শুক্রবার, ২১ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ডাকরা গণহত্যা

বিষ্ণুপদ বাগচী

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে  সবচেয়ে বিভীষিকাময় ও বেদনাদায়ক অধ্যায় গণহত্যা। একের অধিক মানুষকে হত্যাকেই সাধারণত গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছিল। তার মধ্যে গণহত্যা ছিল ভয়াবহ ও মর্মন্তুদ। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ প্রথমে ‘অপারেশন সার্চলাইট’, এরপর ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’ অভিযান পরিচালনা করে। এতে দেশের  প্রত্যন্ত অঞ্চলে হত্যা ও নির্যাতনের বহু ঘটনা ঘটে। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ গণহত্যায় ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়। এসব শহীদের মধ্যে সদ্যোজাত শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ ছিল। সাধারণত আওয়ামী লীগ সমর্থিত বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হিন্দুদের তারা নিশানা করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো একটি দেশে এত অল্প সময়ে এত হত্যা হয়নি। যদিও আমরা বলি ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছে কিন্তু সংখ্যাটি আরও বেশি হবে বলে এক জরিপে বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে গণহত্যা, বধ্যভূমি, নির্যাতন উঠে এলেও গুরুত্বটা কমই দেওয়া হয়েছিল। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের ব্যাপারটি কিছুটা আড়ালে পড়ে গেছে বলে মনে হয়। ভয়াবহতার দিক দিয়ে খুলনার চুকনগরের গণহত্যার পরই উল্লেখ করা যায় ডাকরার গণহত্যার ঘটনা। ডাকরা গ্রামে ১৯৭১-এর ২১ মে শুক্রবার গণহত্যাটি সংঘটিত হয়েছিল। এখানে সেদিন ৬ শতাধিক মানুষ হত্যার শিকার হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ গণহত্যার ঘটনাটি সেভাবে প্রচারিত হয়নি।

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম ডাকরা। উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুমারখালী নদী। নদীর উত্তরে বাঁশতলী, দক্ষিণে বড় কাটালী, পুবে কুমারখালী ও পশ্চিমে রোমজাইপুর গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। নদীর দক্ষিণ পাড়েই ডাকরা বাজার। বাজারের অনতিদূরে শতাধিক বছরের পুরনো একটি কালী মন্দির। এখানেই জড়ো হয়েছিল ভারত গমনেচ্ছু কয়েক হাজার মানুষ। কালী মন্দিরের আশপাশে বেশ কিছু ব্রাহ্মণ পরিবারের বাস। তাঁরাই মূলত ওই মন্দিরের সেবক। তাদের মধ্যে বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী নামে একজন ধর্মীয় গুরু ছিলেন। তাঁর বহু শিষ্য ছিল বিভিন্ন গ্রামে। প্রাণরক্ষার তাগিদে তাঁকে নিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর শিষ্যরা নৌকাযোগে ও পায়ে হেঁটে সেখানে এসেছিল। অন্যান্য গ্রাম থেকেও বহু পরিবার এসে জড়ো হয়েছিল। স্রোত অনুকূলে না থাকায় তারা মূলত সেখানে অবস্থান করছিল। এখানে ক্ষণিকের যাত্রাবিরতি। তারপর আবার রওনা দিতে হবে গন্তব্যের উদ্দেশে। যত দূর জানা গেছে, রামপালের বিভিন্ন গ্রাম ছাড়াও অন্যান্য উপজেলার বহু গ্রাম থেকেও লোক এসেছিল। এর আগে তাদের ঘরবাড়ি লুট হয়ে গেছে। এখন শুধু প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এই যাত্রা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা গেছে, ওই দিন দুপুর ১টার দিকে দুটি ছিপ নৌকা ২৫-৩০ জন লোক নিয়ে পুব থেকে কুমারখালী নদী দিয়ে দ্রুতবেগে আসতে দেখা যায়। একটি নৌকা ডাকরা হাইস্কুলের পুব পাশে কুমারখালী খালে ঢোকে, অন্যটি একটু পশ্চিমে এগিয়ে মাদারতলী খালের মধ্যে ঢুকে ডাকরা বাজারে থামায়। নৌকার লোকগুলো দ্রুত ডাঙায় নেমে গুলি শুরু করে। গুলি করতে করতে তারা ডাকরা কালী মন্দিরের দিকে এগোতে থাকে। অন্যদিকে কুমারখালী খালের মধ্যে থাকা নৌকার লোকজনও তীরে নেমে গুলি করতে করতে কালী মন্দিরের দিকে এগোতে থাকে। গুলির পর গুলি। দুই দিক থেকে গুলির শব্দ শুনে নৌকা ও তীরে অবস্থানরত লোকজন দিশাহারা হয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে তারা জ্ঞানশূন্য অবস্থায় যে যেদিকে পারে ছুটতে থাকে। দুই দিকের গুলিতে বহু লোক প্রাণ হারায়। মৃতের রক্তে রঞ্জিত হয় সব জায়গা। শুধু রক্ত আর রক্ত। যেখানে-সেখানে, পথে-ঘাটে, পুকুরে-নদীতে বহু লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

তারপর শুরু হয় লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ। আগুনের শিখা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে শূন্যে। তা দেখে পালিয়ে থাকা লোকজন ভীত হয়ে আবারও ছুটতে থাকে। ছুটছে তো ছুটছেই ভিন্ন গ্রামের দিকে। পাশের গ্রাম ছাড়াও বহু লোক নদী সাঁতরে বাঁশতলী গ্রামেও আশ্রয় নেয়। জানা গেছে, আহতদেরও ছোরা ও বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে মেরেছিল খুনিরা। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তারা এলাকা ছেড়ে যায়। যারা সবকিছু হারিয়ে দেশের মাটি ত্যাগ করে একটুখানি বাঁচার আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবার-পরিজনসহ পথে নেমেছিল তারাই পথের মাঝে প্রাণ হারাল। স্ত্রীর সামনে স্বামী, মায়ের সামনে সন্তান, বোনের সামনে ভাইকে হত্যা করে পৈশাচিক আনন্দের স্বাদ মিটিয়ে ঘাতকরা চলে যায়। বাগেরহাট থেকে দুটি ছিপ নৌকা নিয়ে ডাকরায় এসে যারা শত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল তাদের নেতৃত্বে ছিল বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকির। সঙ্গে ছিল তারই অনুগামী একদল রাজাকার। এখানকার অবস্থান এবং লোক জড়ো হওয়ার খবর তাদের জানার কথা নয়। নিশ্চয়ই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা এসেছিল যা সহজেই অনুমেয়।

অভিশপ্ত ডাকরা গ্রাম। জীবন বাঁচাতে এসে যারা জীবন দিয়ে গেছেন কে রাখে তাদের খবর। সেদিনের ঘটনা একদিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে। সত্যি ঘটনা একদিন মিথ্যা হয়ে যাবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো এ ঘটনা বিশ্বাসই করবে না। সেদিন যেখানে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল সে স্থান আজ নদীগর্ভে।। ডাকরা বাজার, সেই পুরনো কালী মন্দির আজ সে স্থানে নেই। বহু মানুষের রক্তে রঞ্জিত ডাকরার মাটি কুমারখালী নদী আপন বুকে গ্রহণ করে রক্তের দাগ মুছে দিয়েছে। তবু এলাকাবাসী প্রতি বছর ২১ মে নিহতদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকে।

বহু বছর পার হয়ে গেছে। দেশ আজ স্বাধীন। বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় ডাকরা হাইস্কুলের পাশেই একটি স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন। যাদের উদ্দেশে এ স্মৃতিসৌধ তারা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। স্মৃতিসৌধ শুধু স্মৃতি হয়ে থাকবে। ২১ মে প্রতি বছর আসবে আবার চলে যাবে। এলাকাবাসী হয়তো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে স্মৃতিসৌধ ফুলে ফুলে সাজাবে। তবে এটুকু কামনা করি, ’৭১-এর ২১ মে হৃদয়বিদারক যে ঘটনাটি ঘটে গেছে সেই দিন যেন আর কোনো দিনই আমাদের মাঝে ফিরে না আসে।

 

লেখক : সাহিত্যিক ও গবেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর