বুধবার, ১০ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রের দায় ডিজিটাল নিরাপত্তা ও ইতিহাসের ভাগাড়ে বিএনপি

পীর হাবিবুর রহমান

রাষ্ট্রের দায় ডিজিটাল নিরাপত্তা ও ইতিহাসের ভাগাড়ে বিএনপি

রাষ্ট্র কখনো ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না। তবু আমাদের স্বাধীন দেশে বারবার তেমনটি ঘটেছে। রাষ্ট্র জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকান্ডের ভয়াবহতাকে অনুমোদন দিয়ে কুম্ভকর্ণের ঘুম দিয়েছিল। রাষ্ট্রের ব্যর্থতার যন্ত্রণাবিদ্ধ বেদনা সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছেন বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তাঁদের চেয়ে বেদনার ভার আর কাউকে এ দেশে বহন করতে হয়নি। সেদিন রাষ্ট্র দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার নজিরই স্থাপন করেনি, মানবসভ্যতার ইতিহাসে সংঘটিত সবচেয়ে বর্বরতম হত্যাকান্ডের বিচারের পথ বন্ধ করে খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য দিয়েছিল। এমন ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনই ছিল না সভ্যসমাজে তা ছিল যেন চেঙ্গিস খানের শাসন। বিশ্ববাসীর সামনে ছিল লজ্জার। আইন ও বিচারকে সেদিন কালো কফিনে পুরে রেখেছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসতম প্রক্রিয়ায় হত্যাকান্ড ছিল জঘন্য সন্ত্রাস। সেদিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নীলনকশায় হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিল সামরিক বাহিনীর বিপথগামী সদস্যরা। একটি সাংবিধানিক সরকারকে উৎখাত করে জাতির পিতার রক্তাক্ত লাশ ধানমন্ডির ইতিহাসের বাড়িতে ফেলে রেখে খুনিদের অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতা দখল করেছিল। রাষ্ট্র সেদিন প্রত্যাশিত দায়িত্ব পালনে সর্বনাশা ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। সামরিক-বেসামরিক সব বাহিনীর প্রধানরা সেদিন নির্লজ্জ কাপুরুষের মতো খুনিদের প্রতিরোধের বদলে অবৈধ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। সামরিক বাহিনীর ভিতরে-বাইরে উচ্চাভিলাষীরা ক্ষমতার মোহে ক্যু-পাল্টা ক্যুর পথে রক্তের সিঁড়িপথেই হেঁটেছে। সামরিক শাসনের অন্ধকার অভিশাপ তারা শুধু জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেয়নি, সেদিন জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর জাতীয় চার নেতাকে বন্দী অবস্থায় বুলেটে ঝাঁজরা করে হত্যা করেছিল। খুনি মোশতাক থেকে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের বর্বর শাসনকালে রাজনীতিবিদদের কারাগারে নিপীড়ন-নির্যাতনে দমবন্ধ ভৌতিক পরিস্থিতি তৈরি করে কারফিউর শাসন কায়েম করেছিল। গণতন্ত্র, আইন, বিচার, সংবিধানকে কবর দিয়ে তারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার কখনো হবে না এমন মানবসভ্যতাবিরোধী বর্বর ইনডেমনিটি আইন পাস করেছিল। একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর বিচার যেখানে অধিকার, একটি সাধারণ হত্যাকান্ডের বিচার যেখানে প্রাপ্য সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার এবং মুক্তিযুদ্ধের অনন্য সংগঠক জাতীয় চার নেতার বিচার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। একই সঙ্গে খুনিদের দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, বিদেশের মিশনে চাকরি এবং সশস্ত্র রাজনীতির অধিকার। রাষ্ট্র যেখানে জাতির পিতার জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারেনি, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি, খুনিদের গলায় ফাঁস দিতে ব্যর্থ সে রাষ্ট্র জনগণের জানমালের নিরাপত্তা কীভাবে দিতে পারে? সেদিন রাষ্ট্র এতটাই ব্যর্থ হয়েছিল যে, আইনের শাসনের দরজার তালাটা খুলে দিতে পারেনি। বর্বরতম হত্যাকান্ডের বিচার করতে পারেনি।

’৮১ সালে দিল্লি নির্বাসিত মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে দেশে ফিরে যে সংগ্রাম শুরু করেন তা ছিল কঠিন এবং দুরূহ কাজ। সামরিক শাসনের কবল থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের লড়াইয়ে ঊর্মিমুখর আন্দোলন সংগ্রামে নিজেও জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। দেখেছেন যে পিতা নিজের জীবন-যৌবন উৎসর্গ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিলেন সেই পিতা-মাতা-ভাইদের হত্যার বিচার হচ্ছে না। রাষ্ট্র তার জনকের খুনিদের বিচার করে না! এ নিয়ে রাজনৈতিক শক্তি বা সিভিল সোসাইটির কোনো জোরালো দাবিও নেই। তিনি নিজেই একা তাঁর দল, কর্মীদের নিয়ে ময়দানে লড়েছেন, জনমত গড়েছেন, জনগণকে সংগঠিত করেছেন। সামরিক শাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র মুক্ত করতে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন। গণতন্ত্র মুক্ত হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কপালে জোটেনি। কি ট্র্যাজিক তাঁর জীবনের ক্রন্দন। কি গভীর রাষ্ট্রের ব্যর্থতার ক্ষত দাগ। অবশেষে লড়াইকেই তিনি পথ হিসেবে নিয়েছেন। দীর্ঘ ২১ বছরের সংগ্রাম শেষে ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গণরায়ে ক্ষমতায় এসে কুখ্যাত ইনডেমনিটির কালো দাগ মুছে দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করেছেন। খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে একটি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করে ন্যায়বিচারের আলোর জগতে এনেছেন। তবু ষড়যন্ত্র থামেনি। নোংরা রাজনীতির প্রতিহিংসার ছোবলের বিষে বিষাক্ত হতে হয়েছে তাঁকে। বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন নেমেছে। ঘরছাড়া করা হয়েছে নেতা-কর্মীদের। ধর্ষিত হতে হয়েছে সমর্থকদের। এমনকি শেখ হাসিনাকে একুশের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় দিনদুপুরে উড়িয়ে দিতে গিয়ে আইভি রহমানসহ ২২ জনকে হত্যা করা হয়েছে। কত শত পঙ্গু হয়েছে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে তাঁর ফিরে আসার দৃশ্য দেখে বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়েছে। আর তিনি সেদিনও ন্যায়বিচার পাননি। জজ মিয়া নাটকের প্রহসন দেখেছে দেশ। এমনকি রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেবে কি, সেদিন একজন বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। উল্টো এমন সহিংস গ্রেনেড হামলার সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পৃক্ততার যে ভয়াবহতা পরে উন্মোচিত হয়েছে তা জাতির জন্য লজ্জারই নয়, গভীর বেদনারই নয়, অভিশাপেরই নয়, একটি রাষ্ট্রের ভয়ংকর দুর্বলতার চিত্র উন্মোচিত হয়েছে।

আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে পেয়েছিলাম। যেখানে জনগণকে ক্ষমতার মালিকই করা হয়নি, সাম্য-ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়েছিল। রাষ্ট্রের ব্যর্থতার সবচেয়ে দগদগে যন্ত্রণা যেমন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে বহন করতে হয়েছে তেমনি তাঁকেই দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে মানুষের হারানো সব অধিকার অর্জন করতে হয়েছে। টানা এক যুগের শাসনে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরেই আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। এত উন্নয়ন, করোনার বিরুদ্ধে এমন বিস্ময়কর অর্জন- সব মিলে বাংলাদেশ ইতিহাসের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছে। অতি সম্প্রতি তিনি গৃহহীন ৯ লাখ মানুষকে ঘর দিয়েছেন। খাবার অভাব দূর হয়েছে। কৃষিতে বিপ্লব হয়েছে। কত দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এমনি অবস্থায় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কালো আইন বহাল বেমানান। এর সংশোধন অনিবার্য। সংবিধান ও আইনি বিধিবিধান যেমন জনগণকে মানতে হবে, তা লঙ্ঘনের সুযোগ নেই। তেমনি প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্র বা রাজনৈতিক শক্তিকেও তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের সীমা লঙ্ঘন করতে দেওয়া যায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে গণমাধ্যম- সবখানেই মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা থাকলেও ‘দায়িত্বশীলতা’ শব্দটি বা তার অর্থ এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বহন করা বেদনা ও দীর্ঘ সংগ্রাম এবং তাঁর অর্জনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে তাঁর কাছেই প্রত্যাশা করতে পারি। আমরা আশা করতেই পারি তিনিই আমাদের মানবিক সমাজ দিতে পারেন। ন্যায়বিচার যাতে মানুষ পায়, নিবর্তনমূলক আচরণ যাতে মানুষের ওপর না হয় এবং বিচার ও আইনবহির্ভূত মর্মান্তিক ঘটনা যাতে না ঘটে, সর্বত্র সংবিধান ও আইনের স্বচ্ছ কার্যকারিতার মাধ্যমে আইনের শাসনে দেশ আলোকিত থাকে তা নিশ্চিত করতে পারেন।

রাষ্ট্র আর সরকার যেমন এক নয় তেমনি রাষ্ট্র খুনি, ইতিহাস বিকৃতকারী, ডাকাত, লুটেরা, অর্থ পাচারকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে না। আইনের ঊর্ধ্বে কাউকে যেতে দিতে পারে না। মানুষের সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্টের। রাষ্ট্র কাউকেই আইন লঙ্ঘনে প্রশ্রয় দিতে পারে না।

একইভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রাষ্ট্র যেমন নিশ্চিত করবে তেমনি সমাজে ধর্মীয় উসকানি বা যে কোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর মতো কর্মকান্ডও নিয়ন্ত্রণ করবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংঘটিত অরুচিকর মিথ্যাচার ও চরিত্রহনন রুখবে।

মুশতাক আহমেদ টানা ১০ মাস কারাগারে থাকার পর মৃত্যুবরণ করেছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক মুশতাকের মৃত্যু নির্যাতনের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে তার রিপোর্ট এখনো আসেনি। মুশতাকের মৃত্যু রাষ্ট্রকে কতটা ঝাঁকুনি দিয়েছে তা অনুমান করা না গেলেও আবেগ-অনুভূতিহীন বোধহীন সমাজকে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। তার জন্য ছয়বার জামিন চাওয়া হলেও মুক্তি মেলেনি। এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। মুশতাকের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কার্টুনিস্ট কিশোরও ১০ মাস আটক থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন। এখন তার চিকিৎসা চলছে। কিশোর গণমাধ্যমকে আটকের পর তার ওপর সংঘটিত নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা রোমহর্ষক। বন্দীর ওপর এমন নির্যাতন সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে হওয়ার কথা নয়। কিশোরের অভিযোগ মুশতাকের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, কারাগারে কারও ওপর নির্যাতন করা হয়নি। বাইরে হয়ে থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা অতীতের অনেকের চেয়ে বেশি। আমরা আশা করতেই পারি এর পুরো তদন্তে সত্য বের হবে। কোথাও কেউ দায়িত্বের বাইরে অন্যায় করে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্কের ঝড় ছিল। বিতর্কের মধ্যেই এটি পাস হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাধীনতার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং এটা যাতে কাজের অধিকার খর্ব না করে, হয়রানি না করে সেজন্য শুরু থেকেই সম্পাদক পরিষদসহ নানা মহল কিছু নিবর্তনমূলক কালো ধারা বাতিলের সুপারিশ করেছে। এখনো সে দাবি বহাল।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে এখন নতুন বিতর্কের ঝড় উঠেছে। বিশেষ করে গণমাধ্যম টকশো আর রাজনীতিতে। সাধারণ মানুষের আজকাল কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই। দেখেন শোনেন অবস্থায় থাকেন। বিতর্কে অংশ নেওয়া এক পক্ষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পুরোটাই বাতিল করার পক্ষে মত দিচ্ছেন। এক ধরনের বিপ্লবী কথাবার্তা তাদের। আরেক পক্ষ বলছেন এর অপব্যবহার, অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। সংশোধন করতে হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেছেন, সংশোধনের বিষয়টি তারা বিবেচনা করছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকবে। কিন্তু যুগে যুগে অনেক আইন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়েছে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করতে। প্রতিবাদ রুখতে। এ আইন যাতে সেভাবে অসৎ বা ব্যক্তিস্বার্থে কারও জীবন বিষিয়ে দিতে অপব্যবহার না হয় সেজন্য সংশোধনকালে সুরক্ষা দিতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন মন্তব্য যথার্থ। কিন্তু এর অপব্যবহার এবং দুর্বলতা সারিয়ে তুলতে হবে। নারী-শিশু শুরু করে সর্বস্তরের থেকে মানুষই নয়, দেশের ইমেজ পর্যন্ত ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে কেউ কেউ নির্দ্বিধায় শেষ করে যাবেন এমনটা থাকতে দেওয়া যায় না। ডিজিটাল অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। সেখানে অপরাধীর গ্রেফতার, জামিন, শাস্তির ব্যবস্থা যেমন থাকবে তেমনি যারা এ দায়িত্ব পালন করবেন তাদের বাড়াবাড়ির সুযোগ দেওয়া যাবে না। আসামির গ্রেফতার প্রক্রিয়া থেকে আদালতে হস্তান্তর পর্যন্ত নির্যাতন-নিপীড়ন যাতে না হয় এমন স্বচ্ছ প্রক্রিয়া থাকতে হবে। কেউ চাইলেই আইন ও ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করতে পারবেন না এটা নিশ্চিত করতে হবে। আইন ও বিচারবহির্ভূত কর্মকান্ড বা যা খুশি তা করার সুযোগ দেওয়া যায় না। মুশতাক ও কিশোরের আটকের যে বর্ণনা এসেছে তাও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। একদল সাদা পোশাকে যাবে আর ত্রাস সৃষ্টি করে ধরে নিয়ে আসবে এমনটা হলে দুঃখজনক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা নিজেদের পোশাক পরিচয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে আসামিকে আটক করবে। তারপর মামলার চার্জশিটও সময়মতো দেওয়া হবে। মুশতাকের মামলায় তা কেন দেওয়া হয়নি। এ মামলার আরও কজনকে কেন অব্যাহতি এবং বাকিদের জামিন দেওয়া হলো তাও খতিয়ে দেখা দরকার। নির্মোহ তদন্ত হওয়া উচিত।

বিএনপি ৭ মার্চ পালন করার ঘোষণা দিলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও স্বাগত জানিয়েছিলেন। সব মহলেই আশার আলো জেগেছিল। ভেবেছিলাম বিএনপি ইতিহাসের মীমাংসিত সত্যের কাছে সমর্পণ করেছে। কয়েক দিন আগে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুও বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকেই জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেন। কিন্তু ৭ মার্চের আলোচনায় বিএনপি নেতারা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের স্বাধীনতার ডাক ও যুদ্ধের রণকৌশল ঘোষণাকে অস্বীকার করে তাদের মতোই বক্তব্য দিয়েছেন। বলেছেন বঙ্গবন্ধু সংগ্রামের কথা বলেছেন, স্বাধীনতা বা যুদ্ধের ডাক দেননি। ইতিহাসের মীমাংসিত সত্যকে আবার অস্বীকার করে তারা তাদের সেই পুরনো কলের গান বাজিয়েছেন। ইতিহাস বিকৃতির নোংরা খানাখন্দেই বিএনপি এখনো পড়ে আছে। ইতিহাসের চিরমহান উজ্জ্বল যে সত্য পৃথিবীময় লালিত তা অস্বীকার করে নিজেদের দৈন্যই প্রকাশ করেনি, জানিয়েছে বিএনপি আর যাই হোক বদলাবে না। অসত্য মিথ্যাচার বিকৃতির ভিতরেই তার গতিপথ নির্ণয় করে চলেছে। রক্তাক্ত সামরিক শাসনের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এ দেশের অবৈধ রাজনৈতিক দল বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও ইতিহাসের গতিপথে ফেরাতে পারেনি। পাকিস্তানি ভাবধারার পথেই হাঁটছে। ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক সম্মানই নয়, সেদিন বিশ্ব দেখেছে রাজনীতির কবি কীভাবে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ডাকটা দিয়েছেন গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে। বিএনপির তখন জন্মই হয়নি। অতি ডান-বামের সমন্বয়ে গঠিত বিএনপির শাসনামলে ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা হয়। ইতিহাস বললে তাদের কিছু থাকে না। গ্লানি আড়াল করতে এখনো বিকৃতির ভাগাড়ে পড়ে আছে। তাই বলে বিএনপির জন্য ইতিহাস বসে থাকেনি। স্রোতস্বিনী নদীর মতো বয়ে চলা ইতিহাস বলে যায়, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তা। বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই দেশের আত্মা। তিনি স্বপ্ন দেখেন, লড়াই করেন, নেতৃত্ব দেন এবং তাঁর জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেন।

            লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর