদের খরচের তেমন পথ ছিল না। যেদিন চলে এলাম মনে হয় ছয়-সাত সুটকেস কাপড়-চোপড় এনেছিলাম। তার পরও হাতে টাকা ছিল ৪৬ হাজার। ৪০-৪৩ হাজার বড় ভাইয়ের শিষ্য মঞ্জু ভাইয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে রানওয়ের পথ ধরেছিলাম। মঞ্জু ভাই বলছিলেন, ‘ছোট ভাই এত টাকা আমি রাখব কোথায়? অ্যাম্বাসি যে আমাকে ধরবে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশও ধরতে পারে।’ ডেপুটি হাইকমিশনার সঙ্গেই ছিলেন। বলেছিলাম, ‘টাকাটা ওনাকে দিয়ে গেলাম আপনি দেখবেন।’ ডেপুটি হাইকমিশনার বলেছিলেন, ‘কোনো চিন্তা করবেন না।’ দিল্লি থেকে ফিরেছিলাম তাও ১০-১২ দিন। হঠাৎ একদিন তাজউদ্দীন ভাইয়ের ফোন- ‘কাদের তুমি ফিরেছ? একটু আসো না আমার দফতর হয়ে ঘুরে যাও।’ তাঁর অফিসে যেতেই হাত ধরে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘ভারত সফরে টাকার জন্য খুব কি অসুবিধা হয়েছিল?’ আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। সব ঘটনা খুলে বলেছিলাম। এখনো ভাবী, কত বড় অভিজ্ঞ মানুষ, কত জ্ঞান, কত দূরদৃষ্টি!
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com