বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

আমলা ও বঙ্গবন্ধু

বিমল সরকার

আমলা ও বঙ্গবন্ধু

রাষ্ট্র যা দ্বারা পরিচালিত হয় সংক্ষেপে তাকেই বলে রাষ্ট্রযন্ত্র। রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি আমলা শ্রেণি। একটি সৎ, দক্ষ, নির্মোহ নিরপেক্ষ ও হৃদয়বান আমলা শ্রেণি দেশবাসীর দীর্ঘদিনের আকাক্সক্ষা। সত্যিকারের রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের মনে দেশ পুনর্গঠন ও শাসন পরিচালনায় অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতোই আমলা শ্রেণি নিয়ে একটি ভাবনা থাকেই। কারণ দেশ বা জাতির উন্নতি-উন্নয়ন ও সুখ-দুঃখ, স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে প্রধানত তারাই ওতপ্রোত সম্পর্কযুক্ত। এ নিয়ে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও ভাবনার অন্ত ছিল না।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ৭ ও ৮ এপ্রিল (শুক্র ও শনিবার) ১৯৭২। উদ্বোধনী বক্তৃতায় দল ও সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্য অনেকের উদ্দেশে যেমন, তেমনি ভাষায় সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা যদি জনস্বার্থের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে না পারেন তাহলে প্রয়োজনবোধে খোল নইচা সবই বদল করা হবে।’ একইভাবে ও ভাষায় বঙ্গবন্ধু দলীয় কর্মীদেরও যখন তখন অফিসারদের কাছে ঘোরাঘুরি না করার আহ্‌বান জানান। (সূত্র : দৈনিক আজাদ, পৃষ্ঠা ১, তারিখ ৮ এপ্রিল, ১৯৭২)।

দেশের মানুষের অবস্থা ও মনোভাব এবং তাদের প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ এবং অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুর অনেক হয়েছিল। ইংরেজ আমলের শেষ দিকটা এবং পাকিস্তান আমলের পুরোটাই তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। সাদা বর্ণের ইংরেজ আমলারা তো এ দেশের সাধারণ মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করতে চাইত না। ওদের আচরণ সম্পর্কে ভুখা-নাঙ্গা হতভাগ্যদের নিয়ে কত ঘটনা ও কাহিনি প্রচলিত আছে। ওইসব ‘সাহেব-সাদা আদমি-দুরাচারী’র কথা সহজে ভুলে যাওয়ার নয়। ১৮৩৩ সালে সদম্ভে উচ্চারণ করা লর্ড মেকলের বিখ্যাত উক্তিটিই কি তাহলে সত্যি বলে প্রমাণিত হলো? উপমহাদেশে ইংরেজি শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মেকলে বলেছিলেন, ‘এ দেশে এমন একটি শ্রেণি বানাতে হবে যার বর্ণ ও রক্ত ভারতীয় কিন্তু রুচি, অভিমত, নীতিবোধ এবং বুদ্ধিশীলতা ইংরেজের।’ একটি কথা দিনের আলোর মতোই সত্য, স্বাধীনতার পর সাধারণ প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশায় যিনি যেখানে নিয়োজিত রয়েছেন সবারই মূল ঠিকানাটি এ দেশের ধুলো-কাদা-মাটিতেই প্রোথিত। তারা সবাই কারও না কারও সন্তান, ভাইবোন অথবা কাছের-দূরের কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কযুক্ত। সাত সমুদ্র-তেরো নদী কিংবা দূরদূরান্ত থেকে কেউই আসেননি। নিকটজন মনে করে অধিকার ও দাবি খাটিয়েই বোধ করি বঙ্গবন্ধু বিরাজমান উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাঁর দেওয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণে ইয়াহিয়া-টিক্কা খানদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে খুবই দৃঢ়তা ও আস্থার সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি- আমি যা বলি তা মানতে হবে ...।’

সরকারি কর্মচারীদের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা-আস্থা-বিশ্বাস আমৃত্যু বজায় ছিল। তাদের বিশ্বাসও কম করেননি, আবার কখনো ছেড়ে দিয়েও তিনি কথা বলেননি। ঘাতকদের হাতে প্রাণনাশের অল্প কিছুদিন আগে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া একটি বক্তৃতায় আমলাদের দায়িত্ব-কর্তব্য, এমনকি নীতিবোধ ও মানবিকতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বর্ণনা ও দিকনির্দেশনা রয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়, ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন। ... সরকারি কর্মচারীদের বলব, মনে রেখ, এ ব্রিটিশ কলোনি নয়, পাকিস্তানি কলোনি নয়। যে লোককে দেখবা তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো। ওরাই সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়, তোমরা কাজ করে।

আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা- শিক্ষিত ভাইয়েরা, আপনার লেখাপড়ার খরচ দিয়েছে শুধু আপনার সংসার দেখার জন্য নয়, আপনার ছেলেমেয়ে দেখার জন্য নয়। দিয়েছে তাদের আপনি কাজ করবেন, সেবা করবেন। তাদের আপনি কী দিয়েছেন, কতটুকু দিয়েছেন; কী ফেরত দিচ্ছেন, কতটুকু দিচ্ছেন? কার টাকায় ইঞ্জিনিয়ার সাব, কার টাকায় ডাক্তার সাব, কার টাকায় অফিসার সাব, কার টাকায় রাজনীতিবিদ সাব, কার টাকায় মেম্বার সাব, কার টাকায় সব সাব?

সমাজ যেন ঘুণে ধরে গেছে। এ সমাজকে আমি চরম আঘাত করতে চাই। এ আঘাত করতে চাই, যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের- সেই আঘাত করতে চাই এই ঘুণেধরা সমাজব্যবস্থাকে।’

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন সাহসী ও দরদি নেতা পেয়েছিলাম। অন্যদিকে চরম দুর্ভাগ্য যে এমন এক দেশপ্রেমিক ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা পেয়েও স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁকে হারিয়ে ফেললাম। এরপর দীর্ঘ সামরিক শাসন আর রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি জনবান্ধব আমলা শ্রেণি গড়ে তোলা আর সম্ভব হয়নি। একটি সুদক্ষ, বিশ্বস্ত ও হৃদয়বান রাষ্ট্রীয় কর্মীবাহিনী গঠনের স্বপ্ন আজও স্বপ্ন হয়েই রইল।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর