শিরোনাম
বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

দস্যুরানী সুলতানা ও নবাবজাদা বাঃ মিনিস্টার বাঃ

পীর হাবিবুর রহমান

দস্যুরানী সুলতানা ও নবাবজাদা বাঃ মিনিস্টার বাঃ

গোটা বিশ্ব আজ অজানা অচেনা করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার মুখোমুখি। কার্যত পৃথিবী আজ আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন, স্থবির, অচল হয়ে পড়েছে। চীনের উহান প্রদেশ থেকে যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর চীনকে বিধ্বস্ত করে সেটি এখন পৃথিবীর পথে পথে মানুষকে আক্রান্ত করছে। চীনে নিয়ন্ত্রণে এলেও পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। সেখানে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়েছে। ইউরোপের ইতালিতে পরিস্থিতি বিপজ্জনক। ইরানের অবস্থা করুণ। এখন পর্যন্ত আফ্রিকা ছাড়া কোনো দেশ নিরাপদ নয়। চীনের উহান প্রদেশ ছিল যেখানে বিপজ্জনক বা করোনাভাইরাসের আঁতুড়ঘর। সেই করোনাভাইরাস এখন ইউরোপে ভয়ঙ্কর মূর্তি নিয়েছে। দেশে দেশে এখন আকাশ ও সীমান্ত যোগাযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনের মূল্যকে বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা বড় করে দেখছেন। করোনাভাইরাসের আঘাতে মানবতা আজ বিশ্ব রাষ্ট্রনায়কদের মানুষের জীবন বাঁচাতে এক মোহনায় মিলিত করেছে। দেশে দেশে আজ জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। মানুষের জীবনকেই করোনাভাইরাস হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। পৃথিবী কাঁপছে করোনাভাইরাস আতঙ্ক জ্বরে। মানুষের জীবন রক্ষাই এখন সবার আগে। তাজমহলে সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজ একাই শুয়ে আছেন। আগ্রার তাজমহল বন্ধ হয়ে গেছে। পর্যটক দূরে থাক, প্রেমিক-প্রেমিকাকেও প্রেমের সমাধি টানে না! কেবল জীবনের ভয়। ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। স্ট্যাচু অব লিবার্টি দর্শনে মন নেই কারও। এমনকি ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা গিজগিজ করে ঘুরছে না কাবার চারপাশ। মুসলিম উম্মাহর সুরম্য মসজিদে জামাতে নামাজ আর জুমা বন্ধ। আজানের সুরে ঘরে জায়নামাজে বসে মুসলমান। পশ্চিমাদের গির্জায় ঐতিহ্যের ছায়া ভিতরে বসে না ঈশ্বরের প্রার্থনা। ধর্মশালায়ও আজ সমাগম নেই। চীনের প্রাচীরে আকর্ষণ দূরে থাক, আছে ভয়। দিনরাত জেগে থাকা টাইমস স্কয়ার এখন মানুষশূন্য। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অপরাধ ছাড়াই স্ত্রীসহ গৃহবন্দী, লন্ডন ব্রিজে হাঁটছে না মানুষ। পোপের ভ্যাটিকানে মানুষবিহীন কবুতর, একই দৃশ্য ট্রাফেলগার স্কয়ারে। ভেনিসের জলে ভাসছে না নবযুগল আর পর্যটক। ইতালি যুদ্ধ ছাড়াই অবরুদ্ধ। শূন্য গগনে উড়ছে না প্লেন আর সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে না আন্তদেশীয় ট্রাক আর ট্রেন। পৃথিবীর বিমানবন্দরগুলোয় আকাশযান এখন বিশ্রামে। কোনো সার্কুলার নেই, নোটিস নেই, সবকিছুই স্থবির। সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিকট ঝাঁকুনি। চোখে আঙ্গুল দিয়ে বৈরী প্রকৃতি এক আঘাতে জানিয়ে দিয়েছে, সে কতটা অসহিষ্ণু। মানবসভ্যতার নামে দাপুটে দুনিয়াও কতটা অসহায়। আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা আরও ভয়ঙ্কর। অর্থনৈতিক মন্দা কোথায় দাঁড়ায়? কত মানুষ কাজ হারায়, কত প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয় তা এখনই ভাবতে হবে দেশকে। বিশ্বকে। করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বা চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার হয়নি। উন্নত দুনিয়া নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পেপার টেস্ট-কিট আবিষ্কার করেছে, যা দিয়েই ৩০ মিনিটেই শনাক্ত করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্র পরীক্ষামূলকভাবে স্বেচ্ছাসেবী চারজনের শরীরে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেছে। ৪৫ জনের শরীরে এটি পরীক্ষা করা হবে। গবেষণা সঠিক হলে ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে এটি ব্যবহারের জন্য পাওয়া যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ১৫ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র লকড ডাউনে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেস্টুরেন্ট, পানশালায় না যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। ১০ জনের বেশি জমায়েত না হতে বলেছেন। বিশ্বের ১৬২টি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ২ লাখের মতো মানুষ আক্রান্ত। ৭ হাজারের বেশি মৃত্যুর কোলে। ৮০ হাজারের মতো সুস্থ। বাংলাদেশে আক্রান্ত ১০ জন। ৫৬ লাখ প্রবাসী ঝুঁকিতে।

একমাত্র পৃথিবীজুড়ে সচেতনতা যতদূর পারা যায় ঘরে থাকাই এ ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এটি ভয়ঙ্কর এমন এক ছোঁয়াচে রোগ যেখানে স্ত্রী আক্রান্ত হলে স্বামী তাকে স্পর্শ করতে পারছেন না। মা-বাবা আক্রান্ত হলে সন্তান কাছে যেতে পারছেন না। সন্তান আক্রান্ত হলে অসহায় মায়ের ক্রন্দন ছাড়া করার কিছু নেই। আমার ছেলে অন্তর যুক্তরাজ্যে বার অ্যাট ল পড়ছে। নর্থ আম্রিয়া ইউনিভার্সিটি বন্ধ। এপ্রিলের পরীক্ষা আগস্টে। ঘরে একা কারও সঙ্গে দেখা নেই। ফোনে কথা। মাঝখানে জ্বর ছিল। বললাম, বাবা চলে আসবে দেশে? গ্র্যাজুয়েশন কনভোকেশন বাতিল। পরিস্থিতি খারাপ হলে যদি আসতে না দেয়? অসহায় বাবা নির্বাক আমি! গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাস জ্বরে এতটাই কাঁপাচ্ছে যে, এই বিশ্ব মহামারীতে গোটা পৃথিবীর মানবজাতি কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি ছাড়াই কেবল সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করে লড়াই করছে। প্রকৃতির এক কঠিন ভয়াবহ আঘাতের মুখোমুখি আজকের পৃথিবী। যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বলছে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাস আক্রমণ থাকবে। গেল বছর ডিসেম্বরের ১ তারিখ চীনের উহানে করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হলেও সেখানে মহামারী আকারে দেখা দিলে ৩১ ডিসেম্বর তারা সেটি ঘোষণা করে। নতুন বছর করোনাভাইরাসের আক্রমণে দিন দিন পৃথিবী গভীর সংকটের মুখোমুখি দাঁড়ায়। চিকিৎসায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, অর্থনীতিতে উন্নত দেশগুলো যেখানে করোনাভাইরাসের আক্রমণে আজ অসহায়ই নয়, চরম বিপর্যস্ত সেখানে বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশের পরিস্থিতি এখনো নাজুক হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষাঙ্গন বন্ধসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ যেমন গ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে মানুষ মানসিক শক্তি নিয়ে সচেতনভাবে এর মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি সব বেসরকারি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও বিত্তশালীদেরও এই মহাদুর্যোগে মানবতার টানে অতীতের সব দুর্যোগের মতো আজ মানুষের পাশে দাঁড়াবার সময়।

করোনাভাইরাসে ভয়াবহ লড়াই যেখানে সামনে, মানবতার ধর্ম বা মানুষের জীবন রক্ষার মহান আদর্শের বাতি যেখানে জ্বলে উঠেছে মানুষের হৃদয়ে-মননে, সেখানে আমরা আবেগ-অনুভূতিহীন, মূল্যবোধহীন অসুস্থ, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতার কর্তৃত্ববাদী, অহংকারী দম্ভের সংস্কৃতির ঘটনাও দেখছি। সংবিধান, আইন, বিধি-বিধান লঙ্ঘনের ঘটনা রক্ষাকারীরাই নিয়ত ঘটিয়ে যাচ্ছেন। এক কেটির কুৎসিত ঘটনার পর আরেকটি বীভৎস ঘটনা জনসম্মুখে উঠে আসছে। প্রশাসনযন্ত্র, সমাজ ও রাজনীতি এক কথায় সাধারণ মানুষকেও প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের চাঁদাবাজির অডিও ফাঁসের মাধ্যমে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে তাদের নেতৃত্ব হারানোর ঘটনা, বেআইনি ক্যাসিনো বাণিজ্যের অপরাধের দায়ে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতৃত্বের বিদায়ের বিতর্ক শেষ হাতে না হতেই যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়ার যৌনবাণিজ্যের যে বীভৎস কুৎসিত চিত্র একটি অভিজাত পাঁচ তারকা হোটেল ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদ্ঘাটন করেছে তার সঙ্গে যে ক্ষমতাবানদের যোগাযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল সে রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। পাপিয়া কেলেঙ্কারির ঝড় থামতে না থামতেই করোনাভাইরাসের মতো বিষাক্ত ঘুষ, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার লুট, বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত দেশদ্রোহী খলনায়কদের চরিত্র উন্মোচিত ও বিচার দাবিতে ঝড় উঠতে না উঠতেই প্রশাসনিক সন্ত্রাসের এক নজিরবিহীন ঘটনা এই বিপর্যয়ের মধ্যেও ঝাঁকুনি দিয়েছে সবাইকে।

কুড়িগ্রামের সংবাদকর্মী আরিফুল ইসলামকে গভীর রাতে তুলে এনে সেখানকার জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের বাসভবনে বর্বরোচিত শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে ক্ষমতার মালিক জনগণ বা একজন নিরীহ নাগরিককে সামন্ত প্রভুদের মতো তুলে এনে যে নির্দয় অত্যাচার করা হয়েছে, সেটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্রের আদর্শকেই ভূলুণ্ঠিত করেনি; আইন-আদালতকেই তোয়াক্কা করা হয়নি, একজন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন সামন্ত শ্রেণির ডাইনির চেহারায় বা দুস্যরানীর মতো নিজের মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এটা সেবকের বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর চেহারা নয়, নির্দয় শাসকের কুৎসিত চেহারা। সামন্ত শ্রেণির মতো সরকারি পুকুরের নাম রেখেছিলেন সুলতানা সরোবর। পঞ্চগড়ের মেয়ে সুলতানা পারভীন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সেবকের চেয়ারকে কলঙ্কিত করে সামন্ত শ্রেণির রানীমার নির্দয় আসনে পরিণত করেছিলেন। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার উগ্র বাসনায় সাময়িক চেয়ারের ক্ষমতার মিথ্যা দম্ভে মধ্যরাতে বেআইনি টাস্কফোর্স গঠন করে তার অধীনস্ত কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে এই বর্বরতা ঘটিয়েছেন। বেআদব নাজিম উদ্দিন সংবাদকর্মী আরিফকে জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার জন্য নির্যাতনের পাশাপাশি হুমকিই দেননি, সবাই মিলে মারতে মারতে গোটা শরীরে কালচে দাগই ফেলেননি, পুকুরপাড়ে নিয়ে গিয়ে চোখ বাঁধা আরিফকে বলেছেন, কলমা পড়, ক্রসফায়ার দেওয়া হবে। এই নাজিম উদ্দিন কয় টাকা বেতন পায় যে, সে তার স্কুলশিক্ষক শ্বশুরের যশোরের বাড়িতে বৌয়ের নামে চড়া দামে জায়গা কিনে কোটি টাকার ভবন নির্মাণ করেছে? গোটা প্রশাসনযন্ত্রে একদল গণবিরোধী ক্ষমতার দম্ভে উন্নাসিক বেপরোয়া কর্মকর্তার আবির্ভাব ঘটেছে। জেলায় গেলে এরা নিজেদের সেখানকার মানুষের সর্বোচ্চ সেবক মনে করে না। সামন্ত যুগের জমিদার মনে করে। সেই জেলার মানুষকে তাদের প্রজা আর সমস্ত সম্পদকে তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে। মধ্যরাতে টাস্কফোর্স গঠন সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ।

প্রশাসন সুলতানা ও নাজিম উদ্দিনকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। রংপুরের বিভাগীয় কমিশনারকে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দেশে আমলাদের জন্য এক আইন আর জনগণের জন্য মালিক মানুষের জন্য আরেক আইন ও বিধিব্যবস্থা স্বাধীন দেশে চলতে পারে না। এ ঔদ্ধত্য এই প্রশাসনিক সন্ত্রাস বরদাস্ত করা যায় না। যখন কোনো মানুষ কোনো মানুষের ওপর অন্যায়ভাবে শারীরিক আক্রমণ, নির্যাতন করে বা আইন হাতে তুলে নেয়, তখন তাকে বলা হয় গুন্ডা বা সন্ত্রাসী। কোনো এমপি রাজনীতিবিদের কর্মী হলে তাদের বলি গডফাদার। আর কুড়িগ্রামের ডিসি উচ্চশিক্ষিত সুলতানা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে যখন একজন সংবাদকর্মী আরিফকে তার প্রশাসনের কর্তাদের দিয়ে মধ্যরাতে ধরে এনে নির্দয় নির্যাতন করান তখন তাকে কী বলব? ডাইনি, দস্যুরানী না প্রশাসনিক সন্ত্রাসের গডমাদার?

জনগণের টাকায় পড়ালেখা করা, জনগণের টাকায় বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সরকারি কর্মকর্তারা যখন সেবকের বদলে নিষ্ঠুর শাসকের চরিত্রে মানুষকে ধরে নিয়ে রাতের আঁধারে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্যাতন করে তখন সুলতানা ও নাজিমের প্রত্যাহার এবং কমিটি গঠনে সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত চিত্তে বলতে হয়, জাতির পিতা তাঁর জীবন উৎসর্গ করে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার নেপথ্যে লাখ লাখ মানুষের রক্ত ঝরেছে। বঙ্গবন্ধুর সংবিধানে জনগণকে ক্ষমতার মালিক করা হয়েছে। এখানে আইন সবার জন্য সমান। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে তৃণমূল থেকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়, বিচার বিভাগ থেকে সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। এ অর্জনকে বা প্রশাসনের সুনামকে কেউ শেষ করে দিতে পারে না। আমরা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কথা বলি। কিন্তু প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে আজ রুখে দাঁড়াবার সময় এসেছে। কুড়িগ্রামের সুলতানা ও নাজিমকেই নয়, আরিফের ওপর বর্বর নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাইকে চাকরি থেকে বরখাস্ত ও গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। আরিফ অপরাধ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সুলতানা ক্ষমতার দম্ভে বেপরোয়া নাজিমদের দিয়ে রাতের অন্ধকারে প্রশাসনিক সন্ত্রাসের যে কালো হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সেটি আজকে জনতার প্রতিবাদ ও আইনের খড়্গে ভেঙে দিতে হবে। সাংবাদিক নেতাদের, মানবাধিকার কর্মীদের, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, আইনপ্রণেতা সবাইকে আজ এ অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এ বর্বরতার বিরুদ্ধে নারীবাদীদেরও সোচ্চার হতে হবে। আমলাদের দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতারে বাধা হয়ে কোনো আইন থাকলে তা বাতিল হোক। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মনিব নয় সেবক হয়েই দায়িত্ব পালন করতে হবে। এদের স্যার ডাকবেন না। ব্রিটিশরা স্যার সংস্কৃতি চালু করেছিল। এখনো তারা পথচারীদের স্যার বলে সম্বোধন করেন। এখানে গরিব ঘরের ছেলে সরকারি কর্মকর্তা হয়ে স্যার শব্দটিকে প্রভুর সম্বোধনে পরিণত করেছে। মালিককে তার সেবক স্যার ডাকতে পারে না। স্যার ডাকার কোনো বিধানও নেই। রক্তে লেখা জাতির পিতার সংবিধান জনগণকেই ক্ষমতার মালিক বলেছে। নির্দয় ডিসি, এডিসিদের মালিকের গায়ে হাত তোলার এ বর্বর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ।

সাংবাদিক টিপু সুলতানের ওপর নির্যাতনের জন্য যদি মুক্তিযোদ্ধা, গণতন্ত্রের সংগ্রামের সাহসী জনপ্রিয় নেতা জয়নাল হাজারীর রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়, শাস্তি পেতে হয়, তাহলে সাংবাদিক আরিফকে গভীর রাতে ঘর থেকে তুলে নিয়ে ডিসি সুলতানার সরকারি বাসভবনে, তার বাহিনী বর্বর নির্যাতন করলে কীভাবে তারা জেলের বাইরে থাকে? কেন বরখাস্ত ও গ্রেফতার নয়? অপরাধী যেই হোক শাস্তি তার প্রচলিত আইনেই পাওনা। যাতে প্রশাসনিক সন্ত্রাসের ঔদ্ধত্য কেউ না দেখায়।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সরকারের কর্মকর্তারা বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা আইন বিধি-বিধান বলে মেধা দক্ষতা সৃজনশীলতায় ব্যক্তিত্বের মহিমায় গণমুখী চরিত্র নিয়ে যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন এখনো জাতীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকের নাম মানুষের হৃদয়ে কিংবদন্তি হয়ে গাঁথা হয়ে আছে। গণবিরোধী সুলতানারা সেসব মেধাবী সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দক্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তিকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছেন। গরিবের সন্তানদের একাংশ সরকারি কর্মকর্তা হয়ে ক্ষমতার সিন্ডিকেটে ঢুকে ‘মুই কী হনুরে’ ভাব নিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। ঘুষ-দুর্নীতি আর ক্ষমতার মিথ্যা দম্ভে মানুষকে মানুষ মনে করছেন না।

এককালে জনগণের হৃদয় জয় করা অভিজ্ঞ পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদরা এমপি হতেন, দাপুটে মন্ত্রী হতেন। জনগণের কাছে জবাবদিহি করে তারা যেমন পথ চলতেন, সেসব জননেতার দাপটে অনেক মেধাবী জাঁদরেল সরকারি কর্মকর্তাও তাদের সীমানা লঙ্ঘন করতেন না। একালে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হওয়ায় এমপি-মন্ত্রী দুর্বল হওয়ায় প্রশাসনের একদল কর্মকর্তা বিষধর সাপের মতো ফণা তুলে যাকে তাকে ছোবল দিচ্ছে। রাজনৈতিক ও জনগণের শক্তি আইন এবং সুবিচারের মাধ্যমে এই বিষের মাথা ভেঙে দিতে হবে। নির্যাতিতের ন্যায়বিচার পাওয়া যেমন অধিকার তেমনি অপরাধীর শাস্তি ভোগ করাই একমাত্র পথ। নির্দয় সুলতানাকে সামনে রেখে করোনা যুদ্ধের মুখোমুখি বাংলাদেশ সেটি দেখতে চায়। শুধু রাজনৈতিক শক্তিরই নয়, প্রশাসনেরও ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ এখন সামনে। প্রশাসন ও রাজনীতিতে কোথাও অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। সুযোগ দিলেই রাষ্ট্রশক্তি দুর্বল হবে। দেশ ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

করোনা আক্রান্ত ইতালি থেকে ফিরে আসা প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতে গেলে তারা তুমুল হট্টগোল করেছেন। একজন বাড়াবাড়ি রকমের অসভ্য নোংরা ভাষায় মাতৃভূমিকে গালি দিয়েছেন। এটা বরদাস্ত করার নয়। আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ইতালির মতো উন্নত আধুনিক দেশ থেকে জীবনের মায়ায় তারা দেশে এসেছেন। আমাদের সীমাবদ্ধতা ও আয়োজনে ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য এ ধরনের ঔদ্ধত্য দেখাতে পারেন না। এটা দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু সব চাপা পড়ে গেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমিনের ‘প্রবাসীরা দেশে এলে নিজেদের নবাবজাদা মনে করেন। ফাইভ স্টার হোটেলের খাবার খেতে চান’Ñ এ তাচ্ছিল্য ও তির্যক মন্তব্যে। উপযুক্ত কোয়ারেন্টাইন, সময়মতো চিকিৎসা ও খাবার না দিতে পারা, অব্যবস্থাপনার জন্য দুঃখ প্রকাশ না করে এ ধরনের মন্তব্য দুঃখজনক। রাজনীতি করে উঠে না এলে বা পেশাদার কূটনীতিক থেকে মন্ত্রী না হলে এ ধরনের অতিকথন বা মানুষের মনে আঘাত করার মতো মন্তব্য করা যায়। এর দায় নিতে হয় সরকারকে। হঠাৎ নেতা। হঠাৎ এমপি। হঠাৎ মন্ত্রী হওয়ার এই সুবর্ণ সময় রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বকেই দৃশ্যমান করে না, এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও প্রবাসে ছিলেন, আপনি কি জানেন না, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়া যখন বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় কবলিত আপনার বড় ভাই সব মহলের শ্রদ্ধেয় আবুল মাল আবদুল মুহিত শেখ হাসিনার অর্থমন্ত্রী তখন আমাদের প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আর কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনি দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করেছিল। দেশে যারা কিছু করতে পারে না, তারা বিদেশে চলে যায়। দেশে যারা ক্যারিয়ার গড়তে পারে না, তারাও প্রবাসী হয়েছে। আবার অনেকে দেশে সুন্দর জীবনযাপনের সুযোগ থাকলেও সন্তানের ভবিষ্যৎ ও নিজের নিরাপদ উন্নত জীবনযাপনের জন্য প্রবাসী হয়েছেন। কিন্তু সবার হৃদয়েই দেশের জন্য গভীর দেশপ্রেম রয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রতিটি দুর্যোগে তাদের অবদান ঐতিহাসিক। আমাদের অর্থনীতিতে হাড়ভাঙা পরিশ্রমী প্রবাসী শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাসের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। পরিবার-পরিজন ছাড়া বিদেশে পড়ে থাকা প্রবাসীদের ওপর ঢালাও এমন মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত। শ্রমিকরাই অর্থ পাঠায়, শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিতরা নয়। যারা ব্যাংক লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, যারা ফাইল ঠেকিয়ে ঘুষ খাচ্ছে, যারা বিদেশে অর্থ পাচার করছে, অর্থ-সম্পদের পাহাড় করছে, শেয়ারবাজার লুট করছে, তাদের আমরা গ্রেফতার করে শাস্তি দিতে পারছি না। তুই চোর, তুই ডাকাত, তুই লুটেরা বলতে পারছি না। কিন্তু যারা দিনরাত পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে, দেশপ্রেম রাখছে এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, দেশে এলে হয়রানি করি, তাদের নবাবজাদা বলে তাচ্ছিল্য করছি! বাঃ মিনিস্টার বাঃ

 

                লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর