বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কেন এত মুসলিম-বিদ্বেষ?

তসলিমা নাসরিন

কেন এত মুসলিম-বিদ্বেষ?

ঘন ঘন দাঙ্গা হচ্ছে ভারতবর্ষে। ভারতের উগ্র হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম-বিদ্বেষ প্রচ-। কারো কারো ঘৃণা এমনই ভয়াবহ যে পারলে মুসলমানদের ধরে ধরে খুন করে, অথবা ভারত থেকে তাড়িয়ে দেয়। সংখ্যালঘু মুসলমানদের পাশে কিন্তু দাঁড়ায় হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা প্রগতিশীল, যাঁরা মুক্তচিন্তক, তাঁরা। একই রকম অন্যান্য দেশেও। বিশ্বের মানবতা আর মানবাধিকারের জন্য সেরা দেশ বলে খ্যাত ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে বাড়ছে মুসলিম-বিদ্বেষী, ইমিগ্রেন্ট-বিরোধী নয়া-নাৎসির সংখ্যা। আজ তারা কোরআন পোড়ানোর উৎসব করে জনসভা ডেকে। ডেনমার্কের উগ্র দক্ষিণপন্থি মুসলিমবিরোধী রাজনীতিক রাসমুস পালুডান ‘নাম’ কামিয়েছেন মুসলিমবিরোধী কাজকর্ম করে। ইউটিউবে কোরআন পোড়ানোর ভিডিও আপ্লোড করতেন, একবার তো শূকরের মাংসে মুড়িয়ে কোরআন পুড়িয়েছিলেন। লোকটি ২০১৭ সালে ‘স্টাম কুর্স’ নামে একটি রাজনৈতিক দল বানিয়েছেন। যে দলের লোকেরা ভয়াবহ রকম ঘৃণা পোষে উত্তর- ইউরোপে বাস করা মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। পালুডান ডেনমার্ক থেকে তিন লাখ মুসলিম অভিবাসীকে তাড়িয়ে দেবেন, ডেনমার্কে ইসলাম ধর্মকে নিষিদ্ধ করবেন এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত নির্বাচনে প্রায় জিতে যাচ্ছিলেন। ডেনমার্কের সবাই যে পালুডানকে সমর্থন করেন, তা নয়। বেশ ক’বার জেল খেটেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর জন্য। এই চরম বর্ণবাদী রাসমুস পালুডানই আসতে চাইছিলেন সুইডেনের মালমো শহরে, তাঁর মতো উগ্র-দক্ষিণপন্থি মুসলিম-বিদ্বেষীদের অনুষ্ঠানে, ঘটা করে কোরআন পোড়ানোর জন্য। সে কারণেই পালুডানকে সুইডেনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাঁকে দু’বছর সুইডেনে ঢুকতে দেওয়া হবে না, এমনও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পালুডানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সুইডেনের বর্ণবাদী নেতা ড্যান-পার্ক। এই ড্যান-পার্কও ইমিগ্রেন্ট-বিদ্বেষ ছড়িয়ে উগ্র দক্ষিণপন্থিদের প্রিয়ভাজন হয়েছেন। পালুডান-ভক্তরা বা সুইডেনের স্টাম কুর্সের সদস্যরা মালমোর রাস্তায় জমায়েত করেছে, বিক্ষোভ দেখিয়েছে, রাস্তায় পেট্রোল ঢেলে কোরআন পুড়িয়েছে, সেই কোরআন পোড়ানোর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার পরই শহরের ৩০০ মুসলিম রাস্তায় বেরিয়ে আল্লাহু আকবর স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে, পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়েছে, গাড়ির টায়ারে আগুন ধরিয়েছে। ওই আগুন থেকে ধোঁয়া উঠেই মালমোর আকাশ কালো করেছে। কেন এত মুসলিম-বিদ্বেষ বিশ্বের সেরা মানবাধিকারের দেশগুলোয়?

২০১৩-২০১৪ সালে সিরিয়ার ৭০,০০০ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে সুইডেন। শুধু আশ্রয়ই নয়, স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দিয়েছে। এরপর, ২০১৫ সালে সিরিয়া, ইরাক আর আফগানিস্তান থেকে আসা এক লাখ বাষট্টি হাজার শরণার্থীকে গ্রহণ করেছে। এর ফলেই সুইডেনে ইমিগ্রেন্ট-বিরোধী উগ্র-দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দল ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘সুইডেন ডেমোক্রেট’ নামে সুইডেনের উগ্র দক্ষিণপন্থি যে দলটি এখন সুইডেনের সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দল, সেটি নয়া-নাৎসিবাদে বিশ্বাস করে। সুইডেন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রতিটি নাগরিকের শিশুপালন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বেকার ভাতা ইত্যাদি রাষ্ট্রই জোগায়। এখন সেই ওয়েলফেয়ার স্টেট একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে। এর কারণ, দক্ষিণপন্থিরা মনে করে অভিবাসীদের মধ্যে কাজকর্ম না করে বসে বসে ভাতা খাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি। ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রের সুবিধে ভোগ করতে অভিবাসীরা এক পায়ে খাড়া। শিক্ষাদীক্ষা এবং দক্ষতার অভাবে চাকরি বাকরি করাও অবশ্য অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। সুতরাং সুইডিশদের করের টাকায় চলা কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের দুর্বল হয়ে যাওয়ার জন্য অভিবাসীদেরই দায়ী করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে সুইডেনের বেকার সংখ্যা ৩.৮% থেকে লাফ দিয়ে ১৫%-এ ওঠে। এসব কারণেই উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং বর্ণবাদ ইউরোপের প্রতিটি দেশেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

সুইডেনের মালমোয় আগুন জ্বলার পর নরওয়ের রাজধানী অসলোতেও আগুন জ্বলেছে। উগ্র-দক্ষিণপন্থিরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, স্থানীয় মুসলমানরা বিক্ষোভের প্রতিবাদ করেছে। ফলে শান্তিপ্রিয় ছোট্ট দেশটিতেও দাঙ্গা বেধেছে। যে কারণে সুইডেনে এবং ডেনমার্কে মুসলিম-বিদ্বেষ বাড়ছে, একই কারণে নরওয়েতেও বাড়ছে সেটি। এসব দেশে অভিবাসীদের মধ্যে মুসলিমের সংখ্যাই বেশি। সুতরাং বর্ণবিদ্বেষী, অভিবাসি-বিদ্বেষী হওয়া মানে মুসলিম-বিদ্বেষী হওয়া। এই মুসলিম-বিদ্বেষ বন্ধ করার উপায় কী? কোরআন যারা পুড়িয়েছে, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, ঘৃণা ছড়িয়ে দাঙ্গা বাধানোর জন্যও বর্ণবাদীদের গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন জেল খাটার পর এরা তো বেরিয়ে আসে। মানুষকে জেলে ভরা যায়, মানুষের বিদ্বেষকে তো জেলে বন্দী করা যায় না। সেটি তো আগুনের মতো ছুটে যায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। আমার মনে হয় না জেল জরিমানা করে এই বিদ্বেষের সমাপ্তি ঘটানো সম্ভব। লাখ লাখ মুসলমান আজ সারা বিশ্বের অমুসলিম দেশগুলোয় বাস করছে। যারা সন্ত্রাসী, তারা তো সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত হচ্ছেই। কিন্তু যারা সন্ত্রাসী নয়, যারা ধর্মীয় মৌলবাদী নয়, ভায়োলেন্সে বিশ্বাসী নয়, যারা সাদাসিধে ভালো মানুষ, নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, তাদের কেন ঘৃণা পেতে হবে, যেহেতু কিছু মুসলমান সন্ত্রাস করেছে বিশ্বময়? কিছু সন্ত্রাসী মুসলমানের অপকর্মের দায় এখন প্রতিটি মুসলিমকেই নিতে হবে! পাশ্চাত্যের দেশগুলোয়, যে দেশগুলোয় মুসলমানরা নিজেদের দেশ ত্যাগ করে শরণার্থী হয়েছে বা অভিবাসী হয়েছে, সে দেশগুলোর অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে দিন দিন মুসলিম বিরোধিতা বাড়ছে। একে ঠেকানোর উপায় তো বের করতে হবে। ঘৃণা নিয়ে বাস করা মুসলিম অমুসলিম কারও জন্যই ভালো নয়। ঘৃণা চিরকালই শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির কারণ। বাস্তবতা এই যে, মুসলমানরা নিজেদের মুসলিম দেশে বাস করার চেয়ে উন্নত এবং সভ্য অমুসলিম দেশেই বাস করতে আগ্রহী, কারণ ওসব দেশে তাদের নিজের দেশের চেয়ে বেশি মানবাধিকার, বেশি মানবতা, বেশি বাকস্বাধীনতা তারা ভোগ করতে পারে, শুধু তাই নয়, বিনে পয়সায় উন্নত শিক্ষা, উন্নত চিকিৎসা এবং বিভিন্ন ভাতা পাওয়ার সুবিধেও তারা পেয়ে যায়। এ কারণে মুসলিম দেশ থেকে মানুষ ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি সভ্য দেশগুলোয় পাড়ি দিতেই থাকবে। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই।

এক সময় ইউরোপের বর্ণবাদী ক্রিশ্চানরা তাদের দেশের সংখ্যালঘু ইহুদিদের প্রচ- ঘৃণা করত। ঘৃণার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়েছিল জার্মানির হিটলার এবং তার নাৎসি দল। ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছে নাৎসিরা। বর্ণবাদী ক্রিশ্চানরা আজ ইহুদিদের ঘৃণা করে না। মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের শেকড় হলেও ইহুদিদের তারা আজ ইউরোপীয় বলেই মনে করে। ইহুদিরাও আর ক্রিশ্চানদের ঘৃণা করে না, বরং ঘৃণা করে মুসলমানদের। ইহুদি খুবই ক্ষুদ্র এক জনগোষ্ঠী, এই জনগোষ্ঠী এককালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল ইউরোপময়। বর্ণবাদের শিকার হয়েছে, নাৎসিদের কন্সেন্ট্রেশান ক্যাম্পে অবর্ণনীয় অত্যাচার সয়েছে, গ্যাস চেম্বারে মরেছে কিন্তু দমে যায়নি, প্রতিশোধ নেয়নি, সন্ত্রাস করেনি, যুদ্ধে নাৎসিদের পরাজয় হলে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়নি, নাৎসিদের গ্যাস চেম্বারে নিয়ে নিয়ে হত্যা করেনি, বরং পড়েছে, শিক্ষিত হয়েছে, সেরা ডাক্তার, সেরা ইঞ্জিনিয়ার, সেরা বিজ্ঞানী, সেরা দার্শনিক হয়েছে, সেরা ফিল্ম মেকার, সেরা সাহিত্যিক হয়েছে। আজ ইহুদিরা সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ লোকদের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যাই বেশি। কারা করবে তাদের ঘৃণা?

মুসলমানদেরও শিক্ষিত হতে হবে। তা না হলে অশিক্ষিত, আর অসভ্য হয়ে জীবন কাটালে, নারী পুরুষের সমানাধিকারে, বাকস্বাধীনতায়, গণতন্ত্রে, ধর্মনিরপেক্ষতায়, বিজ্ঞানে, বিবর্তনে বিশ্বাস না করলে, অমুসলিমদের ঘৃণা করলে ঘৃণাই জুটবে, শ্রদ্ধা জুটবে না। মুসলমানদের আধুনিক হতে হবে। অমুসলিমদের দেশে অমুসলিমদের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে শুধু প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, আর দাঙ্গা হাঙ্গামা করে কোনও বেঁচে থাকাই সুখকর নয়। তার চেয়ে অমুসলিমদের শ্রদ্ধা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। সভ্য শিক্ষিত সচেতন মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে হবে। ধর্মীয় অনুভূতি এত ভঙ্গুর হলে চলবে না। একে ইস্পাতকঠিন করতে হবে। আজ কোথাও বাইবেল পোড়ালে যেমন দাঙ্গা বাধবে না, তেমনভাবে মুসলমানদেরও সহনশীল হতে হবে। ক্রিশ্চানরা একসময় ভয়ংকর বর্বর ছিল। কেউ ঈশ্বরে অবিশ্বাস পোষণ করলে তাকে হত্যা করত। সেই বর্বরতার দিন নিজেরাই শেষ করেছে ওরা। সত্যি কথা হলো, ধর্ম থাকে অন্তরে। সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবতাই সত্যিকার ধর্ম। সেটিকেই লালন করা শিখতে হবে।

               লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর