মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

কেমন যাবে সামনের দিনগুলো

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

কেমন যাবে সামনের দিনগুলো

শুভ ইংরেজি নববর্ষ। এ বছরের ১৭ মার্চ, মঙ্গলবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন। আমরা ভাগ্যবান, না হতভাগা বলতে পারি না, বিশ শতকে জন্ম নিয়ে ২০২০ পর্যন্ত বেঁচে আছি। ঝড়-তুফান-ঝঞ্ঝা-বিক্ষোভ যতই যাক- একদিকে শতবর্ষ বা শতাব্দী, অন্যদিকে সহস্রাব্দ বা হাজার বছরের সীমানা পার করছি। এমন ভাগ্য সব মানুষের হয় না, যারা স্বাধীনতা বা দেশের জন্মের বেদনার সঙ্গে জড়িয়ে যান; মা সন্তানের জন্ম দেন, কিন্তু কোনো কোনো সন্তানও তার মাতৃভূমির জন্মের বেদনায় শরিক হয় সেটা খুবই অভাবনীয়। আমরা কিছু মানুষ সেই সৌভাগ্য অর্জন বা বরণ করেছি। একবিংশ শতাব্দী কেমন যাবে বলতে পারি না। তবে শুরুর দিকটা খুব একটা ভালো নয়। সুনামি থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার দাবানল, কদিন আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের বিপ্লবী প্রতিরক্ষা বাহিনীর আল কুদসের প্রধান কাসেম সোলাইমানিকে ইরাকের বাগদাদে হত্যা- এসব খুব ভালো আলামত নয়। পেন্টাগন বলেছে, প্রেসিডেন্টের নির্দেশে এ হত্যা সংঘটিত হয়েছে। যুদ্ধ আর হত্যা এক নয়। ফকির থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত যে কেউ হত্যা করলে তিনি অপরাধী। সে অপরাধ থেকে কারও মুক্তি নেই। কী হয় ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন দেখার সৌভাগ্য হতে চলেছে। বছরটি বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। টুঙ্গিপাড়ার শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শ্রম, ঘাম ও মেধা দিয়ে একটি দেশের জন্ম দিয়েছেন। সে হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ শুধু আওয়ামী লীগের নয়। পিতা হিসেবে দেশের সব নাগরিকের পিতা তিনি। যাঁরা উদ্যোক্তা তাঁদের এ বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। দলমতনির্বিশেষে সবাইকে একত্র করতে না পারলে ব্যর্থতা বিরোধীদের নয়, ব্যর্থতা উদ্যোক্তাদের। পরিশ্রম যতই হোক সবাই মিলেমিশে জাতীয় বিষয়গুলো জাতীয়ভাবে পালন করতে পারলে তা যেমন মঙ্গল তেমন দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ। সাধারণত গায়ের জোরে যারা চলে তারা মেধাকে পদদলিতের চেষ্টা করে, ভবিষ্যৎ ভাবে না। আমি বহুবার বলার চেষ্টা করেছি, আওয়ামী লীগ নেত্রী, বোন হাসিনা তাঁর দক্ষতা-যোগ্যতায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ তথা বিশ্বদরবারে একজন মানবতাবাদী মহান নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মহান প্রধানমন্ত্রী মহীয়সী নারী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিকামী মানুষের পক্ষের নেতা হিসেবে নিজেকে যেমনি মেলে ধরেছিলেন, ঠিক তেমনি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও একটা বিশ্বমানের উদারতা বা মানবতার ছাপ রেখেছিলেন। রোহিঙ্গা প্রশ্নে তিনি যদি সমস্ত জাতিকে এক করার আন্তরিক উদ্যোগ নিতেন যাঁরা তাঁর ডাকে সাড়া না দিতেন তাঁরা মানবতার বিচারে পিছে পড়ে যেতেন, মানুষের কাছে ছোট হতেন, হারিয়ে যেতেন। তাঁদের আর রাজনীতি করতে হতো না। আওয়ামী লীগ হেলাফেলা করে রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিকে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ হওয়া থেকে পিছিয়ে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন পেতে দলমত, শত্রু-মিত্র বিচার করেননি। যাকে দিয়ে কাজ হবে, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমর্থন আসবে তাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। সর্বোদয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণকেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে, দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি তুলে ধরতে পাঠিয়েছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই কাজ করতে পারতেন। তিনি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থান নিয়ে এবং এই মানবিক সমস্যা দূর করার জন্য ড. কামাল হোসেনকে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াবার ব্যবস্থা করতে পারতেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে মুসলিম বিশ্বে পাঠাতে পারতেন। আমাদের প্রিয় আবুল হাসান চৌধুরীকে বিশেষ দূত করে সারা দুনিয়া ছুটে বেড়াতে ছেড়ে দিতে পারতেন। পাঠক কীভাবে নেবেন জানি না, পদ্মা সেতু নিয়ে যে আবুল হোসেন মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন বা ছেড়েছেন, তাঁকেও চীনের সঙ্গে দরকষাকষি করার কাজে লাগাতে পারতেন। রাশিয়া-চীনপন্থি যাঁরা আছেন তাঁদের সেখানে কাজে লাগাতে পারতেন। কিন্তু কাউকে কোথাও কাজে লাগানো হয়নি। যে কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা একটি কঠিন স্থায়ী সমস্যা হতে চলেছে। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ভালো না হয়ে খারাপ হচ্ছে। যেখানে কক্সবাজার এবং আশপাশের লোকেরা নিজেরা না খেয়ে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গা পরিবারকে নিজের ঘরে রেখে নিজেদের খাবার ভাগ করে খাইয়েছেন, সেখানে ইদানীং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই দাঙ্গা-ফ্যাসাদ হচ্ছে। কিছুদিন আগে কক্সবাজারে কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক রোহিঙ্গা ছাত্রীকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রিয় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছন, ‘জ্ঞান অর্জনে প্রয়োজনে চীন যাও’। সেই মর্যাদাময় আলোকিত শিক্ষা অর্জনে কাউকে বাধা- এ সভ্যতার মূলে আঘাত হানার শামিল। কি আজব ব্যাপার! রোহিঙ্গা শিশুরা যারা স্কুলে লেখাপড়া করছে তাদের বাংলা পড়তে বা শিখতে দেওয়া হচ্ছে না। পৃথিবীর কত দেশ কত মানুষ বিদেশি ভাষা শেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। আমরা ইংরেজি শেখার জন্য পাগল। যার ভিতরে এক কালো অক্ষর নেই সেও তার ছেলেমেয়েকে ইংরেজি স্কুলে পড়াবার চেষ্টা করেন। আর আমরা রোহিঙ্গাদের আমাদের ভাষা শিখতে বাধা দিচ্ছি। কারণ তারা আমাদের সঙ্গে মিশে যেতে পারে! আজকাল সমাজপতি ক্ষমতাবান সরকারি ব্যক্তিরা এক মুহূর্তের জন্য ভাবেন না, হাজার বছরে কত শাসক কত ধনিক বণিক আমাদের দেশে এসেছেন, ভারতে এসেছেন তাঁরা কেউ ভারতীয় হতে পারেননি, বাঙালি হতে পারেননি। আর কিছু না হোক, আমাদের জাতীয় সত্তার ভিত বড় শক্তিশালী। জানি এসব বলে তেমন কাজ হবে না, তবু কেন যেন বলতে ইচ্ছা করে পরবর্তী প্রজন্মের যদি কাজে লাগে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়েছে, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। ৭ মার্চের ইউনেস্কোর স্বীকৃতি মহিমময়-অমøান করে রাখতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। উদ্যোক্তা ছিলেন কিছু নাগরিক। মূলত সরকার ও আওয়ামী লীগের সহায়তায় অনুষ্ঠানটি হয়েছে। কিন্তু তেমন দাগ কাটেনি। কারণ জাতির মানসপটে দাগ কাটার মতো চেষ্টাও ছিল না সেখানে। তা যদি থাকত তাহলে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর পাশে যাঁরা ছিলেন বা সেই মঞ্চে যাঁরা ছিলেন তাঁদের এখনো যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের জন্য আলাদা একটা মঞ্চ করে সেখানে বসাতে পারতেন। আমাকে স্বীকার করুন আর না করুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেখানে এখন শিশু পার্ক করা হয়েছে, সেই শিশু পার্কের অনেকটা জায়গাই হানাদারদের নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণের জায়গা। যদি শিশু পার্ক থাকে তাহলে ’৭১-এ আমাদের কাছে হানাদাররা যে নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল তার কোনো চিহ্ন থাকবে না। সে অনুষ্ঠানে বীর বাঙালির প্রতীক হিসেবে আমি ছিলাম। আমাকে স্বীকার করা হোক বা না হোক পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয় এবং আমাদের বিজয় স্বীকার করতে হলে জায়গাটা চিহ্নিত থাকা উচিত ছিল। হানাদারদের অস্ত্র ছেড়ে দেওয়ার সময় না হয় আরও দু-চারজন বীর বাঙালি ছিলেন। কিন্তু সকালে বাঘের গুহায় যখন গিয়েছিলাম তখন ভারতীয় তিন সেনাপতির সঙ্গে বাঙালি হিসেবে একমাত্র আমিই ছিলাম। আমার বীরত্ব না হয় নাই থাকল, আমার নাম না হয় মুছে ফেলা হলো শুধু ভারতীয় বাহিনী নয়, একজন বীর বাঙালিও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর প্রধান টাইগার নিয়াজির গুহা দখল করেছিল, কব্জা করেছিল- এটা বলার স্বার্থেও আমাকে স্বীকার করতে হবে। না হলে ইতিহাস বিকৃতি হবে। শতবর্ষ পর ইতিহাসে মিথ্যার কোনো জায়গা থাকবে না। বর্তমানের প্রভাবের কোনো স্থান থাকবে না। বেঁচে আছি সামর্থ্য আছে তাই এসব নিয়ে ভাবী, দু-চার কথা বলি।

যা নিয়ে শুরু করেছিলাম জাতির পিতার শততম জন্মদিন। এটা যদি শুধু ব্যক্তি-গোষ্ঠী বা কোনো দলের হয় সেখানে দেশবাসীর বলার কী? কিন্তু এটা যদি বাঙালি জাতির হয় তাহলে তো নিশ্চয়ই পিতার জন্মশতপূর্তিতে সবাইকে নিয়ে পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত। সে চেষ্টায় যদি খাত থাকে এবং তাতে করে যদি জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আজ না হোক কাল আয়োজকদের ইতিহাসের কাছে অবশ্যই জবাব দিতে হবে।

নতুন বছরে নতুন আলামত। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা। এসব শুনে বড় অসহায় লাগে। মনে হয়, ২০১৪-১৫ সালের দিকে এস কে সিনহা যখন প্রধান বিচারপতি তখন তাঁর কোর্টে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। সুপ্রিম কোর্টের উচ্চাসনের দিকে মাথা তুলে তাকাতেও মাঝেমধ্যে কেমন যেন বাধো বাধো লাগত। আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য স্লোগান দেওয়া অনেকেই বিচারপতি হয়েছেন। আমার এক প্রিয় সহকর্মী ছানাও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন। অসময়ে আল্লাহ তাঁকে নিয়ে গেছেন। বিচারকের আসনে বসাদের দিকে ভালো করে তাকিয়েও দেখিনি। সমীহ হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানে কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু বিচারকের আসনে বসা এস কে সিনহা আর গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বিদেশে বসবাসকারী এস কে সিনহার কত পার্থক্য! এস কে সিনহার আগে কোনো প্রধান বিচারপতি আমাদের দেশে বরখাস্ত হননি, বরখাস্তের পর দুর্নীতির মামলায় আসামি হননি। তাঁর নামে আজ গ্রেফতারি পরোয়ানা। এতে আমাদের সম্মান বাড়ছে না কমছে, হয়তো তলিয়ে দেখিনি। এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকার আমলে। আর এখন যে অভিযোগ তাঁর নামে সে কাজগুলো তিনি প্রধান বিচারপতি থাকতে করেননি; যা করার হয়তো বিচারপতি হওয়ার আগে করতে পারেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর যা করেননি বা প্রধান বিচারপতি থাকতে এসবের বিন্দুবিসর্গ করেননি তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাহলে শুধু এস কে সিনহার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা কেন? এতসব খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও যাঁরা তাঁকে বিচারপতি বানিয়েছিলেন এমনকি জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি বানিয়েছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি? ব্যাপারটি বিবেকের সঙ্গে বিচার করে দেখতে ক্ষমতাবানদের অনুরোধ জানাচ্ছি। রাস্তাঘাটে গাড়ি-ঘোড়ায় অনেক জায়গায় লেখা থাকে, বিবেক হচ্ছে শ্রেষ্ঠ বিচারক!

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর