বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জনগণ একবার দ্রোহ করলে ভেসে যায় সব

পীর হাবিবুর রহমান

জনগণ একবার দ্রোহ করলে ভেসে যায় সব

জনগণ জেগে উঠলে, একবার দ্রোহ করে বসলে তাসের ঘরের মতো ভেসে যায় সব। বিশ্বের গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এই নজির অনেক রয়েছে। আমাদের ইতিহাসজুড়ে তো আছেই, উপমহাদেশে বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এই সেদিন বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিশাল বিজয় অর্জন করে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। হিন্দুত্ববাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগানে দ্বিতীয় দফা এই বিস্ময়কর রেকর্ড সৃষ্টির ব্যালটবিপ্লবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ডান হাত অমিত শাহ আরও শক্তিশালী হয়ে আসেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও অমিত শাহ ছিলেন ভোটযুদ্ধের ময়দানে নরেন্দ্র মোদির প্রধান রাজনৈতিক সেনাপতি। সেবারও তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে এবারে নরেন্দ্র মোদির ব্যালটবিপ্লবে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন রাজনৈতিক দল ও বহু ধর্ম, বহু জাতি, বহু ভাষা ও সংস্কৃতিকে অভূতপূর্বভাবে লালন করা ভারতের উদার ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শকে ধারণ করা কংগ্রেস কোমর তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ব্যালটের লড়াইয়ে বিভিন্ন রাজ্যের ছোট দলগুলোর দুর্গও তছনছ হয়ে যায়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল দুর্গেও ধস নামে। কংগ্রেসের মতো ঐতিহ্যবাহী দল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার জন্ম, বিকাশ, আধুনিক শক্তিশালী ভারত সৃষ্টিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখা নেহরু-গান্ধী পরিবারের হাত ধরে দীর্ঘকাল শাসন করা দলটিও মুখ থুবড়ে পড়েছিল। মমতা ব্যানার্জি পর্যন্তও ফলাফলের বাইরে যা-ই বলুন না কেন ভিতরে ঘামছিলেন। পর্যবেক্ষকরা বলছিলেন, একসময়ের বামশাসিত পশ্চিমবঙ্গও তৃণমূলের দাপুটে হাত থেকে আগামীতে বিজেপির হাতে চলে যাচ্ছে।

সংশোধিত জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন তালিকা লোকসভায় ও রাজ্যসভায় তুমুল বিতর্কের মধ্য দিয়ে শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাস করিয়ে নেওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সভাপতি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কঠোর অবস্থান, ভারতজুড়ে নাগরিক তালিকা প্রণয়ন, অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কারের হুমকিসহ নানা বক্তব্য শাসক দল বিজেপিকে জনগণের বিদ্রোহের টার্গেটে পরিণত করেছে। আসাম থেকে পশ্চিমবঙ্গই নয়, দিল্লি গেট হয়ে ভারতবর্ষে ছড়িয়েছে প্রতিরোধের আন্দোলন। দাবানলের মতো বিক্ষোভে উত্তাল এই আন্দোলনে ছাত্রসমাজ রাজপথে নেমে এসেছে। ছাত্র-জনতার গড়ে ওঠা ঐক্যে বিজেপি শাসকদের কাঁপুনি দিয়ে জ্বরই আসেনি, মাটিতে শুয়ে যাওয়া সরকারবিরোধী দলগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি জুগিয়েছে। জনগণকে নিয়ে রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ যেমন বিরোধী দলের সামনে এসেছে, তেমনি গণবিক্ষোভ মোকাবিলার কঠিন চ্যালেঞ্জ দরজায় ডেকে এনেছে বিজেপি। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী পুত্র রাহুল গান্ধী ও কন্যা প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে জনতার মাঝে হাজির হয়েছেন। রাহুল লোকসভায়ই নয়, জনতার মাঝখানেও দাঁড়িয়ে অনলবর্ষী বক্তৃতা করছেন। ভাই রাহুলের পাশে ইন্দিরা গান্ধীর অবয়ব নিয়ে প্রিয়াঙ্কাও দলকে সুসংগঠিত এবং জনমত পক্ষে টানতে অনবদ্য ভূমিকা রাখছেন। গ্রেফতার, পুলিশের দমন-পীড়ন এই আন্দোলনকে যেমন দমাতে পারছে না, ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বলতা ধূসর হলেও সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি মাটি ও জনগণকে নিয়ে এতটাই শক্তিশালী যে সরকার রাজনৈতিকভাবেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। মাত্রাতিরিক্ত দমন-পীড়নে যাচ্ছে না। একেক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও বলছেন, এ আইন তাদের রাজ্যে কার্যকর হতে দেবেন না।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির হাজার হাজার মানুষ নিয়ে রাজপথের মিছিল হয়ে উঠেছে অহিংস। এ আন্দোলনের মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খন্ডে যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে, সেখানে ক্ষমতাসীন বিজেপির ভরাডুবি ঘটেছে। ঝাড়খ- মুক্তিমোর্চা, কংগ্রেস ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিশ্চিত করে সরকার গঠনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। ঝাড়খন্ডে ৮১টি আসনে এবার নির্বাচন হয়েছে। ৩০ নভেম্বর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ ধাপে ভোট গ্রহণের পর বিজেপি মাত্র ২৫টি আসন পেয়েছে। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ৪১টি আসন। টানা পাঁচবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি দাপটের সঙ্গে এ রাজ্য শাসন করে আসছিল। এবার নির্বাচনে কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৪৭টি আসন। যার মধ্যে জেএমএম ৩০টি, কংগ্রেস ১৬টি এবং আরজেডি ১টি আসন পেয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে ভারতজুড়ে যে বিক্ষোভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তখন এ নির্বাচনে পরাজয় দেখতে হলো পদ্মশিবিরের বিজেপিকে। এর আগে শিবসেনার সঙ্গে জোট ভেঙে যাওয়ায় পশ্চিমে মহারাষ্ট্র হাতছাড়া হয়ে গেছে বিজেপির। সে তুলনায় ছোট রাজ্য হলেও ঝাড়খ- ছিল গুরুত্বপূর্ণ। টানা পাঁচবারের শাসনের পর এই গণবিক্ষোভে উত্তাল ভারতে শাসক বিজেপির হাত থেকে সেটিও বেরিয়ে গেল। এক বছরের মধ্যে এ নিয়ে পরপর পাঁচটি রাজ্যে হেরেছে বিজেপি। গত বছর কংগ্রেসের কাছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় হারিয়েছিল দলটি। চলতি বছর লোকসভা নির্বাচনে জেতার পরপরই পিছলে গেল মহারাষ্ট্র।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৌন্দর্য হলো বিরোধী মতকে গুরুত্ব দেওয়া। সরকারের সমালোচনাকে বিবেচনায় নেওয়া এবং নির্বাচনের পরাজয়কে মেনে নেওয়া। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ তাঁদের দলের পরাজয়কে মেনে নিয়ে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। ভারত ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কারণেই বন্ধুপ্রতিম বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ হিসেবেই নয়, আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সরকার ও তাঁর জনগণ যে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন, সেজন্য আমাদের অনেকের প্রিয় একটি দেশ। ভারতের জনগণের বাপুজি খ্যাত মহাত্মা গান্ধী অহিংস আন্দোলনের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বরাজনীতিতে এখনো অনেকের আইডল। ভারতের লোকসভায় দেখেছি তাঁর ভাস্কর্য এখনো শোভা পাচ্ছে। যেন তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে মানবতার মহান আদর্শ নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু একজন উদার গণতন্ত্রী নেতা হিসেবে ভারতের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও জনগণের আকাক্সক্ষাকে হৃদয় দিয়ে লালন এবং প্রতিষ্ঠিত করেই যাননি, নেতা হিসেবে বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে অমরত্ব পেয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তাই বলেছিলেন, ‘আমি গান্ধীর ভক্ত, কিন্তু নেহরু আমার আইডল’। জীবনের ২৭টি বছর কারাগারের কঠিন নির্যাতন ভোগ করে বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে এই মহান নেতা বিজয়ী হয়ে তাঁর ওপর নির্যাতনকারীদের ক্ষমতার অংশীদার করে রাষ্ট্রের উন্নয়নেও প্রতিহিংসা এবং বর্ণবাদের অবসানে উদার চিত্তে নেতৃত্ব দেওয়া যায়, সেই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ক্ষমতায় একবার থেকে বিদায় নিয়ে জনগণের হৃদয়ে মাদিবা বা জাতির জনকের আসন নিয়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হয়ে বিশ্বরাজনীতিতে বর্ণবাদবিরোধী বিপ্লবের জনকই নয়, মানবতার উদার মহান নেতা হিসেবে বিদায় নিয়েছেন।

বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের ১৩০ কোটি জনগণ নানা ধর্ম, বর্ণ ও জাতিসত্তা নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ওপর ঐক্যের সুতায় বাঁধা হয়ে আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে উগ্র হিন্দুত্ববাদের স্লোগান দিয়ে আরএসএসের শক্তিতে ভর করে নেতৃত্বের ক্যারিশমায় গুজরাটের জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জনগণকে গান্ধী পরিবার ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে বিশাল বিজয় অর্জন করেছিলেন। সোনিয়া গান্ধীর ক্যারিশমায় বাজপেয়ির বিজেপিকে পরাজিত করে কংগ্রেস জোট মনমোহন সিংয়ের টানা দশ বছরের শাসনামলে যা কিছু অর্জন করেছিল, সেটি মোদিঝড়ে তাসের ঘরের মতো ভেসে গিয়েছিল। ভারতের গণতন্ত্রের শক্তির উৎসই হচ্ছে ব্যালট। অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে গণরায়ের প্রতিফলন। নরেন্দ্র মোদি সেবার তাঁর উগ্র সমর্থকদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখলেও সর্বশেষ বিজয়ের পর ততটা করতে পারেননি। নানা সময়ে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মানবতার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে। একেকটি জনপদকেই রক্তাক্ত করেনি, মানুষের প্রাণহানিই ঘটায়নি, ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জীবনও কেড়ে নিয়েছে। এমনকি উগ্রপন্থি শিখদের স্বর্ণমন্দিরে সেনা অভিযানের প্রতিহিংসায় দেহরক্ষীর হাতে আধুনিক শক্তিশালী ভারতের কিংবদন্তি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবনও বুলেটে নিথর-স্তব্ধ হয়েছে। সেখানে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বলতা ধূসর হয়ে গেছে সংখ্যালঘুদের ওপর ক্ষমতার দম্ভে একদল উগ্রপন্থির জয় শ্রীরাম স্লোগানে নানা প্রতিহিংসার কর্মকান্ডে। ইসলাম ধর্মের নামে ভারতে উগ্র জিহাদি, জঙ্গি, বোমা হামলাকারীরা যেমন শকুনের মতো নখের আঁচড় বসিয়েছে; তেমনি আরেকদল উগ্রপন্থির হাতে গরুর চেয়ে মানুষের জীবন মূল্যহীন হয়েছে। ধর্মের উগ্র রাজনীতির কাছে পৃথিবীজুড়ে মানবতাই দেশে দেশে ভূলুণ্ঠিত হয়নি, মানুষের জীবনের নিরাপত্তাই বিপদের মুখে পতিত হয়নি, সব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গণতন্ত্রের চেতনায় নাগরিক অধিকার নিয়ে সহাবস্থানের রূপ ও মাধুর্যকে ক্ষতবিক্ষত করছে। ধর্মের নামে সন্ত্রাস, সহিংসতা, যুদ্ধ মানুষের প্রাণহানিই ঘটায়নি, একেকটি রাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনাকে আঘাত করেছে।

ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে এমনকি পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের মহান নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী সাহসী নেতৃত্বের শক্তি, সাহস, সমর্থন এবং বিশ্বজনমত গড়ে তোলার নীতিই নয়, মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হয়ে ভারতীয় সৈন্যদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং আত্মদান কৃতজ্ঞতার ঋণে এই স্বাধীন জাতিকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আদর্শ ও রক্তের বাঁধনে জড়িয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে লাখো লাখো মানুষের রক্ত, মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বেদনা ও জাতির বীরত্বের অর্জন এই স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা বরাবর প্রিয় বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক আদর্শের ওপর যে শক্তিতে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে তা এই সৌন্দর্যের উজ্জ্বল বিকাশের মধ্য দিয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখার নীতিতে একটি আধুনিক উন্নত বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবেই দেখতে চাই।

ধর্মের ওপর সাম্প্রদায়িকতার বিষে সেনাশাসন আর জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদে ক্ষতবিক্ষত ২৪ বছরের শোষণ আর একাত্তরের গণহত্যার কলঙ্কিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও আমরা কখনো তাকে বন্ধু ভাবী না। ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলেও যখন তাদের শাসক দলের প্রধান নেতা ও মন্ত্রী অমিত শাহ জঙ্গিবাদী এবং তালেবানি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র বলেন, তখন আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এটা সত্য, দেশ বিভাগের পর ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় অনেকেই এসে যেমন নাগরিকত্ব ভোগ করেছেন, তেমনি এখান থেকেও অনেকেই গিয়ে ভারতের নাগরিক হয়েছেন। সব মিলিয়ে মানুষ তো সুখেই ছিল।

আমাদের জন্যও গভীর বেদনার যে, পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট পরিবার পরিজনসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে অস্ত্রের জোরে ক্ষমতাচ্যুতই করেনি, খুনিচক্র ও সেনাশাসকরা লাখো শহীদের রক্তে লেখা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত জাতিসত্তার পরিচয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং শোষণমুক্তির সমাজতন্ত্র শব্দটি মুছে দেয়। মীরজাফর খন্দকার মোশতাকের টুপি থেকে সংবিধানে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের জুড়ে দেওয়া বিসমিল্লাহ ও এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামই প্রবর্তন হয়নি, একাত্তরের কৃতজ্ঞতার ঋণ ও ঐতিহাসিক অহংকারের বন্ধুত্ব ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ভারতবিরোধী সাম্প্রদায়িকতার বিষের বাতাস ছড়িয়ে দেয় রাজনীতিতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশকে মডারেট মুসলিম কান্ট্রি বলেছিলেন। কিন্তু এখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জন্য সব ধর্মের মানুষ জীবন দিয়েছে। সংবিধান সবার সমঅধিকার নিশ্চিত করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ফিরে এসে বুকভরা বেদনা নিয়ে ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন। এটা সত্য, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তার নেতা-কর্মীদের ওপর বর্বর আক্রমণ, হামলা, প্রতিহিংসার আগুনে ক্ষমতায় আরোহণ করা শাসক দল চালিয়েছে।

বিভিন্ন সময় ভারতে যেমন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, এখানেও বিচ্ছিন্নভাবে সেই বেদনাবহুল ঘটনা ঘটেছে। নানা সময়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, তাদের মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। সরকার, প্রশাসন যেমন এটা বরদাশত করেনি, তেমনি জনগণও কখনো প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, কখনো নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। আমি কখনো সংখ্যালঘু বলতে রাজি নই, আমার মুক্তিযুদ্ধ, আমার পরিবার, আমার সমাজ আমাকে যে চিন্তা-চেতনায় গড়ে তুলেছে সেটি হলো, সকলের নাগরিক অধিকার যেমন সমান, তেমনি আমার ধর্ম আমার, আপনার ধর্ম আপনার। ধর্ম ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের। রাজনীতিতে এর কোনো স্থান নেই। আমরা সবাই পরম আত্মার আত্মীয়। যারা মতলববাজ তারাই ধর্মকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। অমিত শাহ বলেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা অনেকে ভারতে গেছেন।’ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্য দিয়ে বিভ্রান্ত করলেও সরকারের মুখপাত্র আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরিষ্কার বলেছেন, বিএনপি শাসনামলের নির্যাতনে যেসব সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছেন তাদের তালিকা দিন। আমরা ফিরিয়ে নেব। এখনো এ দেশের অনেক সংখ্যালঘুর আত্মীয়দের এক অংশ ভারতে আছেন, আরেক অংশ এখানে আছেন। আর পৃথিবীর সব উন্নত দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম নাগরিকত্ব নিয়ে সুখে নিরাপদ জীবনযাপন করছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে অনেক সাফল্য-ব্যর্থতার মধ্যে বড় সাফল্যই হচ্ছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাবিধান। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে রাজনীতি থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় বুক ফুলিয়ে তাদের অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তাদান। একই সঙ্গে পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন শুধু সংখ্যালঘুদের ওপরই নয়, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ওপরও অত্যাচার-নির্যাতন এসেছে। এমনকি শেখ হাসিনাসহ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। একই সঙ্গে সেই সময় সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আমাদের জনগণের নিরাপত্তাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দেওয়া হয়নি, বন্ধুপ্রতিম ভারতের নিরাপত্তাব্যবস্থাকেও অশান্ত, অস্থির করার জন্য এই ভূখন্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার সেই সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদকে কঠোর হস্তে দমনে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলায় কার্পণ্য করেননি। এখানে তাঁর সরকার বড় সাফল্য অর্জন করেছে। রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে সংবিধান থেকে পাকিস্তানি ভাবধারার আদর্শে বিশ্বাসী সামরিক শাসকদের মুছে দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সংবিধানে পুনর্বহাল করতে না পারলেও এ দেশে ধর্মান্ধ শক্তিকে জনগণ যেমন ব্যালটে কখনো অভিষিক্ত হতে দেয়নি, তেমনি তাদের উত্থানকে রুখতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতি সরকার ও জনগণ নিভে যেতে দেয়নি।

ভারতে যেমন ধর্মান্ধ রাজনীতির তৎপরতা কঠোর হাতে দমন ও নিষ্পত্তি করা অপরিহার্য, তেমনি এখানেও সেটি অনিবার্য। ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ আজ শুধু ভারত-বাংলাদেশের সমস্যাই নয়, বিশ্বরাজনীতির শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং মানুষের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এখানে সাম্প্রদায়িকতাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বা প্রশ্রয় দিয়ে কোনো রাষ্ট্রই এ যুদ্ধে সফল হতে পারে না। আমাদের শেখ হাসিনার সরকার যেমন অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করে লড়াইটা করছেন, জনগণ যেখানে এই যুদ্ধে যুক্ত হয়েছে, তেমনি ভারতকে তার মহান আদর্শকে উদার গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে লালন করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের সময় দরজায় কড়া নাড়ছে।

দুই দেশের আত্মার বন্ধন সুসংহত রাখতে এবং জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ দমনে ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও শেখ হাসিনার সঙ্গে অবস্থান নিতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু সমমর্যাদার ভিত্তিতে সহযোগিতার হাত বাড়াতে ১৯৬২ সালে নেহরুকে যে চিঠি দিয়েছিলেন এবং তাঁর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন, সেই অঙ্গীকার রেখেই নেহরু সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকেই আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবনের ১৩টি বছর কারাযন্ত্রণা ভোগ করে ফাঁসির মঞ্চে আপসহীন থেকে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়ে যেমন যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন, তেমনি নেহরুকন্যা ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে সেটি লালন করে ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রেখে ভারতবিরোধী যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান এখানে ঘটেছিল, প্রতিকূল পরিবেশে শেখ হাসিনার লড়াই সংগ্রাম ও শাসনে সেটি দমন হলেও বিষমুক্ত হয়নি। দুই দেশেই সরকার ও বিরোধী দলকেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নিতে হবে। আর আমাদের সরকারকেও ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এমনিতেই এখানে নির্বাচন, বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু সত্য এটাই হচ্ছে যে, যে কোনো ইস্যুতে একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠলে যেমন আগুন ছড়িয়ে যায়, তেমনি জনতার বিদ্রোহও তাই। ডাকসু ভিপি নূরের ওপর হামলায় শেখ হাসিনা সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর