বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগ-বিএনপি কি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে?

পীর হাবিবুর রহমান

আওয়ামী লীগ-বিএনপি কি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে?

মাঝেমধ্যে মনে হয়, একালের রাজনীতিবিদদের বড় অংশই জানেন না; তাঁদের পূর্বসূরিরা ছিলেন কতটা গণমুখী, কর্মীবান্ধব, সৎ ও দেশপ্রেমিক। বহুবার বলেছি, রাজনীতির ময়দানে তাঁরা ছিলেন জননেতা। কারাগারে গেলে রাজবন্দী। একদল আমলা জানেন না, তাঁদের পূর্বসূরিরা একালের মতো নির্লজ্জ, দলকানা, নীতিহীন, সুুবিধাবাদী ছিলেন না। ছিলেন মর্যাদাবান, দক্ষ, ব্যক্তিত্ববান, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। মানুষের কাছে ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। আইন ও বিধিবিধানবলে তাঁরা তাঁদের কাজ সম্পাদন করতেন। ব্যক্তিত্বহীন, মেরুদন্ডহীন, দলদাস ছিলেন না। একালের গণমাধ্যমে যে বিনিয়োগ হচ্ছে, গণমাধ্যমকর্মীরা যে সুযোগ-সুবিধা, বেতন পাচ্ছেন, তাঁদের পূর্বসূরিদের সময় এটি চিন্তাই করা যেত না। কিন্তু সেসব পূর্বসূরি রাজনৈতিক আদর্শিক জায়গায় উচ্চতায় থাকলেও সংবাদকর্মীদের রুটি-রুজি আর পেশার মর্যাদা, স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ছিলেন নির্ভীক। কখনো নির্লজ্জ দলীয় কর্মীর কাতারে যাননি। ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা আর ধান্দায় -মতলবে সবখানে ছুটে বেড়াননি। এখনকার গণমাধ্যম মোড়লদের সম্মানহীন, শ্রদ্ধাহীন জীবন অতীতে কখনো ছিল না। পেশাদারিত্বের জায়গায় অতিশয় দুর্বলরা একালে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব করে বেড়ান সমাজে, দুই দলের অনুগত কর্মী হয়ে। দু-চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া বাকিরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেছেন। কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি-জামায়াত। এমন নির্লজ্জ দলবাজিতে কোনো দেশের পেশাদাররা তো কখনো ডোবেনইনি, এ দেশের ইতিহাসেও তাঁদের পূর্বসূরিরা এমনটি করেননি। কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন, দায়িত্ব পালনে হামলায় রক্তাক্ত হন। মোড়লদের প্রতিবাদে নামতে দেখা যায় না। মাঠের সাংবাদিক প্রতিবাদ, মানববন্ধন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ছিলেন একসময় সব ছাত্রছাত্রীর পিতৃতুল্য অভিভাবক। শিক্ষকরা ছিলেন একেকজন দার্শনিকের মতো জ্ঞানের আলো ছড়ানো আদর্শের বাতিঘর। একালে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আর অভিযোগ। দু-চারজন যাঁরা ব্যতিক্রম, তাঁরাও এ নিয়ে হতাশায় লজ্জিত। শিক্ষকদের এমন দলবাজি অতীতে কখনো হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাদ দিলেও কলেজশিক্ষকদের একটা অংশ ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান ও গবেষণার চেয়ে শিক্ষা ভবনের কর্মকর্তাসহ মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেটে প্রবেশে বেশি আগ্রহী। কলেজ-স্কুলগুলোয় ভবন বাড়ছে, বিষয় বাড়ছে, শিক্ষার মানই পড়েনি; প্রবল শিক্ষক সংকট চলছে।

সরকারি চিকিৎসকরা মানুষের কাছে সৃষ্টিকর্তার পরে ছিলেন পরম ভরসার জায়গায়। এমন দলবাজিতে তাঁরা নিমজ্জিত হননি। এখনো যাঁরা মানবতার সেবায় মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় পেশাদারিত্বের জায়গায় ইবাদতের মতো দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাস যা-ই হোক, মানুষের সম্মান ঠিকই অর্জন করছেন। দেশের স্বাস্থ্য খাতের নিরন্তর লুটপাট তুঘলকি কেনাকাটায় মানুষ মন্ত্রীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও নেপথ্যে আমলাদের এবং সরকারি দায়িত্বশীল চিকিৎসকদের হাত ধরেই সংঘটিত হচ্ছে। একেকটি হাসপাতাল যত বড় হচ্ছে, আসন শয্যা যত বাড়ছে, স্বাস্থ্যসেবার পরিসর যত বিস্তৃত হচ্ছে, দুর্নীতি তত বেশি প্রসারিত হচ্ছে। তাই মাঝখানে হাসপাতালগুলোয় ডাক্তার সংকট, নার্স সংকট এমনকি টেকনিশিয়ানের সংকট চরম আকার নিয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রতিনিধিরা ডাক্তার-নার্স নিয়ে গেলে বিএমএ থেকে শুরু করে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতনদের সুবাদে নানা পথে তাঁরা বদলি হয়ে আসছেন। তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবার অধিকার বলে কিছু নেই। অসংগতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কেউ নেই।

সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশ ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী কখনো ছিলেন না। যাঁরা সত্যিকার অনুসারী ছিলেন তাঁদের কপালে যথাসময়েই অবসর ঘটেছে। আরেকটি অংশ প্রভাবশালী আমলাদের দলবাজির সিন্ডিকেটের ছায়ায় সরকারি এত সুযোগ-সুবিধার বাইরেও নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। অবসরে গিয়েও বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানেও দায়িত্ব পাচ্ছেন। অনন্তকাল যেন দলবাজ ক্ষমতাশালী সিন্ডিকেটের ছায়ায় তাদের পদ-পদবি নিয়ে ক্ষমতায় থাকা চাই। দেশের সব সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী যে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন, তার ব্যয় তাঁদের পরিবার সামান্য বহন করলেও সিংহভাগ অর্থ ব্যয় করেছে দেশের জনগণ গরিব মানুষ। সেই গরিবের রক্তে লেখাপড়া করা এঁদের সিংহভাগ আজ ভুলে যাচ্ছেন মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। যে যত বেশি ক্ষমতার নির্লজ্জ দালালি করবেন, যে যত বেশি পেশাগত দায়িত্ব বা চেয়ারকে দলীয় কর্মীর কাতারে নিয়ে যাবেন, তাঁর জন্যই পরবর্তীতে বড় পুরস্কার অপেক্ষা করছে। দিনে দিনে এটিই দৃশ্যমান হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলেও এটি দেখা গিয়েছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একজন জনপ্রিয় নেত্রী হয়েও তাঁর অসংখ্য সমর্থককে বাইরে রেখেও তিনি কারাগারে অন্তহীন যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছেন। কিন্তু সেসব সুবিধাভোগী, কর্তৃত্ববাদী পেশাদার যাঁরা দুই হাত ভরে সুবিধা ভোগ করেছিলেন, নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন এবং সমাজে দম্ভের সঙ্গে হাঁটাচলা করেছেন, তাঁদের এখন দুরবিন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাদের মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে চাটুকার, দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের বিরুদ্ধে বারবার সতর্ক করেছিলেন, গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে আহ্বান জানিয়েছিলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বারবার সতর্ক করছেন, সেই তাঁরাই আজ সবখানে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে ক্ষমতার চারদিকে কাচের দেয়াল তুলে দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিদেশ সফরে যান, একদল ব্যবসায়ীকে তাঁর সফরসঙ্গী হতে দেখি। কিন্তু দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের কখনো দেখা যায় না। বহুবার বলেছি, বিদেশি বিনিয়োগ টানতে এবং ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করতে বিপুলসংখ্যক খুচরা ব্যবসায়ীকে না নিয়ে, দেশের অর্থনীতিতে যেসব শীর্ষ ব্যবসায়ী অবদান রাখছেন, বিশাল কর্মসংস্থান তৈরি করছেন, নতুন নতুন ধারণা নিয়ে নানা খাতে বিনিয়োগ করছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে নিলে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিই বাড়বে না; দেশের অর্থনীতির জন্যও সহায়ক হবে।

দেশের একদল গণমাধ্যমের দলকানা মুখ সব সময় সঙ্গে যাচ্ছেন। যাঁদের গণমাধ্যমের মুখ হিসেবে সমাজে বা মানুষের মধ্যে প্রভাব দূরে থাক, পরিচিতি দূরে থাক, ইমেজ বলতেই কিছু নেই, তাঁরাই যাচ্ছেন। মাঠের রিপোর্টাররা যখন যান, তখন কোনো প্রশ্ন থাকে না। মনে হয়, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে-ময়দানে তাঁরা রিপোর্টিংয়ে শ্রম দেন। স্নেহ-মমতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের বিদেশ সফরে নিয়ে সেই শ্রমের স্বীকৃতি দেন। কিন্তু গণমাধ্যমের মোড়ল হিসেবে তথাকথিত যাঁদের নিয়ে যান, দুঃসময়ে এঁদের দুই লাইন লেখার নজির নেই। চারটি কথা বলার রেকর্ড নেই। তার চেয়ে জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করা সম্পাদক ও লেখক-কলামিস্টদের নিতে পারতেন। মর্যাদাবান মানুষ কখনো প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং বা কোনো সিন্ডিকেটে আগ্রহ দেখান না। নিজেদের ব্যক্তিত্ব নিয়ে, আত্মমর্যাদা নিয়ে যার যার জায়গায় দায়িত্ব পালন করেন।

দেশের সব প্রতিষ্ঠানের মতো গণমাধ্যমও এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে মানুষের প্রয়োজনীয় আকাক্সক্ষা পালনের সীমাবদ্ধতা যেমন রয়েছে, তেমনি দক্ষ কর্মী ও নেতৃত্বের আকাল চলছে। অনেক টেলিভিশন কর্মীকে মালিকরা নিয়মিত বেতন দিতে পারছেন না। কিন্তু টেলিভিশনের লাইসেন্সদানের ধারা অব্যাহত রয়েছে। অনেক প্রিন্ট মিডিয়া মাসের পর মাস বেতন দিতে পারে না। সেসব কাগজ কোথাও চোখে পড়ে না। কিন্তু তাদের মোড়লদের ক্ষমতার পাদ-প্রদীপে উজ্জ্বল হাসিমুখে বসে থাকতে দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু রেখে সংবাদকর্মীদের প্রাপ্য পাওনা না দিয়ে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা আহরণ ও সমাজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় তারা লিপ্ত। তথ্যমন্ত্রী একেকটি গণমাধ্যমের সার্কুলেশনের যে তথ্য সংসদে তুলে ধরেন, হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলোর কোনো সত্যতা বাজারে নেই। সরকারি বিজ্ঞাপন লুটপাটের মহোৎসবের চিত্র অসত্য প্রচারসংখ্যার আড়ালে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এসব কাগজের চিহ্ন কোথাও দেখা যায় না।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে সত্য। জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমাদের রেকর্ড বিস্ময়কর জায়গায় এও সত্য। বিশ্বের সেরা অর্থমন্ত্রীর খেতাবপ্রাপ্তি আমাদের জন্য গৌরবের হলেও সেটি ধূসর হয়ে যায়, যখন দেখা যায়, বেসরকারি ব্যাংক মালিকরাই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুলসংখ্যক অর্থ ঋণ নিয়ে গেছেন। তখন সবকিছু ধূসর হয়ে যায়, যখন দেখা যায়, বিদেশে অর্থ পাচারের চিত্রটা কত ভয়ঙ্কর। অর্থনৈতিক খাতের এবং উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতির বীভৎস খবর উঠে আসে। ব্যাংকের টাকা লুট হওয়ার কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী লাখো মানুষকে রিক্ত-নিঃস্ব করে দরপতনের ধারায় অব্যাহতভাবে যেখানে কবরে শুইয়ে দিয়েছে; সেখানে বলা যায়, কবরের আজাব ছাড়া ওখানে আর কিছু নেই। ঘুরে দাঁড়াবার কোনো লক্ষণ শেয়ারবাজারে দেখা যাচ্ছে না। অথচ সব দায়িত্বশীল ব্যক্তিগত ভোগবিলাস ও আয়েশের জীবনযাপনে কীভাবে সুখনিদ্রা যাচ্ছেন! সেই প্রশ্ন থেকে যায়।

একটি দেশে রাষ্ট্রীয় পদক পর্যন্ত যাঁদের প্রাপ্য তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই অনেক ক্ষেত্রে পদকের অর্থমূল্য থাকলেও পদকমূল্য আর থাকছে না। সেদিনের আওয়ামী ও মুজিববিদ্বেষী রাজাকারপুত্রের কপালে স্বাধীনতা পদক জোটে। মন্ত্রিসভায় থাকার সুবাদে অনেকেই নিজেদের পদক নিয়ে যাচ্ছেন। আর চোখের সামনে জ্বলজ্বল করা স্বাধীনতাসংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তিতুল্য জাতীয় বীরদের কপালে সেই পদক জোটে না। এ দীনতা তাঁদের নয়, আমাদের।

দেশের অর্থনীতি টিকে আছে গরিবের শ্রমে। ব্যাংক টিকে আছে গরিবের অর্থে। কিন্তু গরিবের ওপর শোষণ এখনো থামছে না। দেশের অর্থনীতিতে ট্যাক্স-ভ্যাট দিয়ে জনগণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু জনগণের সম্পদ দুর্নীতিবাজ, সিন্ডিকেট লুটে নিয়ে যাচ্ছে। হুন্ডির সঙ্গে কারা জড়িত? কেন ধরা পড়ে না? পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ায় ভারতের হীরা ব্যবসায়ী নীরব মোদিকে দেশে জামিন-অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি হয়। লন্ডনে গ্রেফতার হয়ে তিনি সেখানে জেলে। এ দেশে এত লুটেরা কীভাবে বিদেশে ঘুরে বেড়ান, নিরাপদে থাকেন? এমন বীরত্ব ও নিরাপদ বিলাসী জীবনের ঔদ্ধত্য পান কীভাবে? দেশের প্রকৃত শিল্পপতিরা দেশে বিনিয়োগ করছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাচ্ছেন। বিশাল কর্মসংস্থান তৈরি করছেন। সেখানে তাঁদের দোরগোড়ায় ব্যাংক ঋণ আসে না। ফড়িয়া-লুটেরারা টাকা লুট করে বিদেশে আলিশান জীবনযাপন করছেন। আইন ও ক্ষমতা তাঁদের চুল স্পর্শ করতে পারে না। প্রবাসী শ্রমিকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে মধ্যপ্রাচ্যে দাবদাহের মধ্যে অমানুষিক পরিশ্রম করে রেমিট্যান্সের রেকর্ড গড়েন। কৃষক সকাল-সন্ধ্যা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করে দেশের অর্থনীতিকে শক্ত মেরুদন্ডের ওপর দাঁড় করান। তাঁরা তাঁদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা লুটে নিয়ে যায়। তাঁরা পরিবারকে সময় দিতে পারেন না। পরিবারকে সুখ-স্বচ্ছন্দ দিতে পারেন না। অথচ দুর্নীতিবাজ-লুটেরারা জনগণের সম্পদ লুট করে নিয়ে যায় কেমন করে? কাদের শক্তিতে?

আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ আমরা এখনো প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে সংবিধান থেকে নির্বাসিত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আর ফিরে আসেনি। এত রক্ত, এত মানুষের আত্মদান, এত মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, এত ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে পাওয়া স্বাধীনতার বাংলাদেশে আদর্শিক রাজনীতি ও সমাজ এক কথায় মানবিক রাষ্ট্র এখনো গড়ে ওঠেনি। গণতন্ত্র তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। রাজনীতি আজ আকষর্ণহীন বিবর্ণ ধূসর।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বিচার বিভাগের দুর্বলতাকে বারবার সামনে তুলে এনেছে। সংসদ রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণে অতিশয় দুর্বল। আইনপ্রণেতাদের কর্মকান্ড থেকে স্থানীয় সরকারের নেতৃত্ব পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া। এই তুমুল আর্তনাদ বারবার উঠে আসছে। প্রশাসন দলীয়করণের অভিশাপ প্রায় দুই দশক থেকে চরম আকার নিয়েছে। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে তোয়াক্কা না করার ভয়াবহতা সব ক্ষেত্রে বিরাজমান। মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনীতির আবেগ-অনুভূতির প্রথম ধাপ নির্বাচন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এ দেশের মানুষ তার ভোটের অধিকারের জন্য বারবার লড়াই করেছে। অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্ত উৎসবমুখর পরিবেশে দিনভর দীর্ঘ লাইন ধরে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব বয়সের ভোটার ব্যালটে তাদের রায় দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচন থেকে স্থানীয় নির্বাচনের ভোট এ দেশের গণতন্ত্রের মহোৎসব। কিন্তু সেই ভোটও এখন মানুষের সব আবেগ-অনুভূতি থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। এক কথায় আকর্ষণ হারিয়েছে ভোট। সর্বশেষ চট্টগ্রামের উপনির্বাচন এবং ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ সে বিষয়টি জাতির সামনে নতুন করে তুলে এনেছে। অনেক দায়িত্বশীল বলছেন, দেশ উন্নত হয়েছে। পশ্চিমাদের মতো এখানেও ভোটার উপস্থিতি কমেছে। কিন্তু কানাডা, ফ্রান্সেও ভোটার অংশগ্রহণ ব্যাপক। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ সত্যকে আড়াল করার অপপ্রয়াস ছাড়া কিছু নয়। ঢাকা উত্তরে ২৫.৩০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ ভোটার ভোট দিলেন। নির্বাচনে অনিয়ম কি হয়েছে, সে প্রশ্ন তলিয়ে গেছে। ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন মোট ভোটারের ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশের সমর্থন নিয়ে। ঢাকার দক্ষিণে মোট ভোটারের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের সমর্থন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। অথচ গোটা নির্বাচন ছিল বিনা বাধায়, বিনা ধর-পাকড়ে বিএনপির জন্য সমান প্রচারণার সযোগ। নির্বাচন কমিশনে রাজনীতির জন্য দুই পক্ষ অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ দিলেও শেষ মুহূর্তের প্রচারণা ছিল শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর এবং তুমুল প্রতিযোগিতামূলক। সব মেয়র প্রার্থী ছাড়াও কাউন্সিলর প্রার্থীদের সঙ্গে বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী নেমেছিল প্রচারণায়। নির্বাচনের দিন সিইসি বলেছেন, এজেন্টকে টিকে থাকার সামর্থ্য থাকতে হবে। মধুর চেয়ারে বসা দায়িত্বশীলের এমন কথাকে কেউ আমলে নেয়নি।

প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ভোটের প্রচারণায় নেমেছিলেন, তারা সবাই কি ভোট দিয়েছিলেন? আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বলেছেন, বিএনপিকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। মানলাম করেছে। দমন-পীড়নেও শেষ। কিন্তু ১১ বছরের শাসনামলে দেশজুড়ে সবাই আজ আওয়ামী লীগ, তাহলে আজ আওয়ামী লীগের ভোটার-সমর্থকরা গেল কই? তারা ভোট দিতে যাননি কেন? অনেকে বলছেন, গত ছয় বছরে জাতীয়, স্থানীয় নির্বাচনের বিরূপ প্রভাব হচ্ছে ভোটের প্রতি মানুষের আকর্ষণহীনতা। তাদের কথা বাদ দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য ধরে নিলেও না হয় বুঝতে পারলাম, নেতৃত্বহীন বিএনপি ১১ বছরের প্রতিকূল অবস্থায় অতিশয় দুর্বল হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এত জনপ্রিয় হয়েছে তার প্রতিফলন দলের বিশাল সমর্থকের অংশগ্রহণে ভোট কেন্দ্রে ঘটল না কেন? তবে কি দেশে ছাত্র রাজনীতির মরুকরণের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির যে বন্ধ্যত্ব চলছে বা গণমুখী আদর্শিক রাজনীতির পরাজয় ঘটছে, সেটিই মানুষকে ভোটের প্রতি, রাজনীতির প্রতি অনীহা বাড়িয়েছে? তাহলে কি রাজনীতিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে মানুষ? তার মানে আমরা যে বলে আসছি ক্ষমতা হারালে দেশজুড়ে, সমাজজুড়ে এই যে চারদিকে কেবল আওয়ামী লীগ তারাও থাকবে না। এটাই সত্য! নাকি এক কথায় বলা যায়, আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলই মানুষের কাছেই নয়, নিজ দলের সমর্থকদের কাছেও জনপ্রিয়তা হারিয়েছে? দৃশ্যে যা দেখা যাচ্ছে, তা কেবল ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে সুবিধাভোগীদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা লাভের তুমুল প্রতিযোগিতা? যদি এটা হয়, তাহলে রাজনীতির জন্য অশুভ-অশনিসংকেত; যার পরিণতি গণতন্ত্রের জন্য কখনো শুভ নয়।

                লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর