সোমবার, ৯ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে কেন চড় খেতে হয়েছিল

সাইফুর রহমান

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে কেন চড় খেতে হয়েছিল

করোনাভাইরাস মহামারীর পর ধীরে ধীরে মানুষের জীবন কীভাবে স্বাভাবিক হয়ে আসছে সে বিষয়ে সাধারণ জনগণ ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে গত ৮ জুন ফ্রান্সের ভ্যালেন্স শহরের বাইরে টেইন-ল’হারমিটেজ নামক এক অঞ্চলে গিয়েছিলেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। জনসংযোগের সময় ফরাসি এ রাষ্ট্রপতিকে সজোরে চড় কষিয়ে দেন এক ব্যক্তি। সেখানে ভিড় জমানো জনতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কথা বলার সময় এ ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনার ভিডিওটি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পর তা ভাইরাল হয়ে যায়। সংবাদপত্র পড়ে জানা গেল এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো জনসম্মুখে হামলার শিকার হলেন তিনি।

২০১৭ সালের মার্চে প্যারিসে আয়োজিত একটি কৃষি প্রদর্শনীতে এক বিক্ষোভকারীর হাতে ডিম হামলার শিকার হয়েছিলেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ২০১৬ সালেও প্যারিসে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা তার দিকে ডিম ছুড়েছিল। সে সময় শ্রম আইন সংস্কারের বিরুদ্ধে দেশটির কট্টর-বামপন্থি ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যদের ডাকা ধর্মঘট থেকে ম্যাক্রোঁকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়।

ভিডিওতে দেখা যায়, ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভ্যালেন্স শহরের বাইরের টেইন-ল’হারমিটেজ এলাকায় সরকারি সফরের সময় ভক্ত ও শুভাকাক্সক্ষীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে হাত মেলাতে যান ম্যাক্রোঁ। এ সময় ব্যারিকেডের অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক ম্যাক্রোঁর গালে সজোরে থাপ্পড় মারেন। তারপর নিরাপত্তা বাহিনী ম্যাক্রোঁকে দ্রুত সরিয়ে নেন।

ইতিহাসে সরকারপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের জনগণের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এই তো চলতি বছরেই পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ লন্ডন শহরে চারজন মানুষ দ্বারা প্রহৃত হন। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন যখন আলবারি অঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ব্যস্ত ঠিক তখন এ্যামবার পেইজ হল্ট নামে এক মহিলা তার দিকে ডিম ছুড়ে মারেন। তবে সাধারণ জনগণের আঘাতে সবচেয়ে বেশি চোট বোধকরি পেয়েছিলেন ইতালির আলোচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি। ২০০৯ সালে একটি র‌্যালিতে অংশগ্রহণ করার সময় একটি লোক লোহার রড দিয়ে বার্লুসকোনিকে আঘাত করলে তার মূল্যবান দুটি দাঁত উপড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে নাকটাও ভেঙে যায়। পরে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে কাটাতে হয় তাকে। এটাই অবশ্য তার ওপর প্রথম আঘাত নয় এর আগেও ২০০৪ সালে রোমে ঠিক একই রকম আরেকটি র‌্যালিতে জনসাধারণের মধ্য থেকে একজন তাকে চড়-ঘুসি মেরেছিলেন।

ইরাকের বিখ্যাত সাংবাদিক মুক্তাদির আল জাহিদি তো রাতারাতি সমস্ত দুনিয়ায় বিখ্যাত হয়ে যান প্রেসিডেন্ট বুশকে জুতা নিক্ষেপের কারণে।  

ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জনসম্মুখে চড় খাওয়ার পর চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী ফরাসি কর্তাব্যক্তিদের অভিযোগের তীর প্রচ্ছন্নভাবে মুসলমানদের দিকেই নির্দেশিত হয়। কারণ বিগত দিনগুলোতে মুসলিম নারীদের হিজাব পরাসহ মুসলিম জনগোষ্ঠীর নানা বিষয়ে ম্যাক্রোঁ বেশ কিছু অর্বাচীন ও বালখিল্য মন্তব্য করে সারাবিশ্বে বেশ বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন যার উপযুক্ত জবাব অবশ্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান কিছুটা হলেও দিতে সক্ষম হয়েছেন। আমার বেশ ইচ্ছা ছিল এ ঘটনাটি যখন ঘটে ঠিক তখনই এ নিয়ে একটি লেখা লেখার। কিন্তু আমি আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে চাইছিলাম এটা দেখার জন্য যে আসলে চড়টা কি সত্যি সত্যি কোনো মুসলিম মেরেছিল কিনা? যদিও সে বিষয়ে অবশ্য আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কারণ ম্যাক্রোঁর নিরাপত্তাকর্মীরা যখন যুবকটিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সে কণ্ঠ ফাটিয়ে চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছিলেন- ‘ম্যাক্রোঁইজম নিপাত যাক’ ইত্যাদি বলে। অবশেষে আমার ভাবনাটাই সত্যি হলো। যে যুবকটি ম্যাক্রোঁর গালে চপেটাঘাত করেছিলেন তার নাম ডেমিয়েন টারেল। বয়স ২৮ বছর। ইতিহাসের ছাত্র। ছেলেটির এ কর্মকান্ডে সামারি ট্রায়ালে ১৮ মাসের সাজা হয় তার। কিন্তু সেই একই বিচারপতি ১৮ মাস থেকে সাজা কমিয়ে শেষ পর্যন্ত মাত্র চার মাসের কারাদন্ডের আদেশ দেন। এমন একটি ঘটনা যদি আমাদের এ উপমহাদেশে ঘটত তাহলে কী হতো একটু চিন্তা করুন তো? আর সেই বিচারপতিরই বা কী হতো?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন নাগরিক কেন একজন সরকারপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের গালে চড় কষিয়ে দেন? যে কোনো সুস্থ মানুষই বোধকরি শারীরিক আঘাতকে সমর্থন করবেন না, তারপরও বলতে হয় দেশের একজন সাধারণ নাগরিকের মনের ভিতর কী পরিমাণ রাগ, উষ্মা ও জ¦ালা থাকলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ একজন কর্তাব্যক্তিকে এমন নির্দয়ভাবে আঘাত করতে পারেন। আমার দৃষ্টিতে এর দুটো দিক আছে। এ ধরনের একটি ঘটনা ফ্রান্সের মতো চরম উৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক দেশে সংঘটিত হয়েছে বলেই হয়তো যিনি চড় মেরেছেন তার মাত্র চার মাস জেল হয়েছে। ঘটনাটি যদি রাজতন্ত্র কিংবা দুর্বল কোন গণতান্ত্রিক দেশে ঘটত তবে হয়তো সেই ব্যক্তির কোনো হদিসই খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন কথা হচ্ছে ফ্রান্স, আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নতির সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থানে থাকার পরও কেন এসব দেশের কর্তাব্যক্তিদের থাপ্পড় খেতে হচ্ছে। এখানে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, দেশের উন্নতি একটি আপেক্ষিক বিষয় এবং সে দেশের জনগণ তাদের রাষ্ট্রের অধিপতিদের কাছে থেকে যতটুকু প্রত্যাশা করেছেন নিশ্চয়ই সেসব অধিপতিগণ সেটুকু দিতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন।

রুশোর সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব অনুসারে সভ্যতার আদি যুগে কোনো নেতা ছিল না। কিন্তু তাতে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই ছিল বেশি। বাহুবলই হয়ে উঠেছিল শক্তিমানের নিজেকে জাহির করা ও দুর্বলের ওপর জোরজুলুম করার অস্ত্র। এর ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। তখন সবাই মিলে বসে একজনকে বেছে নিল রাজা বলে। ঠিক হলো রাজার কথা সবাই মেনে চলবে। তিনি দুর্বলকে রক্ষা করবেন, দুর্জনকে শাস্তি দেবেন। দেশ আক্রান্ত হলে রক্ষা করবেন আর পররাজ্য আক্রমণ করে রাজ্যর সীমা বাড়াবেন।

কৌটিল্য বা চাণক্য ছিলেন রাজা চন্দ্রগুপ্তের উপদেষ্টা। চানক্যের জন্ম যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩৭০ বছর আগে অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। অথচ সেই চাণক্যের রাজনীতির প্রথম কথা ছিল ‘প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে হিতম। আত্মপ্রিয়ং হিতং রাজ্ঞঃ প্রজানাং তু প্রিয়ম হিতম।’ অর্থাৎ প্রজার সুখেই রাজার সুখ। রাজার হিতেই প্রজার হিত। মহাভারতে ও গীতায় বিদুর ও ভীষ্মের মুখ দিয়ে রাজনীতির অনেক কথাই বলা আছে। পরবর্তীকালে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাজনীতির কতগুলো সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু-চারটি হলো এমন-

চাণক্যও নেতার (রাজার) গুণ সম্পর্কে বলেছেন-

১। যে রাজা যথার্থ দন্ড দেন, তিনি সবার পুজ্য হন। তবে কাম-ক্রোধ বশত কিংবা অজ্ঞানবশত কাউকে দন্ড দিলে তা প্রজাদের রোষ উৎপন্ন করে।

২। অবিনয় ও আত্মসংযম না থাকলে বহু ধনসম্পত্তিযুক্ত রাজ্যও বিনষ্ট হয়ে যায়। নেতার মধ্যে অহমিকা থাকলেই তা হবে পতনের মূল। তিনি সর্বদা সংযমী হবেন। একমাত্র জিতেন্দ্রিয় নৃপতিই প্রজাদের বশে রাখতে পারেন।

৩। রাজা কখনো একা সব কাজ করতে যাবেন না। তিনি দক্ষ সচিব ও অমাত্য নিয়োগ করবেন। প্রত্যেকের ওপর দায়িত্ব বণ্টন করে দেবেন।

৪। রাজা যাকে বিনা বিচারে আটক রেখেছেন। সেই ব্যক্তি রাজার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন।

ভাবতেও অবাক লাগে আড়াই হাজার বছর আগেও চাণক্য রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কত সুন্দর নীতিমালা প্রণয়ন করেছিলেন।

আমার একজন প্রিয় লেখক ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, নেতা কখনো নির্মাণ করা যায় না। ইতিহাস তার প্রয়োজনে নিজেই নেতা তৈরি করে নেয়। আমার মতে উনি একেবারে সঠিক কথাটিই বলেছেন। সময়ই একজন মানুষকে নেতা বানিয়ে দেয়। আজ থেকে প্রায় সাড়ে বারো শ বছর আগে বাংলায় যখন মাৎস্যন্যায় চলছিল তখন সেই অরাজক অবস্থা থেকে বাঁচতে দেশের মানুষ একজন নেতার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। অবশেষে তারা গোপাল নামে এক সাধারণ যুবকের সন্ধান পায় যার কাজকর্ম দেখে সবারই তার প্রতি গভীর আস্থা জাগে। তখন গোপালকেই তারা রাজার আসনে বসিয়ে দেয়।

যেমন গোপালকে দেখে সেদিনের মানুষের মনে হয়েছিল হ্যাঁ এই সেই নেতা যিনি মাৎস্যন্যায় থেকে উদ্ধার করতে পারবেন শশাঙ্কের গৌরবময় বঙ্গভূমিকে। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় প্রায় ১০০ বছরের ওপর কোনো নেতা ছিল না। ওই সময়টাই অন্ধকারের যুগ। গোপাল নামক নেতাকে বাংলার জনগণ সিংহাসনে যখন বসান তখন আনুমানিক ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ। গোপাল ২০ বছর ধরে রাজত্ব করার পর মারা যান। এ ২০ বছরে দেশে অনেকটাই আইনের শাসন ফিরে এসেছিল। গোপাল যা করতে পেরেছিলেন সেটি হলো তিনি মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। মানুষকে তিনি নিরাপত্তা দিতে পেরেছিলেন। আর সেই সুস্থিতির কাঠামোর ওপর তাঁর ছেলে ধর্মপাল (৭৭০-৮১০) আবার বাংলার হৃত গৌরব ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাংলা রাজত্বের সীমা কনৌজ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। সেখানে উত্তর ভারতের সব রাজাই বাংলার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল।

গোপালের নির্বাচন পৃথিবীর ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রায় ৩০০ বছর টিকে থাকার পর পাল বংশের অবসান হয়। ইতিহাস এই শিক্ষাই দেয় যে পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী। সাফল্য থেকে ব্যর্থতা, উত্থান থেকে পতন, গৌরবময় যুগ থেকে অন্ধকার যুগে গিয়ে পড়া। আবার গৌরবময় যুগের অভ্যুদয় এটাই বলে যে রাজ্য ভাঙা-গড়ার পেছনে একটি অদৃশ্য শক্তি কাজ করে সেটি হলো নেতৃত্ব। আসলে রাজ্যের অভ্যুদয়, স্বর্ণযুগ এবং রাজ্যের পতন সবকিছুর পেছনে থাকেন কোনো সমকালীন নেতা। হ্যাঁ নেতা তো একজনই হয়। বাকিরা তাঁর সহকারী অথবা অনুগামী। ইতিহাস এবং সেই সঙ্গে যুক্তিতর্কের অতীত দৈবই নেতা তৈরি করে। তার সাফল্য ঘটায় আবার ঐতিহাসিক কারণেই দুর্বল নেতার আমলে রাষ্ট্র প্রচন্ড দুর্বিপাকের মধ্যে পড়ে। জনসাধারণের জীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। একটি প্রচলিত প্রবাদ রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট। রাজার পাপ অর্থ হচ্ছে রাজার অযোগ্যতা ও অপদার্থতা। অযোগ্যতা মানে দূরদৃষ্টি সাহস ও বীরত্বের অভাব। অথবা চারিত্রিক দুর্বলতা। নারী সুরা ও বিলাস ব্যসনে রাজকোষ ফাঁকা করে দিয়েছেন অনেক নেতা। অথবা বিশ্বস্ত ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ না করে তোষক অপটু সামন্তদের ওপর নির্ভর করেছেন ও ঠকেছেন। অথবা প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবহেলা করেছেন। পরিণামে বিদেশির আক্রমণে রাজত্ব ধ্বংস হয়ে গেছে।

লেখক ও সাংবাদিক ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছেন, ঐতিহাসিকরা বড়ই কৃপণ। সমস্ত ভারতের ইতিহাস ঘেঁটে তাঁরা মাত্র দুজন মহান রাজার সন্ধান পেয়েছেন। একজন অশোক (খ্রি.পূর্ব. ২৭৩-২৩২ খ্রিস্টাব্দ) আর একজন সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ)। আর ইংল্যান্ডের ইতিহাসে শুধু একজনই আলফ্রেড দ্য গ্রেট (৮৪৯-৮৯৯) তবে আমার মতে, ভারতবর্ষে আরও দুজন রাজা ছিলেন যাঁরা অনায়াসে ইতিহাসে মহান রাজার কাতারে স্থান করে নিতে পারতেন।

প্রথমজন রাজা বিম্বিসার (৫৫৮ খ্রি. পূর্ব-৪৯১ খ্রি. পূর্ব) যে রাজার কথা উল্লেখ আছে কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতায়। দ্বিতীয়জন রাজা হর্ষবর্ধন (৫৯০-৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) হর্ষবর্ধন যে একজন প্রজাহিতৈষী ও সুশাসক ছিলেন সেটা আমরা জানতে পারি চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর লেখা ইতিহাস থেকে। তিনি তাঁর লেখায় রাজা হর্ষবর্ধনের প্রভূত প্রশংসা করেছেন। বিখ্যাত উপন্যাসিক মনজ বসু তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘নিশিকুটুম্বতে’ হিউয়েন সাং-এর বরাত দিয়ে লিখেছেন, সেসময় নাকি মানুষজন ঘরের দরজায় খিল না এঁটেই ঘুমাত। এটা নাকি হিউয়েন সাং-কে বেশ অবাক করেছিল। অর্থাৎ মোদ্দাকথা হচ্ছে হর্ষবর্ধনের শাসন আমলে এ দেশে এতটাই সুশাসন ছিল যে চোর চুরি করতে পর্যন্ত প্রবৃত্ত হতো না। বর্তমান শতাব্দীতে লিঙ্কন, গান্ধী, নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বোস, চার্চিল, মার্টিন লুথার কিং, ম্যান্ডেলা প্রভৃতি নেতাগণ নিঃসন্দেহে ইতিহাসে মহান নেতা হিসেবে স্থান করে নেবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান সময়ে কেন মহান নেতার এমন আকাল। জন্ম নিচ্ছে না কোনো কালজয়ী নেতা। এর প্রধান কারণ সম্ভবত মূল্যবোধের অবক্ষয়। কয়েক দশক পূর্বেও মানুষ রাজনীতি করত একটি আদর্শকে সামনে রেখে। দেখা যেত বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীগণই সাধারণত যুক্ত হতেন রাজনীতির সঙ্গে।

এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় রাজনীতি করে পাড়া-মহল্লার বখাটে ও উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেগুলো। কয়েক দশক আগেও দেখা যেত অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেরা রাজনীতি করে নিঃস্ব হতেন আর বর্তমানে নিঃস্ব ঘরের ছেলেরা রাজনীতি করে রাতারাতি অবস্থাপন্ন হচ্ছেন। আমাদের দেশে রাজনীতিটা মূলত অর্থকড়ি কামানোর একটি অবলম্বন মাত্র। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। আর কিছু আছে যারা রাজনীতি করে নিজের ক্ষমতা ও দাপট বহিঃপ্রকাশের জন্য। সেই কোন আমলে ব্রিটিশ সাংসদ এডমন্ড বার্ক একটি বিশেষ প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন-‘রাজনীতি হচ্ছে একজন দুর্বৃত্তের শেষ অস্ত্র’ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বার্কের এই উক্তিটি আজ বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। তবে বর্তমান সমাজে দু-চারজন এখনো অবশিষ্ট আছেন যাঁরা তাঁদের আদর্শ থেকে এখনো বিচ্যুত হননি।

রাজনীতিতে বহু নেতা গায়ের জোরে ও বন্দুকের জোরে টিকে থাকে। ওপর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মিলিট্যান্ট ক্যাডার বাহিনী গঠন করে কিংবা প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়। হিটলার, মুসোলিনি, স্তালিন, সাদ্দাম হোসেন কিংবা গাদ্দাফি এভাবে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। বিরোধী দল নেই। ভোট নেই। থাকলেও রিগিং করে ভোটে জেতা যায়। কিছু কম্যুনিস্ট দেশে নেতারা এভাবে টিকে ছিলেন ও আছেন। একদা স্পেনের ডিক্টেটর ফ্রাঙ্কোও এভাবে টিকেছিলেন। গণতন্ত্রের মধ্যেও অনেক স্বৈরশাসক এভাবে টিকে থাকেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তারা খলনায়ক হিসেবেই খ্যাত হয়ে থাকে। সমস্ত জীবন রাজনীতি করে এটাই তাদের প্রাপ্তি।

ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, সবাই নেতা নন, কেউ কেউ নেতা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই ‘কেউ কেউ’ কারা? লঙ্কায় যে যায় সে-ই নিজেকে রাবণ বলে ঘোষণা করে। কিন্তু সেই ‘স্বঘোষিত’ রাবণেরা যে পথ দিয়ে এসেছিল, সেই পথ ধরেই ফিরে যায়। অথবা নিষ্ঠুর ইতিহাসই তাদের মহাকালের আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। প্রকৃত নেতাই শুধু বেঁচে থাকেন। তিনি ‘পপুলার’ হতে পারেন কিন্তু ‘পপুলিস্ট’ কদাচ নন। কারণ ‘পপুলিস্ট’ নেতা যা করেন তা আগামী নির্বাচনের কথা ভেবে। আর প্রকৃত রাষ্ট্রসাধক বা নেতা যা করেন তা আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে। ‘পপুলিজম’-এর দ্বারা প্রভাবিত হননি লিঙ্কন, গান্ধী, ম্যান্ডেলা, সুভাষচন্দ্র। অথবা ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে আমৃত্যু দূরে থাকা মাটিন লুথার কিং। বিপ্লবের ধারা বদলায়। কিন্তু বিপ্লবের পতাকা হাতে আজও লাখ লাখ মানুষ সমাজ ও নেতৃত্ব বদলের জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশ, রাশিয়া থেকে ব্রাজিল সর্বত্রই স্বপ্ন দেখে। মজার বিষয় হচ্ছে এই স্বপ্ন দেখা কখনো থেমে থাকে না।

 

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর