শুক্রবার, ৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ধন্যবাদ আইনমন্ত্রীকে : আমরা তো এ কথাই বলেছিলাম

মনজুরুল আহসান বুলবুল

ধন্যবাদ আইনমন্ত্রীকে : আমরা তো এ কথাই বলেছিলাম

ধন্যবাদ জানাই মাননীয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশের তদন্তের আগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া যাবে না- এমন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা বলেছি সরাসরি মামলা নেওয়া হবে না। কোনো অভিযোগ এলে পুলিশ প্রথমে তদন্ত করে দেখবে এবং তদন্ত সাপেক্ষে মামলা নেওয়া হবে। আটক আসামির জামিন হওয়া না হওয়ার প্রশ্নে মন্ত্রী বলেছেন, সাজা যতটা হলে জামিন হবে এবং যতটা হলে জামিন হবে না ঠিক সেই প্রিন্সিপালটা ফলো করে আমরা বিধান করেছি। সারা পৃথিবীতেই এটা করা হয়। এমনকি এ উপমহাদেশেও। আইনমন্ত্রী বলেছেন, সব আইনই যখন করা হয় তখন কিন্তু একটা ট্রায়াল অ্যান্ড এরর বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য মধ্য দিয়ে যায়। কথা হচ্ছে, এখানে যদি কিছু অ্যাবিউজ ও মিসইউজ হয় তা কী করে বন্ধ করা হবে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। মন্ত্রী আনিসুল হক জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সঙ্গেও আলোচনার কথা উল্লেখ করে বলছেন, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের অফিসের সঙ্গে আমি আলাপ চালাচ্ছি। সারা বিশ্বের সঙ্গে আমরা এটার তুলনা করছি। মিসইউজ যেগুলো ধরা পড়েছে বা অ্যাবিউজ যেগুলো হচ্ছে সেগুলোর জন্য একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স সিস্টেম কীভাবে ডেভেলপ করা যায়, এ আইনের মধ্যেই কীভাবে সেটা থাকতে পারে সে ব্যবস্থা আমরা করছি। এসব ব্যবস্থা নিতে আইনের সংশোধনের প্রয়োজন নাও হতে পারে, বিধির মাধ্যমে সেটা করা যেতে পারে।

পাঠককে মনে করিয়ে দিই : ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যেদিন সড়ক পরিবহন আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হয় সেদিনই সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিও পাস হয়। আজ পর্যন্ত সরকার সড়ক পরিবহন আইনটি কার্যকর করতে পারেনি। গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্ট সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ও ৩১ ধারা কেন সংবিধানবিরোধী হবে না। চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব চাওয়া হলেও আজ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি। কোনো বিধিমালা ছাড়াই, প্রস্তাবিত কর্তৃপক্ষ গঠন ছাড়াই আইনটির প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে, অপপ্রয়োগও যে হচ্ছে সে বিষয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই।

সবার অবগতির জন্য জানাই, এ আইনটি প্রণয়নের নানা পর্যায়ে আমরা সম্পর্কিত ছিলাম। আইনটি সংসদে পাসের পর আমরা যে বক্তব্য দিয়েছিলাম তা এখানে তুলে ধরছি :

জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা, এ আইন প্রণয়নকালে সংসদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্য এবং সংসদীয় কমিটির পেশকৃত রিপোর্ট সম্পর্কে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের (অ্যাটকো) সহসভাপতি মোজাম্মেল বাবু এবং বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুলের যৌথ বক্তব্য : ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছি যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আমাদের সঙ্গে প্রতিশ্রুত চূড়ান্ত বৈঠক না করেই জাতীয় সংসদে তাঁদের সুপারিশ একতরফাভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফলে এ সুপারিশে সাংবাদিকসমাজের মতামত যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। আমাদের সুপারিশের কিছু কিছু বিষয় এ আইনে সংযোজন করা হলেও :

১. গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি।

২. তথ্য অধিকার আইন ও অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনের পাশাপাশি অবস্থান নিশ্চিত করে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে।

৩. পুলিশকে অবাধে ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করার পথ সুগম করা হয়েছে।

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এ আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়টি নিয়েও উৎকণ্ঠিত। উল্লিখিত সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা :

১. দ্রুত এ আইনের অসামঞ্জস্যসমূহ দূর করার অনুরোধ জানাই।

২. এ আইনের অপপ্রয়োগ করে যাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করা না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানাই।

৩. গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানাই।

আমরা মনে করি, ‘এ আইন কার্যকরের ক্ষেত্রে বিধিমালা প্রণয়নের বেলায় আলোচনা করে উল্লিখিত সব অসামঞ্জস্য দূর করে আইনটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার সুযোগ রয়েছে।’

মাননীয় আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে আমাদের বক্তব্যের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাসি হোক তবু যে গরিবের কথা কিছুটা ফলতে শুরু করেছে তাতেই আমরা খুশি।

আজকের পৃথিবীতে প্রযুক্তি যেমন তথ্যের সব ভান্ডার উন্মুক্ত করেছে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও তৈরি করেছে। তথ্যজগৎ যেমন সবার জন্য অবারিত হয়েছে তেমনি এর অপব্যবহার করছে দুর্বৃত্ত দল। কিন্তু কিছু দুর্বৃত্তের জন্য এমন অবারিত সুযোগ যেমন সীমিত করা যায় না, তেমনি দুর্বৃত্তদের অবাধ বিচরণভূমিও করা যায় না এ পৃথিবীকে। এ বাস্তবতা মাথায় রেখেই বলি, সাইবার অপরাধ দমনে নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে। তাহলে আপত্তিটি কোথায়? তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বেধড়ক অপব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকেই আপত্তি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রথম করা হয় ২০০৬ সালে। ২০১৩ সালে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে আইনটিকে আরও কঠোর করা হয়। ৫৭ ধারার যে অপব্যবহার হচ্ছিল তা কিন্তু আমাদের অনবরত দাবির মুখে মন্ত্রীরাও স্বীকার করেছিলেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন নতুন আইনে এ রকম উদ্বেগজনক কিছু থাকবে না। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াতেই আমরা দেখলাম : ওই ৫৭ ধারাই নানাভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন আইনে। সম্পাদক পরিষদ ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) লিখিতভাবে এবং টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন মৌখিকভাবে তাদের দফাওয়ারি আপত্তি মন্ত্রণালয়ে জানায়। শেষে সংসদীয় কমিটির সামনেও এসব যুক্তি ও আপত্তি তুলে ধরা হয়। কিন্তু সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা অসমাপ্ত রেখেই ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭, ৬৬ এ পাঁচটি ধারা বিলুপ্ত করে সংসদে কণ্ঠ ভোটে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ পাস হয়। সে সময়কার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী এ বিল পাসের জন্য ‘নিজেকে সৌভাগ্যবান’ মনে করছেন বলে সংসদে বলেন, এ ধরনের একটি আইন ‘তাঁর স্বপ্ন’ ছিল বলে তিনি জানান। তাঁর মতে পৃথিবীর বহু দেশ এ আইন অনুসরণ করবে। কিন্তু আইনটি পাসের কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্বের গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ কয়েক ধাপ নিচে নেমে যায়। কারও ‘ব্যক্তিগত সৌভাগ্য’ সুরক্ষা বা ‘স্বপ্ন’ বাস্তবায়নের জন্য দেশের বারোটা বাজানোর এমন নজির খুব বেশি নেই!

এ আইনের সঙ্গে সরাসরি বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সম্পর্কের জায়গা মূলত তিনটি :

১. চিন্তা ও বিবেকপ্রসূত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

২. পেশাদার সাংবাদিকদের কাজ করার জন্য ভীতিহীন পরিবেশ।

৩. অপতথ্য দিয়ে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ।

মোটা দাগে তিনটিই মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত। তথ্যের যুদ্ধে অপতথ্যের বিরুদ্ধে একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে যথাসময়ে সঠিক ও পুরো তথ্য। অপতথ্যের বিরুদ্ধে যথাসময়ে সঠিক ও পুরো তথ্য নিয়ে যুদ্ধে নামাই একমাত্র কৌশল। তথ্যের যুদ্ধে আর কোনো অস্ত্র নেই।

চিন্তা ও বিবেক প্রসূত লড়াইয়ে যুক্তি ও মেধা নিয়েই প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হবে। আজকের পৃথিবী জ্ঞানভিত্তিক। জ্ঞানের লড়াইয়ে মাঠে নামতে হবে পর্যাপ্ত, যুক্তিগ্রাহ্য জ্ঞান নিয়েই। বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের অনুপস্থিতি দল ও সরকারকে দুর্বল করে। এ দুর্বলতা নিয়ে যুদ্ধ জয় করা অসম্ভব, নানা আসরে অনেকের কণ্ঠ যত উঁচুই হোক না কেন।

প্রকৃত সাংবাদিকরা কাজ করেন নির্দিষ্ট ব্যাকরণ, নৈতিকতা মেনেই। তবে তাৎক্ষণিক তথ্য নিয়ে কাজ করতে হয় বলে ভুল করে তা স্বীকার, দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমাপ্রার্থনা এমনকি খবর প্রত্যাহারের বিষয়টি সাংবাদিকতার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে। সাংবাদিকদের কাজে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তাঁকে ভুল স্বীকার করার সুযোগ দিতে হবে, সংশোধন দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। যতই ক্ষুব্ধ হোন না কেন এ প্রচলিত রীতি মানতেই হবে। সে সুযোগ না দিয়ে সাংবাদিকের কোমরে দড়ি বাঁধা কোনো যুক্তির কথা নয়।

আশঙ্কার অংশ যা তা হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা। এর কোনো ব্যাকরণ নেই। এর একমাত্র কাজ হচ্ছে উদ্দেশ্য হাসিল। যারা এ কর্মটি করেন দেশে বা বিদেশে, এরা হচ্ছেন অপতথ্যের বাহক। আবর্জনা পরিষ্কার করা যেমন জরুরি তেমনি অপতথ্যের এ আবর্জনা অপসারণও জরুরি। এ আবর্জনা দেশেই থাকুক কিংবা বিদেশে। ছড়ানো হোক যেখান থেকেই। বাংলাদেশে বসে যে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন, সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তাদের বলা উচিত : তাদের দেশে বসে কেউ কেউ আমাদের দেশের বিরুদ্ধে আবর্জনা ছড়াচ্ছেন। সেই দুর্গন্ধ এ দেশে আসছে নানা প্রযুক্তিবাহিত হয়ে। বলতে হবে : হয় আপনারা তাদের বিচার করুন না হয় এদের আমাদের হাতে তুলে দিন। আমাদের বন্ধুপ্রতিম হলে আপনার ভূখন্ড তো আমাদের বিরুদ্ধে কোনো লড়াইয়ে ব্যবহৃত হতে পারে না।

এ সার্বিক প্রেক্ষাপটে সরকারের নতুন যে বোধোদয় তাকে স্বাগত জানাই। এ বোধোদয়ের জন্য আমাদের দুঃখজনকভাবে প্রত্যক্ষ করতে হলো একজন মুশতাকের করুণ মৃত্যু। জানি না এ মৃত্যু তাদের আলোড়িত করেছে কিনা, যারা সংসদীয় কমিটিতে আমাদের সঙ্গে আলোচনা শেষ না করেই সংসদে বিপুল উৎসাহে এ বিল উত্থাপন করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন। সেই মন্ত্রী এখন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ে, কিন্তু তার করা আইনটি যে দেশকে পৃথিবীজুড়ে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে সে বিষয়টি প্রমাণের জন্য আজ আর কোনো সাক্ষী-সাবুদের দরকার নেই। সংকীর্ণ চিন্তার এই ধারক-বাহকদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কেও সতর্ক থাকা জরুরি। নানা ঘাটে ঘোরাফেরা করা এ মতলববাজরা তরীটিই ডুবিয়ে দেয় কি না সেদিকে নজর রাখা দলেরই কর্তব্য।

যারা না বোঝার তারা না বুঝুন। ধন্যবাদ জানাই মাননীয় আইনমন্ত্রীকে, যিনি নিজ উদ্যোগেই কিছু কাজ শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন। আইনটি পাসের পর আমরা যে বক্তব্য ও প্রস্তাব দিয়েছিলাম [উপরোল্লিখিত] তার সঙ্গে মাননীয় মন্ত্রীর ভাবনার যথেষ্ট মিল রয়েছে। প্রত্যাশা, তিনি আইন সংশোধন বা বিধিমালা প্রণয়ন করেই হোক, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির ভীতিকর চেহারাটির পরিবর্তন আনতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন। তবে মাননীয় মন্ত্রীকে সহায়তা করার জন্যই বলি : এ কাজটি করতে গিয়ে ‘পদাধিকারবলে বিশেষজ্ঞ’দের চেয়ে দেশে-বিদেশে যারা বিষয়টি নিয়ে সম্যক জ্ঞান রাখেন তাদের সম্পৃক্ত করা হলেই কেবল ভালো ফল মিলবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর