শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থা

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থা

বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে করোনা-ভাইরাস প্রতিরোধে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্বের সব দেশ সম্মুখযোদ্ধাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যেসব সামগ্রী প্রয়োজন তা সঠিকভাবে সরবরাহের ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে ব্যক্তিগত সুরক্ষা কিট পিপিই (Personal Protection Equipment) ও এন-৯৫ সার্জিক্যাল মাস্ক কেনায় ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরা পড়েছে। প্রাথমিকভাবে কভিড-১৯ প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে পিপিই ও এন-৯৫ মাস্ক কেনার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের মৌখিক নির্দেশে এ সামগ্রী সরবরাহের জন্য ‘জেএমআই’ নামে একটি সিরিঞ্জ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত এন-৯৫ সার্জিক্যাল মাস্কের পরিবর্তে ভুয়া ও নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করেছে। চিকিৎসকরা এ ভুয়া মাস্ক প্রত্যাখ্যান করেন। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক শহিদ মো. সাদিকুল ইসলাম এ মাস্ক সম্পর্কে লিখিতভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে অবহিত করেন। ফলে তৎক্ষণাৎ তাকে ওএসডি করা হয়। বিষয়টি মিডিয়ার মাধ্যমে জানাজানি হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালককে প্রত্যাহার করা হয়। বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদ উল্লাহ করোনাকালে এন-৯৫ মাস্ক ও যন্ত্রপাতি সরবরাহে সিন্ডিকেটের কথা তুলে ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে একটি পত্র দেন। পত্রে কেনাকাটার ক্ষেত্রে ‘একজন মন্ত্রী ও তার ছেলের সুপারিশের বিষয়টি’ একজন অতিরিক্ত সচিব তাকে অনুরোধ করেছেন বলে উল্লেখ করেন। তার পত্রে আরও বলা হয়, তাদের (জনৈক মন্ত্রী এবং তার ছেলে) পাঠানো তালিকা ও মূল্য অনুযায়ী দ্রব্যাদি কেনাকাটা করতে হবে। যেন মেডিকেল ইমেজিং লিমিটেডসহ সহযোগী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পায়। যে প্রতিষ্ঠানটি পণ্য না দিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়, সেই ঠিকাদার মিঠুর নামও পত্রে উল্লেখ করা হয়।

কভিড-১৯ প্রতিরোধে সম্মুখযোদ্ধাদের জন্য সরবরাহকৃত সার্জিক্যাল মাস্ক-৯৫-সংক্রান্ত দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ এনে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলাম মামলা করেছেন। ২৯ মে রাজধানীর বনানী থানায় দায়েরকৃত মামলায় মেসার্স এলান করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলামকে আসামি করা হয়। বিতর্কিত এ পিপিই কেনার আগে ৫ মে পিপিইর মান যাচাইয়ের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক বলেছেন, তিনি এ কেনাকাটার কথা কিছুই জানতেন না। এমন প্রেক্ষাপটে পিপিই কেনায় যে দুর্নীতি ও সমন্বয়হীনতা সংঘটিত হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) করোনা ইউনিটে নকল ‘এন-৯৫’ সার্জিক্যাল মাস্ক সরবরাহের অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাবেক নেত্রী শারমিন জাহানকে ২৪ জুলাই রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গ্রেফতার করে। এর আগের দিন রাতে বিএসএমএমইউর প্রক্টর বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছেন, গ্রেফতার শারমিনের প্রতিষ্ঠান অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের সরবরাহকৃত নকল মাস্কের কারণে কভিড-১৯ প্রতিরোধে সম্মুখযোদ্ধাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পে কেনাকাটার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ১৭ আগস্ট মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে এক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় করোনার সরঞ্জাম কেনাকাটায় চরম সমন্বয়হীনতার চিত্র ফুটে ওঠে। বাংলাদেশে পিপিই দুর্নীতির বিষয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পর্যন্ত গড়িয়েছে। জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদ্রোস আদানম গেব্রিয়াসুস এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, পিপিই নিয়ে দুর্নীতি হত্যাকান্ডের শামিল। এ ধরনের দুর্নীতি গুরুতর অপরাধ।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনা প্রথম ধরা পড়েছে ইতালির রোম বিমানবন্দরে। সেখানে অবতরণকারী বাংলাদেশি যাত্রীবাহী কাতার এয়ারলাইনসের বিমানকে ফেরত পাঠানোর খবর প্রকাশের পর। আগের এক ফ্লাইটে বাংলাদেশিরা করোনা ‘নেগেটিভ’ সনদ নিয়ে রোম বিমানবন্দরে অতরণ করেছিলেন। সেখানে নমুনা পরীক্ষায় বেশ কিছু বাংলাদেশি যাত্রী করোনা ‘পজিটিভ’ হিসেবে শনাক্ত হন। এ ঘটনার পর ইতালি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি যাত্রী বহনকারী সব বিমানের ফ্লাইট স্থগিত করেন এবং কাতার এয়ারলাইনসের বিমানকে ফেরত পাঠান।

দেশের ভাবমূর্তি হরণকারী বিভিন্ন অপরাধ উদ্ঘাটনে তদন্তে নেমেছে র‌্যাব। রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে করোনা নমুনা পরীক্ষাসহ চিকিৎসার নামে বহুমুখী প্রতারণা র‌্যাবের তদন্তে বেরিয়ে আসে। র‌্যাব রিজেন্ট হাসপাতাল (উত্তরা ও মিরপুর শাখা) এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ করিমের প্রধান কার্যালয় সিলগালা করে দেয়। অভিযানকালে হাসপাতালের ব্যবস্থাপকসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, সাহেদের মালিকানাধীন হাসপাতাল দুটিতে করোনার নমুনা নিয়ে ভুয়া সনদ দেওয়া হতো। বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করত। ২০১৪ সালের পর নবায়ন না করেই হাসপাতাল দুটি অবৈধভাবে চালানো হচ্ছিল। সাহেদ তার নিজস্ব ‘পরিচিতি কার্ড’, ‘ফেসবুক’ ও ‘টক শোতে’ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে আসছেন। ২১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে করোনাভাইরাস নমুনা পরীক্ষা করার জন্য রিজেন্ট হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ এবং রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ স্মারক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। অনুষ্ঠানে মহাপরিচালক ও সাহেদের মাঝে উপবিষ্ট ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। পেছনে দাঁড়ানো ছিলেন স্বাস্থ্য সচিব ও স্থানীয় সরকার সচিব। অনুষ্ঠানটি মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদফতরের কনফারেন্স কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদের নানা কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের ছবিটি সামাজিক মাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তীব্র সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী চুক্তির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতেন না বলে বক্তব্য দিয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে তার উপস্থিতিতে কী বিষয়ে চুক্তি হচ্ছে, তা মন্ত্রী জানতেন না- এ কথা কোনো পাগলও বিশ্বাস করেনি। এ বিষয়ে সংসদেও তীব্র ভাষায় সমালোচনা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরে অনেক রদবদল হওয়ার পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বপদেই বহাল রয়েছেন!

১৫ জুলাই সকালে সাহেদ বোরকা পরে পালানোর সময় সাতক্ষীরা সীমান্তে র‌্যাবের হাতে নাটকীয়ভাবে গ্রেফতার হন। গোঁফ ছেঁটে, সাদা চুল কালো করে, চেনা বেশভূষা পরিবর্তন করে ছদ্মবেশে, বোরকা পরেও প্রতারক সাহেদের শেষ রক্ষা হয়নি। জানা গেছে, সাহেদ ওইদিন ভোর ৫টার দিকে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্তবর্তী কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গ নদ পার হতে বোরকা পরে মাছ ধরার নৌকায় উঠেছিলেন। সে অবস্থায়ই র‌্যাবের একটি চৌকস টিম তাকে গ্রেফতার করেছে।

এরই মধ্যে ‘জেকেজি’ নামের এক অখ্যাত ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করোনার সনদ জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়। জেকেজি করোনা সনদ নিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে বাংলাদেশকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। নানা জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে ১২ জুলাই বিতর্কিত জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে পুুলিশ গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদে ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী করোনা পরীক্ষার নামে জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন। একই অভিযোগে ১৯ জুলাই র‌্যাব রাজধানীর গুলশানে সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালায়। অভিযান পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, করোনা পরীক্ষার অনুমতি স্থগিত করা হলেও এ প্রতিষ্ঠানটি বেআইনিভাবে করোনা অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করছিল। সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বেআইনিভাবে নমুনা পরীক্ষা করে বা পরীক্ষা না করে ভুয়া সনদ প্রদান করেছে। এ ছাড়া এ হাসপাতালের বিরুদ্ধে করোনা নেগেটিভ শনাক্ত রোগীকে পজিটিভ দেখিয়ে ভর্তি রেখে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ, জেকেজির সাবরিনা ও আরিফ চৌধুরী এবং সাহাবউদ্দিন হাসপাতালের ভুয়া সনদ বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে কোথায় নিয়ে গেছে? তা ইতালির প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে ইতালির ফ্লাইট বন্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা বেশির ভাগ অভিবাসীর মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে। একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা।’ এ ঘটনার পর ইতালির এক সংবাদপত্রের (Messaggero) প্রথম পৃষ্ঠায় Dal Bangladesh contest falsi (From Bangladesh with fake tests) শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। এ খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বহুল প্রচারিত The NewYork Times পত্রিকায় ১৬ জুলাই Big business in Bangladesh : Selling fake Coronavirus Certificates শিরোনামে সংবাদ পরিবেশিত হয়।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পিপিই, মাস্ক ও ভুয়া করোনা সনদ কেলেঙ্কারির পর স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি, প্রতারণা ও অব্যবস্থার লোমহর্ষক চিত্র দেশ ও বিদেশে নগ্নভাবে প্রচারিত হয়। এমনি প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক স্বাস্থ্য খাতের লাগামহীন দুর্নীতি খুঁজে বের করার জন্য কঠোর অবস্থান নেয়। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে ত্রিমুখী আঁতাতের মাধ্যমে দুর্নীতি চলছে। এর এক অংশে আছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এদের সঙ্গে আছে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট আমলা, যারা এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে দেন। শেষ ধাপে আছেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এমন ব্যক্তিরা। এভাবে প্রতিনিয়ত চলছে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি। করোনা মহামারীতে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি, প্রতারণা ও অনিয়ম রোধে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানের প্রথম পর্যায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে রদবদল করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদত্যাগ করেন। ছোট বড় ৪৩টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, আরটিপিসিআর ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালানো হয়। একই ধারাবাহিকতায় দুর্নীতির অভিযোগে ১৪ ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ১১টি উৎসের মধ্যে কেনাকাটা, টেন্ডার, সেবা, নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, ইকুইপমেন্ট ব্যবহার ও ওষুধ সরবরাহ ইত্যাদি উপখাতকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়।

দুদকের অনুসন্ধানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনার ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম ফাঁস হয়। স্ত্রী রুবিনা স্বাস্থ্য অধিদফতরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার সাবেক স্টেনোগ্রাফার। আবজাল ও রুবিনা খানমের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। দুদকসূত্রে জানা যায়, আবজালের স্ত্রী রুবিনা ‘রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ নামে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে ব্যবসা করতেন। দুদক ২৭ জুন আবজাল ও তার স্ত্রীর নামে দুটি মামলা করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, রুবিনা খানম নিজ নামে ট্রেড লাইসেন্স খুলে তার স্বামী আবজাল হোসেনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় স্বাস্থ্য অধিফতরের অধীন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি এবং মালামাল সরবরাহের নামে অবৈধভাবে অর্থ অর্জন করেছেন। ঢাকার উত্তরায় আবজাল ও তার স্ত্রীর নামে ৫টি বাড়ি, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ২৪টি ফ্ল্যাট এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ১টি বাড়ি রয়েছে বলে দুদকসূত্রে জানা যায়। এ ছাড়া আবজালের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় অর্থ পাচারের তথ্য দুদকের কাছে রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য, ঘুষ গ্রহণ, গাড়িচালকদের তেল চুরি সিন্ডিকেট, আট বছর একাধারে অধিদফতরে ক্যান্টিন দখলসহ বিভিন্ন চাঁদাবাজি এবং ভীতি প্রদর্শন করে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন জনৈক ড্রাইভার। ২০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই ড্রাইভার আবদুল মালেক ওরফে হাজী মালেককে তার বাসা থেকে র‌্যাব গ্রেফতার করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালেকের ঢাকায় অন্তত ৪টি ফ্ল্যাট, ১০টি প্লট, কামারপাড়ায় ১ বিঘা জমি, বামনের টেক এলাকায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর সাত তলা বাড়ি, স্ত্রীর নামে সাত তলা বাড়ি এবং হাতিরপুল এলাকায় নির্মাণাধীন ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে।

সিএমএসডি মূলত স্বাস্থ্য খাতের যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও বিভিন্ন সরঞ্জামের সিংহভাগ কেনাকাটার দায়িত্ব পালন করে। যেখানে কেনাকাটা আছে, সেখানেই দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে। সিএমএসডিতেও কোনো ব্যতিক্রম ছিল না এবং অভিযোগের ঊর্ধ্বে ছিল না। পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদ উল্লাহ বদলি হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি ‘সিএমএসডি’র প্রকৃত অবস্থা অবহিত করেন। চিঠির বিষয়বস্তু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মো. শহীদ উল্লাহ সেনাবাহিনীতে প্রত্যাবর্তনের পর ২৫ জুলাই করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মরহুম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদ উল্লাহ কেনাকাটায় অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির কথা সরকারকে জানিয়েছেন। এরপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সিএমএসডির কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। বর্ণিত পত্রে সিএমএসডির কেনাকাটায় মোতাজ্জেরুল ওরফে ‘মিঠু চক্রের’ একচ্ছত্র আধিপত্যের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়। পত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি কেনায় টেন্ডার দেওয়া হয়। মিঠুর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে সেই টেন্ডারের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্রপাতি সরবরাহ সমাপ্ত দেখিয়ে সাড়ে চার শ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার পর আবিষ্কার হয় যে, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো যন্ত্রপাতিই পৌঁছেনি। মোতাজ্জেরুল ওরফে মিঠু সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বাজেট থেকে শুরু করে কেনাকাটার পরিকল্পনাও তৈরি করতেন। তারপর সে তালিকা মোতাবেক সিএমএসডিকে দিয়ে জিনিসপত্র কিনতে বাধ্য করা হতো। উদাহরণ হিসেবে কভিড-১৯ রোধে ৯  কোটি ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকার মাস্ক ও ইনফ্রারেড থারমোমিটার কেনায় বড় দুর্নীতির বিষয় উল্লেখ করা যায়। র‌্যাবের অনুসন্ধানে জানা যায়, কভিড-১৯ রোধকল্পে গৃহীত ইআরপিপি প্রকল্পের আওতায় ক্রয় প্রক্রিয়ার নির্ধারিত নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করা হয়েছে। ‘সিম করপোরেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের মাস্ক ও ইনফ্রারেড থারমোমিটার বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি দামে সরবরাহ করে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের এনওসি ছাড়াই চীন থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে এসব পণ্য আনা হয়। সরবরাহকৃত পণ্য টেকনিক্যাল কমিটির অনুমোদনের আগেই দুই দফায় ৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, করোনা মহামারী শুরুর পর থেকেই সুরক্ষাসামগ্রী কেনা নিয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

মানুষ সাধারণত দুর্যোগ, দুঃসময়, মহামারী ও দুর্দিনে মানবিক হয়। খরচ ও ভোগের বেলায় মিত্যব্যয়ী হয় এবং দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করে। কিন্তু করোনা মহামারীর মতো চরম দুর্যোগের সময় বাংলাদেশের একশ্রেণির লোভী, অমানুষ ও দুর্নীতিবাজ সীমাহীন দুর্নীতি করে দেশ এবং বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করেছেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি, দুঃশাসন ও অব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে সাহেদ, সাবরিনা-আরিফ, আবজাল-রুবিনা, মিঠু সিন্ডিকেট, জসিম, গাড়িচালক মালেকসহ অনেকের দুর্নীতির রহস্যময় কাহিনি রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে যেখানে অনুসন্ধান সেখানেই পাহাড়সম দুর্নীতি ও অব্যবস্থার প্রমাণ পাওয়া গেছে। রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজির প্রতারণার ঘটনা বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে প্রচার পেয়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী একেকজন বাংলাদেশিকে একেকটি করোনা বোমা বলে মন্তব্য করেছেন। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ চরমভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সর্বগ্রাসী আর্থিক দুর্নীতি, চারিত্রিক দুর্নীতি ও দলবাজির দুর্নীতি প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। আসলে রাজনীতি এবং প্রশাসনের উচ্চস্তরে জবাবদিহি ও সততা না থাকলে অধস্তন সর্বস্তরেই দুর্নীতির লাইসেন্স পেয়ে যায়। বস্তুতপক্ষে স্বাস্থ্য খাতে তা-ই ঘটেছে। একজন গাড়িচালক দুর্নীতি করে যখন এত বেশি সম্পদের মালিক হন, তখন স্বাস্থ্য খাতের হোমরা-চোমরা গডফাদাররা কী পরিমাণ দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় সরঞ্জাম সরবরাহকারী ঠিকাদারি এবং পদায়ন-বদলি বাণিজ্যে। উভয় ক্ষেত্রে কর্তাব্যক্তিদের সহযোগিতা, সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া দুর্নীতি এবং প্রতারণার মতো ঘটনা ঘটতে পারে না। বিশিষ্টজনদের মতে, করোনাকালে দুর্নীতি ও প্রতারণার অভিযোগে এ পর্যন্ত যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তারা চুনোপুঁটি ‘মডেল’ মাত্র। সমাজে এ ধরনের পাপী ব্যক্তি দাপটে চলছেন। এদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় ও শক্তি-সাহস দিয়েছেন, সেসব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহালোভীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। নতুবা দুর্নীতি ও প্রতারণার বিষবৃক্ষকে নির্মূল করা যাবে না।

লেখক : সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি- বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ভূ-তত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর