শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাভাইরাস : গুজব থেকে সাবধান!

তপন কুমার ঘোষ

করোনাভাইরাস : গুজব থেকে সাবধান!

করোনাভাইরাস আতঙ্কে কাঁপছে গোটা দুনিয়া। সংবাদমাধ্যমে করোনাভাইরাস এখন প্রধান শিরোনাম। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান। বাংলাদেশ প্রতিদিনে ২৫ মার্চ প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২৪ মার্চ রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১৯৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়েছে। করোনাভাইরাসে বিশ্বে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১৮ হাজার। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। করোনা গেড়ে বসেছে ইউরোপের দেশ ইতালি ও স্পেনে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত ২৪ মার্চ পর্যন্ত আমাদের দেশে কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে মোট চারজন মারা গেছেন। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৯। দিন যত গড়াচ্ছে, মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তত বাড়ছে।

হাজারো গুজব ও ভুয়া খবরে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব। টোটকা চিকিৎসায় করোনা প্রতিরোধ সম্ভব- এ কথাও প্রচার করা হয়েছে। স্বপ্নে পাওয়া ওষুধের কথা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষকে বোঝানো হচ্ছে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। দুর্ভাগ্যবশত বহু মানুষ আছে যারা কুসংস্কারে বিশ্বাসী। ঝাড়-ফুঁক, পানি পড়া, তেল পড়া অন্ধভাবে বিশ্বাস করে। বরাবরের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় এ অপপ্রচার বেশি হচ্ছে। গুজবে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। মৃত্যুভয় মানুষকে দুর্বল করে দেয়। তাই গুজবের সত্যাসত্য বিচার না করে সহজ-সরল মানুষ এগুলো বিশ্বাস করছে। কথায় বলে না, ‘দশ চক্রে ভগবান ভূত’। কেউ সচেতনভাবে, কেউ বা অজান্তে এগুলো ফেসবুকে শেয়ার করছে। যাচাই-বাছাই না করেই মেসেজ ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছে। গুজবে কেনাকাটার হিড়িক পড়েছে।

কয়েক মাসের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা এক দিনেই সেরে ফেলেছে অনেকে। বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। দাম বেড়েছে এক ধাক্কায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খাদ্য নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দেশে খাদ্যদ্রব্যের কোনো সমস্যা নেই। আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে যার যতটুকু প্রয়োজন সেটুকুই সংগ্রহ করতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। করোনা মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সমালোচনার শূলে চড়ানোর আগে সমস্যার ব্যাপকতা বোঝা দরকার। করোনা নিয়ে কম্পমান গোটা বিশ্ব। সম্পদশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা ইউরোপের ধনী দেশগুলো যেখানে করোনা সংক্রমণ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের প্রস্তুতি বা সক্ষমতা নিয়ে কথা কম বলাই ভালো। ‘গতস্য শোচনা নাস্তি’। প্রতিটি দেশের সীমাবদ্ধতা এখন স্পষ্ট। তবু সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। করোনা নিয়ে রাজনীতি বা রঙ্গরসিকতা করার সময় এটা নয়। আবার সব সমালোচনাকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দেওয়াটাও কাজের কথা নয়। করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়ায়। কাজেই সিদ্ধান্ত বা প্রস্তুতি গ্রহণে কোনো টালবাহানা নয়। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। এখন মানুষের একমাত্র চিন্তা করোনার মারণ থাবা থেকে মুক্তি। দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট চিকিৎসকরা নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোয় তা প্রচার করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ ক্রমাগত জরুরি গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করে চলেছে। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে সবাই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ও স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। মানসিকভাবে শক্ত থাকা অনেক বেশি জরুরি। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা আমাদের সবার অবশ্য-করণীয়। মুশকিল হচ্ছে, আমরা অন্যকে পরামর্শ দিই, কিন্তু নিজেরা মেনে চলি না। বিদেশফেরতদের ১৪ দিন সঙ্গরোধ বা কোয়ারেন্টাইনে (রোগ ছড়াবার ভয়ে অন্য সবকিছু থেকে নিজেকে সাময়িকভাবে আলাদা করে রাখা) থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অথচ তাদের কেউ কেউ বাড়িতে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মেলামেশা করছে। সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে। গণমাধ্যমে এসব খবর আমরা পড়েছি। মানুষকে সচেতন করতে সরকারের এতসব তৎপরতা তবে কি কোনো কাজে আসছে না! আমরা কবে আর সচেতন হব? সর্বনাশের কিনারে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমাদের হুঁশ হয় না। শুধু বিদেশফেরতরাই নয়, আমরা কেউই ঝুঁকির বাইরে নই। এত দিন বলা হচ্ছিল, বয়স্করা বেশি ঝুঁকিতে আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলছে, তরুণরাও ঝুঁকিমুক্ত নয়। এখন সময় ঘরে আবদ্ধ থাকার। আমাদের সবাইকেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। বিদেশফেরতদের দায়িত্ব আরও বেশি। তাদের সংস্পর্শে আসার ফলেই তো আত্মীয়স্বজনের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রোগের চিকিৎসা একটাই- কোয়ারেন্টাইন। কোনো হেলাফেলা নয়।

গুজব ও মিথ্যা তথ্য থেকে সাবধান! সোশ্যাল মিডিয়ায় (ফেসবুক, মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপ) ঘুরপাক খাওয়া তথ্যের উৎস কী? অনেক ক্ষেত্রেই খুঁজে পাওয়া যায় না। তথ্যের উৎস কতটা নির্ভরযোগ্য, এ বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়া বিশ্বাস করা বা ছড়িয়ে দেওয়া মস্ত বড় ভুল। আমরা আশাবাদী, করোনা সংকট একদিন কেটে যাবে। আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে। করোনা মহামারী আমাদের শিক্ষা দিয়ে যাবে অনেক কিছু। সবাই সাবধানে থাকুন।

                লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক

সোনালী ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর