বাংলাদেশে কুকুর নিধন করার আর্জি নিয়ে মানববন্ধন হয়। এ বড় অভিনব মানববন্ধন। কুকুর নিধন তো চলছেই। পৌরসভা থেকে তো বটেই, ব্যক্তিগত উদ্যোগেও পাড়ায় পাড়ায় এই নিধনযজ্ঞ চলে। নৃশংসতার ভয়াবহতা কত দূর পৌঁছলে অসহায় প্রাণীদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারে মানুষ। একটি দেশ কতটা সভ্য তা নির্ভর করে সেই দেশ তাদের অসহায় প্রাণীদের কতটা নিরাপত্তা দেয় তার ওপর।
অরণ্যের নেকড়ে প্রজাতি থেকেই বিবর্তনের ফলে কুকুরের জন্ম, শৃগালের সঙ্গেও প্রজাতিগত আত্মীয়তা রয়েছে কুকুরের। এরা অরণ্য ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে বহু আগে। ১২ হাজার বছর ধরে ঘনিষ্ঠভাবে বাস করছে মানুষের সঙ্গে। এদের কাজ ছিল দূরপাল্লার পথিকদের সঙ্গ দেওয়া, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আর শিকারিদের শিকারে সঙ্গ দেওয়া। কুকুর সঙ্গে নিয়ে শিকারে যেত শিকারিরা, কুকুরের ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি মানুষের ঘ্রাণ এবং দৃষ্টিশক্তির চেয়ে বেশি ধারালো বলে শিকারে কুকুরদের সাহায্য দরকারী ছিল। শুধু কি শিকারি আর পথিকের উপকারই করতো কুকুর? সব মানুষেরই উপকার করতো। ভেড়ার পালকে চড়াতে নিয়ে যাওয়া, গবাদি পশুকে পাহারা দেওয়া, বরফের দেশে স্লেজগাড়ি চালানো, ভার বওয়া, সব কাজই কুকুর করতো, এখনও করে। প্রাচীন মিশর তো কুকুর বেড়ালকে দেবতা মানতো। তারা কুকুর বেড়ালের উপকারকে যথাযথ মূল্য দিয়েছিল। বেড়ালেরা শস্যক্ষেতের ইঁদুর মেরে মিশরের মানুষকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।
কুকুর বেড়ালদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি করা, তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজটি এখন উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপের লোকেরা করছে। অনুন্নত দেশেগুলোয় এখনও কুকুর বেড়ালকে খাদ্য হিসেবে, আপদ হিসেবে বা চোর তাড়ানোর প্রহরী হিসেবে দেখা হয়। কুকুরকে তো নাপাক প্রাণী হিসেবে অনেক দেশেই ঘৃণা করা হয়। এশিয়ার উচ্চবিত্তরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো কুকুরে কুকুরে মিশ্রণ ঘটিয়ে পছন্দসই শাবক প্রসব করিয়ে তবে পোষে। কিন্তু দেশি কুকুরেরা পথে পথে ঘোরে, দেশি মানুষেরা তাদের খাদ্য দেয় না, আশ্রয় দেয় না। এই কুকুরেরা অভুক্ত অবস্থায় ডাস্টবিন ঘেঁটে পচা গলা কিছু পেলে খায়, তা না হলে ওভাবেই অভুক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। কুকুরকে মেরে পা ভেঙে দেওয়া, কুকুরকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা... এসব অহরহই অসভ্য সমাজে ঘটে চলেছে। রাস্তার জীবন্ত তরতাজা কুকুরগুলোকে হত্যা করে করে ভোরবেলায় ট্রাক বোঝাই করতে দেখেছি। কুকুর কামড় দিলে মানুষের র্যাবিস হতে পারে। এর সমাধান তো কুকুরদের মেরে ফেলায় নয়। এর সমাধান ওদের র্যাবিসের টিকা দেওয়ায়। মানুষ কি চাইলেই কিছুটা উদার হতে পারে না? আমি তো মনে করি রাস্তার কুকুরদের ঘরে ঘরে নিয়ে পোষা উচিত। তাহলেই রাস্তায় কোনও কুকুর থাকবে না। এ যদি না করা হয় তাহলে কুকুরদের বন্ধ্যত্বকরণের ব্যবস্থা হোক। মহল্লা মহল্লায় কুকুরের আশ্রয়স্থল থাকুক। যেখানে তারা খাবে, ঘুমোবে। কুকুরদের পশু হাসপাতালে নিয়ে বন্ধ্যা করলেই তো কুকুরের সংখ্যা কমবে। হত্যাযজ্ঞ করে কুকুরের সংখ্যা কমানো যায় না। নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা অনুশীলন করে সভ্য হওয়া যায় না, শিক্ষিতও হওয়া যায় না।
আমি বেড়াল পুষি। আমার বেড়ালটিকে দোকান থেকে জাত দেখে কিনে আনিনি। দেশি বেড়াল আমার। বেড়ালটিকে কলকাতার এক মাছের বাজার থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম। হ্যাঁ রাস্তার বেড়াল। আজ আমার বেড়ালের বয়স ১৭ বছর। মানুষের হিসেবে ওর বয়স ৮০। ১৭ বছর দেশি বেড়ালরা বাঁচে না। রাস্তাঘাটে মানুষের মার খেয়ে অসুখে অনাহারে দুর্ঘটনায় মারা যায় অল্প বয়সেই। পুষেছি বলেই বেঁচেছে এত কাল। ভালো খাদ্য পেয়েছে, নিরাপত্তা পেয়েছে। এই বেড়াল অতি বুদ্ধিমতী। আমি পৃথিবীর নানা দেশের নানা জাতের বেড়াল দেখেছি, এত বুদ্ধিদীপ্ত কোনও বেড়াল দেখিনি। সিয়ামিস জাতের বেড়ালের বুদ্ধি বেশি লোকে বলে, কিন্তু আমাদের দেশি বেড়ালের ঘটে নিঃসন্দেহে বুদ্ধি তার চেয়েও বেশি ধরে, এত প্রতিকূল পরিবেশে বুদ্ধি না থাকলে বেঁচে থাকতে পারতো না। নির্বংশ হয়ে যেত অনেক আগেই। ওর বুদ্ধিমত্তার খবর শহরে চাউর হয়ে গিয়েছিল। ওর ফুটবল শো দেখানো হয়েছে টিভিতে, ওকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেই চলচ্চিত্র জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। শুধু বেড়াল নয়, কুকুরও প্রখর বুদ্ধি ধারণ করে। সে কারণেই বিরুদ্ধ পরিবেশে আজও টিকে আছে। দেশি কুকুর পোষ মানে না বলে যে প্রচার হয়, সেটা ভুল। ভারত-বাংলাদেশের রাস্তা থেকে কুকুরের বাচ্চা ধরে নিয়ে আমেরিকায় পুষেছে এমন লোকের ঘরে গিয়ে দেখে এসেছি আমাদের দেশিগুলো কুকুরশ্রেষ্ঠ হয়ে সোফায় রাজা বাদশাহর মতো বসে আছে। খাবার পেলে, নিরাপত্তা পেলে, আরাম আয়েশ পেলে, আদর পেলে রাস্তার অসহায় প্রাণীও সুন্দর পোষ্য হয়ে ওঠে, প্রভুভক্ত হয়ে ওঠে। কুকুরের প্রভুভক্তি তুলনাহীন। ইউরোপ-আমেরিকার রাস্তায় গৃহহীন মানুষকে কুকুর পাশে নিয়ে শুয়ে থাকতে কত যে দেখেছি। কুকুর যতই ক্ষিধেয় কষ্ট করুক, তার ভিক্ষুক-বন্ধুকে ছেড়ে কোথাও সে যায় না, প্রভু শব্দটির চেয়ে বন্ধু শব্দটি ভালো। কুকুর নিয়ে বসলে মানুষের ভিক্ষেও ভালো জোটে। কারণ কুকুর না খেয়ে থাকবে, উদার পথচারীরা এ সইতে পারে না।
আমি কুকুর পুষি না এখন। কিন্তু আমার গাড়িতে কুকুরের খাবার সব সময় থাকে, রাস্তায় কুকুর দেখলেই আমি গাড়ি থামিয়ে থালায় করে ওদের খাবার দিই, দাঁড়িয়ে থাকি যতক্ষণ খাওয়া শেষ না হয়। রাস্তার বেড়ালদের খাওয়ানোর জন্য ডে কেয়ার সেন্টারই খুলেছি। এ কাজটি করে আমি স্বস্তি পাই। অসংখ্য অসহায় ক্ষুধার্ত কুকুর বেড়ালের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সে সম্পর্কের মূল্য আমার কাছে অনেক মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের চেয়ে বেশি। এতে কোনও রাজনৈতিক বাণিজ্যিক সাহিত্যিক স্বার্থ নেই, এই স্বার্থ না থাকাটাই আমাকে অপার আনন্দ দেয়। নিঃস্বার্থ কাজের একটি সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্যটি, দুঃখ এই, সকলে দেখতে পায় না।
অনেকে আমাকে দোষ দেয়, রাস্তার কুকুর বেড়ালকে খাওয়াচ্ছি, কিন্তু রাস্তার ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াচ্ছি না! রাস্তার ক্ষুধার্ত মানুষকে আমি খাওয়াচ্ছি না, এ কথা ঠিক নয়। তাদের খাওয়াচ্ছি, তবে রাস্তার মানুষের চেয়ে রাস্তার কুকুর বেড়ালদের প্রতি আমার দরদ বেশি, বেশি কারণ মানুষকে সাহায্য করার জন্য অনেক সংস্থা সংগঠন আছে, কুকুর বেড়ালকে সাহায্য করার জন্য নেই। কুকুর বেড়ালদের মানুষ ঘৃণা করে, তাদের নিধন করে, তাদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার বেশি কেউ নেই। তাই আমি তাদের পাশেই দাঁড়াই। কিন্তু আমার একার পক্ষে তো বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। সরকারি বেসরকারি সংগঠনের এগিয়ে আসতে হবে, কুকুরদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য খাদ্য দিতে, টিকা দিতে, বন্ধ্যত্ব দিতে। আশ্রয় কেন্দ্র থেকেই অনেকে পোষার জন্য ঘরে নিয়ে যাবে কুকুরদের।
দেশি বেড়াল পুষেছি অনেক কাল, যদি বেঁচে থাকি, একটি দেশি কুকুরের বাচ্চা এনে পুষবো। ভালোবাসা আর নিরাপত্তা পেলে দেশি কুকুরও জার্মান শেফার্ডকে টেক্কা দেবে।
রাস্তার কুকুরের চিৎকারে কান্নায় অনেকে বিরক্ত, তাই কুকুর নিধনের চিন্তা তাদের মাথায় আসে। আমি বুঝি না তাদের কেন মাথায় আসে না, কুকুর হয়তো ক্ষিধেয় চিৎকার করছে, কেন তাদের মাথায় আসে না কুকুরকে খাবার দেওয়ার। খাবার দিলেই তো খেয়ে শান্তিতে ঘুমোবে ওরা। এই সহানুভূতি তো মানুষের সমাজ থেকে ওরা আশা করতে পারে। মানুষের সেবা করেছে ওরা হাজার হাজার বছর, আজ ওরা ব্রাত্য, আজ সামান্য খাদ্যের আশায় উদ্ভ্রান্ত ঘোরে। ওদের কষ্ট যন্ত্রণা ওদের অসহায়তা, অসুখ, অশান্তি, অনিরাপত্তা একমাত্র আমরাই দূর করতে পারি, ওদের জীবনের সুখ-দুঃখ আমাদের ওপরই নির্ভর করে। আমাদের নিঃস্বার্থ হতে হবে। নিঃস্বার্থ হওয়াই শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণ।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।