শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

চুরির চেয়ে চুমু উত্তম

সৈয়দ বোরহান কবীর

চুরির চেয়ে চুমু উত্তম

বেচারা ম্যাট হ্যানকক। কপালটাই খারাপ। ব্রিটেনের করোনা পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করেছিলেন। গণটিকা কর্মসূচিতে তার কৌশল ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল দেশে- বিদেশে। এ খুশিতেই হয়তো একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। অফিসকক্ষেই চুমু খেয়ে বসেন সহকারী গিনাকে। কিছু দুষ্টু লোক স্বাস্থ্য বিভাগে ঘটে যাওয়া একান্ত ব্যক্তিগত মুহুর্তকে ক্যামেরাবন্দী করে ফেলে। ব্যস, এটি ছড়িয়ে পড়ে ট্যাবলয়েড থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তীব্র সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেন ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক। ম্যাট চুরি করেননি, নিয়োগবাণিজ্য করেননি, গণমাধ্যমকর্মীকে চার ঘণ্টা আটকে রেখে বলেননি ‘ওই সাংবাদিক খামচি দিয়েছে’। করোনা মোকাবিলায় একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নেননি। তবু তাকে সরে যেতে হলো। কারণ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ম্যাট তার সহকর্মী গিনা কোলাডকে চুমু খেয়েছেন। ভাগ্যিস দুর্নীতির দায়ে তাকে পদত্যাগ করতে হয়নি। চুমুর জন্য পদত্যাগ করতে হয়েছে। এটা দেখে নিশ্চিত, দুর্নীতিবাজ কোনো স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলবেন ‘আমি তো জীবনে কাউকে চুমুই খাইনি, আমি কেন পদত্যাগ করব!’ চুমু মানেই অশ্লীলতা নয়। চুমু ভালোবাসার এক নিবিড় আবেগের প্রকাশ। প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীই শুধু ভালোবাসার আবেগ প্রকাশে চুমু দেয়। পিতা তার কন্যাকে চুমু দিয়ে স্নেহের প্রকাশ ঘটায়। চুমুর নানা প্রকরণ আছে। এটি ভালোবাসার এক শারীরিক প্রকাশ। কিন্তু বিদায়ী ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুটো ভুল করেছিলেন।

প্রথমত করোনাকালীন তিনি স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চুমু খেয়েছেন। দ্বিতীয়ত এ চুম্বন অনৈতিক। কারণ তারা দুজনই বিবাহিত। এ চুম্বনের মাধ্যমে তাদের ‘পরকীয়া’ উন্মোচিত হয়। একটি অনৈতিক সম্পর্কের কথা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় একজন মন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনৈতিকতা কেবল সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয় না, কাজের ক্ষেত্রেও হয়। অনৈতিক সম্পর্ক যেমন সমাজে অগ্রহণযোগ্য তেমনি অনৈতিকভাবে অর্থ প্রাপ্তিও অগ্রহণযোগ্য। অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক যেমন একটি অনৈতিক কাজ, তেমনি অন্যের বা জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করা আরও গুরুতর অনৈতিক কাজ। ম্যাট হ্যানককের পদত্যাগের পর আমার মনে প্রশ্ন এলো, চুমু খাওয়ার অপরাধে যদি একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরে যেতে হয় তাহলে চুরির অপরাধে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কী হওয়া উচিত?

করোনাকালে অবশ্য বিশ্বের তাবৎ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঝুঁকিতে আছেন। একজন ছাড়া। ছোটখাটো কারণে প্রায়ই কোনো না কোনো স্বাস্থ্যমন্ত্রী চাকরি হারান। অবশ্য তীব্র সমালোচনার পরও একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইস্পাতের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। করোনাকালে বিশ্বের সব দেশেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদটা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তারা যেন সার্কাসের দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছেন। একটু এদিকওদিক হলেই অনিবার্য পতন। করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে সফল দেশগুলোর একটি হলো নিউজিল্যান্ড। দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রীদের একজন। এ দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ডেভিড ক্লার্ক। ছোট অপরাধে তার চাকরিটা যায়। নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্লার্ক লকডাউনের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সমুদ্রসৈকতে খানিকটা প্রমোদবিহারে গিয়েছিলেন। গণমাধ্যমে সে ছবি প্রকাশিত হতেই হুলুস্থুল পড়ে গেল। একপর্যায়ে পদত্যাগে বাধ্য হন ডেভিড ক্লার্ক। নিউজিল্যান্ড যেমন করোনা মোকাবিলায় সফল দেশ, ব্রাজিল তেমনি করোনা বেহাল হওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। করোনায় আক্রান্ত দেশগুলোর শীর্ষ তালিকায় প্রথম তিনটির মধ্যে ব্রাজিল। করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় সে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেলসন তেইখ পদত্যাগ করেন। ভদ্রলোক ভালো। নিজের সীমাবদ্ধতা ও অক্ষমতা বুঝতে পেরেছিলেন। নিজেই সরে দাঁড়িয়ে সুযোগ করে দিয়েছিলেন যোগ্য কেউ যেন দায়িত্ব নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। অবশ্য চোখ মেললেই আমরা দেখি, এ রকম অযোগ্য লোক আছে যাদের নিজেদের অযোগ্যতাটুকু বোঝার ন্যূনতম ক্ষমতা নেই। এরা স্বেচ্ছায় সরে গেলে যে যোগ্য ব্যক্তিরা সুযোগ পায়, এ বোধটুকুও তাদের নেই। অবশ্য একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সরে গেলেই যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে তেমনটিও সব ক্ষেত্রে সঠিক নয়। যেমন চেক প্রজাতন্ত্র। করোনাকালে চেক প্রজাতন্ত্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর চেয়ারটা যেন হয়ে গেছে ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’। চারজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন।

এরপর গত মে মাসে দায়িত্ব নিয়েছিলেন পিতর এরেন বার্গার। ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে তাকেও সরে যেতে হয়েছে। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসেই গণটিকা কার্যক্রম চালু করে জনমনে স্বস্তি এনেছেন। টিকাদান কর্মসূচিতে সামান্য স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে চাকরি হারিয়েছেন ইকুয়েডরের দুজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। প্রথমজন কার্লোস জেভালো। তিনি একটি নার্সিং হোমে টিকাদানের জন্য ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ওই টিকা কার্যক্রম দেখতে সরেজমিন তিনি ওই নার্সিং হোমে গিয়েছিলেন। গণমাধ্যম জানায়, ওই নার্সিং হোমে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মা থাকেন। এজন্যই জেভালো পক্ষপাত করেছেন। সমালোচনার ঝড়ে তিনি পদত্যাগ করেন। কার্লোস জেভালোর বদলে ইকুয়েডরের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন রোডলফো ফারদান। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে টিকা প্রদান কর্মসূচিতে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে। তিনিও পদত্যাগ করেন। চোখ বন্ধ করে দেখুন এমন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চেনেন কি না, যিনি টিকা আবিষ্কারের জন্য মানবদেহের পরীক্ষা কার্যক্রম অবলীলায় মাসের পর মাস আটকে রেখেও বীরদর্পে ঘুরে বেড়ান। দেশি টিকা উৎপাদনের প্রস্তাব অবলীলায় ফাইলে বন্দী রেখে বলেন, ‘টিকা নিয়ে কোনো সংকট হবে না’। এ রকম একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবার প্রায়ই দাবি করেন, তিনি দিনরাত কাজ করছেন। ২৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করে এ রকম ‘অনুকরণীয়’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ক্লান্ত না হলেও অস্ট্রিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুডলফ অ্যানশোবার কিন্তু ঠিকই ক্লান্ত হয়েছিলেন। গত ১৩ এপ্রিল রুডলফ পদত্যাগ করেন। কারণ হিসেবে তিনি পদত্যাগপত্রে লেখেন, ‘কভিড পরিস্থিতির কারণে আমি সাধ্যের বাইরে কাজ করেছি। আমি অসুস্থ। আমার চিকিৎসকরাও আমাকে পদত্যাগ করে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।’

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইরাক। করোনার ছোবলে দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থাও নাজুক হয়ে পড়ে। এর মধ্যে অক্সিজেন ট্যাংক বিস্ফোরণের ঘটনায় একটি কভিড হাসপাতালে কয়েকজন রোগী মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে ইরাকের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসান আল তামিমি পদত্যাগ করেন। গত বছর বাংলাদেশের একটি নামকরা হাসপাতালে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকে বিস্ফোরণ ঘটে মারা যান কয়েকজন করোনা রোগী। এজন্য কেউ পদত্যাগ তো দূরের কথা, ওই হাসপাতালের ন্যূনতম শাস্তিও হয়নি। ভুয়া করোনা হাসপাতাল আবিষ্কৃৃত হওয়ার পর সাহেদকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু সাহেদের সঙ্গে যারা চুক্তি করলেন তারা এতটুকু লজ্জিত হননি। পদত্যাগ দূরের কথা এ ঘটনার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি নাকি সাহেদকে চেনেনই না।

বাংলাদেশের মতোই ফেব্রুয়ারিতে গণটিকা কর্মসূচি শুরু করেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু বারবার এ কর্মসূচি ব্যাহত হচ্ছিল। জনগণকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল, তারা বিশৃঙ্খল আচরণ শুরু করে। এ রকম পরিস্থিতিতে গণটিকা কর্মসূচি সফলভাবে করতে না পারার ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন আর্জেন্টিনার স্বাস্থ্যমন্ত্রী গিনিস গনজালেস গার্সিয়া। অথচ বাংলাদেশের অবস্থা দেখুন। গণটিকা বন্ধ হয়ে আছে। কারও কোনো দায় নেই। ভিক্ষার টিকা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ টিকাদান কর্মসূচি চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন শুধু সেরাম থেকে টিকা নেওয়ার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিল? যার প্রভাব-প্ররোচনায়ই এ ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক, এর দায় অবশ্যই স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে। চীন তাদের আবিষ্কৃৃত টিকার ট্রায়াল করার অনুমতি চাইল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দিনের পর দিন কালক্ষেপণ করল। বিষয়টি যখন প্রধানমন্ত্রীর নজরে এলো তখন প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘তাদের অনুমতি দেওয়া হোক’। তিন মাস পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যখন অনুমতি দিল তখন চীন বলল, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। অথচ এ টিকার ট্রায়ালের অনুমতি দিলে আমরা কম টাকায় সবার আগে টিকা পেতাম। দায় কে নেবে? ফাইজার বাংলাদেশকে টিকা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরল। কেউ পাত্তাই দিল না, দায় কার? চীনের থেকে টিকা কেনার চুক্তিতে চীনা ভাষার সংস্করণে ভুলে সই করলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। এ ভুলের কারণে টিকা প্রাপ্তি বিলম্বিত আরও এক দফা। কে দায়ী? চীনের সঙ্গে টিকা চুক্তির একটি অংশ ছিল গোপনীয়। এ গোপনীয় অংশ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করা হলো। চীন অসন্তোষ জানাল। এ ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে দেশের জনগণকে। টিকার লাইনে বিশৃঙ্খলার জন্য আর্জেন্টিনার স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন আর আমাদের দেশে টিকা নিয়ে এতসব কান্ডের পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তা বুক ফুলিয়ে হাঁটেন! কি বিচিত্র!

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীতে অন্যতম কাক্সিক্ষত নাম ‘অক্সিজেন’। দেশে দেশে অক্সিজেন নিয়ে আহাজারি। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। অক্সিজেন সংকট হয়েছিল জর্ডানেও। সরকারি একটি হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটে ছয়জন মারা যান। এর দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন জর্ডানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাজির ওবেইদাত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্রে বলেন, ‘এ অক্সিজেন অপ্রতুলতায় মানুষের মৃত্যু আমার নৈতিক অবস্থানকে ক্ষুণ্ণ করেছে।’ বাংলাদেশে গত দেড় বছরের বেশি সময়ে অক্সিজেনের অভাবে, আইসিইউ বেডের অপ্রতুলতায় কতজন মারা গেছেন তার হিসাব কি আছে? এসব মৃত্যু কি কারও ‘নৈতিক অবস্থান’কে ক্ষুণ্ণ করেছে?

করোনায় এভাবে ছোটখাটো কারণে স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের পদত্যাগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক। জনগণের আগে নিজে টিকা নিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন পেরুর স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. পিলার মাজেত্তি। সমালোচনার মুখে তিনি পদত্যাগ করেন।

এ ঘটনাগুলো উল্লেখ করলাম এ কারণে যে ‘পদত্যাগ’ মানে আত্মহত্যা বা মৃতুদন্ড নয়। মাঝেমধ্যে দেশের মঙ্গলের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য সরে যেতে হয়। এ সরে যাওয়া অনেক সময় গৌরবের, ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। একজন মানুষ সব কাজে সব সময় সফল হতে পারে না। পদত্যাগের সংস্কৃতি তাই একটি মানবিক সুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। যেসব কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন তার চেয়ে অনেক বড় বিপর্যয়কর ঘটনা বাংলাদেশে গত দেড় বছরে ঘটেছে। তার ফিরিস্তি দেশের গণমাধ্যমে এতবার প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়েছে যে এসব এখন মানুষের মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই এগুলো নতুন করে বলতে চাই না। পরীক্ষা না করেই করোনার রিপোর্ট প্রদান, মাস্ক কেলেঙ্কারি, পিপিই কেলেঙ্কারির কথা বলতে বলতে সবাই ক্লান্ত। জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল স্বাস্থ্য খাতে কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনবিরক্তি উৎপাদন করছেন গুটিকয় আমলা আর দু-এক জন প্রতিমন্ত্রী। এরা সরকারকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানোর সর্বাত্মক চেষ্টায় ব্যস্ত। গত ১৪ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে নানা আঙ্গিকে লকডাউন চলছে। কখনো ‘সীমিত’ কখনো ‘কঠোর’। বলা হলো, ১ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন। জনগণকে ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হবে না। লকডাউন মানতে সশস্ত্র বাহিনী মাঠে নামানো হবে। ইত্যাদি। ৩০ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো তা দেখে চোখ কপালে উঠবে যে কারও। প্রজ্ঞাপনটি সমন্বয়হীনতা এবং অরাজকতার এক নিষ্ঠুর দলিল। এ প্রজ্ঞাপনটি সরকারকে জনগণের কাছে খেলো, হাস্যকর করেছে। এখন ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কাঁচাবাজার খোলা রেখে লোকজনকে কীভাবে ঘরে রাখা সম্ভব? সবকিছু বন্ধ রাখার কথা বলে শিল্পকারখানা খোলা রাখা হয়েছে। কি অদ্ভুত। এ রকম কৌতুক ১৪ এপ্রিল থেকেই চলছে। একের পর এক এ ধরনের প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশে ‘প্রজ্ঞাপন বিনোদন’ সংস্কৃতি চালু করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সারা দেশের মানুষের তামাশায় পরিণত হয়েছে সরকারি এসব আদেশ। বাস্তবতাবিবর্জিত এসব আদেশের ফলে করোনা কমছে না বরং বাড়ছে। যেমন ২৫ জুন রাতে ঘোষণা করা হলো, সোমবার (২৮ জুন) শুরু হবে কঠোর লকডাউন। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী (নাকি তিনি লকডাউন প্রতিমন্ত্রী) জানালেন শনিবার এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে। শনিবার সকালে বললেন, ‘জুন ক্লোজিং, তাই কিছু অফিস খোলা রাখতে হবে।’ শুক্রবার রাতে কি মনে ছিল না যে এখন জুন ক্লোজিং, সংসদে বাজেট চলছে? রাতে আবার সুর পাল্টে গেল। বলা হলো, ‘সোমবার থেকে কঠোর নয়, সীমিত লকডাউন। পয়লা জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন।’ শনিবার সকাল থেকেই বাজারে আগুন। ফেরিঘাটে, লঞ্চঘাটে উপচে পড়া মানুষের ভিড়। সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে দেওয়ার মহান প্রকল্পের যেন নিপুণ বাস্তবায়ন চলছে। সোমবার অফিস-আদালত খোলা রেখে গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হলো। মানুষকে খেপিয়ে তোলার এক ক্লান্তিহীন চেষ্টায় যেন নেমেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী আর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সবচেয়ে বড় কথা, লকডাউন নিয়ে কথা বলার এখতিয়ার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী কোত্থেকে পেলেন? এজন্য কি তার নৈতিক অবস্থান এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি? প্রজ্ঞাপন নিয়ে জাতির সঙ্গে সীমাহীন তামাশার কারণে কি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল কোনো আমলা বলবেন, ‘আমি ভুল করেছি, জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করছি।’ আজকাল দেখি অনেকেই বলেন, প্রধানমন্ত্রী কেন ব্যর্থদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিচ্ছেন না। অযোগ্য আমলাদের দৌরাত্ম্য কীভাবে সহ্য করছেন। আমি যদি পাল্টা বলি অযোগ্য, ব্যর্থ, জনগণের কাছে হাস্যকর দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-আমলারা কেন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে জাতিকে স্বস্তি দিচ্ছেন না? তাহলে কি আমরা ধরে নেব তারা বোধশূন্য হয়ে পড়েছেন? এক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর তার অযোগ্যতায় লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় আসা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জনবিচ্ছিন্ন কিছু আমলা সরকারকে জনগণের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। চুমু খাওয়ার জন্য যদি ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট পদত্যাগ করেন তাহলে এদের তো এক শবার পদত্যাগ করা উচিত। চুমু খাওয়া অন্তত চুরির চেয়ে উত্তম। চুমু খাওয়া এসব জঘন্য, অসামঞ্জস্যপূর্ণ, বিভ্রান্তিকর প্রজ্ঞাপন জারির অপরাধের চেয়ে লঘু।

বিজ্ঞ মানুষরা তাদের সীমাবদ্ধতা বোঝেন। মূর্খরা মানুষের আকাক্সক্ষা বোঝে না। দুর্নীতি, অযোগ্যতার বোঝা মাথায় নিয়ে যারা এখনো দায়িত্বে আছেন তাদের বিনীতভাবে বলতে চাই- অনেক হয়েছে, এবার জনগণকে একটু শান্তি দেন। আপনাদের কারণে সরকারের ভালো অর্জনগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যখন মানুষের জন্য সারাক্ষণ কাজ করছেন তখন আপনারা কয়েকজন দেশটাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। আপনাদের মধ্যে যদি ন্যূনতম দেশপ্রেম থাকে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি যদি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকে, দেশের মানুষকে যদি সামান্যতম ভালোবাসেন তাহলে দয়া করে সরে দাঁড়ান। আপনারা সরে গেলে জাতি ভারমুক্ত হবে। আপনাদের বোঝা বইতে আর পারছে না এ দেশ, এ সরকার। প্রধানমন্ত্রীর সহ্যক্ষমতা অনেক। প্রধানমন্ত্রী আপনাদের অযোগ্যতা, দুর্নীতি এবং ষড়যন্ত্র সহ্য করছেন। তিনি বিষ হজম করে নীলকণ্ঠ। প্রধানমন্ত্রী তাই এদের প্রস্থানপথ দেখান না। কিন্তু এ দেশের জনগণের তো সেই সহ্যক্ষমতা ও ধৈর্য নেই। কান পেতে শুনুন, মানুষ অস্থির হয়ে উঠেছে। তাই জনগণ আপনাদের চেয়ার থেকে টেনেহিঁচড়ে নামানোর আগে আপনারা পদত্যাগ করে নজির স্থাপন করুন। আওয়ামী লীগে অনেক যোগ্য-দক্ষ লোক আছেন যারা এ দায়িত্ব নিতে পারেন। আমলাদের মধ্যে অনেক যোগ্য-দক্ষ ব্যক্তি আছেন যারা এ রকম প্রজ্ঞাপনের নিপীড়ন থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে পারেন। তাই করোনার ব্যর্থতার জন্য জাতি যাদের চিহ্নিত করেছে, যাদের সমালোচনায় মুখর দেশ তাদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, জনগণকে মাফ করে দিন। আর আমাদের কষ্ট দেবেন না।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর