মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
পাঠক কলাম

নিজেদের শুধরে নিতে হবে

মাজহারুল ইসলাম

নিজেদের শুধরে নিতে হবে

করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সফলভাবে মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ। আশা করা হচ্ছে আর ছয়-সাত মাসের মধ্যে বিশ্ববাসী করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ নামের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। এ দৈত্যের মোকাবিলায় মানুষেরই জয় হবে। করোনার কারণে বাংলাদেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা সুবিবেচনাসম্পন্ন কোনো মানুষের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঘুষ, দুর্নীতির কেচ্ছা কাহিনি গজনির সম্রাট সুলতান মাহমুদের সোমনাথ মন্দির লুটপাটের ইতিহাসকে হার মানিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের গাড়িচালক মো. আবদুল মালেক। করোনার আগে তার নামটি আমাদের জানা ছিল না। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা নিয়ে পত্রপত্রিকাগুলো লিখতে লিখতে ক্লান্ত। কে শোনে তাদের কথা।

আবজাল দম্পতির দেড় শ কোটি টাকা দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র বারবার সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেক ১০০ কোটি টাকার মালিক। লেখাপড়ার দৌড়ে অষ্টম শ্রেণি পাস। তিনি এক দিনে ১০০ কোটি টাকার মালিক নিশ্চয়ই হননি। তার কাছে তো আলাদিনের কোনো চেরাগ ছিল না। তার দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক ধৃত হওয়ার পর জাতি জানতে পেরেছে সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে। আদালত কর্তৃক দোষী প্রমাণিত হওয়ায় তিনি আজ কারাগারে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ১৩ বছর একটানা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনিই জাতির আশা-আকাক্সক্ষার শেষ ভরসা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি যে আপসহীন তা তার সমালোচকরাও স্বীকার করবেন। তবে যুগ যুগ ধরে দুর্নীতি আর অনিয়মের যে দানব ফুলে ফেঁপে উঠেছে তাকে সামাল দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। দুর্নীতি নামের আলাদিনের চেরাগের কল্যাণে একসময় যাদের কিছুই ছিল না তাদের অনেকেই আজ শত শত কোটি টাকার মালিক। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কাজ কী? তারা যদি সঠিকভাবে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করত এবং দুর্নীতি দমন কমিশন যদি দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করত তাহলে হয়তো বা আমাদের এ নাটকীয় দৃশ্য দেখতে হতো না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের দামে অর্জিত বাংলাদেশের মর্যাদা কিছু অসৎ ব্যক্তির জন্য ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না। যারা আবদুল মালেকদের স্রষ্টা তারা কীভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। এ দেশে কি তাদের জন্য আলাদা কোনো আইন আছে? বাংলাদেশের সংবিধানে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান।

যেসব রাঘববোয়াল শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে বেগমপাড়ায় বাড়ি কেনে, সুইস ব্যাংকে টাকা রেখে আরাম-আয়েশে বহাল তবিয়তে আমাদের সামনে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় তারা কি আইনের ঊর্ধ্বে? সরকারের কি এমন কোনো প্রতিষ্ঠান আছে যা দুর্নীতিমুক্ত? ক্ষেত্রবিশেষ বিশেষ কোনো ব্যক্তি সৎ থাকতে পারেন, কিন্তু তার প্রতিষ্ঠান যদি সৎভাবে না চলে তবে তার সততা মূল্যহীন।

ধর্মেও বলা আছে- যিনি অপরাধ করেন আর যিনি অপরাধ সহেন উভয়েই সমান অপরাধী। দুর্নীতি কাকে বলে কত প্রকার ও কী কী দেশবাসী তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তবে তারা অসহায়। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমার মনে হয় এ সরকারের আমলেও দুর্নীতিবাজরা আগের চেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বারবারই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, টকশোয় হাওয়া ভবনের দুর্নীতির উদাহরণ টেনে আনেন। হাওয়া ভবন দুর্নীতি করেছে বলেই তো তার ধারক ও বাহকরা আজ কারাগারে কেউ বা পলাতক দেশান্তরে। হাওয়া ভবন আপনাদের জন্য আশীর্বাদ তাই তো আপনারা ১৩ বছর যাবৎ ক্ষমতায়। এ সময়ে আগের চেয়ে দুর্নীতি কমেছে, এ কথা কেউ হলফ করে বলতে পারবেন?

শুধু স্বাস্থ্য খাত নয়, সরকারের প্রতিটি খাতের হিসাব-নিকাশের সময় এসেছে। বিশেষ করে ২০০৯ সাল থেকে যারা রাজনীতিতে, সরকারি চাকরিতে, কালোবাজারি ব্যবসা, মাদক, ইয়াবা ও ক্যাসিনো খেলে এবং আর্থিক খাত লুটপাট করে শত শত কোটি টাকার মালিক হলেন তারা কি বিচারের আওতায় আসবেন না? যত দিন পর্যন্ত দলমত নির্বিশেষে সবাই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াবেন, তত দিন বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে না। যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের ছত্রচ্ছায়াতেই দুর্নীতি হয় এটাই ঐতিহাসিক সত্য। আমার ধারণা ছিল জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবর্ষ পালন উপলক্ষে এই মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে রাজনীতি ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সংবেদনশীল হবেন। কিন্তু চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি। তার পরও সবাইকে বলি, দুর্নীতি করে কোটি টাকার মালিক হওয়া যায় কিন্তু ইমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করা যায় না।

দেশ বাঁচলে আমি আপনি বাঁচব। দেশের কথা দেশের মানুষের কথা ভাবতে হবে। তাদের কথা ভাবতে হবে আমাদের সমাজপতিদের। আমাদের নতুন প্রজন্ম তাদেরই অনুসরণ করবে। আবদুল মালেক বেশে যারা রাজনীতিতে, সরকারি চাকরিতে, পেশাজীবী সংগঠনে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ান তারা মানবতার শত্রু।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে নিবেদন, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে হবে আপনাকেই। ৩০ লাখ শহীদের ঋণ শোধ করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। সবার প্রতি সমান আচরণ এটাই হোক অঙ্গীকার। রাজনীতিবিদদের বলি, নিজেদের শুধরে নিন। ইতিহাস বলবেন, ইতিহাস পড়বেন, কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন না তা হতে পারে না। অবশ্য ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না।

                লেখক : কলাম লেখক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর