মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

দুর্যোগে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করাই নেতৃত্ব

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

দুর্যোগে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করাই নেতৃত্ব

কদিন ভাবছি, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার-ভিডিপিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। কি কষ্টই না তারা করছে। এত ভয়ভীতির মধ্যেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, লোকজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। ভিডিপিদের তো যেখানে সেখানে কর্তব্য পালন করতে দেখে বুক ভরে যায়। গরিব মানুষ, বাড়িতে সবাই শঙ্কায়। তবু তারা রয়েছে জাতীয় দায়িত্ব পালনে রত। কিন্তু পুলিশ যখন কিছু কিছু সময় মানুষকে লাঠিপেটা করে তখন বড় মর্মাহত হই। মানুষের সম্মান সবার ওপরে, তারা যদি রাস্তায় মার খায় তাহলে মানুষের মর্যাদা কোথায় থাকে? মুক্তিযুদ্ধে আমরা যোদ্ধা ছিলাম, করোনার যুদ্ধে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা যোদ্ধা। প্রথম দিকে ভুলভ্রান্তি যা-ই থাকুক এখন ডাক্তার, নার্স, কম্পাউন্ডার, ওয়ার্ডবয়দের দিক থেকে ত্রুটি নেই, ত্রুটি ব্যবস্থাপনায়। যে ত্রুটির কোনো আগামাথা নেই। গত পরশু জাহিদ মালেককে টিভিতে দেখলাম। যে কথাই বলতে পারে না, শুদ্ধ ভাষা জানে না, পরিচালনা করতে যে যোগ্যতা-দক্ষতা লাগে তার লেশমাত্র নেই। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্পর্কে এক অসাধারণ লেখা লিখেছেন, যা সত্যিই ভাবিয়ে তোলে। আগে মন্ত্রী হতে যোগ্যতা ছিল, দেশপ্রেম, মানুষের সমর্থন। কী যে হয়েছে আমার বোনের, মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হতে যোগ্যতা কী, কিছুই বুঝি না। বাণিজ্যমন্ত্রী একখান, কী করে মন্ত্রী হয়েছেন আল্লাহ মালুম। বলেছিলেন, পিয়াজের দাম আরও এক মাস বাড়বে। মন্ত্রী বলেছেন, এমনিই নাচুনে বুড়ি তার ওপর ঢোলের বাড়ি! সারা দেশে যে পরিমাণ করোনা বিস্তার হয়েছে তার জন্য গার্মেন্ট মালিক আর বাণিজ্যমন্ত্রী দায়ী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাওলানা জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজা নিয়ে মারাত্মক শোরগোল হয়েছে। এখানে শোরগোলের কিছু নেই। কার জানাজা কেমন হবে আল্লাহ নির্ধারিত। জানাজায় যারা হাজির হয়েছিলেন তারা সবাই হাত-পা ধুয়ে অজু করে আল্লাহর কালাম পড়তে পড়তে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু ৪ এপ্রিল বাণিজ্যমন্ত্রী আর গার্মেন্ট মালিকদের ব্যর্থতায় যে লাখ লাখ শ্রমিক ঢাকায় এসেছিল করোনার প্রাদুর্ভাব যদি বাড়ে তাতে বাড়বে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জানাজার কারণে বাড়বে না। ওইভাবে পায়ে হাঁটিয়ে কতগুলো মানুষ ঢাকায় এনেছিলেন আবার ফিরেছেন এর কোনো প্রতিকার হয়নি। আরেকজন সাভারের, কী করে যে মন্ত্রী হয়েছেন আল্লাহই জানেন। রানা প্লাজায় কয়েক হাজার শ্রমিকের জীবন গেছে, কিন্তু জনাব এনামের কপাল খুলেছে। সেদিন শুনলাম, তিনি বেসরকারি হাসপাতাল সমিতির সাধারণ সম্পাদক। মন্ত্রী হয়ে সাধারণ সম্পাদক আর মন্ত্রী নন তিনি সভাপতি! এতেই সামাজিক দর ও অবস্থান বোঝা যায়। এরা কয়েকজন মন্ত্রিসভায় না থাকলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বর্তমান সমস্যা নিয়ে এত হাবুডুবু খেতে হতো না।

সে যাক, বর্তমান সমস্যা সমাধানে ধৈর্য হারালে চলবে না। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এই দুর্যোগ দুর্বিপাকে মানুষ কত আস্থায় নিয়েছে, এর চাইতে বেশি আস্থায় তাঁকে আর কখনো নেয়নি। এখন যারা তাঁর কথা অবজ্ঞা করছে তারা দলের লোক, তাঁর দলেরই ডালপালা, বাইরের কেউ না। যে যতই বলুন, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। যে কোনো কারণেই হোক অনেক ছ্যাঁচড়া সরকারি দলের লতায়পাতায় পরিণত হয়েছে। যাদের চাটনের স্বভাব তাদের ফেরানো মুশকিল। তাই এখানে সেখানে ত্রাণ বিতরণে বিঘœ ঘটছে। চুরি-জোচ্চুরি ধরা পড়ছে। আগেও চোর ছিল, কিন্তু টপ টু বটম আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ছিল না। আমাদের সময় গোড়ায়ও যেমন দেবতুল্য নেতা-নেত্রী ছিলেন, আগায়ও স্মরণ করার মতো মানুষ ছিলেন। তাই আমরা হতাশ হইনি। আলোকময় ঝকঝকে পথে হেঁটেছি। এখন চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। খারাপ মানুষ তো বটেই, ভালো মানুষেরও পথ চলতে কষ্ট হয়। প্রায় সময়ই মনটা বিক্ষুব্ধ থাকে। ভিতরে গুমরে মরি। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের কিছু করার ক্ষমতা ও সুযোগ দুটোই কেমন জানি একেবারে নষ্ট হতে চলেছে। সারা জীবন মানুষের কষ্টে ছুটে বেড়িয়েছি। কিছু না পারলেও ঝড়-ঝাপটায় ভেঙে পড়া ঘরদোর খাড়া করে দিতে, ঘরের খুঁটিটা, বেড়াটা, চালটা লাগিয়ে দিতে দিনমজুরের সঙ্গে কাজ করেছি। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। চট্টগ্রামে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। ছুটে গিয়েছিলাম সেখানে। আমরা যে কজন গিয়েছিলাম কী করেছি, ১৫-২০ জনের ঘরে ২০-২৫ কেজি চাল দিয়েছি, কিছু ডাল-নুন-তেল-ম্যাচবাতি, দু-একটা সাবান কত আর হবে আমাদের ১২-১৩ জনের ৫০০-৬০০ টাকার জিনিস, দু-তিন বাড়িতে ধ্বংসস্তূপ সাফ করে উঠানে বসার জায়গা করে দিয়েছিলাম- এই ছিল কাজ। তারপর যখন বড় হলাম করটিয়া কলেজের ছাত্র তখন ’৬৯-এর ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে জেল থেকে বেরিয়েছিলেন। পয়লা বৈশাখ বৃহস্পতিবার ছিল করটিয়ার বিখ্যাত হাট। এখন আর সেই হাট বৃহস্পতিবারের জন্য বসে থাকে না, সোম-মঙ্গলে শুরু হয়ে শুক্রবারে শেষ হয়। প্রকৃত হাটবার কবে এখন আর খুব সহজে বোঝা যায় না। দুপুরের দিকে কলেজ ছেড়ে করটিয়া বাজারে এসে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি পেয়েছিলাম। করটিয়া থেকে চার-পাঁচ মিনিটের রাস্তা ভাতকুড়া গোরস্থান ও মসজিদের কাছে এলে সে কি তুফান! একটা গাছের কাছে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় ৩০-৪০ মিনিট। ঝড়-তুফান থামলে চলে আসতে দেখি ভাতকুড়া থেকেই রাস্তায় গাছ পড়ে আছে। একের পর এক গাছ। প্রায় এক ঘণ্টা লেগেছিল পুরনো বাসস্ট্যান্ড আসতে। সেখান থেকে আকুর টাকুর পাড়ার বাড়ি। সবদিকে গাছপালা ভাঙা, ঘুর-দুুয়ারের চাল পড়ে আছে। বাড়ি এসে দেখি আমি যে ঘরে থাকি সে ঘর পড়ে গেছে। খাতা-কলম রেখে কাছা দিয়ে বাড়ির কাজের লোকজনের সঙ্গে লেগে গেলাম টিন খুলতে। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল টিন-জানালা-দরজা এটাওটা। সন্ধ্যা হয়ে এলো সব গোছগাছ করতে। এরপর শহরে গেলাম। ক্ষিতীশ বাবুর দোকানে ঢুকতেই কে একজন বলল, খুদিরামপুর-ভাতকুড়া তছনছ হয়ে গেছে। সকালের দিকে বঙ্গবন্ধু আসছেন। কি অবাক কা-! বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তখন জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত। আমরা তখনই বেরিয়ে পড়লাম লোকজনের কাছে সাহায্য চাইতে। চাল, ডাল, বিস্কুট, পুরানো কাপড়। রাত ৮টার মধ্যেই কয়েক বস্তা হয়ে গেল। সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় ঘোরাফেরা করলাম। নানা রংবেরঙের কাপড়, টাকা-পয়সা, নানা কিছু সংগ্রহ হলো। আমরা ছুটলাম খুদিরামপুর ভাতকুড়া। সাড়ে ১১টা-১২টার দিকে সাত-আটটা গাড়িসহ বঙ্গবন্ধু এলেন। এর কদিন আগে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হলে ঢাকায় গিয়ে দেখে এসেছিলাম। আমাদের পেয়ে তিনি ভীষণ খুশি। আমরা ত্রাণ বিতরণের জন্য চার-পাঁচটা স্পট করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর পেছনে পেছনে কিছু সময় ঘুরলাম আবার ত্রাণ কেন্দ্রগুলো মনোযোগের সঙ্গে দেখাশোনা করছিলাম। আমাদের নেতা আনোয়ার বক্স, আবদুর রাজ্জাক, সোহরাব আলী খান আরজু, আলী হোসেন, করটিয়া কলেজের ভিপি মঞ্জুসহ অনেকে। মনে হয়, ১৯৬৮-৬৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের চাইতে ছাত্রলীগ সব কাজকর্মে এগিয়ে থাকত, এখানেও তেমন ছিল। বঙ্গবন্ধু আমাদের ৪০০-৫০০ টাকা দিয়ে এসেছিলেন। সে সময় ৪০০-৫০০ এখনকার ৪০-৫০ হাজার। সোনার দামে তো আরও বেশি। তিন-চার দিন আমরা ত্রাণকার্য অব্যাহত রেখেছিলাম। ঝড়ের আঘাতে কারও হাত-পা ভেঙেছিল, কারও ঘর-দুয়ার, বাড়িঘর চুরমার হয়েছিল। আমরা যে তেমন কিছু করতে পেরেছিলাম তা নয়, কিন্তু আমাদের কাছে পেয়ে মানুষের হতাশা কেটে গিয়েছিল। তারা কাটিয়ে উঠেছিল ঝড়-ঝাপটা। সময় বড় তাড়াতাড়ি চলে যায়। ওর পরই এসেছিল ’৭০-এর নির্বাচন। সে এক ঐতিহাসিক ব্যাপার! যে করটিয়া সব সময় মুসলিম লীগের ঘাঁটি সেই করটিয়ার সব ভোট, করটিয়াসংলগ্ন খুদিরামপুর-ভাতকুড়ার ভোট পড়েছিল নৌকায়। আট-দশটা কেন্দ্রে নৌকা ছাড়া ১০টা ভোটও বাইরে পড়েনি। সে ছিল এক বিস্ময়ের ব্যাপার! মানুষের সেই ঐতিহাসিক রায় ইয়াহিয়া খান মানেননি। ছলেবলে-কৌশলে ক্ষমতা হাতে রাখতে জনগণের ব্যালটের রায় বুলেটে নস্যাৎ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। ব্যালটকে পাকিস্তানিরা যখন বুলেট দিয়ে প্রতিহত করতে চেয়েছে দেশের মানুষ বুলেটের প্রতিবাদ বুলেটে করেছে। সেখানেও পেছনে ছিলাম না। স্বাধীনতায় ভূমিকার জন্য সারা দেশে সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীজোড়া পরিচিতি এসেছিল। হঠাৎই ’৭৩-এর গোড়ায় সিলেটে আচমকা বন্যা হয়। সিলেট সদর, বিয়ানীবাজার, গোহাইলঘাট, কানাইঘাট আরও কোথায় কোথায় বন্যায় সব ভেসে গিয়েছিল। আমরা ৬০ জন সিলেট গিয়েছিলাম ত্রাণ কাজে। টাঙ্গাইলের মানুষ বিপুল সহযোগিতা করেছিল। চাল-আটা-ময়দা-কাপড়-ওষুধ গাড়ি বোঝাই করে দিয়েছিল। তখন রাস্তাঘাটে মারাত্মক সমস্যা ছিল। বিশেষ করে দাউদকান্দি ফেরি ভারী যান চলাচলে অনুপযোগী ছিল। তখন মিজানুর রহমান চৌধুরী ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু বলে দিয়েছিলেন, ‘কাদের সিলেট যাচ্ছে। ওর ত্রাণসামগ্রী হেলিকপ্টারে পৌঁছে দিও।’ সানন্দে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমরা যা পেরেছিলাম সঙ্গে নিয়েছিলাম। বিমানবাহিনীর বিশাল কার্গো হেলিকপ্টার চার খেপে আমাদের মালপত্র পৌঁছে দিয়েছিল। আমরা ১৬ দিন ছিলাম সিলেট ত্রাণ পরিচালনায়। বাঘাবাড়ী ওয়াপদা ডাকবাংলোয় উঠেছিলাম। যে কজনের জায়গা হওয়ার সেখানে ছিলাম, বাকিরা স্থান করেছিল আশপাশে। সেই প্রথম যাত্রায়ই সিলেটের কতজনকে পেয়েছিলাম। তারা কখনো পিছ ছাড়েনি। সেখানে শাহ আজিজ যেমন ছিল, বাবরুল হোসেন বাবুল ছিল, ছিল লালা-তোফা-ফাহিম-লেস-কয়েস-ক্যাপ্টেন জলিল-সুলতান-রূপবান সিরাজসহ অনেকে। যারা পরে সারা জীবন আমাকে অনুসরণ করেছে। বিয়ানীবাজার ত্রাণ দিয়ে ফেরার পথে এক স্পিডবোট ডুবে বাবরুল হোসেন বাবুলের বোন কাজল নদীতে পড়ে যায়। আমরা কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে খরস্রোতা নদী থেকে তাকে টেনে তুলেছিলাম। এখন লন্ডনে থাকে। ‘ঠিকানা’ পত্রিকার মালিক মহিবের স্ত্রী। আজ থেকে ৩০ বছর আগে ওদের লন্ডনের বাড়িতে আমাকে যে যতœ করেছে তা বলেকয়ে বোঝানো যাবে না। কোনো সন্তানও তার বাবাকে অত যতœ করতে পারে না যেটা ওরা করেছিল। সিলেট ত্রাণ যাত্রায় যাতায়াত খরচ হিসেবে টাঙ্গাইলের মটু মিয়া বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। মাননীয় মন্ত্রী মান্নান ভাই ১৫-২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন, লন্ডনপ্রবাসী আরেকজন তার কথা বলে আরও ১৫-২০ হাজার দিয়েছিল। তখন ২০ হাজার এখনকার ২০ লাখের মতো। ১৬-১৭ দিন ত্রাণ পরিচালনা করেও সব ত্রাণসামগ্রী শেষ করতে পারিনি। তাই সিলেট রেডক্রসের সভাপতি রূপবান সিরাজের কাছে রেখে এসেছিলাম। এখনো সেদিনের সেই ত্রাণ পরিচালনা আমাকে শিহরিত করে।

’৭৪-এ মানিকগঞ্জের জামশায় মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। ঝড়ের এক দিন পর বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকা দেখতে গিয়েছিলেন। সেটাও আমার জীবনের এক অভিনব দুর্লভ ঘটনা। জামশা যাব ত্রাণ পরিচালনায়। আগের দিন বিকালে বেইলি রোডের গণভবনে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেছি। বলেছিলাম, জামশা যাচ্ছি সম্ভব হলে সহযোগিতা করুন। দোতলার কোণের ঘর ছিল তাঁর শোবার। ‘যা বালিশের নিচে টাকা আছে ওখান থেকে নিয়ে যা।’ আমি তব্দা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বলেন কী দেশের পিতা! তার বালিশের নিচ থেকে টাকা নেব- এও কি সম্ভব! দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘কী রে! গেলি না? এখন আমাকে দোতলায় যেতে হবে!’ ইতস্তত করতে করতে দোতলায় গেলাম। সাধারণ একটা বিছানা, বালিশ সরাতে দেখি ১০ টাকার তিনটি প্যাকেট। মানে ৩ হাজার টাকা। আমি দুটি নিয়ে নিচে নেমে এলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কী রে! নিয়েছিস?’ বললাম, হ্যাঁ, নিয়েছি। কেন যেন হঠাৎ মনে হয়েছিল নেতাকে জিজ্ঞাসা করি। তাই করেছিলাম, বলেন তো কটা নিয়েছি? বললেন, ‘তুই হাতেমতাই হলে একটা। কিন্তু তুই তো আর হাতেমতাই না। আর যা ইচ্ছা তাও না। তাই দুইটা নিয়েছিস।’ কী অসাধারণ আস্থা! আমি দুই প্যাকেট মানে ২ হাজার নিয়েছিলাম। টাকার দিক থেকে হয়তো বিরাট কিছু না, কিন্তু ভালোবাসার দিক থেকে অনেক। গিয়েছিলাম জামশায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর বাড়ির কাছে ঘাটপাড়ে আমাদের জন্য কয়েকটি নৌকা রাখা ছিল। হালিম চৌধুরী ছুটে এসে খুব আদরযতœ করেছিলেন। হালিম চৌধুরীর বোন টাঙ্গাইলের মটু মিয়ার স্ত্রী আমাকে ছেলের মতো আদর করতেন। নৌকায় চাল-ডাল-আটা-ময়দা-গুড়-চিনি-সাবান-সোডা-চিঁড়া-মুড়ি, মরিচ-পিয়াজ-আদা-রসুন- যা দরকার তুলছিলাম। নিজে হাত লাগালে ঘণ্টার কাজ ১৫-২০ মিনিটে হয়ে যায়। তাই মুজিবকোট খুলে অন্যদের সঙ্গে পাল্লাপাল্লি করে জিনিসপত্র নৌকায় তুলছিলাম। এ সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০-২৫ জন ছেলেমেয়ে আমার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘শুনলাম, এখানে কাদের সিদ্দিকী এসেছেন। আপনারা তার দলের লোক। তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ দুজনকে দিয়ে তাদের এক গাছের নিচে বসার ব্যবস্থা করেছিলাম। সেখানে তাদের চা-নাশতা খাওয়ানো হয়েছিল। আধঘণ্টা পর জিনিসপত্র বোঝাই করে হাতমুখ ধুয়ে তাদের সামনে মুজিবকোট গায়ে বসলে প্রায় সবাই সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে, ‘এ কী! আপনাকেই না বস্তা টানতে দেখলাম! মাথায় ধুলাবালি আটা-ময়দা ছিল বলে ঠিক বুঝতে পারিনি। আপনি নিজেই কাজ করছিলেন?’ বলেছিলাম, সবার সঙ্গে কাজ করলে কর্মীদের উৎসাহ বাড়ে। সেবার ত্রাণকাজে প্রবীণ সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তার বহু অভিজ্ঞতা। আমরা তিন-চারটা নৌকায় ধলেশ্বরীর পাড়ে বিধ্বস্ত বিলীন জামশা গ্রাম দেখে খুবই মর্মাহত হই। গাছপালা, ঘরদুয়ারের লেশমাত্র নেই। একেবারে বিরান। কিছু কিছু মানুষ যার যার ভিটায় দাঁড়িয়ে ছিল। বাচ্চারা উলঙ্গ, মা-বোনদের গায়ে ছেঁড়া কাপড়, পুরুষদেরও একই দশা। আমরা প্রচুর কাপড়-চোপড় নিয়ে গিয়েছিলাম। চাল-ডাল-কাপড়-চোপড় দেওয়া শুরু হয়েছিল। কিছুটা ভিড় জমেছিল। মোদাব্বের দাদু বললেন, ‘বঙ্গবীর! তোমার অনেক লোক, এখানকার লোকজনও সহযোগিতা করছে। এক কাজ কর, কটাই-বা বাড়িঘর, ৩০০-৪০০-এর বেশি হবে না। সারা দিন তোমার লোকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কার কজন মেম্বার, কী প্রয়োজন একটা তালিকা করে স্লিপ দিয়ে আসুক। বিকালে জিনিসপত্র দেওয়া যাবে। এক দিনে পারা না যায় দুই দিন লাগুক।’ তার পরামর্শ মনে ধরেছিল। জামশা প্রাইমারি স্কুলের পাশে নৌকায় ফেরার পথে পৃথিবীর বিস্ময় এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখলাম। এক পেঁপে গাছে ২৫-৩০ ফুট টিউবওয়েলের পাইপ লতাপাতার মতো পেঁচিয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবে পাইপ ওভাবে পেঁচানো মুশকিল। তার ওপর আবার পেঁপে গাছের গা জড়িয়ে। যা অসম্ভব! সেদিন মনে হয়েছিল আল্লাহ সব পারেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো কিছু অসম্ভব না। মোদাব্বের দাদুর পরামর্শক্রমে লিস্ট করে সবার ঘরে ঘরে জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়েছিলাম। সময় লেগেছিল তিন দিন। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয়েছিল এই তো শুরু করলাম আর শেষ হয়ে গেল।

’৯৬-এর নির্বাচনের সময় বাসাইলের মিরিকপুর-সুন্যা-কাউলজানি-কলিয়া এক মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছিল। সবাই টাকা খরচ করে নির্বাচন করেন। আমি কখনো তেমন টাকা খরচ করিনি। লোকজন যা দিয়েছে তাই আবার তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। তাতে ’৯৬-এর নির্বাচনে লাখ পাঁচেক টাকা খরচের একটা কথা ছিল। হঠাৎ হলো ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় আমি বাসাইলে জনসভা করছিলাম। সভা শেষ হতে হতে ঘূর্ণিঝড়ের শুরু। কলিয়ায় রাতে থাকতে চেয়েছিলাম। ঝড়ের জন্য যেতে পারিনি। ৮টা-সাড়ে ৮টা বাজতেই দেখি শত শত আহত। কিয়ামতের গজব নেমে এসেছে। হাসপাতালেই ছিলাম রাত ২টা-আড়াইটা পর্যন্ত। অনেক রোগী টাঙ্গাইল পাঠিয়েছিলাম। আজাদ, মুরাদ, মিরন, সরদার আজাদ, আরও অনেকে ভীষণ কাজ করেছিল। সেই দুর্যোগে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এসেছিলেন ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায়। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তাঁর সহমর্মিতা ভালো লেগেছিল। রাতেই গিয়েছিলাম ঢাকায় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে আমন্ত্রণ জানাতে। পরদিন তাঁর খুলনায় নির্ধারিত সভা ছিল। বাসাইলের দুর্গত এলাকায় যাওয়ায় খুবই অসুবিধা ছিল। আমি তাঁকে বোঝাতে পেরেছিলাম যেহেতু প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গেছেন, সেহেতু আপনার যাওয়া খুবই প্রয়োজন। না হলে প্রভাব পড়বে। তিনি রাজি হয়েছিলেন। আমি ৩টা-সাড়ে ৩টায় ফিরেছিলাম। নেত্রী শেখ হাসিনা সকাল সাড়ে ৭টায় বাসাইলের দুর্গত এলাকায় এসেছিলেন। মানুষ খুব ভরসা পেয়েছিল। আমরা প্রায় ৮-১০ দিন দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ, মানুষের ঘর-দুয়ার বেঁধে দেওয়া, পানিতে ডুবে থাকা লাশ তুলে দেওয়া- এ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সখিপুরের বন্ধুরা দু-একবার অনুযোগ করছিল, সময় শেষ হয়ে আসছে, আপনি বাসাইলে পড়ে আছেন! সখিপুরে এলেন না। তাদের কথা খুব একটা গা করিনি। আমি যেদিন বেড়বাড়ি বংশাই নদী পার হয়ে সখিপুরে যাই, তার পরই নদীতে পানি এসে যায়। আর কোনো গাড়ি ফেরি ছাড়া নদী পেরোতে পারেনি। সেসব ত্রাণে সারা দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কোনো দুর্যোগে যখন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, সামাজিক লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন আর কোনো অসুবিধা থাকে না। দশের নড়ি একের বোঝা। এখন কোনো দুর্যোগে সবাইকে এগিয়ে আসার উৎসাহ কেন যেন নষ্ট হয়ে গেছে। এটা ফিরিয়ে আনতে না পারলে আমরা যে যাই করি খুব একটা কাজের কাজ হবে না। তাই সরকারের প্রতি আমার আকুল আবেদন- অধৈর্য না হয়ে মানুষ যতটা সহ্য করেছে তাতে খুশি হোন, দেশবাসীকে ধন্যবাদ দিন। আমরা দেশবাসীর পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যকর্মী, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার-ভিডিপিসহ সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের প্রাণঢালা অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ত্রাণ চোর, চাল চোর, চোরদের সাবধান হতে বলছি। জনগণের চোখে রাস্তার একটা বালু এড়ায় না। তাই চোর সাবধান, তারা যে দলেরই হোক।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর