শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

অপারেশন ক্লিন হার্টের কথা ভুলে গিয়েছেন?

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

অপারেশন ক্লিন হার্টের কথা ভুলে গিয়েছেন?

১৮ বছর আগের ঘটনাপঞ্জি স্বভাব নিয়ন্ত্রিত পন্থায় ভুলে যাওয়ারই কথা। তবে ঘটনাগুলো যখন বিভীষিকাময় হয়, তখন কি তা আদৌ ভোলা যায়? ১৯৭১-এর গণহত্যার কথা কি কেউ ভুলতে পারবেন? তবে এখন যাদের বয়স ২৫-অনূর্ধ্ব তাদের তো সেই লোমহর্ষক ঘটনাগুলো জানারই কথা নয়। হ্যাঁ, আমি সেই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কু-প্রবর্তিত অপারেশন ক্লিন হার্টের কথাই বলছি, যেটি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া প্রবর্তন করেছিলেন ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর। সেই দিনটিতে বেগম জিয়া এক নির্বাহী আদেশক্রমে তার নির্বাচিত ৪০ হাজার লোককে নির্দেশ দিয়েছিলেন বাছাই করা লোকজনকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করতে, গ্রেফতার করতে, জখম করতে, আহত করতে, বিকলাঙ্গ করতে, অঙ্গহানি ঘটাতে, তাদের সম্পত্তি দখল করাসহ বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে। এই ৪০ হাজার লোক নেওয়া হয়েছিল সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ এবং আনসার থেকে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, অতীতে আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, সুলতান মাহমুদ, নাদির শাহ প্রমুখের মতো দুর্ধর্ষ, নিষ্ঠুর দিগি¦জয়ীরা অযথা হাজার হাজার নির্দোষ মানুষকে হত্যা করে পৈশাচিক আনন্দ ভোগ করত। কখনো বিজিতদের মনে ত্রাস সৃষ্টির জন্য, কখনো নিজেদের বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য, কখনো বা রক্তের হলি খেলার মাধ্যমে নিষ্ঠুর প্রবৃত্তিদায়ক আনন্দের জন্য। ইংল্যান্ডের পরপীড়ক, অত্যাচারী শাসক অষ্টম হেনরির নির্দেশনায় কয়েক হাজার লোকের মু-ুপাত ঘটেছিল, যার মধ্যে হেনরির দুজন স্ত্রীও ছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের মনগড়া অভিযোগ আনা হয়েছিল। হেনরিকন্যা প্রথম এলিজাবেথও নির্দয় হত্যাযজ্ঞে পিছিয়ে ছিলেন না। ফরাসি বিপ্লবের পর রেইন অব টেররের সময় হাজারো জেকোবাইনসদের গিলোটিনে মু-ুপাত করা হয়েছিল। বলশেভিক বিপ্লবের আগে রাশিয়ার জার রাজন্যবর্গ, অনেক ক্ষেত্রে রাসপুটিনের সহায়তায়, বহু লোক হত্যা করেছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসররা গণহত্যার সমস্ত বৈশ্বিক নজির ভেঙে রক্তগঙ্গা বইয়ে ছিল। অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিককালে ইন্দোনেশিয়ার ঘাতক সুহার্তো এবং চিলির কসাই পিনুসে যে হত্যার মহোৎসবে জড়িয়ে পড়েছিল তার জন্য পরবর্তীতে দুজনকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। বয়সজনিত ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে সুহার্তোর বিরুদ্ধে মামলার সমাপ্তি ঘটানো হলেও পিনুসেকে তার পঙ্কিলতার প্রেতাত্মা এখনো ধাওয়া করছে।

উপরোল্লিখিত বর্বর হত্যাকান্ড ঘটিয়ে ছিলেন হয় রাজ্যলোভী রাজা বাদশাহগণ অথবা সর্বগ্রাসী বা কর্তৃত্বব্যঞ্জক অথবা স্বৈরশাসকগণ। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রথায় বিচারিক প্রক্রিয়া ভিন্ন সরকার বা সরকারপ্রধানের প্রকাশ্য নির্দেশনায় ওই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটানোর কোনো উদাহরণ নেই, খালেদা জিয়ার উপরোল্লিখিত নজিরবিহীন প্রশাসনিক, অবৈধ, সভ্যতাবিবর্জিত নির্দেশ ছাড়া। খালেদা নির্দেশিত এই ত্রাসের আয়ুষ্কাল ছিল ১৬ অক্টোবর, ২০০২ থেকে ২০০৩-এর ৯ জানুয়ারি মোট ৮৫ দিন। এ নির্দেশ খালেদা এমনকি পার্লামেন্টকে পর্যন্ত অবহিত করেননি। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এই জঘন্য নরহত্যার প্রকল্প গ্রহণ করে হঠাৎই ঘোষণা আসে। বলা হয়, দেশে অরাজকতা এবং সন্ত্রাস দমনের জন্যই নাকি এ নির্দেশ। অথচ আমাদের দেশের বিচার বিভাগের দক্ষতার ইতিহাস ২০০ বছরের বেশি পুরনো। ১৭৭৪ সালে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে প্রথম ব্রিটিশ বিচার পদ্ধতির আদালত স্থাপনের পর থেকে এ উপমহাদেশে, আমাদের দেশসহ, গড়ে উঠেছে এক সুযোগ্য বিচারব্যবস্থা এবং প্রণীত হয়েছে সব ধরনের অপরাধ বিচারের আইন। তাই বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ অন্যান্য অমানবিক নির্দেশনার পেছনে যে খালেদার ভিন্নতর মতলব ছিল তা বলাই বাহুল্য।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বস্ত পত্রপত্রিকা রেডিও, টেলিভিশন এমনকি বিদেশি বিশ্বস্ত প্রচারমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ওই বিচার ভিন্ন হত্যাকান্ডে যারা খুন হয়েছে তার সংখ্যা শতাধিক। তা ছাড়া অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যাদের অঙ্গহানি ঘটানো হয়েছে, যাদের বিকলাঙ্গ করা হয়েছে, যাদের বিনা পরোয়ানা এবং আদালতের নির্দেশ ছাড়া গ্রেফতার করা হয়েছিল তার সংখ্যা শত সহস্র (হাই কোর্টের রায় অনুযায়ী)। ভুক্তভোগীর সবাই বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক। ওই দুর্বিষহ দিনগুলোয় বিরোধী দলের হাজারো নেতা-কর্মী গা-ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

খালেদার পঙ্কিল কর্মকান্ড শুধু খুন, জখম, অঙ্গহানি, নির্যাতন, গ্রেফতার ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার নির্দেশে যারা ওই সব পাপাচার বাস্তবায়ন করেছিল আইন এবং বিচারের হাত থেকে তাদের এবং খালেদা জিয়া নিজেকে বাঁচানোর জন্য তার প্রয়াত স্বামীর অনুকরণে একটি অবান্তর এবং ধিকৃত দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, নির্যাতন, অঙ্গহানি ঘটানো, জখম, বিকলাঙ্গকরণ, বেআইনি গ্রেফতার, সম্পত্তি জবরদখলসহ খালেদা জিয়া নিজে এবং যেসব ব্যক্তি উপরোক্ত অপরাধের জন্য দায়ী তাদের বিচারের আওতামুক্ত রাখার নিষ্ঠুর এবং পাপাচারী প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় সমাপ্ত হয়। কারণ মাননীয় হাই কোর্ট অবশেষে খালেদা প্রণীত অমানবিক ওই আইনটি শুরু থেকেই অবৈধ বলে বাতিল করে দেয়।

বেআইনি ঘোষিত ওই আইনটির কিছু অংশ নিচে হুবহু মুদ্রণ করা হলো : ‘যৌথ অভিযানে কৃত যাবতীয় কার্যাদির জন্য দায়মুক্তি

(ক) ১৬ই অক্টোবর, ২০০২ তারিখ হইতে ৯ জানুয়ারি, ২০০৩ তারিখ কার্যদিবস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দেশের শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানের জন্য সরকার কর্তৃক ১৬ই অক্টোবর, ২০০২ তারিখে প্রদত্ত আদেশ এবং তৎপরবর্তী সময়ে প্রদত্ত সকল আদেশ, উক্ত আদেশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য কৃত যাবতীয় কার্য এবং উক্ত আদেশসমূহ বলে ও অনুসারে যৌথ অভিযানে নিয়োজিত শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য বা যৌথ অভিযানের অন্য কোন সদস্য বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত সময়ের মধ্যে তাহার দায়িত্ব বিবেচনায় প্রদত্ত আদেশকৃত আটক, গ্রেফতার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদসহ সকল প্রকার কার্য ও গৃহীত ব্যবস্থা, প্রচলিত আইনে ও আদেশ সমূহে যাহাই থাকুক না কেন, ১৬ই অক্টোবর, ২০০২ তারিখ প্রদত্ত আদেশ প্রদানকারী এবং উক্ত আদেশ বলে ও অনুসারে আদেশ প্রদানকারী এবং কার্য সম্পাদনকারী, এবং যৌথ অভিযানে নিয়োজিত শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণকে তজ্জন্য সর্বপ্রকার দায়মুক্ত করা হইল;

(খ) দফা (ক) এ উল্লিখিত ১৬ই অক্টোবর, ২০০২ তারিখে প্রদত্ত আদেশ বা তৎপরবর্তী সময়ে প্রদত্ত কোন আদেশ বা কার্যের দ্বারা কাহারও প্রাণহানি ঘটিলে, কাহারও জান বা মালের কোন ক্ষতি হইলে বা কাহারও কোন অধিকার ক্ষুণœ হইলে বা কেহ আর্থিক, শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা কেহ অন্য কোনভাবে সংক্ষুব্ধ হইলে তজ্জন্য সংশ্লিষ্ট সকল আদেশ প্রদানকারীর বিরুদ্ধে বা কার্য নির্বাহীর বিরুদ্ধে বা উক্ত দফায় উল্লিখিত কোন সদস্য বা ব্যক্তি বা শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণের বিরুদ্ধে বা তাহাদিগকে আদেশ প্রদানকারীর বিরুদ্ধে বা উক্ত বাহিনীর কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বা যৌথ অভিযানে নিয়োজিত শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য কোন সদস্যের বিরুদ্ধে বা সরকার বা সরকারের কোন সদস্যের বিরুদ্ধে বা সরকারের কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন প্রকার দেওয়ানি বা ফৌজদারি মোকদ্দমা বা কার্যধারা বা অন্য কোন প্রকার আইনগত কার্যধারা চলিবে না বা তৎসম্পর্কে কোন আদালতের নিকট কোন অভিযোগ বা প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না এবং এতদ্সম্পর্কে বা এই প্রকার কোন মোকদ্দমা বা কার্যধারা কোন আদালতে দায়ের করা হইলে বা এই ধরনের কোন মোকদ্দমায় বা কার্যধারায় বা প্রশ্নের ভিত্তিতে কোন রায়, আদেশ বা সিদ্ধান্ত দেওয়া হইলে তাহা বাতিল, অকার্যকর হইবে বা হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।’

উক্ত হাই কোর্টের নির্দেশে বাতিল হওয়া তথাকথিত আইনটি ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ বিশেষ গেজেটে প্রকাশিত হয়। এ আইনটি রিট মামলার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করেন জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, যিনি বহু মানবাধিকার রক্ষার মামলা করে দেশে বিদেশে বিশেষভাবে সুনাম অর্জন করেছেন। হাই কোর্টোর মাননীয় বিচারপতিদ্বয় মাইনুল ইসলাম চৌধুরী এবং আশরাফুল কামাল আইনটি বাতিল করে যে রায় প্রদান করেন তার মূল অংশবিশেষ সংক্ষিপ্ত আকারে নি¤েœ প্রকাশিত হলো বাংলায় অনুবাদ করে :

‘‘এই মামলার বাদী সুপ্রিম কোর্টের একজন অ্যাডভোকেট, যিনি বিগত বছরগুলোতে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছেন সংবিধানের প্রাধান্য এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে। যাই হোক ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন ২০০৩’ নামে একটি আইন ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি প্রণয়ন করা হয় যার দ্বারা সকল শৃঙ্খলাভুক্ত কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং অন্য সকল সরকারি কর্মকর্তা যারা ২০০২ সালে ১৬ অক্টোবরে জারিকৃত সরকারি নির্দেশ পালনার্থে বিভিন্ন জনকে আটক, গ্রেফতার, তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ এবং অন্য কোন কর্মপন্থা, যাহা ২০০২ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি সময়ের মধ্যে পালন করেছেন অথবা তৎপরবর্তী কোন সময়ে সরকারি নির্দেশ মোতাবেক তাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি প্রদান করা হয়। উক্ত আইনে ৩(খ) ধারায় বলা হয়েছে উক্ত সরকারি নির্দেশ পালনকল্পে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কোন কর্মকান্ডে কারো জীবন, স্বাধীনতা অথবা সম্পদ বিনষ্ট হয়ে থাকলে, অথবা কেউ মানসিক বা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ উক্ত সরকারি নির্দেশ পালনকারী কোন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন ধরনের মামলা করতে বা প্রতিকার প্রার্থনা করতে পারবেন না। ৩(খ) ধারায় আরো বলা হয়েছে যদি ক্ষতিগ্রস্ত কেউ ক্ষতির প্রতিকার বা বিচার প্রার্থনা করে কোন আদালতে কোন মামলা করে থাকেন তাহলে সে মামলা বা কোন আদালত যদি সে ধরনের কোন মামলার প্রেক্ষিতে কোন রায় বা আদেশ বা সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন তাহলে সে মামলা বা রায় বা আদেশ বা সিদ্ধান্ত বাতিল এবং অপ্রয়োগযোগ্য বলে গণ্য হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সন্ত্রাস দমন, বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের ধুয়া তুলে সরকার ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর অপারেশন ক্লিন হার্ট নাম দিয়ে শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহকে দেশব্যাপী অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। সে মর্মে নির্দেশিত হয়ে তারা ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে যান। ওই অভিযানকালে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা অবাধে এবং অব্যাহতভাবে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেআইনি কার্যকলাপ করেছেন বলে ক্রমাগত অভিযোগ পাওয়া যায়। বহু লোককে হত্যা, নির্যাতন, বেআইনি গ্রেফতার, জনগণের সম্পত্তি বেআইনি দখল, অঙ্গহানি ঘটানো, হয়রানিসহ অপারেশন ক্লিন হার্টের সদস্যরা বহুবিধ ভয়ঙ্করী অপরাধ করেছে। বাহিনীর হেফাজতে বহু লোককে হত্যা, বিকলাঙ্গ করা হয় এবং তাদের অঙ্গহানি ঘাটনো হয়। ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বাসযোগ্য পত্রপত্রিকা এবং বিদ্যুৎচালিত সংবাদমাধ্যমে বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ব্যাপক আকারে বহু জঘন্য অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য এবং সংবাদ প্রকাশ করা হয়। দৈনিক প্রথম আলো, ডেইলি স্টার এবং অন্যান্য দৈনিক পত্রিকায় জনগণের মারাত্মক দুর্দশার খবর এবং বাহিনীর লোকদের দ্বারা সংঘটিত নিষ্ঠুরতা ছাড়াও বাহিনীর হেফাজতে হত্যা করার খবর প্রকাশিত হয়। ওই সকল গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ওই ৮৫ দিনের অভিযানকালে কমপক্ষে ৪৩ জনকে হেফাজতে রাখাকালে হত্যা করা হয়। বাহিনীর কর্মকান্ডে ভুক্তভোগী সবাই দেশের ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইনে বিচার চাইতে পারেন। বাহিনীর সদস্যরা যাদের খুন করেছে তাদের পোষ্যরা সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে মামলা করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী। যেহেতু ২০০৩ সালে দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) আইনের শাসনের এবং সংবিধানে প্রদত্ত মানবাধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক এটি আইনবহির্ভূত এবং অবৈধ বলে ঘোষিত হওয়ার যোগ্য।”

“যৌথ বাহিনীর সদস্য এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী আইনের ঊর্ধ্বে নয়। হেফাজতে নির্যাতিতদের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে নির্যাতকদের শাস্তি চেয়ে, ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার।”

“কিন্তু নির্যাতকদের আইনি সুরক্ষা দিয়ে ২০০৩ সালে দায়মুক্তি আইন প্রণয়নের কারণে ভুক্তভোগী বা তাদের পোষ্যরা আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না। কিন্তু এ ধরনের দায়মুক্তি আইন আইনের শাসনের তত্ত্বের পরিপন্থী অথচ আইনের শাসনই হচ্ছে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তি। সেহেতু ওই আইনের ৩(ক) ধারা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। ওই আইন দ্বারা যৌথ বাহিনীর সদস্যদের দায়মুক্তি প্রদান করে তাদের আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান দেওয়া হয়েছে, যার দ্বারা সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার এবং সব নাগরিকের সমান অধিকারের বিধান ধ্বংস করা হয়েছে।

আমরা দেখতে পাই আইনটি দ্বারা ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইনের কবল থেকে যৌথ বাহিনীর সদস্যদের নিরঙ্কুশ দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যারা মারাত্মকভাবে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ভঙ্গ করেছে। এ ধরনের দায়মুক্তি অচিন্ত্যনীয়, অযৌক্তিক, বর্বরতাসুলভ এবং সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের প্রতি ধ্বংসাত্মক।”

“এই মামলার সাথে প্রদত্ত কাগজ থেকে এটা পরিষ্কার যে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে যৌথ বাহিনীর দ্বারা বিকলাঙ্গ হয়ে, আহত হয়ে, অঙ্গ হারিয়ে, তাদের সম্পত্তি ধ্বংস করার কারণে শত সহস্র নাগরিক মারাত্মকভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তদুপরি যেসব নাগরিককে যৌথ বাহিনী হত্যা করেছে তাদের পোষ্যরা নিহতদের উপার্জন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।”

“উপরের আলোচনার আলোকে আমরা সিদ্ধান্ত দিচ্ছি যে উক্ত দায়মুক্তি আইনটি মোটেও কোন বৈধ আইন নয় এবং তৎকারণে অবৈধ আইন বলে ঘোষিত হওয়ার যোগ্য, যার কারণে এটি শুরুর থেকেই অবৈধ এবং আইনবহির্ভূত।” “এ কারণে মামলাটির পক্ষে রায় দেওয়া হলো। অপারেশন ক্লিন হার্টের কারণে যারা বর্বর, নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা, যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের পোষ্যরা ইচ্ছা অনুযায়ী হত্যা, নির্যাতনকারীদের শাস্তি চেয়ে, ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইচ্ছামতো আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন।”

অপারেশন ক্লিন হার্ট থেকেই আমাদের দেশে জঘন্য বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু হয়।

               লেখক : সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর