বুধবার, ২৮ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই

জহিরুল হক শামীম

মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই

মাদকের সঙ্গে মানুষের পরিচয় আজকের নয়; বহুকাল আগের। বলা যায় মাদক ও মানুষ পৃথিবীর সমান বয়সী। আজকে আমরা আইন করে, জনগণকে সচেতন করে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছি অথচ আজ থেকে দেড় শতাধিক বছর আগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে রীতিমতো আইন করে প্রচার চালিয়ে ভারতবর্ষে আফিমের চাষ ও ব্যবসা শুরু করে। ১৮৫৭ সালে আফিম অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়। গাঁজা ও মদ ব্যবসা থেকেও রাজস্ব আদায় করা হতো। মাদক ব্যবসার প্রসার ও রাজস্ব আদায়ের জন্য ১৯০৯ সালে বেঙ্গল এক্সাইজ অ্যাক্ট ও বেঙ্গল এক্সাইজ ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে মাদকের ব্যবসা ও বিস্তার এতটাই ফুলে ফেঁপে ওঠে যে ব্রিটিশ সরকার মাদকবিরোধী আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতালাভের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে মাদক নিয়ন্ত্রণে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আমাদের সংবিধানের ১৮ (১) নম্বর অনুচ্ছেদে মদ ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।

সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) ড. বেনজীর আহমেদ জঙ্গিবাদ ও মাদককে করোনার মতোই বৈশ্বিক সমস্যা আখ্যা দিয়েছেন। আইজিপি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে মাদকমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে নিরলস কাজ করছেন। আমরা তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে মাদকমুক্ত করতে শূন্যসহিষ্ণুতার নীতিতে কাজ করছি। পুলিশের কোনো সদস্য মাদক গ্রহণ করবেন না, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হবেন না, মাদকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না। পুলিশ হবে মাদকমুক্ত।’ বাংলাদেশ পুলিশ মাদক বিষয়ে শূন্যসহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ করেছে। পুলিশে ডোপ টেস্ট প্রথা চালু হয়েছে। ডোপ টেস্টে কারও মাদকাসক্তির প্রমাণ পাওয়া গেলে তৎক্ষণাৎ চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে।

এত দিন যুদ্ধটা ছিল মাদকের বিরুদ্ধে। বর্তমানে মাদকের পাশাপাশি মাদকাসক্তদের নিরাময়েও নতুন ফ্রন্ট খুলতে হচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আজকের নয়, বহুকাল আগের। মাদক নিয়ন্ত্রণের কাজটাও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের, সরাসরি পুলিশের নয়। পুলিশের না হলেও মাদক পরিবহন, চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের কাজগুলো পুলিশের ওপর অনেকটাই বর্তায়।

বর্তমান সরকার মাদকের চাহিদা হ্রাসের লক্ষ্যে মাদকবিরোধী শিক্ষা, জনসচেতনতা গড়ে তুলতে প্রচার, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি, সামাজিক আন্দোলন ও মাদকবিরোধী বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন, শিক্ষকসমাজ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, সুশীলসমাজসহ অভিভাবকরাও কাজ করে যাচ্ছেন। এত কিছু করেও মাদকের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়নি।

সরকারকে বাধ্য হয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মাদকাসক্তদের নিরাময়ের কথা ভাবতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকার গত অর্থবছরে ৯১টি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রকে অনুদান প্রদানের পাশাপাশি বর্তমান অর্থবছরে অনুদানের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। সরকারি অর্থায়নে সাত বিভাগীয় শহরে ২০০ শয্যার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, এলএসডিসহ জীবনঘাতী বেশির ভাগ মাদকেরই উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ নয়। তার পরও এ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী আজ মাদকের মরণ থাবায় আক্রান্ত। রাজপথের টোকাই থেকে শুরু করে ধনীর দুলালও এ থাবার বাইরে নয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিফতরের ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী এ দেশে মাদকাসক্ত রোগী প্রায় ৭০ লাখ। এরা ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, কোকেন, গাঁজা, বিভিন্ন ধরনের মদ, প্যাথেড্রিন, বুপ্রেনরফিন, মরফিন, রিকোভেক্স, এলএসডিসহ ৩০টির বেশি মাদকাসক্ত। গত ১০ বছরে এর মধ্যে মাত্র ৬০ হাজার ২৩২ জনকে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে; যা মাদকাসক্ত রোগীর মাত্র শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ।

সারা দেশে বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র ৩৫৫টি। সরকারি প্রতিষ্ঠান চারটি। কিন্তু বেশির ভাগ কেন্দ্রেই ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা নেই। মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে রোগী ভর্তি করা হয়। মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য আন্তর্জাতিক চিকিৎসা প্রটোকল থাকলেও তার কিছুই মানা হয় না।

সম্প্রতি রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড নামের নিরাময় কেন্দ্রে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমের নির্মম মৃত্যুর পর এসব মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে। মালিবাগে হলি লাইফ মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ইয়াসিন নামে এক যুবকের মৃত্যু নিয়েও তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি দৈনিকের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তদন্তে ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০-১৫টি ছাড়া বাকিগুলো চিকিৎসার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের দেখা মেলেনি অনেক কেন্দ্রে। অভিযোগ রয়েছে মাদক নিরাময়ের নামে অপচিকিৎসার। মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের তরফে বলা হয়, অনেকেই চিকিৎসা শেষ না করে চলে যায়। ফলে চিকিৎসা কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

আশার কথা, মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদের নির্দেশনায় বাংলাদেশ পুলিশের উদ্যোগে খোদ রাজধানীতে ‘ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ওই কেন্দ্রটি পুরোদমে চালু হলে মাদকাসক্তদের নিরাময়ে এটি হবে বিশ্বমানের একটি প্রতিষ্ঠান- এ কথা জোরের সঙ্গেই বলা যায়। দেশবাসীর প্রত্যাশা- ‘ওয়েসিস’ যেন প্রকৃত অর্থেই মাদকাসক্তদের নিরাময়ের ‘মরূদ্যান’ হয়ে ওঠে।

লেখক : সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর