মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা কেন?-৩

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা কেন?-৩

১৭ নভেম্বর রবিবার ছিল আফ্রেশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিদূত হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। সকালে গিয়েছিলাম তাঁর মাজারে দোয়া-দরুদ পড়তে। আমি তাঁর একজন আধ্যাত্মিক ভক্ত। রাজনৈতিক কর্মী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তাই তাঁদের নিয়ে আমার চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি সব অন্য ধরনের। আমার মনে হয়নি আজ পর্যন্ত যথাযোগ্য মর্যাদায় হুজুর মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। এবারও হয়নি। এবার শ্রদ্ধা নিবেদন করতে নয়, অনেকটাই পাল্লাপাল্লি করতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগের কোনো জাতীয় নেতা অংশ নেননি। ফজলুর রহমান খান ফারুক ও অন্য নেতাদের দিয়ে কাজ সেরেছে। অন্যদিকে স্থানীয় বিএনপির সঙ্গে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও অন্য নেতারা যোগ দিয়েছেন। হুজুরের মৃত্যুদিনে তাঁর কবরে হাজির হতে হয় তাই হয়েছেন, মানুষ যে জ্বলছে-পুড়ছে তার প্রতিকারে নয়। আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন হুজুর মওলানা ভাসানীকে বেহেশতবাসী করেন এবং আমাদের তাঁর ছায়াতলে রাখেন।

জাতীয় চার নেতা নিয়ে লিখতে গিয়ে দুই পর্বে শেষ করতে পারিনি। লিখতে গিয়ে মনে হলো শ্রদ্ধেয় নেতাদের নিয়ে একটা বই লিখলে মন্দ হয় না। এখন তো আমরা শুধু হাওয়ায় ভাসছি। ন্যায় নেই, নীতি নেই, সত্য নেই, মায়া-মমতা নেই, মূল্যবোধের কোনো বালাই নেই। অমিল হলে, অপছন্দ হলে কেউ কারও মর্যাদা রাখি না। কীভাবে একজন আরেকজনকে তাচ্ছিল্য করেন, চোর-চোট্টা বলেন ভেবে পাই না। মঙ্গলবারের লেখা নিয়ে অনেকেই অপেক্ষায় থাকেন; শুধু চুপ করে থাকেন না, সরব নড়াচড়াও করেন। ফোন করেন, চিঠি লিখেন, দেখা হলে মুখে বলেন। পিয়াজ নিয়ে যে পিয়াজি চলেছে সে নিয়ে দু-চার কথা শুনতে চান, আমিও বলতে চাই। কিন্তু প্রিয় নেতাদের নিয়ে শেষ করতে পারিনি।

ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতোই আমাদের কাছের মানুষ, বেশ দিলখোলা। অতটা মোহাম্মদ নাসিম হতে পারেননি, মোহাম্মদ সেলিমও নন। অসাধারণ লোক ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। একটা ব্যাগ আর ছাতা নিয়ে দু-এক সপ্তাহ পরপরই সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আওয়ামী লীগ করতেন। এখন ছাতা আর ব্যাগ নিয়ে নড়াচড়া করার অমন নেতা পাওয়া যাবে না। এখন তো অমন নেতারা হেলিকপ্টারে যাতায়াত করবেন। কতবার কতরূপে কতভাবে মনসুর ভাইকে দেখেছি বলে শেষ করতে পারব না। মনসুর ভাইয়ের মৃত্যুতে বঙ্গবন্ধুর মতোই আঘাত পেয়েছিলাম। কারণ তাঁর কাছে গেলে বঙ্গবন্ধুর মতোই সাড়া পেতাম। তিনি ছিলেন আমার এক আশ্রয়স্থল। কোনো কারণে তাঁর কাছে গেলে যেমন সর্বস্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন, না পারলে অসম্ভবসব পরামর্শ দিতেন। মারাত্মক অসুবিধায় বাবা যেমন মাঝেমধ্যে এমন সব অসাধ্য সাধন করতেন যা ভাবার মতো নয়, তেমন ছিলেন মনসুর ভাই। মাসখানেক আগে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘বজ্র, জেলে এসে এবার বাবার অভাব বড় বেশি করে অনুভব করছি।’ কথাটি খুবই সত্য। আওয়ামী ঘরানার বড় মাপের কোনো আইনজীবী প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হতে পারেন এ ভাবনায় জামিনের আবেদন করেননি। অথচ আমি যত দূর জানি, লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে আইন স্বাভাবিক গতিতে চললে প্রধানমন্ত্রী বরং যারপরনাই খুশিই হতেন। যাক, গত সপ্তাহে হাই কোর্ট তাঁকে ছয় মাসের জামিন দিয়েছিল। দুদক আবার তাঁর জামিনের বিরুদ্ধে প্রথমে চেম্বার কোর্ট, শেষ পর্যন্ত এক সপ্তাহ জামিন স্থগিত রেখে সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়ে ছিল। তারা হাই কোর্টের জামিন বহাল রেখেছে। আল্লাহ রব্বুল আলামিনের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। এসব নিয়ে পরে লেখার চেষ্টা করব। মনসুর ভাইকে নিয়ে দু-একটি ঘটনা বলি। মরে গেলে, চলে গেলে আর বলতে পারব না। মনসুর ভাই খুবই নিবেদিত একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। সব কাজে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকতেন। রাজনীতিতে অনেক নেতা-কর্মী হয় বা থাকে; কেউ কেউ একসময় সমর্থন করে, আরেক সময় নীরব থাকে, কখনোসখনো চরম বিরোধিতা করে। শাহ আজিজের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এমন হয়েছে অনেকবার। ’৭৩-এর দিকের কথা। নতুন দেশ, সবদিকে নতুন নতুন কায়কারবার। হোল্ডিং বা মজুদ নিয়ে এক কঠিন আইন করা হয়েছে। কোনো হোল্ডিংয়ের জন্য একবারে বিচার। কোনো বেল-টেলের বালাই নেই। এমনি এক ঘটনায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ঘাটাইলের মোয়াজ্জেম হোসেন খান চাপায় বাংলার জেল হয়েছিল। তাঁকে ২০-২৫ ড্রাম কেরোসিন ও ডিজেলের একটা লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তাঁরই নাকি স্টকের মিল ছিল না। ২২০ লিটারের এক ড্রাম তেল কম বা বেশি হয়েছিল। তাই নিয়ে মামলা। মোয়াজ্জেম হোসেন এমন একজন মানুষ যে সত্তর হাত মাটির নিচে থাকলেও তাঁর গলা শোনা যেত। ভদ্রলোক সত্যিই একজন সম্মানী মানুষ। প্রায়ই ডিসির দফতরে যেতেন। ডিসি সাহেবরা তাঁকে অভাবনীয় সম্মান করতেন। হঠাৎ একদিন ডিসি কথাবার্তার এক ফাঁকে চাপায় বাংলা মোয়াজ্জেম হোসেনকে বলেন, মোয়াজ্জেম সাহেব কী বলি, আপনার নামে একটি মামলায় রায় হয়ে গেছে। ছয় মাসের জেল হয়েছে। হঠাৎ পুলিশ যদি আপনাকে আটক করে কেউ ছাড়াতে পারবে না। মন্ত্রণালয় গিয়ে একটা বিহিত করে আসুন। সেখানেই মোয়াজ্জেম হোসেন ফায়ার। পারলে ডিসিকেই এটাওটা করে ফেলেন। পরদিনই ঢাকায় বাবর রোডের বাড়িতে হাজির, ‘স্যার, বিচার করেন। আমাকে একটা তেলের লাইসেন্স দিয়েছে সেটা তো আমি ভালোভাবে দেখাশোনাও করি না। মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা পাই। তাতেই সংসার চলে। এখন শুনছি আমার জেল হয়ে গেছে। হয়তো দোকানে গিয়ে ঘুষখোররা টাকা-পয়সা চেয়েছে, আমার লোক দেয়নি। কবে কোথায় মামলা হয়ে আমার নাকি জেল। জেলে আমি কী করব, আমি তো জেলে থাকতে পারব না।’ গেলাম মনসুর ভাইয়ের বাড়িতে। যে বাড়ি জাসদের ইনুরা ঘেরাও করেছিলেন। সব শুনে মনসুর ভাই বললেন, ‘বড় মারাত্মক কথা। মুক্তিযুদ্ধে মোয়াজ্জেমের এত অবদান। ভারত থেকে সে এত অস্ত্র গোলাবারুদ এনেছে। এক ড্রাম তেলের গরমিলের জন্য তার জেল! সে তো হতে পারে না। ১০০ এমনকি ১০০০ ড্রামের গোলমাল হলেও এক-দুইবার মোয়াজ্জেমকে কিছু বলা যাবে না।’ মোয়াজ্জেম খানের মাথায় কাঁধে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কাদের যখন বলেছে তোমার কোনো চিন্তা নেই। এক ড্রাম কেন ১০০০ ড্রামের অমিল হলেও আমি ঠিক করে দিতাম।’ মনসুর ভাইয়ের কথায় অনেকটা তাক লেগে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ভাই, আপনি তো বলছেন, কিন্তু এর মধ্যেই আমি অনেক বড় বড় আইনবিদের কাছে গেছি। এমনকি সবিতা রঞ্জন পালের কাছে গেছি। সবাই বলেছেন এর নাকি কোনো পথ নেই। জেল খাটতেই হবে। মনসুর ভাই বললেন, ‘আরে রাখো, মোয়াজ্জেমের জেল অত সোজা।’ আমি বললাম, তা নয় তো কী? ‘আরে কাদের ডব ধৎব ষধি সধশবৎ ধহফ ধষংড় ষধি নৎবধশবৎ. আমরা আইন বানাই আবার প্রয়োজনে ভালো মানুষের জন্য আইন ভাঙি। মোয়াজ্জেমের জন্য না হয় আইন ভাঙতে হবে সেটা আমরা আনন্দের সঙ্গে ভাঙা।’ তিনি তা ভেঙেছিলেন। মনে হয় আনন্দের সঙ্গেই ভেঙেছিলেন।

’৭৩ সালের আরেকটি ঘটনা। আমি গিয়েছিলাম আজমিরে। খাজা বাবার মাজার জিয়ারত করে ওই রাতেই ঢাকায় ফিরেছি। রাত আড়াই-তিনটায় বড় ভাইয়ের ফোন। লতিফ ভাই তখন কালিহাতীর এমপি। কিন্তু আমাকে গালাগাল করতে গিয়ে সব সময় বলতেন, তোমার সরকার, তোমাদের সরকার। বলছিলেন, ‘বজ্র, তোর সরকারের বল্লা ক্যাম্পের পুলিশ রামপুর-কুকরাইল পুড়ে ছারখার করে দিয়েছে।’ আমি এসবের বিন্দুবিসর্গও জানতাম না। হঠাৎই ফোন পেয়ে বলেছিলাম, আমি আসছি। মার ঘরে ডাক দিতেই বললেন, ‘কী হয়েছে?’ না, বড় ভাই ফোন করেছিলেন টাঙ্গাইলে যেতে হবে। ‘তা এই রাতে?’ বলেছিলাম, মা গো, বিপদ যখন আসে তখন তো রাতদিন বিচার করে আসে না। কিছু খাবার খেয়ে সাড়ে ৪টায় রওনা হয়ে ৬টায় টাঙ্গাইল পৌঁছেছিলাম। কী কারণে বড় বেশি কুয়াশা ছিল। কুয়াশা না থাকলে ৬টার আগেই পৌঁছতে পারতাম। তখনই গিয়েছিলাম ডিসির বাড়িতে। ফুলবাড়িয়ার আছিমের শেখ ফরিদ তখন টাঙ্গাইলের ডিসি। বেশ ভালো লোক ছিলেন। শিক্ষা-দীক্ষা-জ্ঞান-গরিমা ছিল। ২-৩ মিনিটের মধ্যেই এসপি এলেন, প্রিন্সিপাল হুমায়ুন খালিদ এমপি, একটু পরে লতিফ ভাই। এসপি-ডিসি পুলিশ ছাড়া সরেজমিনে যেতে চাচ্ছিলেন না। বললাম, পুলিশ নিয়ে গেলে অসুবিধা হবে। ওর চেয়ে পুলিশ ছাড়াই চলুন, কোনো অসুবিধা নেই। তারা রাজি হলেন। এসপি-ডিসি আমার সঙ্গে, অন্যরা অন্য গাড়িতে। সবুর খান বীরবিক্রম আমাদের মূল সারথি। গেলাম রামপুর-কুকরাইলে। অমন অবর্ণনীয় দুর্দশা আমি আমার জীবনে দেখিনি। হানাদাররাও ওভাবে লুটতরাজ, হত্যা করেনি। আমরা যখন যাই তখনো একদল পুলিশ রামপুর-কুকরাইল লুটপাট করে ফিরছিল। আমাদের দেখে লুটপাট করা জিনিসপত্র টাকা-পয়সা এদিক-ওদিক ছুড়ে ফেলেছিল। আমরা তা কুড়িয়ে নিয়ে সেই পুলিশ দলকে আটক করে প্রথমে বল্লায় পরে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বিচারে তাদের শাস্তিও হয়েছিল। পরদিন রামপুর-কুকরাইলে গিয়েছিলেন হুজুর মওলানা ভাসানী। ৫৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেদিনই তাদের ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। দুই ঘণ্টার মধ্যে সরকারি গাড়িতে তাদের সবাইকে রামপুর পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। পরদিন ঢাকা ফিরতেই মনসুর ভাইয়ের কাছ থেকে ডাক পড়ে। ছুটে যাই তাঁর বাড়ি। দোতলায় নিয়ে গিয়ে বললেন, তোমার নেতা কথা বলবেন। বঙ্গবন্ধু তখন একটা অপারেশনের জন্য মস্কোয় ছিলেন। ওপরে নিয়ে ফোন ধরিয়ে দিতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কাদের চারদিকে ষড়যন্ত্র। মনসুরকে নিয়ে যেভাবে পারিস সামাল দে।’ তখনই আমরা হেলিকপ্টারে রামপুরে গিয়েছিলাম। আমাদের পেয়ে মানুষ খুব খুশি হয়েছিল। সুদবিহীন ৯ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছিল। বল্লা-রামপুর-কুকরাইল এমন ধনী গ্রাম যে তারা দু-চার মাস সারা টাঙ্গাইলকে খাওয়াতে-পরাতে পারত; তারা সেদিন সম্পূর্ণ অসহায়! এক বেলার খাবারও ছিল না। কিন্তু আমরা সেখানে যাওয়ায় মনসুর ভাইয়ের কথাবার্তায় লোকজন ভীষণ খুশি হয়েছিল। রামপুর-কুকরাইলের সে সমস্যা আর বড় হতে পারেনি। অনেক টেলিভিশন, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, জার্মানের কোলন বেতার বহুজন বহুভাবে ব্যাপারটা নিয়ে টানাটানির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তেমন কিছু করতে পারেনি। আমাদের প্রিয় সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরী গিয়েছিলেন। এখনো সেসব কথা হৃদয়পটে জ্বলজ্বল করে। কী অসাধারণ মানুষই না ছিলেন মনসুর ভাই। আমরা তাঁর সঙ্গে ছায়ায়মায়ায় লতায়পাতায় জড়িয়ে ছিলাম। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে জননেতা আবদুল মান্নানকে ফোন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথম নিজেকে রক্ষা কর, তারপর প্রতিরোধ গড়ে তোলো। আমাকে ডাকলেই পাবে।’ এরপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম। দাদু খুব ভিতু ছিলেন। বলেছিলেন, ‘তোমার নেতা নিজেও মরেছেন, আমাদেরও মেরে গেছেন।’ শেষ ফোন করেছিলাম ক্যাপ্টেন মনসুর ভাইকে। তিনি বলেছিলেন, ‘এই হত্যা বিনা প্রতিবাদে যেতে দেওয়া যায় না। তোমরা যেভাবে প্রতিবাদ করবে, বিশেষ করে কাদের আমি তোমার সঙ্গে আছি। শুধু আমাকে নিয়ে যাবে।’ তাঁর দৃঢ়তা আমাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করেছিল। দাদু সৈয়দ নজরুল ইসলামের কথায়ও আমি খুব একটা বিস্মিত হইনি। কারণ ওই রকম দুঃসময়ে অনেকেই এ ধরনের কথা বলেন। তখনকার কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল না। দু-তিন বার আমাদের টাঙ্গাইলের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার কারণে একটা জানাশোনা ছিল। তখন আওয়ামী লীগের সব নেতাই ছিলেন জননেতা। মুসলিম লীগের নেতাদের মতো জমিদারি স্বভাব কারও ছিল না। ’৭৭ সালে ভারতে সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয় আর জনতা পার্টির বিজয়ে আমাদের প্রতিরোধ ভেঙে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মহীয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের পতন হলে শ্রী মোরারজি দেশাই আমাদের ব্যক্তিগত শত্রুর মতো মনে করেন। ইংল্যান্ডে কী এক সম্মেলনে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে শ্রী  দেশাইর এক চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুসারে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামী জাতীয় মুক্তিবাহিনীর প্রায় ৬ হাজার যোদ্ধাকে জিয়া সরকারের হাতে ভারত সরকার তুলে দেয়; যার ১০৪ জনকে এক দিনেই হত্যা করা হয়। হালুয়াঘাট-নরুন্দী-নান্দাইল ও অন্যান্য ক্যাম্পে জামালপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকার কলাকোপায় রাখা হয় প্রায় ১ হাজারের ওপরে। নানা জেলে ১৪ জনের ফাঁসি, ২ শতাধিক জনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। এসব কিছুকে অতিক্রম করে সাত-আট বছর পর সবাই বেরিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে শ্রী প্রণব মুখার্জি ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। বিশ্বজিৎ নন্দীর ফাঁসির আদেশ স্থগিত করতে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়েছিল। তার আগে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একমাত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছিল। ’৭৭-এর দিকে এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে লিটন আর স্বপন নরেন্দ্রপুর স্কুলে পড়ত। স্বামী লোকেশ্বরানন্দজির সহযোগিতায় স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিবিজড়িত রামকৃষ্ণ মিশন সোসাইটি, গোলপার্ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভারতে যার খ্যাতি সর্বত্র সেখানে ওরা দুজন পড়ত। নরেন্দ্রপুর স্কুলের প্রিন্সিপাল স্বামী গহরানন্দজি মহারাজ সে যে কী অভাবনীয় সম্মান ও যত্ন করেছিলেন। এখন কেউ কাউকে ওভাবে সম্মান, আদরযত্ন করে না, গুরুত্ব দেয় না। আমার এক সহকর্মী সাভারের গৌড় গোপাল সাহা আমাদের পক্ষে সব সময় খোঁজখবর রাখতেন, দেখাশোনা করতেন। যত দিন লিটন-স্বপন সেখানে লেখাপড়া করেছে তত দিনই গৌড় ওদের চমৎকার দেখাশোনা করেছেন। সেসব স্বপন-লিটনের এখন মনে আছে কিনা আল্লাহই জানেন।

 

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর