সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

কঠিন বাজি ধরেছে ভারতের বিজেপি সরকার

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

কঠিন বাজি ধরেছে ভারতের বিজেপি সরকার

আগামী দিনের বিশ্ব ব্যবস্থায় ভারত এখন উদীয়মান শক্তি। কিন্তু বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপের জের ধরে ভারতের অভ্যন্তরে চরম বিভাজনজনিত অস্থিরতা ও উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বত্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট সাম্প্রতিক একটি সংখ্যায় হেডলাইন করেছে, ‘অসহিষ্ণু ইন্ডিয়া-বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের বুকে বিভাজনের রেখাপাত, ২০ কোটি মুসলমান সম্প্রদায়ের মনে ভয় সৃষ্টি হয়েছে ভারত হয়তো হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে।’ সুতরাং গৃহীত পদক্ষেপ ও উ™ভূত পরিস্থিতির প্রজ্ঞাজনিত মীমাংসা না হলে বিশ্ব অঙ্গনে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ বিশ্ব ব্যবস্থার বড় শক্তিকে মানুষ বহুত্ববাদের ধারক বাহক এবং ধর্ম বর্ণের বিবেচনায় একটা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। বিজেপি সরকার কর্তৃক আনীত ও ইতিমধ্যে বলবৎ হওয়া সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং নাগরিকপুঞ্জ তৈরির ঘোষণায় ধর্মীয় বিভাজনের পদক্ষেপ থাকার কারণেই মূলত ভারতজুড়ে বিরোধী পক্ষের বৃহত্তম প্লাটফরম ও উদারপন্থি মানুষের পক্ষ থেকে দৃঢ়চেতা প্রতিবাদের ফলে অশান্ত উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি এবং সর্বত্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বহির্প্রকাশ ঘটছে। বিজেপি সরকারের এসব পদক্ষেপের কারণে পুরো ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি আবার সামনে এসেছে। প্রায় দুইশ বছর পুরো ভারতবর্ষ, আজকের বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ ইন্ডিয়া ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। তার আগে তেরোশত শতাব্দীর শুরু থেকে সুলতানি ও মুঘল আমল মিলে আরও প্রায় সাড়ে চারশ বছর ভারতবর্ষ শাসনকারী মূল শাসকরাও বিদেশি ছিলেন। তারা এসেছিলেন মধ্য এশিয়া অঞ্চল থেকে। এই শাসকগণ ধর্মীয়ভাবে মুসলমান এবং জাতিগতভাবে বিদেশি হলেও তারা এদেশের সমাজ, সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে এ দেশকেই নিজেদের দেশ মনে করেছেন। এদেশের মানুষকে নিয়ে এবং তাদের দ্বারাই শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। ব্রিটিশদের মতো ভারতবর্ষের ধন-সম্পদ তারা নিজেদের পিতৃভূমিতে পাচার করেননি এবং এদেশকে কখনই উপনিবেশ মনে করেননি। ভারতের কংগ্রেস দলের বর্তমান সদস্য এবং সুলেখক শশী থারুর তার লেখা- ‘ইরা অব ডার্কনেস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শুরুতে বিশ্বের মোট সম্পদের শতকরা ২৩ ভাগের অধিকারী ছিল ভারতবর্ষ, আর ব্রিটিশরা যখন চলে যায় এটি নেমে আসে মাত্র শতকরা তিনভাগে। ব্রিটিশ শাসকরা ডিভাইড অ্যান্ড রুল তত্ত্বের ধারায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে চরম বিভাজনের বীজ রোপণ করেন। ব্রিটিশদের আগমনের আগ পর্যন্ত ভারতবর্ষে সব ধর্মের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত মনোদর্শন এবং শাসন ব্যবস্থায় বহুত্ববাদের অপার ঐক্যবদ্ধতা ছিল বলেই ভারতবর্ষ তখন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ ছিল, যার উল্লেখ করেছেন শশী থারুর ‘ইরা অব ডার্কনেস’ গ্রন্থে। সুতরাং ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজের সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাত নির্বিশেষে বৈষম্যহীন ঐক্যবদ্ধতার পরিবেশই একটা রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি। ব্রিটিশ ও তার আগে সুলতানি এবং মুঘল আমলে অনেক ঘটনা ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে ঘটেছে, যা এ সময়ে এসে আমাদের মনে হতে পারে তা না ঘটলেই ভালো হতো। কিন্তু আজকে কয়েকশ বছর পরে এসে ইতিহাসের চাকাকে রোল ব্যাক করে ওই কয়েকশ বছরের পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চাইলে তা হবে সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত চিন্তা। তাই বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বড় রকম ভুল পদক্ষেপের মাধ্যমে কয়েকশ বছর পূর্বের ভুল পদক্ষেপকে সংশোধন করতে যাওয়া মানে নতুন করে একটার পর একটা বিপর্যয় ডেকে আনা, যার কোনো শেষ থাকবে না। ইংরেজিতে Fait Accompli কথাটি এ জন্য এসেছে। ভয়ঙ্কর দ্বিজাতিতত্ত্বের পরিণতি আমরা ১৯৪৬-৪৭ সালে দেখেছি এবং এখনো দেখছি। সেটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রের পরিণতি কী হতে পারে তার জ্বলন্ত উদহারণ আজকের পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতের যাত্রার শুরুতে রাষ্ট্রের লিখিত দর্শন এবং শাসকগণের মনোদর্শনে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণেই ভারত আজ বিশ্ব দরবারে যথা উপযুক্ত নেতৃত্বের স্থান লাভের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। এখন শুধু ভিতরে প্রবেশের অপেক্ষা। তৈরি অবস্থান ভাঙতে সময় লাগে না; কিন্তু পাঁচ-দশ বছরে একটি রাষ্ট্রকে এই অবস্থানে আনা সম্ভব নয়। এই সময়ে এসে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত আবার সাতচল্লিশ পূর্ব অবস্থার বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। ভারত কি রাষ্ট্রীয় দর্শকসহ দৃশ্যমানভাবে কথায় ও কাজে এবং শাসকগণের মনোদর্শনে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা বহুত্ববাদের সৌন্দর্য ও শক্তিকে বজায় রাখবে, নাকি সাতচল্লিশের প্রাক্কালে মুসলিম লীগ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘসহ (আরএসএস) হিন্দু মহাসভার মতাদর্শের রাজনীতি দ্বিজাতিতত্ত্বের নবরূপে ভারতকে মনোলিথিক হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র বানাবে। এই দুই বিপরীতমুখী দর্শনের কোনটি ভারতের জন্য কল্যাণকর হবে, সেটা নিয়েই বিতর্ক চলছে। ক্ষমতাসীন দল বিজেপি বলছে, তারা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এক নতুন ভারত তৈরি করতে চায়। বিপরীতে বৃহত্তর রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষগুলো থেকে এর তীব্র বিরোধিতা করে বলা হচ্ছে, নতুন ভারতের স্লোগানের ছদ্মবেশে বিজেপি সরকার আসলে আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার এজেন্ডা, ভারতকে হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে, যা দেশের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে। সবচেয়ে কঠিন মন্তব্য করেছেন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সহসভাপতি চন্দ্র কুমার বসু, বলেছেন ভারত আবার ভাগ হতে চলেছে। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আলোচ্য বিতর্কটি শুরু হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কর্তৃক কয়েকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল বিষয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় সেটিকে ঘিরে এখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চরম অনিশ্চয়তা এবং বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ ঠেকাতে পুলিশের গুলিতে দুই ডজনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ৭৩ বছরের স্বাধীনতার ইতিহাসে ভারতের অভ্যন্তরে এত বড় বিভাজন আর কখনো দেখা যায়নি। গত ডিসেম্বর মাসের শুরুতে ভারতের নাগরিকত্ব আইনটি বিজেপি সরকার পার্লামেন্টে তাদের ব্রুট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যেভাবে সংশোধন করেছে সেটিকে কেন্দ্র করেই মূলত সমগ্র ভারতব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, সঙ্গে বাবরি মসজিদ-রামমন্দির ইস্যু এবং কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা অবনমনের বিষয়টিও বিক্ষোভ প্রতিবাদের সামনে রয়েছে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের মূল ভাষ্য ও কথায় ভারতের মৌলিক শক্তি ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের শেকড়ে আঘাত করা হয়েছে বলে বিরোধী পক্ষ মনে করছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, জৌন, পারসি- এসব ধর্মের মানুষ, যারা পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছে তাদের এই সংশোধনী আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। শুধু একটি ধর্মের অর্থাৎ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে আইনের দ্বারা আলাদা করে ফেলা হয়েছে, যা বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের সঙ্গে যায় না। আসামে নাগরিকপুঞ্জের চূড়ান্ত ফলাফল দেখার পর সংশোধিত আইনের অন্তর্গত মর্মার্থের ভিতরে লুকায়িত উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে তা নিয়েই মূলত সংশয় ও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে সাড়ে ১৯ লাখ বাদ পড়ার ভিতরে প্রায় ১২ লাখ হিন্দু, এই তথ্য প্রকাশ হওয়ার পরপরই নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই মনে হতে পারে সাড়ে ১৯ লাখের সবাই মুসলমান হলে হয়তো এই উদ্যোগ নেওয়া হতো না। তাই সারা দেশেই নাগরিকপুঞ্জ হওয়ার ঘোষণায় সংশয়-শঙ্কা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কথা সত্য যে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের পরিণতিতে বহু সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর বড় সংখ্যক মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়েছে এমন কথার ভিত্তি প্রমাণাদিসহ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না এবং সেটি বিশ্বাসযোগ্যও হবে না। বর্ণিত বিধি মোতাবেক কাগজ-দলিল দেখাতে না পারলেই বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ আসাম ও পশ্চিম বাংলার বাস্তবতায় ভারতের নেই। আসামের নাগরিকপুঞ্জের কাহিনি, যেখানে সাবেক উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের পরিবার পর্যন্ত বাদ পড়েছে, সেখানে বর্ণিত কাগজ-দলিল না দেখাতে পারার কারণে শেষ পর্যন্ত সারা দেশে কোটি না হলেও কয়েক লাখ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে যদি ঘোষিত বন্দী শিবিরে রাখা হয় তাহলে সেটি গণতান্ত্রিক ভারতের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি এবং আগামী দিনের বিশ্ব নেতৃত্বের প্রত্যাশী ভারতের জন্য কি সহায়ক কিছু হবে? তারপরও সেরকম যদি একান্তই হয় তাহলে বিশাল সংখ্যক মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিকত্ব হারিয়ে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে কেউ যদি মনে করেন ভারতের জাতীয় নির্বাচনে কোনো আসনে মুসলমান ভোটাররা যেন জয়-পরাজয়ের নির্ধারক না হতে পারে তার একটা পন্থা বের করার জন্যই বিজেপি নিজেদের দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে এই পদক্ষেপ নিয়েছে তাহলে সে কথাকে খ-ন করা কঠিন হবে। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ধর্মকে প্রধান বিবেচ্য করার কারণেই বিতর্ক ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিজেপি সরকারের দ্বিতীয় বড় পদক্ষেপ, যা নিয়ে একই ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তাহলে ৭২ বছর বলবৎ থাকা জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা প্রদানকৃত ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল। বিজেপি সরকার বলছে কাশ্মীরের মানুষের কল্যাণের জন্যই এটা করা হয়েছে। সন্ত্রাস দমন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং বাইরের বিনিয়োগ এলে কাশ্মীরের উন্নতি হবে। সত্যিকার অর্থে এই উদ্দেশ্য যদি সাধিত হয় তাহলে এটা নিয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু নাগরিকত্ব আইনের মতো কাশ্মীরের এই ইস্যু নিয়েও ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলো থেকে একই রকম বিরোধিতা করা হচ্ছে। বিরোধী পক্ষের যুক্তি হচ্ছে যে পদ্ধতিতে এই কাজটি করা হয়েছে এবং যা করা হয়েছে তার সব কিছুতেই হিতেবিপরীত হবে। কোন পক্ষ সঠিক তা কেবল সময়ই বলে দিবে। তবে কাশ্মীরের বৃহত্তর জনগণ, আইনসম্মত রাজনৈতিক দল, দলের নেতা কারোর সঙ্গেই বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি। বরং নতুন ব্যবস্থা কার্যকরণ করার প্রাক্কালে কাশ্মীরের সব রাজনৈতিক দলের টপ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার ও গৃহবন্দী করা হয় এবং ইন্টারনেট মোবাইল ফোনসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর শাটডাউন আরোপ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক হাজার অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কাশ্মীরে নিয়োগ করা হয়। সব শিক্ষাঙ্গন আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। সব মিলে পুরো কাশ্মীরে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। সুতরাং নতুন আদেশটির ইনফোর্সমেন্ট পদ্ধতি ও পরিস্থিতি দেখে যে কেউ বলবে এটা কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক কাশ্মীরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বলে অন্যান্য রাজ্য থেকে মর্যাদায় একধাপ উপরে থাকা বৈষম্যহীন নীতির দর্শনে যৌক্তিক কিনা তা প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে নতুন ব্যবস্থায় ইউনিয়ন টেটিটোরির মর্যাদা দেওয়ায় এখন থেকে অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে কাশ্মীর মর্যাদায় সমান সমানও থাকল না, একধাপ নিচে নেমে গেল। এর ফলে কাশ্মীরের মানুষ ক্ষুব্ধ হলে সেটিকে অস্বাভাবিক বলা কঠিন। কাশ্মীরের আজকের এই পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান বহুলাংশে দায়ী। কাশ্মীরের ছোট একাংশ উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী মানুষের সহায়তায় পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে কাশ্মীরের অভ্যন্তরে, এমনকি ভারতের মূল ভূখন্ডে যেভাবে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত তাতে রাজ্যের সম্পদ ও ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষা এবং জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা যদি যথা উপযুক্ত হয় তাহলে সেটাকে অযৌক্তিক বলা যায় না। তবে এখন যা করা হলো, যেভাবে করা হলো সেটি যথা উপযুক্ত ও যৌক্তিক কিনা এবং বিজেপি সরকার মুখে যা বলছে সেগুলো আসলে কি অর্জিত হবে, নাকি পরিস্থিতির আরও অবনতি ও রক্তক্ষরণ বৃদ্ধি পাবে সেটাই বড় প্রশ্ন। কিন্তু ভারত অভ্যন্তরীণভাবে আজ কঠিন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে এটাই বাস্তবতা। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, নাগরিকপুঞ্জ এবং কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অভ্যন্তরে এবং বিশ্ব অঙ্গনে কঠিন বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে এই মর্মে যে, ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ও আগামী দিনের বৈশ্বিক নেতৃত্বের প্রত্যাশী ভারত যদি একটি মনোলিথিক ধর্মীয় হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হয়ে যায় তাহলে সেটি ভারতের জন্য হবে মহাবিপজ্জনক, আর বিশ্বের জন্য হবে বড় দুঃসংবাদ। পতিত সন্ত্রাসী রাষ্ট্র পাকিস্তানের পথ, ভারত অনুসরণ করবে তা যেন কেউ ভাবতে পারছে না। এ রকম শঙ্কা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে আরও কারণ আছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপি সরকারের অনেক কাজকর্মের ভিতরে আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার আদর্শ এবং চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। এই দুই সংগঠনের পক্ষ থেকে মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের মূর্তি বানিয়ে যখন মালা দেওয়া হয় তখন এই শঙ্কা আরও বৃদ্ধি পায়। ইউটিউবে দেখলাম বিজেপি নেতা ও থিঙ্কট্যাংক হিসেবে পরিচিত সুব্রামানিয়ান সোয়ামী বলছেন, ভারত ইতিমধ্যেই হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে গেছে। সাম্প্রতিকভাবে সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা অনবরত বলে যাচ্ছেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো প্রয়োজন নেই। গুগলে সার্চ দিলেই এই প্রপাগান্ডার বহর দেখা যায়। একটা রাষ্ট্রের সংবিধানে কি থাকবে, কি থাকবে না এবং নাগরিকত্ব আইন কি হবে সেটি ওই রাষ্ট্রের একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়। একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে এত হৈচৈ সৃষ্টি হওয়ার নিশ্চয়ই সঙ্গত কারণ আছে। সুতরাং ভারতের মতো বৃহৎ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও মূল্যবোধের প্রভাব বিশ্ব অঙ্গনে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। সে কারণেই ভারতের সাম্প্রতিক ইস্যুগুলো নিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিয়নসহ বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানে বহুমুখী আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স শাখার প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে গণতন্ত্রের সূচকে ভারত দশ ধাপ নিচে নেমে গেছে। ২৭ জানুয়ারি ভারতে বেসরকারি টেলিভিশন এনডিটির্ভি অনলাইন খবরে প্রকাশিত হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৫০ জন সদস্য সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে পাঁচ পৃষ্ঠার এক প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতের এই পদক্ষেপ একটি বিপজ্জনক পরিবর্তন যার মাধ্যমে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংখ্যক রাষ্ট্রহীন মানুষের সীমাহীন মানবিক ভোগান্তির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপিনাথ মন্তব্য করেছেন, ভারতের চলমান অর্থনৈতিক ঝিমুনি অবস্থা বিরাজমান থাকলে বিশ্বের সার্বিক উন্নয়নের হার কমে যাবে শূন্য দশমিক এক শতাংশ।

সুতরাং অভ্যন্তরে বৃহত্তর রাজনৈতিক পক্ষগুলোর প্রবল বিরোধিতা ও বিশ্ব অঙ্গনের আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে ভারতকে আগামী দিনে উদার গণতান্ত্রিক শান্তিময় সমৃদ্ধশালী ও প্রত্যাশিত বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত করার লক্ষ্য অর্জন বিজেপি সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এ এক বিপজ্জনক যাত্রা। বলা যায়, কঠিন বাজি ধরে এগোতে চাইছে ভারতের বিজেপি সরকার।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর